মহ্সিন
ওস্তাদ আলি মখমলবাফ-এর একটি নাটক
অনুবাদ :
অ র্জু
ন ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনে ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগে নাটকটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ
পেতে শুরু করল ‘কালিমাটি/১৬’ (জুন ২০১৪) সংখ্যা থেকে। এই সংখ্যায় রইল
তার তৃতীয় কিস্তি। নাটকটির আগের
অংশটুকু পড়ার জন্য নীচের লিঙ্কে যান।
১ম কিস্তি
২য় কিস্তি
http://www.kalimationline.blogspot.in/2014/07/blog-post_42.html
খাঁচার ভেতর খাঁচা
মহ্সিন মখমলবাফ
রচনা মহ্সিন ওস্তাদ আলি মখমলবাফ
রচনাকাল ১৯৮১
পরিচালক মহম্মদ রেজা হনারমন্দ
ভাবানুবাদ ও রূপান্তর অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
দৃশ্য ৩
(নিজেদের সেলের ভেতরে
যুবক ও বৃদ্ধ ঘুমোচ্ছে। বৃদ্ধের নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মঞ্চে কয়েকজন লোকের
প্রবেশ। তাদের সাথে নতুন একজন কয়েদী। এই কয়েদীটি দেশের গুপ্তচর বাহিনীর সদস্য।)
১ম লোক :
ঢুকিয়ে দে টিকটিকিটাকে
সেলের ভেতরে... এ্যাদ্দিন যাকে পেয়েছে এইখানেই ধ’রে ধ’রে ঢুকিয়েছে সবাইকে...
এবার নিজে থাক...
গুপ্তচর : (লোকগুলোর
পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে,
কাঁদতে কাঁদতে) বাঁচাও আমাকে... বাঁচাও... এইখানে আমি একা থাকতে পারব না... ম’রে যাব... আমাকে রেখো না এখানে... ক্ষমা চাইছি... বাঁচাও...
২য় লোক :
শালা, খোঁচড়... যেমন কাজ
করে এসছিস এ্যাদ্দিন... (বৃদ্ধের সেলে নতুন কয়েদীকে ঢুকিয়ে দেয়) এবার তার ফলটা ভোগ
করবি না?!
৩য় লোক : (বাকি সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে) ছাড়ো ছাড়ো... চলো
তো... কথা বাড়িও না এর সাথে... এই সবকটা খোঁচড়কে
আমরা জেলে ঢোকাবো...
বৃদ্ধ : আচ্ছা
আমার এখানে জায়গা তো... বলছি যে নতুন একটা জেল তৈরি হবে শুনছিলাম, হয় নি এখনও?
১ম লোক : এঃ!
কী দারুণ দিন কাটাচ্ছেন উনি এখানে... আরো একটা জেল চাই ! জায়গা না হ’লে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমাদের অনেক কাজ আছে... এই চলো তো চলো।
যুবক : আপনারা
চাইলে ওঁনাকে আমার সেলে রাখতে পারেন। কোনো ব্যাপার না। কিন্তু একটা শর্ত, উনি আমার
জিনিসে হাত দেবেন না। (কোণ থেকে নিজের টাওয়েলটা তুলে) এটা আমার নিজের টাওয়েল।
২য় লোক :
(গুপ্তচরের উদ্দেশ্যে)
আহ্! আসুন বেরিয়ে আসুন। (গুপ্তচরকে যুবকের সেলে ঢুকিয়ে দেয়) কী সাঙ্ঘাতিক শপথ
ভাবা যায় !
৩য় লোক :
চলো এবারে...
১ম লোক :
(লোকগুলো বেরিয়ে যায়,
যেতে গিয়ে বেরোবার আগে একজন মাঝপথে ফিরে এসে গুপ্তচরের উদ্দেশ্যে) এই যে
টিকটিকি... ভালো ক’রে
শুনে রাখো, পালাবার চেষ্টা করবে না একদম। এই লোকদুটো কিন্তু তাহলে ছিঁড়ে খাবে। মনে
থাকে যেন, নইলে এমন জায়গায় নিয়ে রাখব আর বাঁচার রাস্তা পাবে না। (প্রস্থান)
যুবক :
কমরেড! ইউ আর ওয়েলকাম
(গুপ্তচরের উদ্দেশ্যে)
বৃদ্ধ : আপনি
লেফটিস্টদের কোন্ গ্রুপে আছেন? (কোনো উত্তর নেই)
যুবক :
মানে উনি বলতে চাইছেন
আপনি এ্যারেস্ট হলেন কেন? কী জন্যে ওরা ধ’রেছে আপনাকে? উনি আর আমি
দুজনেই একই লেফট অর্গানাইজেশন করতাম। উনি যদিও আমার ওপরে ছিলেন। আমি ওঁনার কয়েক বছর
পরে অ্যারেস্ট হয়েছি। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক সেই স্কোয়্যাডে থাকতে। কিম্বা তারও
আগে...
বৃদ্ধ :
কমরেড, এত তাড়াহুড়ো নয়।
ওকে আমাদের ব্যাপারে এত তথ্য দিও না। আগে আমাদের ওকে বুঝতে দাও।
গুপ্তচর :
তোমরাও কি কয়েদী?
বৃদ্ধ :
(হাসি) তুমি কি আমাদের
গভর্ণর ভেবেছিলে নাকি? আমাদের পায়ে কি? শেকল দেখছ না?
গুপ্তচর :
মানে? ওরা... ওরা কি
আমার পায়েও শেকল বাঁধবে নাকি!!? দ্যাখো...
বলছি যে... এখান থেকে কোনো পালাবার রাস্তা
জানো তোমরা?
বৃদ্ধ : পালানো?
সেকি? তোমার কি কোনো তাড়াহুড়ো আছে নাকি! আচ্ছা বেশ, চলো ধরেই নিলাম তুমি পালালে।
কিন্তু আমাকে বলো তো, একা একা তুমি কী করতে পারবে? বাইরে গিয়ে একা তুমি কী বদলাবে?
ইতিহাসে একটা লোক কী করতে পারে? ব’সো, ব’সো,
অপেক্ষা করো, সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করো ব’সে। শুধু
চেষ্টা করো পার্টির সাথে থাকতে।
গুপ্তচর :
কিন্তু এই লোকগুলো কাউকে
মারার আগে ওয়ার্নিং-ও দেয় না। ওরা আমাদের এক্ষুনি মেরে ফেলবে। তোমার কাছে চুলের
ক্লিপ বা ওরকম কিছু আছে? আমি দরজাটা খুলতে চাই...
যুবক :
উনি কিন্তু সত্যিই খুব
আশাবাদী ! কত বছর হলো আপনি জেলে আছেন?
গুপ্তচর : বছর...!!
বৃদ্ধ :
তিন বছর হলো আমি এখানে
একজন কয়েদীকে দেখছি, যে এখানে কম করে হলেও দশ বছর আছে। কিন্তু, আমার মনে হয় না
তুমি বছর পাঁচেকের বেশি আছ।
গুপ্তচর : পাঁচ
বছর!! কিন্তু আমি তো জেলে একটু আগেই এলাম...
বৃদ্ধ :
একটু আগে!
গুপ্তচর :
হ্যাঁ... আমি তো
শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম... সেইখান থেকে তুলে নিয়ে এলো... ভাবুন তো! সব জায়গায় ওরা
খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। সরকারের লোক ব’লে যাকে চেনে, তাকেই ধ’রে ফেলছে।
বৃদ্ধ :
কারা? কারা করছে এসব?
গুপ্তচর : সবাই।
কলেজ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট থেকে শুরু ক’রে কারখানার লেবার। সবাই। সাথে পিপ্ল্স গেরিলা পার্টিও আছে। ওরা সব
জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে সরকারের সব অফিসার-কর্মচারীদের বের করছে। (কাঁদতে থাকে)
কিন্তু আমি তো একটা সাধারণ কেরানী। গোয়েন্দা অফিসে চাকরি করলেই কেউ গোয়েন্দা হয়
নাকি? আমি ওদের কত চেষ্টা করলাম বোঝাতে, একটা ছোট্ট অফিসের ম্যানেজার আমি। কিন্তু
ওরা তো শুনলই না আমার কথা...
বৃদ্ধ : হুম্।
তুমি নিশ্চয়ই তোমার কাজে কোনো ফাঁকি দিয়েছ। তুমি ইয়েকে চেনো... ইয়ে... মিস্টার... মিস্টার... কী যেন নাম ছিল... মিস্টার সাদেগি?
উনিও তো গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন। অল্প কয়েকদিন ছিলেন উনি এখানে। ওঁনার জন্যেই আমাদের এইখানে অবস্থাটা
একটু ভালো হয়েছে। আহ্! কী দারুণ আড্ডা হতো
ওঁর সাথে। কত বিষয় নিয়ে কথা হতো আমাদের। সত্যিই কতদিন আগের কথা। নাইন্টিন
ফিফটি ওয়ান ! অয়েল ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে
লেবারদের মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে আমাদের ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন তখন কী জোরদার আন্দোলন করছে। অয়েল কোম্পানির ন্যাশনালাইজেশনের
বিরুদ্ধে পার্টি তখন সোচ্চার। রাস্তায় নেমে এসেছে লোকজন। পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে। গুলি
চালাচ্ছে। কতজন অ্যারেস্ট হলো। আমিও হলাম। তার কিছুদিন পরে কী
একটা কারণে যেন অ্যারেস্ট হলেন মিঃ সাদেগি। অল্প কয়েকদিনই ছিলেন। দারুণ মানুষ।
(নীরবতা। বৃদ্ধ তাঁর স্মৃতিতে ডুব দেয়।) হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম? ওহ্! তাহলে তুমি
বলছো তুমি গোয়েন্দা অফিসে চাকরি করো।
যুবক : তাহলে
বাইরে কি সত্যিই কিছু একটা ঘটছে?
বৃদ্ধ : কমরেড, তুমি কিন্তু আবার তাড়াহুড়ো করছ। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখো। তাকে বিশ্লেষণ কর। ঘটার মতো কিছুই
ঘটে নি। ঘটবেটাই বা কি!
এই একটা সেমি-ফিউডাল সেমি-কলোনিয়াল দেশ! কমরেড, তুমি বোধয় ভুলে যাচ্ছ,
ক্যাপিটালিজমের সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভেতরে থেকে শ্রেণীর যে সংগ্রাম— সেটাই কিন্তু মার্ক্সবাদ গ’ড়ে ওঠার মূল ভিত্তি।
যুবক :
কিন্তু এও তো হতে পারে
যে, আজকে দেশে যা-ই ঘটুক, তা’ অতীতের কোনো ঘটনার রিপিটেশন নয়? আগের কোনো ভিতের ওপরেই হয়তো দাঁড়িয়ে
নেই এটা? হতে পারে না?
বৃদ্ধ :
না কমরেড, তা’ নয়। যদি নতুন যুগ এসেই থাকে, তাহলে
তার জন্য নতুন যে খাঁচা দরকার হবে সেটাও
কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকবে অতীতেরই সমালোচনামূলক সমাধানের ওপর। যখন ক্যাপিটালিজম তার
বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে, এবং তার ফলাফলগুলো আমরা দেখতে পাবো, আর সেই সিস্টেমের
মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম আর শ্রমিক-শ্রেণীর
লড়াই শুরু হবে, সেটাই মার্ক্সবাদ থেকে আমাদেরকে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের দিকে নেবে।
হ্যাঁ, এখন বাইরে যেটা হতে পারে, হয়তো সরকার নতুন ক’রে
সবকিছু রিফর্ম করবে ব’লে ঘোষণা করেছে। আমরা এটা বিশ্বাস করি বা না-ই করি, আসল কথা
কিন্তু যতক্ষণ না ক্যাপিটালিজম ফুলে-ফেঁপে বেড়ে উঠছে আর শ্রমিক-শ্রেণী জাগছে,
ততক্ষণ কোনো খবর নেই। অন্ততঃ যে খবরের জন্যে আমরা অপেক্ষা করে আছি সে খবর তো নয়ই।
(বাইরে থেকে কিছু লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। কয়েকজন মিলে এক নতুন কয়েদীকে
[ফিউডালিস্ট] নিয়ে ঢুকছে)
১ম লোক :
(নতুন কয়েদীর উদ্দেশ্যে)
তোমাদের রক্ত খাওয়ার দিন শেষ। গরিব চাষির পেটে লাথি মেরে খাওয়া? এবারে তোমাদের সব
জমি কেড়ে নেব আমরা... ব্যাটা সুদখোর... তোমার সব সুদের টাকা আর জমি এবার ভাগ হবে
চাষিদের মধ্যে
২য় লোক :
(যুবকের উদ্দেশ্যে) তুমি
কিন্তু ভুল করছ। বাঁচতে চাও তো তাড়াতাড়ি
বেরিয়ে এসো। আর যদি বলো কোনো পাগলাগারদ চাই, তাহলে যাও অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নাও।
আমরা এখন এই লোকগুলোকে ধ’রে ধ’রে জেলে ঢোকাবো।
বৃদ্ধ :
ওকে আমার এইখানে ঢুকিয়ে
দিন। এখনও জায়গা আছে আমার এখানে। আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব।
৩য় লোক : এরপরের বার এসে তোমাকে যদি দেখি, ছুঁড়ে ফেলে দেব
বাইরে। বুঝতেই পারছি না এই লোকগুলো এদেরকে পাহারা দেওয়ার জন্য ব’সে আছে কেন ! (লোকগুলো বেরিয়ে যায়)
গুপ্তচর : (নতুন
কয়েদীর উদ্দেশ্যে) আপনিও কি গোয়েন্দা অফিসের লোক?
বৃদ্ধ :
পাঁচ বছর ধ’রে আমি এর’ম
একটা দিনেরই অপেক্ষা করছিলাম। দেরিতে হোক বা জলদি, এটা হওয়ারই ছিল। ফিউডালিজমের
দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত ঝুলি থেকে বেরিয়েই পড়ল তাহলে ! হু হু... বেরোতে তো তাকে
হতোই।
ফিউডালিস্ট :
এসবের মানে কী ! অ্যাঁ? আমি একটা ফোন করতে চাই।
হচ্ছেটা কী এগুলো? আমার একটা সম্মান আছে। আমার এলাকায় পঞ্চাশটা গ্রাম আমার নামে
কাঁপে। কোত্থেকে কতগুলো ফালতু চাষাভুষো আর কারখানার লেবার এসে আমাকে বললো জমি
ছাড়ো, আর আমি ছাড়ে দেব! মামা বাড়ি? ফোন কোথায়? আমি একটা ফোন করব খালি... দেখাচ্ছি
তারপরে...
গুপ্তচর :
ফোন ক’রেও কোনো লাভ নেই দাদা। আপনি যাদেরকে
ফোন করবেন ভাবছেন, তারা হয় পালিয়েছে নয়তো জেলে ঢুকেছে। অবশ্য যদি বেঁচে থাকে।
পুলিশ কন্সটেবল থেকে জমিদার কাউকে ছাড়ছে ওরা? তার চেয়ে বরং অন্য কোনো রাস্তা
ভাবাটাই ভালো আমাদের পক্ষে।
বৃদ্ধ :
চিন্তা কোরো না। ধীরে
ধীরে তোমরা এই জায়গার সাথে মানিয়ে নেবে। জানো তো, জেলে প্রথম বছরটা খুব কঠিন।
কিন্তু সেটা কেটে যাবে আসতে আসতে। দশ বছর পরে দেখবে এগুলোতেই অভ্যস্থ হয়ে যাবে
তোমরা। জানো, (সেলের গরাদ ধ’রে) এই গরাদগুলো ছাড়া আমার জীবনটা এখন কি ভয়ঙ্কর কঠিন মনে হয় !?
এগুলোকে না-ধ’রে আমি ভাবনা-চিন্তাই করতে পারি না আজকাল।
এই দরজার বাইরে পা দিলে আমার সব শান্তি উবে যায়। একটা অজানা ভয় ঘিরে ধরে আমাকে।
আমার চারিদিক এই খাঁচার গরাদে ঢাকা। এইখানে আমি নিরাপদ। আমার এই ভাবনার বিরোধীতা
যদি কেউ করতে চায়, তাকে অবশ্যই আগে এই জায়গা থেকে ঘুরে আসতে হবে (সেলের দরজার দিকে
দেখিয়ে)। আমরা আর তোমরা, আমরা সবাই এক, একইরকম, খালি একটাই পার্থক্য আমাদের।
যুবক : পার্থক্যটা
হলো, তোমাদের সময় ফুরিয়ে গেছে। আর আমাদের সময় এখনও অনাগত।
বৃদ্ধ : ওয়েল
ডান কমরেড ! আচ্ছা, কারখানাগুলোর খবর কি এখন? আমি শুনেছিলাম খুব রবরবিয়ে ব্যবসা
চলছে নাকি? (অল্প সময় নীরবতা) জমিদারবাবু, আপনি দয়া ক’রে গরাদের সামনে থেকে সরে দাঁড়াবেন?
(ফিউডালিস্টের উদ্দেশ্যে) আমার বুকটা ব্যথা করে ওগুলো দেখতে না পেলে।
যুবক :
আচ্ছা ওরা যদি আরো লোককে
ধ’রে আনে, তাহলে তো এখানে অত
জায়গাই হবে না। আবার সেই আগের মতো অবস্থা হবে, দম বন্ধ করা, খাবার নেই...
বৃদ্ধ :
রাজা আসে রাজা যায়।
কমরেড, তোমাকে ভাবতে হবে আগামী তিরিশ বছরের কথা, যখন ওরা এইরকম এক একটা সেলে
পঞ্চাশ জন শ্রমিককে ঢুকিয়ে দেবে। ভাবো কমরেড, ভাবো একবার, জাস্ট থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট
! প-ঞ্চা-শ জন শ্রমিক তাদের ঘামে ভেজা শক্ত হাত রাখবে এই গরাদে, আর সবাই, সবাই গলা
ছেড়ে এক সাথে একটাই গান গাইবে.. আহহহ্,
কী অসাধারণ একটা দিন দেখতে পাচ্ছি... (বৃদ্ধ এবং যুবক একসাথে গান ধরে-- উই শ্যাল ওভার কাম সাম ডে)
যুবক :
কিন্তু আমাদের কি এইভাবে
অপেক্ষায় থাকাটা ঠিক কমরেড? আমাদের কি নতুন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে বসা উচিত নয় এই
মুহূর্তে? একজন কমিউনিস্ট যখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যান, তিনি কি জলে থাকা মাছের মতো
সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে যেতে পারেন আদৌ? বরং সে তখন একটা একলা মাছ। যাকে কুমির
ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। আপনারা যখন গিলান ফরেস্টে শিয়াকলের একটা ছোট্ট গ্রামকে
মুক্তাঞ্চল করেছিলেন, আর্মি ক্যাম্প দখল ক’রে নিয়েছিলেন, কই সেই সময়েও তো মানুষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে...
বৃদ্ধ :
আমি জানি তুমি কি বলতে
চাইছো কমরেড। কিন্তু যখন আমাদের দলের ছেলেরা শ’য়ে শ’য়ে খুন হচ্ছিল একের পর এক, পার্টি আণ্ডারগ্রাউণ্ডে,
সেন্ট্রাল কমিটির সব নেতারা এক এক ক’রে ধরা পড়ছে কিংবা
মার্ডার হচ্ছে, দল তখন নিজেকে গুটিয়ে আনবেই। শিংওয়ালা চতুষ্পদ জন্তু যেভাবে শিঙের
গুঁতো মারার আগে দু-পা পিছিয়ে আসে।
সেইভাবে পিছিয়ে আসবে না-হয় দু-কদম। হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের
থিওরেটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ককে আরো আরো এক্সপ্লোর করতে হবে, ডেভেলপ করতে হবে। নিশ্চয়ই করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের এটা
পরিষ্কার ক’রে বুঝে নিতে হবে, এর কাছ থেকে আমরা ঠিক কী চাই? কী চাইছি? এই ফ্রেম কিন্তু
মার্ক্স-লেনিনের কোনো থিওরেটিক্যাল কাজের কয়েকটা সংকলন নয়। কিংবা ওঁনাদের
প্র্যাক্টিসের কোনো থিওরেটিক্যাল যোগফলও নয়। সেটা হবেও না কোনোদিন।
যুবক :
এটা যে একটা অর্গ্যানিক
হোল (organic whole) এ তো আর
নতুন্ ক’রে বলার অপেক্ষা রাখে না কমরেড। আপনি নিশ্চই
কমিউনিজমের ক্লাসরমে কোনো বিগিনারকে পড়া বোঝাচ্ছেন না!
বৃদ্ধ :
শুধু একটা অর্গ্যানিক
হোল? আর কিচ্ছু না !? এর প্রত্যেকটা স্তর, প্রত্যেকটা স্তর তখনই ডেভেলপ করতে পারবে
একমাত্র যখন তোমার প্র্যাক্টিসে এই থিওরির সাধারণ অর্থ এবং প্রকৃত বিষয়বস্তুগুলি
পুরোপুরি উপস্থিত থাকবে।
যুবক :
আপনি এটা কেন ভুলে
যাচ্ছেন যে, মার্ক্সের সময়ে মার্ক্সবাদ আর লেনিনের সময়ের মার্ক্সবাদ-- এ দুটো এক জিনিস নয়? এদের মধ্যে একটা বিরাট
গুণগত পার্থক্য আছে। আছেই। আসলে মুশকিলটা কি জানেন কমরেড, আপনি হয়তো ভেবেছিলেন,
মার্ক্সের থিওরি একটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের মতো। ব্যাঙ্কে রাখলে সুদে বাড়ে।
বৃদ্ধ :
(রেগে উত্তেজিত) কমরেড,
তুমি কিন্তু পার্টি লাইনকে বিশ্বাস করছ না, বরং প্রশ্ন তুলছ। তোমাকে কিন্তু
এর জন্য পলিটব্যুরোতে...
যুবক : হাঃ
হাঃ হাঃ হাঃ...
গুপ্তচর :
তোমরা খামোকা সময় নষ্ট
করছ। ওরা এলেই আমাদের
স্রেফ মেরে ফেলবে! ওরা কাউকে
ভয় পাচ্ছে না... মাথায় রক্ত উঠে গেছে যেন ওদের... এত হিংস্র হয়ে গেছে...। আমাদের এক্ষুনি
যে ক’রেই হোক এখান থেকে পালাবার
একটা উপায় ভাবতে হবে। নইলে আর বাঁচা যাবে না। কোনোভাবে এই তালাটা তোমরা খুলতে
পারবে না? চুলের ক্লিপ বা ঐরকম কিছু নেই? (নিজের পকেটে হাতড়াতে থাকে) আমার পকেটে
কিছু কাগজপত্র আছে। এগুলো সঙ্গে রাখাটা বিপজ্জনক। কোথায় ফেলা যায় এগুলো?
ফিউডালিস্ট :
আমি তো এই ছাতার মাথা
আন্দোলনের মাথা মুণ্ডু কিসুই বুঝতে পারছি না। হচ্ছেটা কি সারা দেশে! দেড় দু’বছর
ধরে শুনছি, দেখছি এগুলো... মানেটা কী এসবের? কী বলছেটা কী এরা? তোমরা জানো, একদিন
ওভারসিয়ার এসে জানালো, গ্রামের সব চাষি নাকি একজায়গায় জড়ো হয়েছে। কে একজন ওদের
নেতা... কি নাম... যাক্গে... সে নাকি বলেছে কোনো জমিতে যে চাষি সাত বছর বা তার
বেশি সময় ধ’রে
কাজ করছে, সে জমি সেই চাষির। শুনে আমি ওভারসিয়ারকে বললাম, যাও, ওদেরকে গিয়ে বলো
আমি এই জমিতে সত্তর বছর ধ’রে কাজ করছি। জমিতে কাজ করা
মানেই ফসল ফলানো না, চাষ করা না বা ফসল কাটা না। আর কারা এরা? কে এদের মাথা? সাহস
হয় কি ক’রে এদের আমার বিরুদ্ধে কথা বলতে! এক রাত্রে হঠাৎ
ওরা আমার বাড়ি ঘিরে ফেললো চারিদিক থেকে। জানালা দিয়ে দেখলাম প্রত্যেকের হাতে
বন্দুক, আর মশাল। আমাকে মারার জন্য এসেছে।
কী ভয়ঙ্কর জিনিস হচ্ছে এগুলো! একশোবার ক’রে আমি অফিসারদের বলেছি, বার বার বলেছি... আমাকে
সিকিউরিটি দিন... একবার ভাবুন এই সমস্যাটা নিয়ে... একবার ভাবুন কী হচ্ছে এটা?
যুবক :ওহ্... তার মানে তো সত্যিই বাইরে একটা দারুণ
কোনো ঘটনা ঘটছে... নতুন কোনো খবর আছে নিশ্চয়ই...
বৃদ্ধ :
আআআঃ ! অহেতুক কোনো
স্বপ্ন দেখো না কমরেড। কোনো খবর নেই। কোনো খবর নেই। কোনো খবর নেই। আরে যখন কিছু
ঘটবে, তার স্লোগান শুনতে পাবে তুমি। স্লোগান তোমাকে ব’লে দেবে কী হচ্ছে। ওরা একটা লোককে বার
খাইয়ে ওপরে তুলেছে, আর তাকে দিয়ে বলাচ্ছে যে, সব জমি কৃষকদের। জমি দিয়ে হবেটা কি?
ওটা কোন্ কাজের? ওটা একটা বুর্জোয়া শ্রেণীর কাজ। আমরা ভাববো শ্রমিক শ্রেণীকে নিয়ে। মার্ক্স কোথাও পিজেন্ট্রি ক্লাসকে
ওয়ার্কিং ক্লাস বলেন নি। ওরা রেভোলিউশন করে না। বিপ্লবে সহায়ক শ্রেণী হতে পারে।
কিন্তু বিপ্লব নয়। তাহলে? সমস্যাটা কোথায়? দুঃখ কিসের তোমার? বি হ্যাপি কমরেড, বি হ্যাপি। ক্যাপিটালিজম যখন তার অন্তিম দশায়
পৌঁছাবে, জানবে সোশ্যালিজম আর এক পা এগোলেই আছে। হাসো কমরেড হাসো, হাসো...
গুপ্তচর :
এই কাগজগুলোকে যে ক’রেই হোক নষ্ট করে ফেলাটাই ভালো। ওরা
আমার কাছে কোনো প্রমাণ পেলে শেষ ক’রে দেবে একেবারে। (গুপ্তচর কাগজগুলো পকেট থেকে বের ক’রে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে, এবং ফিউডালিস্টের উদ্দেশ্যে বলে) আপনি কি
কিছু কাগজ খেয়ে আমাকে একটু সাহায্য করবেন স্যর?
ফিউডালিস্ট :
না। আমি প্রমাণ সংগ্রহ
করছি। প্রমাণ ধ্বংস নয়। বরং আপনার কাছে পেন থাকলে আমাকে দিন। আমি এদের সম্পর্কে
অভিযোগ জানাব। আমাকে একটা কাগজ আর পেন দিন। আর প্লীজ কাগজগুলো খাবেন না। আমাকে দিন একটা কাগজ। আমি ওটার উলটো
পিঠেই চিঠি লিখব। চাষাগুলোর বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব আমি।
বৃদ্ধ :
(যুবকের উদ্দেশ্যে)
দেখলে? দেখলে তুমি? ফিউডালিজম আর ক্যাপিটালিজমের মধ্যে দ্বন্দ্বটা দেখলে? এটা বড় জোর
একটা কোনো কৃষক বিদ্রোহ। কিন্তু কোনো সলিউশন নয়।
ক্যাপিটালিজমের রাস্তাকেই খুলে দেবে এটা।
গুপ্তচর :
এতো কাগজ আমি একা খাব কী
করে ! ওহ... ওয়াক... তোমরা একটু হেল্প করো না আমাকে... এগুলো
ফেলার মতো কোনো জায়গা নেই এখানে?
যুবক :
তোমার কাছেই রাখো ওগুলো
আপাতত। যখন টয়লেটে যাবে ফেলে দেবে।
বৃদ্ধ :
কিন্তু জেলখানার নিয়ম
কাউকে টয়লেটে কোনো কাগজ ফেলার অনুমতি দেয় না। কেন তুমি ওকে এখানকার নিয়ম বহির্ভূত
কাজ করতে জোর করছ ?
গুপ্তচর :
দেখুন দাদা, আমরা যদি
সবাই একটু একটু ক’রে
খেয়ে ফেলি কাগজগুলো, তাহলে কিন্তু সমস্যাটা মিটে যায়। (কেউ কোনো কথা বলে না। কেউ
রাজি হয় না কাগজ খেতে।)
বৃদ্ধ :
সব কিছু এখন অনিশ্চিত।
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে পরিস্থিতির ওপর।
যুবক : তাহলে হোয়াট ইজ টু বি ডান?
বৃদ্ধ :
নাথিং। কিচ্ছু না। আমরা শুধু অবজার্ভ করব। যা হচ্ছে তার ওপর খুঁটিয়ে নজর রাখব। আর নিজেরা
অ্যানালাইস করব সেগুলোকে। (ফিউডালিস্টের উদ্দেশ্যে) প্লিজ জমিদারবাবু, আপনি গরাদটা
ছেড়ে দাঁড়ান। আমাকে একটু চিন্তা করতে দিন। গরাদ না-ধ’রে আমি কিছু ভাবতে পারি না।
(বাইরে আবার একটা হৈ-চৈ
শোনা যায়। আরেকজন নতুন বন্দীকে [ক্যাপিটালিস্ট] নিয়ে আসছে কয়েকজন)
১ম লোক :
এবার তো তোমাদের বেরোতে
হবে। আমাদের নতুন গেস্ট এসেছেন...
যুবক :
না। এখনও জায়গা আছে
এখানে। ওঁকে আমার সেলে দিন।
২য় লোক :
হয় তুমি পাগল, নয় তো
কোনো চাল খেলছ। ধান্ধাটা কী বলো তো তোমার !? এই জেলের ভেতরে তুমি খুশি ! কীভাবে !? তুমি কি এই
শেকলগুলো খুলতে ভয় পাচ্ছো? আছটা কি জন্য এখানে! সরো তো সরো, সরো একদিকে। (নতুন বন্দীকে যুবকের সেলে
ঢুকিয়ে দেয়)
ক্যাপিটালিস্ট : আমাকে কতদিন এখানে থাকতে
হবে যদি বলেন... (একটু জোরে) আচ্ছা আমি কি একটা ফোন করতে পারি?
ফিউডালিস্ট :
আমি আগে বলছিলাম। আপনার
ফোন করতে হলে আমার পরে করবেন। আমি এক ঘন্টা আগে বলেছি।
২য় লোক :
আমাকে সারাজীবনের জন্য
কারখানা থেকে বের ক’রে
দিয়েছিলি শালা, মনে পড়ে? পার্টি যদি আমার হাতে একবার তুলে দেয় না তোকে, শালা এখুনি
পুঁতে ফেলব তোকে এখানে। (লোকগুলোর প্রস্থান)
বৃদ্ধ :
ওদের কথায় কান দেবেন না।
ওরা আপনার চিন্তা-ভাবনাকে গুলিয়ে দিতে চায়। (ক্যাপিটালিস্টের উদ্দেশ্যে) ওরা কি
আপনাকে এইমাত্র অ্যারেস্ট করেছে? (কোনো উত্তর নেই)
যুবক : আপনি
কি করেন? (উত্তর নেই)
বৃদ্ধ :
আপনি কি এখানে এসে খুশি?
(উত্তর নেই)
ফিউডালিস্ট :
আপনি কি এটাই চেয়েছিলেন
স্যর? (ক্যাপিটালিস্টের উদ্দেশ্যে) কি অবস্থা বানিয়ে দিলেন বলুন তো দেশটার!
আপনাদের কারখানা আর ইণ্ডাস্ট্রির ধাক্কায় তো গ্রামের লোকগুলো দম আটকে মরতে বসেছে।
কিন্তু আপনার তাতে কি!? একের পর এক জমি নিয়ে নিচ্ছেন। কি? না, শিল্প হবে! বলি,
ধানটা কি আপনার কারখানার মেশিনে বানাবেন? বিশেষ কৃষি অঞ্চলগুলোতে আপনারা বিশেষ
শিল্প অঞ্চল বানাচ্ছেন, ভালো কথা। কিন্তু সেটাও তো ঠিক মতো করতে পারলেন না। দেখছেন
তো শহরের লোকগুলো কির’ম
ক্ষেপে গেছে আপনাদের ওপর। আরে লোকের বাড়ি জমি ভিটে মাটি কেড়ে কারখানা বানালে লোকে
ক্ষেপবে না ! এখন তো সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে। যে লেবারগুলো কাজ করে আপনাদের
কারখানায়, তাদেরও তো ক্ষেপিয়ে দিলেন।
বৃদ্ধ :
এরা সব একসাথে ঘোঁট
পাকিয়েছে। আমাদেরকে এরা বিশ্বাস করাতে চায় এই লোকটা একটা বুর্জোয়া।
যুবক :
আপনাকে ওরা অ্যারেস্ট করেছে
কেন?
গুপ্তচর :
বিনা কারণে। আমার মতো
এ-ও নির্দোষ। আমি জানি ওঁনাকে। কোনো অপরাধই করেন নি উনি।
বৃদ্ধ :
এরা সবাই ডাহা মিথ্যে
বলছে। এই লোকটা একজন বুর্জোয়া ক্যাপিটালিস্ট হতেই পারে না। আমি সারাজীনের
অর্ধেকটাই জেলে কাটিয়ে দিলাম, আমাকে ষড়যন্ত্রের শিকার বানানো সোজা কাজ নয় কমরেড।
ক্যাপিটালিজম এখন যে জায়গায় আছে, মনে হয় আগামী পঞ্চাশ বছর বাদে একজন ক্যাপিটালিস্টকে
আমরা এই জেলে ঢোকাতে পারব। তার আগে নয়।
যুবক :
কিন্তু এমনও তো হতে পারে
যে, হয়তো ক্যাপিটালিস্টদের নিজেরদের মধ্যে
কোনো মত নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়েছে !
ফিউডালিস্ট :
(ক্যাপিটালিস্টের
উদ্দেশ্যে) আপনাকে আমি আগে বলিনি বলুন, আমাদের এই সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে?
ক্যাপিটালিস্ট : আমি কী করব ! ফ্যাক্টরিতে যখন স্ট্রাইক শুরু
হলো, সব লেবার রাস্তায় নেমে পড়ল মিছিল করতে,
মিটিং করতে, অবরোধ করতে। আমি সবসময় পুলিশ আর সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ রেখেছি সেই
সময়। লোকজন এতোদিনে বুঝতে পেরেছে, তারা আসলে নিজেরাই নিজেদেরকে মারার খেলায়
নেমেছে। আর গ্রামের উজবুক লোকগুলো সেটা বুঝল না। আপনি তাদের কিছু বোঝাতেই পারলেন
না। আপনি জমিগুলো ওদের মধ্যে ভাগ ক’রে দিলেই তো পারতেন। ওরা তখন শহরগুলোর ওপর একটা চাপ তৈরি করতে পারত।
ফিউডালিস্ট :
হ্যাঁ, ঠিকই, আপনিও তো
পারতেন আপনার ফ্যাক্টরিগুলো লেবারদের মধ্যে ভাগ ক’রে বিলিয়ে দিতে!
বৃদ্ধ : এদের
কোনো কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই কমরেড। আমাদের বিশ্বাস আর বিশ্লেষণে ফাটল ধরাবার
জন্যে এরা সব হাত মিলিয়েছে। বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দ্যাখো কমরেড, বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে
দ্যাখো। একই সময়ে ফিউডালিজম আর ক্যাপিটালিজমকে দমন করা একটা অবাস্তব ব্যাপার।
হ্যাঁ, একজন ধনকুবের বুর্জোয়া একজন পেটি বুর্জোয়াকে দমন করতে পারে।
ক্যাপিটালিস্ট : (ফিউডালিস্টের উদ্দেশ্যে) যখন আমি দেখলাম এই পুলিশ আর সিকিউরিটির লোকগুলো কোনো কাজই করছে না, একটা হুলিগ্যানকেও ধরছে না,
তখন আমি অ্যামেরিকার হেড অফিসকে জানালাম।
বৃদ্ধ :
দেখলে, দেখলে আমার কথাগুলো শোনার পরেই কীভাবে
ওঁর যুক্তি পালটে দিল ! এরা সবাই একসাথে
মিলে আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করাতে চায় যে, বাইরে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এই লোকটা যে একটা পেটি বুর্জোয়া, আমি এটাও বিশ্বাস
করতে পারছি না।
ফিউডালিস্ট :
বাইরের অবস্থা সত্যিই
ভীষণ খারাপ। এক তো আমাদের সবাইকে ধ’রে ধ’রে জেলে ঢোকাচ্ছে। এরা বন্দুক গুলি
কিছুকেই দেখছি ভয় পাচ্ছে না। এ কী জঘন্য
অবস্থা তৈরি হলো দেশে !
ক্যাপিটালিস্ট : এটা? এটা তো একটা জঙ্গল
! এরা ঠিক মতো ইণ্ডাস্ট্রি করতে দেবে না। ফ্যাক্টরির জন্য জমি দেবে না। মানুষকে
সিকিউরিটি দেবে না। আপনি যেখানে যাবেন, যা-ই করতে যাবেন, আপনাকে পার্টির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ওদেরকে খুশি করলে তবে
আপনাকে কাজ করতে দেওয়া হবে। আর সব কিছুতে ওরাই শেষ কথা বলবে। আপনি যতই খারাপ কাজ ক’রে থাকুন, একবার আপনি ওদের দলে ঢুকে
যান, ব্যস্ আর আপনাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না।
ফিউডালিস্ট :
এই সব ফালতু নোংরা
লোকগুলোর সাথে ঝামেলায় জড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
ক্যাপিটালিস্ট : আমাদেরও কোনো আগ্রহ নেই
স্যর। কিন্তু এখন যা অবস্থা দেখছি, এর’ম চললে এবারে সব ব্যবসা-পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য কোথাও যেতে হবে।
বৃদ্ধ :
(যুবকের উদ্দেশ্যে)
তোমার যদি মনে হয়, ওদের কথা তোমার মনে কোনো প্রভাব ফেলছে, তাহলে কানে আঙুল দাও কমরেড, কানে আঙুল দাও। (বৃদ্ধ
নিজের দু’কানে আঙুল গোঁজে। বাইরে
আবার একটা হৈ- চৈ শোনা যায়।)
গুপ্তচর :
ওই ওরা বোধহয় আবার আসছে... মেরে ফেলবে... সব্বাইকে মেরে ফেলবে
এবারে... (অস্থির হয়ে ওঠে)
ফিউডালিস্ট :
চুপ ক’রে ব’সো।
কিচ্ছু করবে না ওরা। ভুল ক’রে ধ’রে এনেছে আমাদের। শান্ত হয়ে ব’সো এক জায়গায়।
ক্যাপিটালিস্ট : (বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে)
আপনার কী মনে হয়? কী করবে ওরা আমাদের সাথে?
বৃদ্ধ :
(দু’কানে আঙুল দেওয়া অবস্থায়) এসব ফালতু
কথা বলবেন না আমাকে। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না আপনার কথা। (কয়েকজন লোক ঢোকে।
একজন অ্যামেরিকানকে বন্দী ক’রে নিয়ে এসেছে।)
১ম লোক :
এই যে তোমাদের
মাস্টারমশাই এসে গেছেন। একেই দরকার ছিল তোমাদের।
২য় লোক :
তাহলে? এবারে তো তোমরা
সবাই একসঙ্গে হয়ে গেলে ! পার্টি হবে না একটা?
১ম লোক :
(বৃদ্ধ এবং যুবকের
উদ্দেশ্যে) তোমরা কি এখনও বেরোবে কিনা ঠিক করো নি?
৩য় লোক :
আরে ওরা জেলে অপেক্ষা
করছে মৃত্যুদণ্ডের আদেশটা পাওয়ার জন্য। ম’রে গেলেই বেরিয়ে যাবে।
বৃদ্ধ :
গার্ড ! তোমরা আজকে
আমাদের খাবার দিতে ভুলে গেছ...
৩য় লোক :
ঐ দ্যাখো ! আবার বলে গার্ড ! আমরা গার্ড নই
দাদা। কেন বুঝছেন না ! আর আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই। আপনারা চাইলে এখনও বেরিয়ে
যেতে পারেন জেল থেকে। (লোকগুলো মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়)
যুবক :
আপনি কোথায় কাজ করেন
কমরেড?
গুপ্তচর :
উনি আমাদের ভাষা বুঝবেন
না।
যুবক :
কেন? উনি কোথায় থাকেন?
গুপ্তচর :
মেড ইন অ্যামেরিকা।
বৃদ্ধ :
অ্যামেরিকা !! (প্রচণ্ড
অবাক হয়ে) হাঃ হাঃ হাঃ এটা সত্যিই মিথ্যের চূড়ান্ত হয়ে গেল। অসম্ভব ব্যাপার এটা...
যুবক :
তা’ কী
করেন উনি? (গুপ্তচরের উদ্দেশ্যে)
গুপ্তচর :
(অ্যামেরিকানের উদ্দেশ্যে) হোয়াট ডু ইউ ডু?
অ্যামেরিকান :
অয়েল অয়েল।
গুপ্তচর :
উনি বোধহয় তেলের খনিতে কাজ করেন !
ক্যাপিটালিস্ট : (গুপ্তচরের উদ্দেশ্যে)
আমি বুঝতে পারছি না তুমি দেরি করছ কেন!? তুমি যদি ওর ভাষাটা জানো তাহলে ওকে
জিগ্যেস করো, বাইরের খবর কী? কী দেখে এলো এখন? জানতে চাও ওর কাছে। লাল ঝাণ্ডা গেরিলা পার্টির লোক কি এখনো মুক্তাঞ্চল ক’রে রেখেছে? নাকি পুলিশ গিয়ে অ্যারেস্ট
করেছে ওদের? ফ্যাক্টরির খবর জানতে চাও...
ফিউডালিস্ট :
আর গ্রামের খবরটাও
ভাই... আমার হয়ে একটু জিগ্যেস করো ওকে। জমিগুলো কি সব বিলিয়ে দেওয়া হলো?
গুপ্তচর : দাঁড়ান দাঁড়ান। একটা একটা ক’রে জিগ্যেস করতে
দিন। (অ্যামেরিকানের উদ্দেশ্যে) আপনি যখন এলেন এখানে, বাইরের অবস্থা কীরকম দেখলেন?
এখনও কি গণ্ডগোল চলছে?
অ্যামেরিকান : হোয়াট ডু ইউ সে?
ক্যাপিটালিস্ট : আরে তুমি তো ইংরেজিতে বলছ না
! ও বুঝবে কি করে ! দাঁড়াও দাঁড়াও আমি বলছি।
ফিউডালিস্ট : দাঁড়ান আমাকে একবার জিগ্যেস
করতে দিন।
গুপ্তচর : এরকম গণ্ডগোল করবেন না। উনি
তো তাহলে আরোই কিছু বুঝতে পারবেন না। বলছি, ও দাদা, বাইরের খবর জানেন কিছু? পুলিশ
কি ধরতে পারলো কাউকে?
অ্যামেরিকান : আই কাণ্ট স্পিক ইওর
ল্যাঙ্গুয়েজ।
ক্যাপিটালিস্ট : ধ্যাত্তেরি ! বলছি ও
মিস্টার... (অ্যামেরিকানের উদ্দেশ্যে) গেরিলা পার্টি... রেড ফ্ল্যাগ...
ফিউডালিস্ট : সরুন তো ! আমাকে বলতে দিন...
ফার্মার্স... ল্যাণ্ড ডিস্ট্রিবিউটেড?
ক্যাপিটালিস্ট : ওয়ার্কার্স... ইউনিয়ন...
স্ট্রাইক রানিং?
বৃদ্ধ : (যুবকের উদ্দেশ্যে) কমরেড,
শুনবে না ওদের কথা, শুনবে না কমরেড। সব ফালতু ব’কে যাচ্ছে এরা। এটা অসম্ভব। হতেই পারে না এরকম। একটা জেলে একই
সেলে একজন ফিউডালিস্ট, একজন বুর্জোয়া, রাষ্ট্রের একজন গুপ্তচর, একজন অ্যামেরিকান
একই সঙ্গে থাকতে পারে? এটা হয় কখনো? আবার সেখানে কমরেড তুমি-আমিও আছি!? এটা কোন্
শ্রেণী? এটা কি কৃষকরা করছে? তাহলে তো তারা শুধু সামন্তপ্রভুকে, জমিদার শ্রেণীকেই
জেলে ঢোকাবে। শ্রমিক শ্রেণী তো এটা করতেই পারে না। এ দেশে একজন বুর্জোয়াকে জেলে
ঢোকাবার মতো অগ্রসর শ্রেণী হয়েই ওঠেনি এখনও শ্রমিকরা। এটা মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে। কান দিও না এসব কথায়
কমরেড, কান দিও না। বিশ্বাস কোরো না তোমার কানকে। ভুল বকছে এরা। এরা আমাদের সব বিশ্লেষণকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য একজোট হয়েছে।
বুঝতে পারছ? এরা আমাদের বিপ্লবকে ধ্বংস করতে চাইছে কমরেড, ওরা ভয় পেয়েছে। ওরা বুঝে
গেছে, আগামী একশো বছরের মধ্যে আমাদের বিপ্লব হবেই। ওরা এখনই সেটাকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রে
নেমেছে। পুঁজিবাদ যখন সম্পূর্ণ বেড়ে উঠবে, তার ভেতরে জন্ম নেওয়া শ্রমিক শ্রেণী
এগিয়ে আসবে নিজেই তার শোধ তুলতে, বদলা নিতে। এরা সব ভুল কথা বলছে। আমাদেরকে বিপ্লবের পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে
চাইছে ওরা। তুমি দেখো, একটু পরেই গার্ডরা আসবে, ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে এখান থেকে।
এরা কেউ বুর্জোয়া নয়, কেউ জমিদার নয়, কেউ গুপ্তচর নয়। সব সাজানো। সাজানো ঘটনা। সব
ষড়যন্ত্র। এদের কথায় কান দেওয়ার কোনো দরকার নেই। তার চেয়ে চলো বিশ্রাম নেওয়া যাক।
ঘুমনো যাক একটু। তারপরে উঠে আমরা আবার পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণে বসব।
(আলো নেভে)
[ক্রমশঃ...]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন