বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

০২) অনুপম মুখোপাধ্যায়




একটা খুলিগ্রাম আর একটা খুলিগ্রাম

যে কোনো লেখার ইতিহাস থাকে। তার মধ্যে একটা অংশ হলো প্রকাশের ইতিহাস।  কখনো পত্রিকা লেখাটিকে বেছে নেয়। কখনও লেখাটি পত্রিকাকে বেছে নেয়। লেখাটি ‘কী’ এটাই বিবেচ্য, লেখাটা ‘কোথায়’ এটা সম্ভবত খুব গৌ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের  এখানে একজন লেখক ‘কী’ লেখেন, তার চেয়ে ঢের জরুরি প্রশ্ন হয়ে যায়, তিনি ‘কোথায়’ লেখেন।

‘সিরিয়াস’ পাঠকরা সফল পত্রিকার সার্থক লেখার দিকেও তাকাতে চান না। আবার ঠিক এই একইভাবে ‘সফল’ কবিরা লিটল ম্যাগাজিনের কবিদের প্রকাশ্যে হেয় করতে দ্বিধা করেন না।

আসলে আমাদের এই লোকসমাজে আমরা বেশ কিছু ধারণা নিয়ে বাঁচি। বেশ কিছু ধারণা আমাদের স্কিজোফ্রেনিক করে রেখেছে। আমরা আমাদের খুলির মধ্যে একটা একটা পৃথিবী বানিয়েছি। সেটা প্রত্যেক খুলিতে আলাদা। সমস্যাটা হয়, যখন একটা খুলিগ্রাম আরেকটা খুলিগ্রামকে দখল করতে এগোয় বা একটা খুলিরাজ্য আরেকটাকে চুরমার করে দিতে চায়।

আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা হয়তো ব্যতিক্রম নই, বরং আরো বেশি করে আজকাল এটা নির্বাহ করছি আমরা, এই খুলির পৃথিবীর আলো বাতাস নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি আমরা। আমরা কেউ চাই না নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক ভাবতে। ফলে যেটা ঘটছে, যে কোনো দুটো পৃথিবীর তুলনামূলক পরিসরটা পাঞ্জা লড়ার জায়গায় চলে যাচ্ছে। অনেক সময় ছায়ার সঙ্গে লড়াই করছি আমরা। কখনও সেই ছায়ার নাম প্রতিষ্ঠান, কখনও লিটল ম্যাগাজিন।

‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামটা মেনে নিতে আমার সমস্যা হয়। কেন লিটল? কোন  দৃষ্টিকোণ থেকে লিটল? যে কোনো বিগ’এর চেয়ে এই পত্রিকাগুলো বিগ তারপরেই মনে হয়, লিটল মাস্টার সুনীল বা সচিন বা সেই পারমাণবিক বোমার নাম ছাড়াও, আমাদের মাইথোলজিতে বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হলেন বামন। একটি লিটল ম্যাগাজিন আসলে ওই বামন অবতার। আমাদের পরিত্রাতাকে আমরা আদর করে ওই নাম দিয়েছি। তার রক্ত-ঘাম-অশ্রুর যে ইতিহাস, তা আমাদের মাথা নত করে দেয়।

ছোট পত্রিকায় লেখা একজন লেখকের কাছে এক প্রাপ্তি, এক পুরস্কার। ছোট পত্রিকার বড়ো লেখক হওয়া বড়ো পত্রিকার ছোট লেখক হওয়ার চেয়ে ঢের কাম্য।

বাণিজ্যিক পত্রিকার ধারণাটি এক সোনার পাথরবাটি। সব কাগজই বাণিজ্যিক। এমন   কোনো পত্রিকা যদি প্রকাশিত হয়, যে নিজের বিনিময় মূল্য লেখে না, তাহলে একমাত্র সেই পত্রিকাই অ-বাণিজ্যিক। আমরা হয়তো বাণিজ্যিক পত্রিকার আড়ালে সেইসব  পত্রিকাকে হেয় করতে চাই, যারা বিশেষ এক ধরনের লেখা ছেপে চলেছে নিজের আপামর পাঠকের কাছে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার জন্য। লিটল ম্যাগাজিন চায় স্বল্প কিন্তু সমর্থ পাঠকের সামনে নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করতে, অযোগ্য পাঠকের জন্য তার কোনো সমঝোতা নেই। কিন্তু বাজারসফল একটি পত্রিকা সেই সমঝোতাটা করে। প্রশ্ন হলো, খুব ভুল কি করে?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষর পরিচয়টুকুও ঠিকভাবে করায় না। আমরা কি এটা আশা করতে পারি যে, যে কোনো একজন বি এ বা এম এ পাশ ‘শিক্ষিত’ মানুষের সামনে ‘সুহাসিনীর পমেটম’ বা ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ রেখে দিলেই তিনি তার প্রতি উদগ্রীব হবেন? যদি, যে পত্রিকাগুলোর প্রতি আমাদের  এত ঘৃণা, তারা ওইসব লেখা ছাপত, বাংলা সাহিত্যের কোনো মঙ্গল হতো? আমাদের এখানে এমন কি কলেজে অধ্যাপনা করার জন্যও ওই বই দুটির নাম জানা আবশ্যক নয়। বরং না জানলেই পড়াতে সুবিধে হয়।

আমি বলছি শুনুন, যদি বাংলা বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটি আলোক সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত, উদয়ন ঘোষ, স্বদেশ সেনদেরই কবিতা ছাপত, তাহলে ওই পত্রিকার বিক্রি কমে আসত হাজারের তলায়। আর তখন এখনকার তথাকথিত ‘সফল’ কবিদের কবিতা ছাপার জন্য অন্য কাগজ তৈরি হতো, তাদের বিক্রি বাড়তে বাড়তে ওই  পত্রিকাটির জায়গায় পৌঁছত। আমাদের এখানে কোনোদিনই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হতে পারবেন না রাজ চক্রবর্তী বা হরনাথ চক্রবর্তীর মতো জনপ্রিয়। যদি ভেংকটেশ ফিল্মস দেব, জি, কোয়েল, শ্রাবন্তীদের বাদ দিয়ে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে বরণ করে নেয়, যেটা ঘটবে, মফস্বলের সিনেমা হলগুলোতে দক্ষিণী আর ওড়িয়া সিনেমা চালানো ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।  

ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘গানের ওপারে’ নামে একটি অত্যন্ত রুচিশীল সিরিয়াল আরম্ভ  করেছিলেন আমাদের ড্রইংরুমের জন্য। সেটা তিনি শেষ করতে পারেননি, করতে দেওয়া হয়নি। ‘গানের ওপারে’র ইতিহাসটা জানলেই আমাদের সমসাময়িক ইতিহাস আপনাদের কাছে প্রাঞ্জল হয়ে যাবে আশা রাখছি। লোকে রুচি চায় না, ‘ফুলকো লুচি’ চায়। অভিনয় চায় না। ফূর্তি চায়।

এটা অবশ্যই ঘটনা, এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অবক্ষয়ের পিছনে সাহিত্যকে বিক্রি করার মানসিকতাই দায়ী। আমাদের এখানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা, তাতে সাহিত্যকে বিক্রি করতে হলে এমন কিছু নামকে আইকন করে তুলতেই হয়, যারা পাঠককে সস্তা বিনোদন ছাড়া কিছু দিতে পারেন না, এবং সেটাও দেন আবার ফুটো পয়সার বিনিময়ে। এর ফলেই আজকাল সত্যিকারের শিক্ষিত বাঙালিরা লিটল ম্যাগাজিনের দিকে তাকান। ফাঁপা উন্নাসিকরা তাকান ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের দিকে। তাঁরা  ‘প্যান্টি’ পরেন, থুড়ি, পড়েন না, ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ বা ‘গোল্ডেন গেট’ পড়েন।
দোষটা কিন্তু বিগ হাউসের নয়। বিগ হাউসকে ভিলেন বানিয়ে লাভ নেই। একটা বিগ হাউস গেলে আরেকটা তার জায়গায় তৈরি হবে। অলীক প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কোনো অর্থ হয় না। যদি প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা করতে হয়, নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো করে করতে হবে। তিনি একটা ‘ভাষাবন্ধন’ বানিয়েছিলেন। আপনিও বানান।
শুধু মনে রাখা ভালো, বদল ঘটাতে হবে আমাদের সামাজিক সাহিত্যরুচির। কেউ  যদি ভাবেন, সেটা সত্যিই বদলে ফেলবেন, তাহলে শুধু সাহিত্যিক হিসেবে নয়, তাঁকে   সেখান থেকে শুরু করতে হবে, যেটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিসর, বঙ্কিমবাবুর নয়।


1 টি মন্তব্য:

  1. কথাটি খুবই সত্যি | আসলে আপনার পাঠক যদি আপনার কথা না হজম করতে পারে তাহলে সে আপনার কথা শুনবে কেন? পৃথিবীতে মাথাওলা পাঠকের সংখ্যা কমে আসছে দ্রুতগতিতে | তার সাথে পাল্লা দিয়ে আপনাকেও এমন কথা লিখতে হবে যা ওই পাঠকরা বুঝতে পারে | এই সঙ্গে লিটিল মাগাজিনের জাতও বজায় রাখতে হবে | তাই শুরুটা ওই মাথামোটাদের মনপসন্দ কথা দিয়ে করবেন আর শেষটা আপনার যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে করবেন | তাহলে আপনার মাগাজিনের পাঠকও তৈরী হলো আবার জাতও গেল না |

    উত্তরমুছুন