যাচাই
গল্প : বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায় নাট্যরূপ
: সুকোমল ঘোষ
(নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, জামশেদপুর শাখা
পরিবেশিত শ্রুতি নাটক)
চরিত্র
সুরেশ – একুশ বছরের যুবক;
ননীবালা - সুরেশের মা;
কনক - ননীবালার ঠাকুরঝি; প্রীতিলতা -
গাঙ্গুলী বাড়ির বৌ
চাটুয্যে বুড়ো – গ্রামবাসী
(১)
(গরুর গাড়ি চলার শব্দ, গাড়িতে সুরেশ ও ননীবালা)
সুরেশ-
(ঘুম জড়ানো স্বরে) ও কাকা, গরুগুলো কি জল
খাবে নাকি? কি রকম হাঁপাচ্ছে দেখ!
ননীবালা- ও বাবা সুরেশ, চেয়ে দেখ, ওই আমাদের গ্রাম চাঁদপুর এসে
গেছে। ঐ দেখ ব্রাহ্মণকপাড়া, দুলেপাড়া। সেই
ত্রিশ বত্রিশ বছর আগে এ গ্রামে বৌ হয়ে
এসেছিলাম, উঠে পড় বাবা!
সুরেশ-
আমি ঘুমোইনি মা, চেয়ে দেখছি — (শুয়ে শুয়ে গান ধরে) “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম/পতিত পাবন সীতারাম”। মা মনে আছে, মহাত্মাজীর মহাপ্রয়াণের বছর পূর্তির দিন আমি এই গানটা
গেয়েছিলাম? সবাই খুব বাহবা দিয়েছিল।
ননীবালা- গান তো তুই ভালোই গাস খোকা।
সুরেশ-
সবাই বলে মা, আমাদের দেশ এখন স্বাধীন হয়েছে,
এখন আমাদের আর কোনো কষ্ট করতে হবে না, এখন মানুষের ভালো চাকরি হবে, উন্নতি হবে, মাইনেও অনেক বাড়বে — না খেয়ে আর কেউ মারা যাবে না এই
স্বাধীন দেশের মাটিতে।
ননীবালা- তোর বাবা মারা যাবার পরে, তোর বয়স তখন মাত্র দশ, যে
বিপদে পড়েছিলাম — আজ মনে হচ্ছে সমুদ্রে
পাড়ি দিয়ে এসে অদূরে এবার কূলরেখা যেন
দেখা দিয়েছে।
সুরেশ-
তোমরা কতদিন এই গাঁ ছেড়ে গিয়েছিলে?
ননীবালা- তোর যা বয়স।
সুরেশ-
তার মানে একুশ বছর!
ননীবালা- হ্যাঁরে সুরেশ, একুশ বছর। তোর বাবার ইস্কুলের চাকরিটা
গেল —আমরাও গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে
চলে গেলাম — তোর বয়স তখন মাত্র ন’ মাস। তোর যখন দশ বছর বয়স, তখন তোর বাবা আমাদের চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে
গেলেন — কী আতান্তরেই ফেলে গিয়েছিলেন সেদিন! মনে হয়নি যে,
আবার একদিন এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারা যাবে।
সুরেশ- হ্যাঁ মা, আমারও অল্প অল্প আবছা আবছা মনে পড়ে — রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে আমরা বাসা
বাড়িতে চলে এলাম। স্কুলের সেক্রেটারী দাদু আমাকে ফ্রী-শিপ দিলেন।
ননীবালা- তুইও তার মান রেখেছিস বাবা, পড়াশোনায় ভালো ছেলে হয়ে,
নইলে যে অপাত্রে দয়া দেখানো হতো!
সুরেশ- মা, আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে — এই চাঁদপুর গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় বাবার কোনো কষ্ট হয়নি,
বাবা কখনও আর গ্রামে ফিরে আসতে চান নি?
ননীবালা- আজন্মের গ্রাম, দুঃখ তো হবেই বাবা — খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। গ্রামে একবার আসতেও চেয়েছিলেন। আহা! মরবার আগে প্রায়ই বলতেন, বড়বৌ, একবার যদি চাঁদপুর যেতে পারতাম ফিরে,
তবে বোধহয় কিছুদিন আরও বাঁচতে পারতাম। ওখানে এখনো চৈত্রমাসের দুপুরে বুড়ির কুলচুর
শুকোচ্ছে রোদ্দুরে। বাঁশবনে কত কোকিল পাপিয়া ডাকছে। আমি গাঁয়ে যাব...! শহরের ছোট্ট বাসার মধ্যে উনি চিরকাল হাঁপিয়ে
এসেছেন।
সুরেশ-
আমি যদি তখন বড় হতাম, বাবাকে বাবার জন্মভূমিতে ঠিক নিয়ে আসতাম।
ননীবালা-
(অপূর্ব অনুভূতির শিহরণ) চেয়ে দেখ বাবা, চেয়ে দেখ — এই গাঁয়ের সীমানা। ওই, ওই যে দুলেপাড়া-
সুরেশ- ব্রাহ্মণপাড়া! কতদূর?
ননীবালা- আরও আগে, মনে হয় ভোর ভোর পৌঁছে যাব। (স্মৃতিচারণ) প্রথম এ গাঁয়ে ঢুকেছিলাম ‘নতুন বৌ’ হয়ে। তখন তোর বাবা ছিল পাশে। আজ তিনি নেই, তুই আছিস।
সুরেশ-
আমরা আমাদের বাড়িতেই উঠবো তো মা? কিন্তু এই
একুশ বছরে তা কি আর বাসযোগ্য আছে?
ননীবালা- হ্যাঁ খোকা, আমরা আমাদের বাড়িতেই উঠব । বিনোদ ঠাকুরপোকে চিঠি দিয়েছিলাম, ওঁর খুড়তুতো ভাই, উত্তর দিয়েছেন, পরিষ্কার
করে রাখবেন, যাবার দিনক্ষণ জানিয়ে দিতে। আজ পৌঁছবো, জানিয়ে
দিয়েছি।
সুরেশ-
আমার তো কিছুই মনে নেই আমাদের বাড়ির কথা...
ননীবালা- দূর, তোর তো মনে থাকবার কথাও নয়। বললাম না, তোর ন’মাস বয়েসে আমরা গাঁ ছেড়ে চলে যাই! বাড়িতে তিনখানা ঘর, দুটো বারান্দা দু’দিকে,
ভাঁড়ার, রান্নাঘর আলাদা।
সুরেশ-
এখন এখানে কিছুদিন থাকবে তো মা? আমার বড় ভালো
লাগছে।
ননীবালা- থাকতেই তো এলাম। এখন মা মঙ্গলচন্ডী যা করেন!
(২)
(ননীবালার ঘর গৃহস্থালি)
কনক-
বউদি, আমাকে মনে পড়ে বউদি? মনে পড়ে?
ননীবালা- হ্যাঁ ভাই, খুব মনে পড়ে, কনক ঠাকুরঝি। ভালো?
কনক- ভালো, তুমি?
ননীবালা- দেখতেই পাচ্ছ। তোমার সঙ্গে এ কে গো?
কনক- ও প্রীতিলতা, গাঙ্গুলী বাড়ির বৌ।
প্রীতিলতা- আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসব ভাবছি আজ ক’দিনই-
ননীবালা- আমার কথা কে বলল তোমায়?
প্রীতিলতা- সবাই বলে। আমার পিসিশাশুড়ি বলছিলেন, বড় ভালো বৌ ছিল এ
গাঁয়ের, গিয়ে দেখা করে এসো বউমা। আপনাকে কী বলে ডাকবো?
ননীবালা- আমার নাম ননীবালা। তুমি আমায় কাকীমা বলে ডেকো। তোমার
বাপের বাড়ি কোথায়?
প্রীতিলতা- শান্তিপুরের কাছে হবিবপুর। কাকীমা, আপনার নাতনীর একটা
নাম ঠিক করে দেবেন? এখনো কিছু রাখিনি। আমি ডাকি টুলু বলে-
ননীবালা- দেব না কেন বউমা, নিশ্চয়ই দেব।
কনক-
ও খুব ভালো গান করে বউদি।
ননীবালা- তাই বুঝি!
প্রীতিলতা- গাই, তবে সে তেমন কিছু না। আপনার গান শুনব। সবাই বলে আপনি ভালো গান জানেন।
ননীবালা- আমি? আমার গানের পাট তো চুকে গিয়েছে মা। আবার — নাঃ!
কনক-
তোমার চেহারা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে বউদি।
ননীবালা- আর চেহারা ঠাকুরঝি! কী দরকার আর চেহারায় বল? সে পাট তো
ঘুচে গিয়েছে।
কনক-
দাদার কী আর যাবার বয়্স হয়েছিল! সবই অদেষ্ট-
কি বলবে বল!
প্রীতিলতা- কাকীমা, আজকে আমি আসি-
ননীবালা- এসো বউমা, তোমাদেরই মুখের দিকে চেয়ে তো আবার এ গাঁয়ের মাটিতে পা দিলাম। আবার এসো মা।
(প্রীতিলতার প্রস্থান)
বেশ মেয়েটি, তাই না গো ঠাকুরঝি! তোমার দাদার কথা বলছিলে ঠাকুরঝি, সত্যিই আমার অদৃষ্ট। নইলে অভয় নাপিতের বৌ, যে কিনা আমার মায়ের
বয়সী, সেও পাকা চুলে সিঁদুর পড়ছে—। জান ঠাকুরঝি, এখানে এসে বড্ড বেশি করে তাঁর
কথা মনে পড়ছে। একবার উনি নতুন ধানের শিস
নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, “লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে রেখে দাও। নতুন জমির ধান। তুমি ঘরের লক্ষ্মী, শাঁখ
বাজাও, শাঁখ বাজিয়ে অভ্যর্থনা করা নিয়ম তোমার।” সব ঘরে,
সব বারান্দায়, প্রতি কোণে, ওই তক্তপোষখানায় তাঁর ছড়ানো স্মৃতি আমি অনুভব করি।
কনক-
আহা, মনে পড়লে আমারও বুক ফেটে যায়। এই তো
সেদিনের কথা — আমি আর রায়চৌধুরী পাড়ার সুবাসিনী তোমাদের
বন্ধ দুয়ারের বাইরে আড়ি পেতে বসে থাকতাম
রাত দুপুর পর্যন্ত। যেদিন ধরা পড়ে গেলাম, সেই রাত্রে
দাদা আমার মুখে খড়ি গুলে মাখিয়ে দিলে আড়ি পাতবার জন্য।
ননীবালা- যুঁইফুলের গন্ধে ভরা দীর্ঘবিলসিত সেই পুরনো বাতাস আজ কোন্
দিগন্তে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর পথে আজ
আমি একা। না, না, খোকা আছে। তার ঘরকন্না গুছিয়ে দিতে হবে না? তাকেই গুছিয়ে দিতে
হবে সব। জান ঠাকুরঝি, এখন যখন সুরেশ এসে বলে, মা একটু
তেঁতুল জরাও না নুন দিয়ে লেবুপাতা দিয়ে, আমি চমকে উঠি। তোমার দাদাও
পেছন থেকে এসে চুপি চুপি বলতেন, “নুন দিয়ে লেবুপাতা দিয়ে তেঁতুল জরাও দিকি বেশ করে!” আর
তার পরদিনই ওঁর সর্দি আর গলাব্যথা। আজ যদি
তিনি থাকতেন, আমরা তাঁকে কাজ করতে দিতাম না। আরাম করে খেতেন ছেলের রোজগার। ছেলের
বৌ সেবা করত, তেঁতুল জরিয়ে নিয়ে আসতো আর এই দুপুরে বসে বসে গল্প করতাম আমরা দুজনে।
কনক- থাক
বউদি, সে সব কথা থাক--
ননীবালা- হ্যাঁ ভাই কনক ঠাকুরঝি, সেদিন
সত্যনারায়ণের পুঁথি পড়ার সময় যে বুড়ো মানুষটিকে দেখলাম, উনি কে ভাই?
কনক- কার কথা বলছ বউদি?
ননীবালা- তা তো জানিনে, উনি জিজ্ঞেস করলেন, “পুজো
হয়নি?” হরিদাস চক্কোত্তির ছেলে বলল, “না। আসুন
জ্যাঠামশায়, বসুন!” উনি বললেন, “মেয়েদের মধ্যে আর বসব না। যাই বাইরে। আবার বাড়ি
গিয়ে রুটি করতে হবে, তবে খাব”। শুনে আমার খুব কষ্ট হলো ঠাকুরঝি। উনি কে?
কনক- ও
চাটুয্যে বুড়ো। ছেলেরা মস্ত রোজগেরে। কলকাতায় থাকে। বুড়ো বাবা এখানে পড়ে আছে, খোজও
নেয় না।
ননীবালা- বৌ বেঁচে নেই বোধহয়?
কনক- খুব আছে! ছেলেদের কাছে কলকাতায় থাকে।
ননীবালা- উনি যান না কেন ছেলেদের কাছে?
কনক- তা কি জানি! তা বলতে পারিনে। এখানে থাকে তাই তো দেখি। আর তুমিও যেমন, নিজের খবরই
রাখতে পারিনে, তার আবার পরের খবর! তা তুমি যাও না, গিয়ে একদিন আলাপ করে এসো। এমনিতে লোক ভালো আর তুমিও তো এ গাঁয়ের একজন।
যেতেই পারো!
ননীবালা-
ভাবছি যাব। কালই যাব।
(দৃশ্যান্তর)
(৩)
(চাটুয্যে বুড়োর
বাড়ি)
বুড়ো- কে, কে তুমি মা?
ননীবালা- আজ্ঞে জ্যাঠামশায়, আমি এ গাঁয়েরই বাসিন্দা। বিনোদ ঠাকুরপোর বৌঠান। একুশ বছর আগে এ গাঁ ছেড়ে চলে যাই। ফিরে
এসেছি, সঙ্গে ছেলে সুরেশ — তিনি নেই।
বুড়ো- ও, তা ছেলে কী করে?
ননীবালা- ছেলে রেলের শিক্ষনবিশী শেষ করেছে, এবার চাকরি পাবে। নাম তার সুরেশ।
বুড়ো- বা, বা, খুব খুশি হলাম। একটানা পথ বেয়ে তুমি ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছো। এবার মনে পড়েছে বউমা, তুমি বোধহয় ইস্কুল মাষ্টারের বৌ।
ননীবালা- হ্যাঁ, ওঁর ইস্কুলের চাকরিটা যাওয়ার পর আমরা
এখান থেকে চলে যাই। এবার ফিরে এসেছি। বাঃ, কী সুন্দর বাগান আপনার
জ্যাঠামশায় —একদিকে ডুমুর গাছ,
অন্যদিকে বাতাবি লেবু। কত পেঁপে ধরেছে পূব-দিকের ঐ গাছটায়—
বুড়ো- সব আমার নিজের হাতে করা বউমা, সবাইপুরের বিশ্বাসদের বাড়ি থেকে বীজ আনিয়ে
ছিলাম আজ ন’ বছর আগে। সেই গাছ। তখন
ওরা সব এখানে ছিল।
ননীবালা- ওরা! কারা জ্যাঠামশায়?
বুড়ো- তোমার জেঠিমা।
ননীবালা- আপনাকে এখানে রেঁধে দেয় কে?
বুড়ো- নিজেই রাঁধি। খুব ভালো রাঁধতে পারি। এই এখন বসে পরোটা করব।
ননীবালা- জেঠিমা থাকেন না এখানে?
বুড়ো- না,না, ওরা বড় ছেলের কাছে থাকে — কলকাতায়।
ননীবালা- ক’ ছেলে আপনার?
বুড়ো- তিনটি। তা নিজের মুখে বলতে নেই, তিন ছেলেই ভালো চাকরি করে।
শ্যামবাজারে তেতলা বাসা, ইলেকট্রিক লাইট, ফ্যান, বড় ছেলের মোটর গাড়ি -- দশে
মানে, দশে চেনে। চাটুয্যেসাহেব বললে সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের সকলে এক ডাকে চেনে।
চেহারাও একেবারে সায়েবি। নিজের ছেলে ভেবে বলছি ভেবো না! তা এসো বউমা, এই পরোটা ক’খানা ভাজি আর তোমার সঙ্গে গল্প করি। অ্যাই, অ্যাই বুঝলে
বউমা, দালদা। ভালো দালদা। আর তা ছাড়া পাচ্ছি কোথায় — শ্রী
ঘি আট টাকা সের!
ননীবালা- কেন, আপনার ছেলে টাকা পাঠায় না?
বুড়ো-
না, নৃপেন? তার অনেক খরচ। রোজগারও
যেমনি, খরচও তেমনি। আমি আর তাকে বিরক্ত করিনে। আমার বিঘা তিনেক ধানের জমি আছে, আর ধর -- লাউ করি, কুমড়ো করি, ঢেঁড়স, ডাঁটা — সবই তৈরি করি নিজের হাতে। বেশ চলে যাচ্ছে। নৃপেন পুজোর সময় একখান ভালো থান কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছে
— ফাইন থান -- তা বউমা, সে
আমি তুলে রেখেছি। বার বার দেখি, বলি বড় খোকা আমায় দিয়েছে। ছোট ছেলের বাসা আগে ছিল কলকাতায়, এখন মণিপুরে। সে একজোড়া চটিজুতো পাঠিয়ে
দিয়েছিল ওই পুজোর সময়ই।
ননীবালা- আমার তো পরোটা বেলা হয়ে গেল, আপনি ভেজে নেবেন, না আমি
দেব?
বুড়ো-
না মা, আমিই নিচ্ছি।
ননীবালা- কেন আবার কষ্ট করবেন! আমি করে দিচ্ছি। আপনার ছেলেদের বউ কেউ এখানে থাকেন না কেন?
বুড়ো-
না, না, পাগল! তাদের কি এই অজ পাড়াগাঁয়ে
থাকতে বলতে পারি? তুমি জান না, এসব অশিক্ষিত স্থানে তাদের আমি আসতে বলতে পারি না। তাদের মন টেঁকে এখানে? গরীব ছিলাম নিজে বটে, কিন্তু ছেলেদের মানুষ করে দিয়েছি
কষ্ট দুঃখ করে। বিয়েও দিয়েছি তেমনি ঘরে। বড় বউমার বাবা মতিহারিতে সিভিল সার্জন— মেজ বউমার বাবা নেই — মামারা খিদিরপুরের বড় কন্ট্রাক্টর। রায়চৌধুরী কোম্পানির নাম শুনেছ? সেই
রায়চৌধুরী কোম্পানি। ছোট বউমার বাবা এখন বাঁকড়োর সদর এস.ডি.ও। বড় বউমা ম্যাট্রিক পাস, ছোট বউমা বি.এ পর্যন্ত পড়েছিলেন, -- পরীক্ষা দেন নি।
ইংরেজি বলেন কী! আড়াল থেকে শুনেছি, যেন
মেমসাহেব! হুঁ হুঁ বউমা — এ সব গল্পকথা এখান থেকে
শোনাবে -- নিজের চোখে না দেখলে--
ননীবালা- তাঁরা কখনো এখানে আসেন নি?
বুড়ো-
বড় বউমা এসেছিলেন একবার পুজোর সময়, যে বার
আমার বড় নাতির ভাত হয়। সে আজ বিশ বছর আগের
কথা। সে নাতি এখন ডাক্তারি পড়ছে, মেডিকেল কলেজে। ছোট বউমাকে নিয়ে আমার ছোট খোকা এসেছিল সেবার মোটরে করে। ঘণ্টা চার পাঁচ ছিল সবাই। আমি অনেক দিন দেখিনি কিনা, তাই চিঠি লিখেছিলাম। চিঠি পেয়ে বউ নিয়ে দেখা করতে
এসেছিল। ছোট বউমা এসে শুধু ডাব আর চা খেয়েছিলেন — পাড়াগাঁয়ের জল খেলেই ম্যালেরিয়া হবে। তাদের অবস্থা ভালো, শিক্ষিত — সবই তো বোঝ মা! রাত কাটালো না এখানে — কোথায়
বা শুতে দিতাম, না বিছানা, না মশারি। নিজে শুই একটা ছেঁড়া মশারি টাঙ্গিয়ে। সারারাত
মশা কামড়ায়, নিজে ভালো দেখতা পাই না চোখে যে সেলাই করব!
ননীবালা- এইবার খেতে বসুন জ্যাঠামশায়। আমি দুধ জ্বাল দিয়ে রেখেছি—
বুড়ো-
কী সুন্দর পরোটা হয়েছে! মেয়েমানুষ না হলে কি
খেয়ে তৃপ্তি? মেয়েদের হাতের রান্নাই
আলাদা। বেঁচে থাকো বউমা, বেঁচে থাকো। মুখ বদলালাম আজ অনেকদিন পরে।
ননীবালা- এবার তবে আমি আসি জ্যাঠামশায়, কাল এসে আমি আপনার মশারি
সেলাই করে দেব।
বুড়ো-
তা বেশ। এসো বউমা, -- বউমা, কাল একটু গুড়
সঙ্গে করে আনতে পার? বড্ড গুড় খেতে ইচ্ছে হয়, এ বছর আমি কিনতে পারিনি। বড্ড দাম!
পরোটা দিয়ে খেজুরের গুড় লাগে বড় ভালো—
(দৃশ্যান্তর)
(৪)
(ননীবালার ঘর গৃহস্থালি)
ননীবালা- খোকা, এখানে তোর কেমন লাগছে বাবা-
সুরেশ-
বেশ ভালো লাগছে মা! দেখ আজ কেমন জ্যোৎস্না
উঠেছে — এখানে একটু বোসো না মা-
ননীবালা- হ্যাঁরে সুরেশ, বাবাকে তোর মনে পড়ে?
সুরেশ-
খুব মনে পড়ে মা! বাবা আমায় নামতা পড়াতেন, রোজ
সকালে উঠে। পড়ানো শেষ
হতো ইষ্টিশান থেকে ট্রেনটা বেরিয়ে যাবার
হুইশ্যালে। বাবা যদি আজ থাকতেন...
ননীবালা- রাত হয়েছে বাবা, যা শুয়ে পড়—
(স্বগত)
ওগো শুনছো, খোকা আজও তোমার নাম করছে। তুমি নেই বলে
ওর চোখের জলে তোমার স্মৃতি সার্থক হোক। বেঁচে থাকো তুমি সম্মানের সঙ্গে আমার মনে, খোকার মনে। জীবিত মানুষের জন্য
মন শুকিয়ে যায়, তুমি বেঁচে থাকলে হয়তো চাটুয্যে জ্যাঠামশায়ের মতো তোমাকেও অবহেলা
পেতে হতো। বেঁচে থেকেও আজ জ্যাঠামশায়ের মনে কত দুঃখ। ভালোই হয়েছে, তুমি তোমার মান নিয়ে
চলে গেছ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন