রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

০৭) শ্রাবণী দাশগুপ্ত


আজ কাল ও পরশু

আমাদের ঝকঝকে সাজানো ড্রইংরুমের সোফায় বসে ছেলেটা কাঁদছে শৌখিন চশমা খুলে সেন্টার টেবিলে শব্দ নেই, মুখ ঢেকে রেখেছে দুমড়ে বেঁকে কাঁপছে লম্বা ফরসা ছিপছিপে জিম-করা সাতাশ পার হওয়া যুবক ও আমি কী করব, মানে ঠিক কী করা উচিৎ এমতাবস্থায়, ভেবে কুল পাচ্ছি না সুনন্দা ওকে জল এনে দিল, ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল আমি আলতো হাত রাখলাম ওর পিঠে,
--বিশ্ব, জল খাও কুল ডাউন, শান্ত হও
আমি বাবা! এর বেশি আর কী বলতে পারি? বিশ্ববসু মুখ তুলে ঘষে ঘষে রুমাল দিয়ে মুছল নাক-চোখ টকটকে লাল। পরনের দামি জামাটাও মোচড়া্নো চশমা পরে নিয়ে বলল,
--আসছি আঙ্কল আপনাদের সঙ্গে আর দেখা হওয়ার চান্স থাকল না
আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি ও খুব লম্বা, ছয়-এক বোধহয় তিতাসের পাঁচ সাত দারুন ম্যাচিং। এখন ওসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না বিশ্ব বেরিয়ে গেলে, দরজাটা বন্ধ করে ঘরে এসে, শুয়ে পড়ি সুনন্দা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও, বিয়াস আর তিতাসের স্টেপ-মা নয়, মা-ও নয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুনন্দা খুব বিচক্ষণ আমার মাথার কাছে চেয়ারে বসল কিছু বলল না
--নন্দা, দোষটা কাকে দেব বলতে পারো? আমি কনফিউজড্‌ মাথা ভার হয়ে গেছে
সুনন্দা আমার মাথায় হাত বোলায় ঠাণ্ডা নরম হাত আস্তে আস্তে বলে,
--দোষ আর কার! আমিও তো মরা-মায়ের জায়গা নিতে পারিনি তা হলে...!


দুজনে চিত হয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকি। রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করেনি। আমাদের হতে পারত জামাই তার মেঘলা আকাশের অনেকটা ভার আমাদের শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।
এইচ্‌-এস্‌ থেকে বি-টেক্‌ এক স্কুল ও কলেজে। তিতাস ওর চেয়ে এক বছরের ছোট। প্রথমবারে জয়েন্ট ক্লিয়ার হয়নি বিশ্ববসুর। তিতাস মাঝে মাঝে হাল্কা খোঁচাত। খুনসুটি, হুল্লোড়, ঘোরাফেরা, রাগ-অভিমান, রাত জেগে ফোনে গল্প। আমি জানতাম সব। জি-আর-ঈ দেওয়ার সবচেয়ে বড় উৎসাহদাতা তো বিশ্ববসু। তিতাস মোটা স্কলারশিপ পাওয়ার আনন্দে পার্‌টী-থ্রো করল সে-ই। ভেবেছিলাম, তিতাস যাওয়ার আগেই অন্তত এনগেজমেন্ট-টা সেরে ফেলব।


ভুল কথা বলে সুনন্দা। ও-ই সব। আমি খালি অভিভাবক, ওদের মধ্যে নিজের মতো কেরিয়ারের বীজ পুঁতে খালাস। বিয়াস অনেক অন্যরকম। বুঝদার, শান্ত, গোছালো। চাকরি সংসার একসাথে সামলায়। দিদিকে খুব ভালোবাসে তিতাস।   বিশ্বকে একবার ওর কাছে পাঠালে কি ভাল হতো? সুনন্দা আমার দিকে ফেরে।  আমিও তাকাই।
--জি-আর-ঈ বিশ্ব দেয়নি?
--হ্যাঁ, দিয়েছিল, পায়নি। তাতে কোন্‌ মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? এতো বছরের মেলামেশা! দুজনের পে-প্যাকেটও যথেষ্ট ভালো। শুধু এই অপরাধে... এটা  ক্রাইম না?
হঠাৎ মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে, রাগে কথা বের হয় না। মনে হয়, তিতাস সামনে থাকলে ঠাটিয়ে দুটো...। সুনন্দা আমাকে শান্ত করে,
--তিতাসটা ছোট্ট থেকেই পড়াশোনায় বড্ড ভালো গো! তাই ওর চিন্তা ভাবনাগুলো...


বিশ্বর বাবা-মা-ভাই মোটামুটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত। আমি আর সুনন্দা গেছি দুএকবার। অতি ভালো মানুষ। আর আমরা কোনওদিন ওদের বাড়িতে যাব  না। বিশ্ব চেন্নাই ফিরে যাচ্ছে বলল। তিতাস আপাতত দিল্লীতে, ভিসা ক্লিয়ার হওয়া নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন। দুদিন আগে ফোন করেছিল। বিশ্বর কাছে জানতে চাইনি, অনেক কথা। যতটুকু বলেছে, ততটুকুই শুনেছি। চাকরিতে জয়েন করেই তিতাস নাকি ওকে আলটিমেটাম দিয়েছিল।


তিতাসকে ফোনে ধরি গোপনে। ভীষণ ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। তবু জোর করে জানতে চাই,
--এটা কী করলি তুই? বিবেকে লাগছে না?
--ওহ্‌, কী যে সেন্টিমেন্টাল কথা বলো বাপী... ইটস্‌ আ মিউচ্যুয়াল ব্রেক্‌-আপ্‌। দুজনে এ্যাট পার না হলে কী করে... আমি ওকে বলেই ছিলাম, সো হী শুড্‌ হ্যাভ ওল্‌সো ট্রায়েড্‌ সীনসিয়ারলি। আই ক্যানট্‌ প্লে উইদ্‌ মাই কেরিয়ার। তোমারই মেয়ে যে! রাখি, বাবা? লভ ইউ!

কত স্বাভাবিক তিতাসের আওয়াজ। আমি তিতাসের বাবা-ই তো, না কি আর কেউ?

২টি মন্তব্য:

  1. Valobasa jodi career er kache here jay tahole dhore neoa jete pare sekhane kono valobasa nei. Ajker generation ki chai seta orai jane. Aamra ekhon kebol sakhkhi.

    উত্তরমুছুন
  2. প্রজন্মের ভাবনা পালটেছে অনেক। 'ভালবাসা' নামের অনুভূতি, যার সেই অর্থে কোনও ব্যাখ্যা নেই বা কোনও আকার নেই, তার মূল্যহীনতা তো আছেই। আর... 'সব ইকোয়েল ইকোয়েল'- এই ভাবনাটিও বটে!! '
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত

    উত্তরমুছুন