মহ্সিন ওস্তাদ আলি মখমলবাফ-এর
একটি নাটক
অনুবাদ : অ র্জু ন ব
ন্দ্যো পা ধ্যা য়
‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনে নাটকটি ধারাবাহিক ভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে গত জুন ২০১৪ (১৬তম সংখ্যা) থেকে। এই সংখ্যায় প্রকাশিত হলো দ্বিতীয়
কিস্তি। নাটকটির আগের অংশটুকু পড়ার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন –
খাঁচার ভেতর খাঁচা
মহ্সিন মখমলবাফ
রচনা মহ্সিন ওস্তাদ
আলি মখমলবাফ
রচনাকাল ১৯৮১
পরিচালক মহম্মদ রেজা হনারমন্দ
ভাবানুবাদ ও রূপান্তর অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
দৃশ্য ২
(মঞ্চ আগের দৃশ্যের মতোই। পাশাপাশি দুটো সেলে বৃদ্ধ ও যুবক। পায়ে শেকল।
সেলের দরজায় তালা। মঞ্চে প’ড়ে
আছে দুই রক্ষীর মৃতদেহ। একটি লোকের প্রবেশ)
লোক : একি! আপনারা এখনও এখানে! আরে খোমেইনি ফিরে এসেছে। শাহ্ আর নেই। আমাদের বিপ্লব সফল। সব অ্যামেরিকানগুলো
পালিয়েছে। (রক্ষীদের দেহগুলো দ্যাখে, কষ্ট ক’রে টেনে মঞ্চের এক কোণে সরিয়ে রাখে) সব কটা সি.আই.এ.-র
চর ছিল, বুঝলেন? আরে ভয় পাবেন না। বেরিয়ে আসুন। অন্য সব কয়েদীরা বেরিয়ে গেছে। কেউ
নেই আর জেলে। সবাই বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিয়েছে। সরকারের সব কটা টিকটিকির নাম আমরা
জেনে গেছি। এবারে কে বাঁচাবে ওদের! বাইরে গিয়ে দেখুন, কী হচ্ছে চারদিকে। ছেলে বুড়ো জোয়ান সবাই বেরিয়ে এসেছে
রাস্তায়। সবার মুখে স্লোগান — বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! খুনি পুলিশের মুণ্ডু চাই! চলুন চলুন, বেরিয়ে
আসুন। (চমকে গিয়ে, সেলের তালা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে) একি! দরজায় তালা দিল কে!?
গার্ডগুলো কি বেঁচে আছে নাকি এখনও! (বৃদ্ধকে) কে তালা দিয়েছে? চাবিটা কোথায়?
বৃদ্ধ : ঐ খানে (দ্বিতীয় রক্ষীর মৃতদেহের দিকে দেখিয়ে)
লোক : কোথায়? (দ্বিতীয় রক্ষীর কাছে প’ড়ে
থাকা চাবিটা নিয়ে সাবধানে চারদিক তাকিয়ে সেলের দরজার দিকে এগোয়) তাড়াতাড়ি করুন। আর
দেরি করবেন না। আসুন তাড়াতাড়ি। আমি বাকিদের বলে দিচ্ছি ওরা চারপাশে ভালো ক’রে খুঁজে দেখবে আর কেউ আছে কিনা। (বৃদ্ধ হাসতে থাকে। ক্রমে হাসি জোরে হ’তে থাকে। যুবকও হাসতে থাকে
এবার। জোরে। লোকটি একটু ঘাবড়ে যায়। সে-ও এবারে হাসতে চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে লোকটির
এবং যুবকের হাসি থেমে যায়। বৃদ্ধ হাসতেই থাকে।)
(লোকটি বাইরের দিকে তাকিয়ে মানে মঞ্চের উইংসের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে) হেই,
কে আছিস তোরা? আয় তো এদিকে... এদিকে আয়... (কয়েকজন লোক ঢোকে। তাদের মুখে দাড়ি। মাথায় একটা
সবুজ কাপড় বাঁধা প্রত্যেকের) আরে, এদের সেলের দরজা কেউ আটকে দিয়ে চলে গেছে। আর এখন
এরা কিছুতেই বেরোতে চাইছে না। আমার মনে হয় বোধহয় ভয় পেয়ে আছে খুব।
২য় লোক : (দুই বন্দীকে উদ্দেশ্য ক’রে)
ভয়ের কিছু নেই... বাইরে চলে আসুন...
৩য় লোক : ওরা বোধয় জানে না যে, আমাদের বিপ্লব সফল হয়েছে। তুমি বলেছ ওদের যে ইমাম
খোমেইনি দেশে ফিরে এসেছে?
১ম লোক : না, মানে... (বন্দীদের দিকে) দেখুন, শাহ্ পালিয়ে গেছে। শাহ্-র সব সাঙ্গপাঙ্গরাও হয় পালিয়েছে, নয় ধরা
পড়েছে আমাদের হাতে। সব্বাইকে মেরে ফেলেছি আমরা। সব কটা শেষ। আর ভয়ের কিচ্ছু নেই।
দয়া ক’রে বেরিয়ে আসুন এবারে...
২য় লোক : বেচারা! লোকদুটো জানেই না কী হয়ে গেছে দেশে
৩য় লোক : আরে চলুন তো আমাদের সাথে। দেখুন না বাইরে গিয়ে কী হচ্ছে। সব থানা, আর্মি ক্যাম্প আমরা দখল ক’রে নিয়েছি। সব লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। সব আমাদের হাতে এখন।
বৃদ্ধ : এগুলো সব বাজে কথা। মিথ্যে বলছেন আপনারা। আমরা জেলখানার
নিয়ম মেনে চলি, বুঝেছেন?
১ম লোক : কিসের জেল? আপনি স্বাধীন! (সেলের দরজা খুলে দেয়) বেরিয়ে
আসুন। এখানে কোনো জেল নেই।
বৃদ্ধ : দেখুন, এরকম ঘটনা আগেও অনেকবার ঘটেছে। এই নিয়ে আমি এটা
পাঁচবার দেখলাম, গার্ডরা নিজেদের মধ্যে মারামারি ক’রে
মেরে ফেলছে একজন আরেকজনকে।
৩য় লোক : গার্ড? কোন্ গার্ড? আমরা তো...
বৃদ্ধ : আপনারা ওদেরকে মেরেছেন, কেননা আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই
কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা ছিল। আপনাদের নিজেদের ব্যাপারে আমাদের নাক গলাতে নিষেধ আছে।
(যুবককে উদ্দেশ্য ক’রে, যেন সে শুনতে পাচ্ছে না, তাকে
শোনাবার জন্য) আমরা শুধুমাত্র ওদের কথাই মেনে চলতে পারি, তাতেই আমাদের লাভ।
২য় লোক : পাগল নাকি!? হ্যাঁ? পাগল না হলে জোর ক’রে সেধে জেলে থাকার কারণ কি !
বৃদ্ধ : ঠিক ভাষায় কথা বলুন গার্ড। আমাদের অপমান করতে পারেন না
আপনি। আমরা রাজনৈতিক বন্দী। একজন রাজনৈতিক বন্দীকে সম্মান দিয়ে কথা বলাটা আপনার
ডিউটির মধ্যে পড়ে।
১ম লোক : আজব তো! এ নিশ্চয়ই পাগল। আরে আমি এখানে আসার আগে ঐ লোকটা আপনাকে চাবুক মারছিল। তখন কোথায় ছিল
সম্মান?
বৃদ্ধ : জেলখানার নিয়ম আলাদা।
৩য় লোক : আচ্ছা এই লোকটা শাহ্-র দলের লোক না তো? শোনো তো কি বলে ও..
২য় লোক : আপনারা কি বিশ্বাস করতে পারছেন না দেশে একটা বিপ্লব হয়ে
গেছে?! আসুন, হাতটা দিন। বেরিয়ে আসুন। (বৃদ্ধ পিছিয়ে যায়) এই জেলখানার বাইরে পা
রাখুন। দেখুন, নিজের চোখে দেখুন, রাস্তায় রাস্তায়
কিভাবে লোক জড়ো হয়েছে, তারা কী স্লোগান দিচ্ছে।
বৃদ্ধ : আমরা সবটাই জানি। আমাদের বাইরে যাবার দরকার নেই।
১ম লোক : আমি নিশ্চিত এই
লোকগুলো পাগল। অন্ততঃ পলিটিক্যাল প্রিজনার নয় এরা। দ্যাখো, এদের পায়ে শেকল বাঁধা।
কোনো পলিটিক্যাল প্রিজনারের শেকলে পা-বাঁধা থাকবে?
৩য় লোক : একেবারেই তাই, কোনো সুস্থ লোক নিজেকে কখনো জেলে ঢুকিয়ে
রাখে! ছাড়ো এদের। আমরা যাচ্ছি। (যুবকের দিকে) তুমি থাকবে এখানে? (যুবকটি বৃদ্ধের
দিকে তাকায় এবং নিরুত্তর থাকে। লোকগুলো বেরিয়ে যায়। দুই বন্দী নিজেদের সেলের দরজা
আটকে দেয়।)
নেপথ্য কণ্ঠ : দরজা খোলা থাক। পরে ঠিকই বেরিয়ে আসবে ওরা...
বৃদ্ধ : আমার মনে হয় ওরা কোনো
চাল খেলছে আমাদের সাথে। আমি তোমাকে বলছি কমরেড, কিচ্ছু বদলায় নি। মানে, বদলাবেটা
কী? কী বদলাবে শুনি? গত বাইশ বছর আমি এখানে, এই জেলের ভেতরে আছি, এইটুকু সময়ের
মধ্যে আমরা ফিউডালিজম থেকে ক্যাপিটালিজমে, ক্যাপিটালিজম থেকে সোশ্যালিজমে চলে যেতে
পারি না। এটা হয় না। এভাবে হয় না। অসম্ভব ব্যাপার।
যুবক : কিন্তু দেখে তো মনে
হচ্ছে নতুন কিছু একটা হয়েছে বাইরে
বৃদ্ধ : যেটাই হোক, সেটা কোনো
বিষয় নয়। যে লাল সূর্যোদয়ের জন্য আমরা অপেক্ষা
করছি, তা’ অন্য কিছু। হতে পারে ফিউডালিস্টরা হয়তো
নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে নিজেদের জমি
নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে।
যুবক : ঠিক। ঠিক বলেছেন
আপনি। আমরা এত তাড়াতাড়ি সোশ্যালিজম আশাই করতে পারি না। এটা অবাস্তব। দেশে
ক্যাপিটালিজম পুরোপুরি ছড়াতেই অনেক লম্বা সময় নেবে এখনও। তারপর তো তাকে বেড়ে উঠতে
হবে। তবেই না হবে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী-সংগ্রাম!
(আলো নিভে যায়)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন