রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

১৪) লিপিকা ঘোষ


মোহনা

‘ছলাৎ’
কাঁসা-বরণী কলসি বলে কাঁকনের ঠনক লেগে
‘ছলাৎ’
জল বলে সে কলসীর ছোঁয়া লেগে
ছলাৎ’
বলে নূপুর ঘেরা পা-দুখানিতে জলের ঢেউ লেগে
‘বৌ কথা ক’... আ মোলো যা, এ কি তোদের গাঁ দেশের বৌ পেলি না কি! শহুরে ঠাট ঠমক দেখিস নে? পাখি গাঁ শহর চেনে না। পাখি বলে ‘কথা ক’। কী কথা  কইবে ভাবে বিনি। অনেক দিন পর কোনো গাঁয়ে এলো বিনি, তার মা’র মামাবাড়ির দেশঅজ-গাঁ দেশপ্রখর গ্রীষ্মসান-গ্লাস মাথার ওপর তুলে বিনি ঘাটের শেষ ধাপে পা ডুবিয়ে বসে। পাশেই গাঁয়ের  দুই প্রৌঢ়া তার দিকে কুতুহলী তাকিয়ে তাদের কলসিতে জল ভরা শেষওঠার ধাপে পা রাখে তারা।
‘দত্ত বাড়িতে এয়েছে’
‘অ, সেবার আমার মেজো জামাই এর সাথে শহর গেনু...’

চলে যায় ওরা বিনি বসে থাকে ঘাটের ধাপে। এ বৌয়ের মুখে কথা নেই দেখে  পাখিও চুপ বুঝি। পাশেই এক পোড়ো শিব মন্দির। গাঁয়ের লোকে ডাকে ‘পোড়া শিব’কেন, কে জানে! শিবও অনলে পুড়েছিলেন বুঝি!

বেশ জংলা জায়গা। পুরনো বটও বিদ্যমানক্যামেরায় কিছু স্ন্যাপ নিয়ে যাবে ও। সপ্তর্ষিকে দেবে। পুরনো জায়গার খোঁজে আছে সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষি আজকাল বেশ লিখছে, ছবি তুলছে, ডকু বানাচ্ছে, টেলিফিল্ম বানাচ্ছে। রমরমিয়ে এগোচ্ছে
একটু দূরে এক তান্ত্রিকের ডেরা। নদীর ওপারে গোঁসাইয়ের আখড়াখোল খঞ্জনীর  বোল ভেসে আসছে মৃদু। মিঠে লাগেআপন মনে বলে ওঠে বিনি,
‘আচ্ছা তান্ত্রিক কবে থেকে তান্ত্রিক হলো? তাকে দেখা যায়?’    
‘যায় বৈকি! তুমি দেখবে নারী?’
চমকে ওঠে বিনি। এত গম্ভীর আওয়াজ! ঘা ঘুড়িয়ে দেখে এক দীর্ঘ পুরুষশক্ত  পোক্ত তার কাঠামো। গায়ে রোদ্দুর প’রে ঠিকরোচ্ছে এমন টকটকে রঙ। বড় বড় চুল দাড়িচোখের দৃষ্টির তীব্রতায় ঝলসে যাচ্ছে যেন বিনি! হাঁ হয়ে থাকে বিনি, উঠে দাঁড়ায়। দীর্ঘদেহী বলে ‘বসো’মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ে ও। দীর্ঘদেহীর পরনে  সাদাধুতি লুঙ্গি মতোন করে জড়ানো
কী নাম?’  
‘বিনি’
‘ও তো লোকে ডাকে’
‘পোশাকি নাম মোহনা’
‘মোহনায় এসে নদী সাগর এক হলো
‘হ্যাঁ’
‘মোহনা দেখেছ?’  
‘না’
‘তান্ত্রিক দেখার শখ কেন?’  
‘দেখিনি কখনও’
‘ভয় পাবে না?’  
‘পেলে পাব’
‘বেশ
সে যখন বাচ্চা-মানুষ, তখন গঙ্গা পেরিয়ে দাদামশায়ের বাড়ি যাচ্ছিল। হঠাৎ নৌকো থেকে পড়ে যায়। ডুবে যেতে যেতে দেখে সদ্য বিসর্জন হওয়া এক কালীমূর্তি। তারপর আর তার কিছু মনে নেইমাঝিরা কখন যে তাকে টেনে তোলে! জ্ঞান ফেরায়!  দাদামশায় মস্ত কবিরাজকিন্তু সেই বাচ্চা মানুষটি সেদিন পুরুষ হয়, তার কী  ভীষ যৌনতা পায়  জলের তলায় ডোবা কালীমূর্তিতে তার যৌনতা পায়, ভয় পায়। কী ভীষ ভয়’!
‘তারপর!’ বিনির চোখের পলক পড়ে না, বিনির নিশ্বাস ঘন
‘এখানে বেশিক্ষণ বসে থেকো না শহুরে যুবতী, মোহনার দিকে যাও, নিজের খোঁজে’

উঠে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহীধীরে ধীরে উঠতি ধাপে পা রাখলেনপাখি চুপ। শহুরে বৌ, কথা কয় নাকাঁধের ঝোলা থেকে ক্যামেরা বের করে তাড়াতাড়ি ‘শুনছেন...’
দীর্ঘদেহী থমকান
‘কয়েকটা স্ন্যাপস্ নেব আপনার আমি একটা কাগজের দপ্তরে আছিএই যে আমার কার্ড। আপনার নাম?’
হা হা করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসেন দীর্ঘদেহী
‘ঘরে যাও হে যুবতী, মোহনার দিকে যাও’
ঘাটে ওপরে ওঠার শেষ ধাপে দীর্ঘদেহীতারপর হেঁটে এগিয়ে যান দ্রুত। ঘাটের শেষ ধাপে বিনি, মোহনা। পাখি চুপ   


1 টি মন্তব্য: