ভগ্নাংশ
১
ছেলেটাকে দেখা গেল শ্রাবণের ভিজে বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের ধারে
বালির ঢিবিটায় বসে আপন মনে আকাশ দেখতে।
সন্ধ্যার আলো ধরে আসা জামালপুর ইস্টিশনে ফের ছেলেটাকে
দেখা গেল ঈদে পাওয়া নতুন জামাটায় নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে।
তারপর একটা সাদা রুমাল দুলে উঠল।
হরি জ্যাঠার পানের দোকানে তখন বাজছে, দিল নে দাস্তা রখা ন
বিছায়া, দাওয়াত-এ-ইশক হ্যায়...
রহিম শেখের মন কুলিগিরি ছেড়ে মেল ট্রেনের সাথে ছুটছে, কবেকার
ফুলপুরে, যেখানে মা তার ঈদের সেমাই রান্না করতে করতে গুনগুন করত, মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও...
তারপর
সেই ছেলেটাকে আর
কোথাও দেখা গেল না।
২
মেস বাড়ির তিন বেলার রান্না। শেষ করে বাড়ি ফিরতে
ফিরতে সেতারার রাত হয়ে যায়। উৎসবেও দু’ চারদিন ছুটি মেলার যো নেই। সারা বছরই মেসে কেউ না কেউ
থাকে। এদের ঘরে ফেরার তাড়া নেই অথবা এদের ঘরই হয়তো নেই, কে জানে! এবারকার ঈদের দিনটায় সে এক বেলার ছুটি পেয়েছে।
ঈদের পরদিন আবার সকাল বেলাই তাকে হাজির হতে হয়েছে কাজে। তিন বেলা রান্নার ফাঁকে
আরও দু’ বাড়ির কাজ করে সে যখন বাড়ির পথ ধরল, হেলালের মনোহারি দোকানের তীর্যক আলো তখনও অন্ধকার পথ ভাসিয়ে রেখেছে। ওই পথটুকু
পেরোলে পরে হেলাল দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে বাড়ির পথ ধরে।
সেতারা যখন এগারো বছর বয়সে যাবতীয় কিশোরী কৌতূহল বিসর্জন
দিয়ে মতি গাজির ঘর করতে আসে, তখন ইশকুল
পড়ুয়া এই হেলালকে দূর থেকে সে দেখত। দূর সম্পর্কের
দেওর, ভাসা ভাসা দু’টো চোখ আর উদাসীন হেলালের সাথে তার কোনো একদিন আলাপ হয়। তারপর কাকীদের ভিটে
ক্রমেই আলগা হলো। কাকা কোন দূরদেশে পাড়ি
দিল, কেউ হদিস পেল না। শোকে, অভাবে কাকী শয্যা নিল আর হেলাল তার পড়ার বইগুলো কোনো এক রৌদ্রময় সকালে
তার সহপাঠিদের বিলিয়ে দিয়ে বাড়ির কাছে বটতলায় একটা চা-এর দোকান খুলে বসল। তারপর
দিন গেছে, পথগুলো ভেঙে চুরে গেছে।
চারপাশের খানাখন্দে দিন আর রাতের হিসাব বদলে বদলে গেছে। একসময় সেতারা নিজের কক্ষপথ
থেকে যখন ছিটকে ছিটকে পড়ছে, তখন ওই চোখ দু’টো...
ঘরের দাওয়ায়
দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ এইসব ভাবতে থাকা সেতারার হঠাৎ খেয়াল হলো, ছেলেটাকে সে সারাদিন
চোখের দেখা দেখেনি।
৩
বছর তিনেক মতি গাজির ঘর করেছিল সেতারা।
মতি গাজি, থাকার মধ্যে সম্বল ছিল কেবল ভিটেবাড়ি আর মাথা
ভর্তি অন্ধ রাগ, যে রাগকে সেতারা সমঝে
চলেও কখনও কখনও নিস্তার পেত না গাজির মারের হাত থেকে। দুই বউ মরা নিঃসন্তান বুড়োর
গায়ে অত জোর যে কোথা থেকে আসত, কে জানে! অথচ সেবার একদিনের জ্বর সেই গাজিকে হারিয়ে
দিল। সারাদিনের প্রচণ্ড জ্বরের তাপে গাজি একেবারে নেতিয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যার পর
সেতারা কোথা থেকে বার্লি এনে তাই এক খাবলা জ্বাল দিয়ে গাজির মুখের কাছে ধরলে গাজি
সামান্য মুখ খুলেছিল আর সেতারা সেই বার্লি ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে তার মুখে তুলে দিয়েছিল।
তারপর কী করে কী হলো, গাজির সামান্য খোলা
ঠোঁট গড়িয়ে বার্লি গড়িয়ে পড়েছিল মাটির টানে।
সেতারার তখন তিন মাস চলছে।
গাজির মুখে এক ফোঁটা বার্লিও পৌঁছাতে না পেরে পোয়াতি
সেতারা ভর সন্ধেতে বুক ফাটা চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল।
বটতলায় তখন জোর বাজছিল হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল
দুপাট্টা...
হেলালের চা-এর দোকান সেদিন সেজেছিল মনোহারি দোকানের
সাজে। হেলালের ঘরে প্রদীপ জ্বালছিল তার সদ্য বিয়ে করা বউ।
৪
ঘর অন্ধকার।
এত রাত অথচ ছেলেটা ঘরে নেই... কেন?
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল সেতারার।
এদিক ওদিক দেখে হতাশ হলো সে। নেই... কোথাও নেই সে...
এরকম তো হয় না কখনও!
দু’ঘর পরে রতনদের ঘর। সোহাগ সারাদিন রতনের সাথে সাথেই
থাকে। সঙ্গী বলতে এক রতনই আছে, সেতারা সেখানেও ঢুঁ দেয়। রতনরা নেই...
একে একে প্রত্যেকের ঘরে সেতারা সোহাগের খোঁজ করে। নাহ...
নেই...
আশঙ্কায় পেটের ভেতর সব দলা পাকিয়ে ওঠে। ছটফট করতে করতে
সে একসময় পাগলের মতো হেলালের বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
৫
চাষাড়া স্টেশনে সকাল নামল শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টি নিয়ে।
একটা সিটি ট্রেন নারায়ণগঞ্জের দিকে ছেড়ে যেতেই স্টেশন যেন ফাঁকা হয়ে গেল।
এক কোণে বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিজেকে বাঁচাতে জবুথবু
বসে আছে একটা ছেলে। কে বা কারা তার সামনে
একটা শাদা রুমাল দুলিয়ে দেবার পর থেকে ওর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর এই
কথাটিই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।
ছেলেটা... চোখ দু’টো
তার অবিকল হেলালের মতো।
সুখ পাখি
উত্তরমুছুনসুখে আছে যারা সুখে থাক তারা
সুখ পাখি রে সুখকে ভুলে যেও না।
আমি যে সুখের লাগিয়া কাঁদি ফিরি
সুখ পাখি রে কেবা চিনি সুখের তরি।
অন্ধ হয়েছে আমার অন্তরখানা অন্তরা
আঁধারের জ্বালা অবুঝ হৃদয় বুঝে না।
অন্যালোকে চক্ষু খোলে এখনও চাহনিতে অশ্রু ঝড়ে
আঁধারের আলো আঁধারে করে আরো কালো।
সুখে আছ সুখে থাক বার মাস
সুখের লাগিয়া কাঁন্দা কিবা লাভ।
ও মায়া ও মায়া ও যে মায়া মমতার খেলা
কায়া বিবিকে হার মানায় তুমি যে জয়া।