বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

০১) তানিয়া চক্রবর্তী


 
“আমার বিষয়বস্তু মুখে একটা ফুলকাটা দাগ”

বিশেষত যে সময় পাঠক শামুক হন বা নিভৃতে নিজেকে মেলে ধরেন, যখন আর  রং-চং খেলা নয়, নিজেকে ডুমো ডুমো কিল-চড় মারতে ইচ্ছা করে, তখন যে ধরনের লেখনী অনুভূতির গোঁড়া খুঁচিয়ে নিজেকে সমকালীন থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায় -- সে প্রসঙ্গে স্বদেশ সেন।

‘রহস্য নিয়ে’ শীর্ষক একটি গদ্যে স্বদেশ সেন বলেছেন, কীভাবে নতুন আসে -- কৃতি  থেকে বিকৃতি — বিকৃতি আর বিশৃঙ্খলা এক তাগিদ নয়, দুটো ছিন্নমূলও নয়। কখন তার প্রয়োগ স্বাভাবিকের থেকে আলাদা হয়েও স্বাভাবিক, তেজী, আবেদনকারী ও গ্রাহ্য বিকৃতি, সেটাই গ্রহণযোগ্য। স্বদেশ সেন বুঝিয়েছেন, রহস্যের ঘোমটা কতক্ষণ অবধি   প্রসূত চিন্তার কায়েমী ফল – যেন পারমাণবিক বিভাজন।

‘মাটিতে দুধের কাপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘গণনীয় হয়ে’ কবিতায় ধারালো ক্ষুব্ধতাকে সহজ  আলিঙ্গনে তুলে এনেছেন যেন -- “কিন্তু এ নম্বরী জন্ম / ঠাসা মাংসে, এক দাগ মেধায় / শুধু পাশখানে ব’সতে চায় / আরো  কার চোখে পড়তে চায় / একবার গণনীয় হয়ে’’

‘ব’ল না জায়গা নেই’ কবিতায় -- “বললাম তো হাইফেনগুলো তোমাকে মিলিয়ে  দেবে দেখো / ...সাত শরিকের পিঁড়ি তোমার নিজের পিঁড়ি ধরো” – এই যে গ্রাহ্য দূরত্ব আর অবস্থানের ক্লিশে খেলা, এটাতেই কবি আশ্চর্যজনক ভাবে সহজ, এই সহজটা  যারা কবিতার ক্রোশ ক্রোশ দূরে কুণ্ডলীকৃত, তাদের সত্যির মতো।  


‘আস্ত একটা ব্যাপার কবিতায়’ কবিতায় -- “এই যে তুমি লবণাক্ত সেটা একটা  ব্যাপার”-- আমরা যারা ক্ষণিক চরিত্রের প্রকাশে ক্রমশ পোলারাইজড, তারা স্থায়িত্বের হেতু হই বা না হই, সেটাই বিশেষ বিশেষণ, তা এখানে প্রতিফলিত।

কখনও প্রকৃতির নিমগ্নতা থেকে শুকনো হওয়া অবধি খাঁজে খাঁজে গাঢ় হওয়া অথবা সচেতন চরিত্রের গতিপথ তাঁর কবিতার মধ্যে চোরাস্রোতের মতো। কিছু কিছু লেখনীই থাকে, তা যেন “বানানো উনুনের কাছ থেকে চাহিদার মতো তাপ নিতে শেখায়”,   আবার কিছু থাকে “তা যেন মেরুবাসীর কাছে সূর্যের মতো’’ — দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্বদেশ সেনের কবিতা।

‘সাদা ট্যাবলেট’ কবিতায় -- “ভোরে সাদা ট্যাবলেট রাত্রে হলুদটা / ভোলা নেই / একটু জল খেয়ো একটু বেশী” -- যেন দ্রাব দ্রাবকের সম্পৃক্ততার খামতি আর তাকে প্রতিস্থাপনের পরিমাণে ভেজিয়ে দেওয়া... যেন নিভৃত সময়ের অনুকৃতিকে পূরণ করার খেলা।

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভালোবাসা’ কবিতায় একটা কোষীয় কায়জমার মতো  ভাষা, যা আমরা জানি অথচ জানি না — “ওকে চেনার খুব দরকার ছিল / ওকে বোঝা অনিবার্য ছিল... অনিবার্য ছিলো একটু ভালোবাসা / ভালোবাসাই অনিবার্য ছিল”।

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘একত্রিশ আশা’ কবিতায় -- ধ্রুবক হয়ে গেছে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা যেখানে অধ্যাস নেই অথচ গন্তব্য বিহ্বলতা -- “এই বলা একবার বলো /ধনে জনে থাকো / ...থাকো হিসাবের তাপে /পরিমাণের রোদে” ‘সুখ একটা ধারণা’ কবিতায় -- “সুখ একটা ধারণা পেছনে প্রাণ মহাপ্রাণ দৌড়য়’’ অতিপ্রাকৃত   ভাবে ভাবলে এগুলো “+/-’’এর মতো কল্প আঙ্গিকের রূপক, তার পিছনে স্তরীভূত হওয়ার জন্য চলছি, আসলে অ্যাবস্ট্রাকশন একটা মুক্তকল্পের মতো দর্শকহীন অডিটোরিয়ামে নিজেকে নাচায়... কোথাও তীব্র মুদ্রায় এসে স্থাপিত হয়, সেটা চরমবিন্দু। এখানে কেউ আক্রান্ত হই, কেউ হই না। পাঠক আর লেখকের অ্যগ্লুটিনেশন মানেই আক্রান্তকারী কবিতা -- সফল কবিতা।

‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ কাব্যগ্রন্থের ‘কোথায় এক পরিবর্তন’ কবিতায় দুটি লাইন -- “পড়ো এমন করে, এমন অসাধারণভাবে পড়ো / যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়” -- একটা ধরার চেষ্টা আর না ধরতে পারার প্রপাত -- সেটাই তো কায়েমী বিকৃতি, কিন্তু বিশৃঙ্খলা নয়, তা এখানে বোঝা যাচ্ছে। ‘জাদু’ কবিতায় তুলনামূলক জিঘাংসা -- “একটা কি সূর্য উঠছে না আগুনের ব্লুম” আসলে কবিতার ব্যুৎপত্তি হয় না, তার যে কোনো সূত্র বা ধর্মের দায় নেই -- এটা এই কবিতায় ধরা দিচ্ছে, বিশেষত কবিতা হচ্ছে একটা আস্ত ‘হয়তো’, যেখানে সম্পূর্ণতা  একটা চাপ -- রূপকরা সত্তা... স্বদেশ সেনের কবিতা বিমূর্তকরণকে ধারারেখ করে দেখায় 

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমার বিষয়বস্তু’’ কবিতায় -- “আমার বিষয়বস্তু মুখে  একটা ফুলকাটা দাগ” শেষ লাইন -- “তবুও বিষয়বস্তু মুখে একটা ফুলকাটা দাগ”  এই যে কবিতার এন্ট্রি আর এক্সিট -- ফিরে আসার কথা না ভেবেও তার দ্রাঘিমার পাশে ঘুর ঘুর করা অথবা ফেরার প্রবণতায় অজানাকে নিয়ে ভুলভুলাইয়ার যাপন,  তাই তো চরম অভিব্যক্তি...

সব শেষে বলি, স্বদেশ সেনের কবিতায় অ্যাবস্ট্রাক্ট জরুরিপনার যে আলগোছ বাস্তব  নশ্বরতা পেয়েছি, তা কতটা সফল, বলার ক্ষমতা নেই... তবু এটুকু সত্যি যে, তা  আক্রান্তকারী... এমন কবি তিনি, যাঁর কবিতা তাৎক্ষণিকের নয়... একটা অসামঞ্জস সময়ের সমসংস্থ চয়ন। আসলে যা পৃথিবীতে আছে কিংবা যা নেই অথবা যা হ্যালুসিনেশনের প্রাথমিক অবয়ব, তারা তো চিত্রকল্প হয়েই আভিযোগী হয়এখানেই আমরা তাদের জন্য কাল্পনিক ছিপ নিয়ে ঘুরে বেড়াই... আর এখানেই তাঁর সক্রিয়তা দৃষ্টান্তমূলক। তাঁর লেখনীর আরোহণে তাঁকে আপ্রাণ শ্রদ্ধা জানাই।  
                                                                   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন