'ইওর ব্যালেন্স ইজ জিরো ডলার্স হুইচ ইজ মেড অফ জিরো ডলার্স'
মোবাইলে ভারতে ফোন করার কার্ড ভরানোর পর থেকে ব্যালেন্স চেক করতে গেলে বলে,
"ইওর ব্যালেন্স ইজ জিরো ডলার্স হুইচ ইজ মেড অফ জিরো ডলার্স উইথ জোন 'এ' মিনিটস ওয়ান হান্ড্রেড"। 'জিরো ডলার্স হুইচ ইজ মেড অফ জিরো ডলার্স'--এই বাক্যাংশের প্রয়োজন কী, তা বুঝতে আমার খানিক সময় লেগেছে। প্রথমে মনে হয়েছিল একেই বলে টটোলজি বা পুনরুক্তি। কিন্তু পরে বুঝলাম কারুর ব্যালেন্স যদি কয়েক ডলার এবং কিছু সেন্ট হয়, তবে রেকর্ডিং ওই অঙ্কটাকে যাতে ভেঙ্গে বলতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভেঙ্গে নতুন একটা শূন্য তৈরি করেছে। শূন্য কি শূন্য দিয়েই তৈরি হয়? তাকে কতটা ভাঙ্গলে আরেকটা শূন্য তৈরি হতে পারে, বা তাকে কি আদৌ ভাঙ্গা যায়, এইসব ইষৎ গাণিতিক ইষৎ দার্শনিক প্রশ্ন করতে করতে ফোন করলাম দেশে। আমার এক আত্মীয় গতকাল রাতে গত হয়েছেন। বাবার মেইল দেখে ফোন করলাম ডিটেইল জানতে। মৃত ব্যক্তি আমার মামাদাদু, মানে ঠাকুমার ভাই। ঠাকুমার থেকে বয়েসে ছোট। শয্যাশায়ী ঠাকুমাকে এখনো তাঁর মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি।
বহুদিন আমি দেখিনি ওনাকে। ছোটবেলায় আসা যাওয়া ছিল। মনে পড়ে, স্টেশনের কাছের রেস্তরাঁয় আমায় বেশ কয়েকবার মোগলাই পরোটা খাইয়েছিলেন। আমার মার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন বহুবছর পর। লাইক আ ব্লাস্ট ফ্রম দ্য পাস্ট। তখনই আবার এবং শেষবার দেখা। তার মাস তিনেক পর আজ তিনি নিজেও এখন পাস্ট। বিয়ে-থা করেননি। দাদা বৌদির ডিভোর্স আর বৌদির মৃত্যুর পর তাদের দুই মেয়েকে একাই দেখাশোনা করেছেন সারা জীবন। দুই মেয়ে মানে আমার দুই পিসী। যাঁদের ভালো নাম আমি কখনই জানতাম না। শুধুই তাঁদের ডাকনাম। তাঁদের দুজনেরই মানসিক ভারসাম্যের অভাব ছিল। সেইজন্যই কি হয়েছিল ডিভোর্স? আমি ঠিক জানি না, কিন্তু এইটুকু জানি, তাঁদের কাকা তাঁদের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। নিজের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পরেও আমৃত্যু তাঁদের জন্য যা যা করণীয় করেছেন। ক্রমশ অন্য সকল আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। অনেকেই তাঁকে তাঁর একগুয়েমি ছেড়ে মেয়েদুটোকে কোথাও ইনস্টিটিউশনালাইজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কারুর কথা শোনেননি। নকল বুঁদির গড় রক্ষা করে গেছেন একা কুম্ভ হয়ে। কার হয়ে? কার জন্য? এসব প্রশ্ন জটিল। তাঁর দাদার জন্য? নাকি মৃত বৌদির মুখ চেয়ে? নাকি ওই দুটো বাচ্চা মেয়ের জন্য যাঁরা সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে উঠতে পারেননি, বাচ্চাই থেকে গেছে্ন। তাঁদের একজন বোধ হয় স্প্যাস্টিক ছিলেন, তিনি আগেই মারা গেছেন। আরেকজন রয়ে গেলেন এখন।
বাবার সাথে কথা হলো। ফোনটা কেটে টেবিলের ওপর রাখলাম। পাশে একটা বই রয়েছে। ক্যথারিন মালাবুর 'হোয়াট শুড উই ডু উইথ আওয়ার ব্রেইন'। লাইব্রেরীর হার্ডকাভার বইয়ের এই এক জ্বালা। বই কিনেই লাইব্রেরী অথরিটি হার্ডকাভারের পেপার জ্যাকেটটা খুলে নেয়। ফলে এই ধরনের বইয়ের কাভার বা তার ছবি কখনো দেখতে পাওয়া যায় না। স্পাইন দেখে বই চিনতে হয়। পাঠের শুরুতেই অজ্ঞাত এক অপূর্ণতা শূন্য হয়ে ঘিরে ধরে, যেন ওই শূন্যের শরীর চিরেই বেরিয়ে আসবে পাঠ। এই জন্য আমি পেপারব্যাক পছন্দ করি, কিন্তু লাইব্রেরী আবার তার উন্নাসিকতার দোহাই দিয়ে পেপারব্যাক কিনতে চায় না। আর আজকাল বিজনেস লজিকও বলে যে, হার্ডকাভারের টার্গেট মাত্রেই লাইব্রেরী। বইটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখনই তার শূন্য প্রচ্ছদহীনতায় আস্তে আস্তে একটা ছবি ফুটে উঠল:
চ্যাটার্জিহাটে মামাদাদুদের বাড়ি। ডানদিকে ঘরের দরজা দিয়ে সোজাসুজি ঢোকা যায় অথবা পাশের গলি দিয়ে পিছন বরাবর ঢুকতে হয়। বহুবছর আগে গেছি ওই বাড়িতে। তাই প্রচ্ছদের ওপর ছবিটাও ক্ষীণ। দরজা দিয়ে ঢুকলে মামাদাদুর ঘর। তাঁর বিছানার ওপর দুটি মেয়ের মধ্যে ছোটজন বসে রয়েছেন। এখন তাঁর বয়েস বছর দশ-বারো। তাঁর পাশে বসে কাগজ পড়ছেন মামাদাদু। পাশের ঘরে বড় মেয়েটি বিছানার ওপর। তাঁর বয়েস বছর পঁচিশ। এলোমেলো চুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সামনের টেবিলের ওপর রাখা মৃত মায়ের ছবির দিকে। ডানদিকে রান্নাঘরে একটা বিড়াল চুপ করে ঝিমিয়ে নিচ্ছে। ঘর পেরোলে পেছন দিকে একটা মাঠ। একদিকে একটা মন্দির আর অন্যদিক বরাবর খানিক এগোলে একটা পুকুর। আমার মগজে অমন একটা বাড়ি যেখানে আমি শেষবার গিয়েছি অন্তত কুড়ি বছর আগে এবং যেখানে এরপর হয়তো কখনই আর যাব না। এখন আমার দুই পিসী আমার জন্মের আগে পৌছে গেছেন। এখনো জন্ম হয়নি আমার। আর হার্ডকাভারের ব্ল্যাঙ্ককাভারে ফুটে ওঠা ওই বাড়িটায় এবার বিকেল নামছে। দরজা-জানালাগুলো সূর্যের আলোয় চিকিয়ে উঠছে শেষবার, যেন সোনার তেলের ছোপ ছোপ। আর গোটা বাড়ি জুড়ে গুমরে বেড়াচ্ছে অস্ফূট একটা বাক্য অথবা বাক্যাংশ- 'ইওর ব্যালেন্স ইজ জিরো ডলার্স হুইচ ইজ মেড অফ জিরো ডলার্স'।
দেশ-বিদেশ এখানে এ জীবন-সে জীবন। শব্দগুলো সূর্যের আলোয় চিকিয়ে উঠছে। বেশ।
উত্তরমুছুন