রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

০২) শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

পুনর্বিন্যাস



(আবহে কোনো এক সকালের রাগে বাঁশির সুরে পর্দা উঠলে মঞ্চে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির Drawing Room’এর আভাষ পাওয়া যায়। আসবাবের আধিক্যহীন, কিন্তু রুচিশীলতায় ভরা। বাঁশি fade-out করে bathroom থেকে ভেসে আসা জলের শব্দ fade-in করে। Calling Bell বেজে ওঠে)

আবিরা -   যাই...

(Calling Bell আবার বাজে। একটু প্রলম্বিত।) 

আবিরা -   যাই-যাই... উঃ, কাপড়গুলো ধোবার সময়ও দেবে না ছাই...

(কেউ যদি Bathroom’এ কাপড় কাচতে-কাচতে হড়বড় করে বেরিয়ে আসে, তাহলে তার  বেশবাসের যে বিস্রস্ত অবস্থা থাকে, ঠিক সেভাবেই কাঁধে বেশ কিছু ভেজা কাপড় নিয়ে এসে আবিরা দরজা খোলে। অবাক হয়।)

আবিরা -   কাকে চাই?!
অরিন্দম - তোমাকেই।
আবিরা -   আমাকে! আপনাকে তো ঠিক...
অরিন্দম - চিনতে পারলে না, তাই তো? আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি।

(আবিরা এখনও চিনে উঠতে পারেনি, এবং সেটা তার চোখ-মুখের ভাবে পরিস্ফুট।)

অরিন্দম - ওরে বাবা, আমি অরিন্দম। তোমাদের শিল্পী...
আবিরা -   ও মা, তুমি! কি আশ্চর্য! আমি একদম চিনতে পারিনি। ছি... ছিঃ... ছিঃ...
অরিন্দম - That’s all right...এতদিন পর দেখা, চিনতে না পারার মধ্যে কোনো অস্বাভিকতা           নেই।
আবিরা -   কি করে চিনব! একেবারে বদলে গেছ। কোথায় সেই রঙ-তুলি হাতে ছবি-ছবি চেহারা, আর কোথায় এই গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া রূপ। কোথাও এতটুকু মিল নেই।
অরিন্দম - তা আমরা কি এই দরজার ফ্রেমেই ছবি হয়ে থাকব, নাকি ঘরের ভেতরে ঢুকব?
আবিরা -   ওমা সে কি! মাথাটা একেবারে গেছে আমার। এসো এসো, ভেতরে এসো...
অরিন্দম - বাঃ...
আবিরা -   কি?!
অরিন্দম - খুব সহজে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছ তো!
আবিরা -   বোসো তো... এতদিন পর বুঝি ঘর সাজাবার প্রশংসা করতে এলে? একটা ফোন করলে না কেন?
অরিন্দম - কেমন surprise দিলাম বল? তা আমি না হয় বসলাম, কিন্তু তুমি কি ওগুলো তোমার কাঁধেই শুকোবে ঠিক করেছ? ও বোঝা নামাও।
আবিরা -   রবিবার আমি সম্পূর্ণ domestic হয়ে পড়ি।
অরিন্দম - মাত্র একদিন? আর বাকি দিনগুলো?
আবিরা -   School’এর যাঁতাকল থেকে রেহাই পাব, তবে তো! তারপরও থাকে ছাত্রীদের অত্যাচার–
অরিন্দম - অন্ততঃ রবিবারটা তো ছুটি পাও?
আবিরা -   একে তুমি ছুটি বল! সেখানে যদিও বা প্রত্যেক দিন কাজ করতে হয়, এখানে তো সাতদিনের কাজ একদিনে সারতে হয়। সকাল-সন্ধ্যের হিসেবই থাকে না... এই, দু-মিনিট বসো, আমি এগুলো মেলেই আসছি।

(আবিরা কাপড় মেলতে চলে যায়। অরিন্দম chair’এ বসে খুব অমনোযোগী ভাবে magazine’এর পাতা ওলটাতে থাকে। বেশ বোঝা যায় যে, ও সেটা আদৌ দেখছে না। আবহে সেই আগের বাঁশি বাজতে থাকে। আবিরা তাড়াতাড়িই ফিরে আসে। কিন্তু তার ফাঁকেই কাপড়টা বদলে ফেলেছে।)

আবিরা -   তুমি আমার ঠিকানা পেলে কোথায় বল তো? বাড়ি গেছিলে বুঝি?
অরিন্দম –  হ্যাঁ, গাবলু তোমার ঠিকানা দিল। ও তো একটা চর্বির তাল হয়ে উঠেছে দেখলাম!
আবিরা -   অত কুঁড়ে হলে হবে না! যত বয়েস বাড়ছে, দাদামনিটা তত বেশি কুঁড়ে হচ্ছে। দাঁড়াও, তোমার জন্যে একটু চা করে আনি।
অরিন্দম - একটু শান্ত হয়ে বসো তো, অত ছটফট করছ কেন! চা পরে খাব। অনেক দিনের অনেক জমানো কথা বেরিয়ে আসার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে, আগে তাদের সাথে আপোষ করি, তারপর চা। বসো।
আবিরা -   অনেক দিনের পুরনো কথা! আমাদের শেষ দেখা বোধয় ১৯৯৭ সালে, তাই না?  
অরিন্দম - To be precise April-1997… তারিখটা ঠিক মনে নেই।
আবিরা -   দীর্ঘ সময়---। অথচ আজও চোখ বুজলেই সেই দিনগুলো স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। ছ-ছটা সোনালী বছর। Collage, University, Class, মিছিল, Common-room, পরীক্ষা, Result…
অরিন্দম - তারপর?
আবিরা -   ব্যস, তারপর সব ঝাপসা। এখন আর কোনো কিছু ভাবার অবকাশ নেই। তখন সত্যিই অনেক কিছু ভাবতাম। ভাবতে পারতাম। স্বপ্ন দেখার থেকে ঘুমের সময় ছিল কম, তাই জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখতাম। আজ আর সে বয়েসও নেই, চোখের সে রঙও নেই। মন আর আগের মতো আকুল হয়ে ওঠে না। এ বেশ ভালোই আছি একরকম।
অরিন্দম - ভারি অদ্ভুত তো!
আবিরা -   অদ্ভুত নয়, এটাই বাস্তব। এর মধ্যে কোনো সংশয় নেই, কো্নো প্রশ্নও নেই। আমি  যা, আমি তা। তার বেশি কিছু হতে পারি না। প্রত্যাশাও করি না। আমার নির্দিষ্ট পথেই আমায় এগোতে হবে।
অরিন্দম - বটেই তো। সফল শিক্ষয়িত্রী হবে, তারপর কোনো এক ‘শিক্ষক দিবসে’ শ্রেষ্ঠত্বের  প্রমাপত্র হাতে নিয়ে School’এর ভাড়া করা Camera Man’এর Lens’এর সামনে হাসি-হাসি মুখ...

(আবিরা খিল খিল করে হেসে ওঠে। অনেকদিন পর বাঁধভাঙা হাসি। তার Cell Phone বেজে ওঠে।)   

আবিরা -   হ্যাঁ দাদামনি বল... তুই থাম, তোর এই ঢিমে তেতালা স্বভাবটা আর গেল না!  লোকটা এসে পুরনো হয়ে গেল, তুই এখন খবর দিচ্ছিস – ‘যেতে পারে’, হিঃ...হিঃ...হিঃ... না, একদম আসবি না, আজ আমরা চুটিয়ে আড্ডা দেব। দরজার বাইরে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লাগিয়ে দিয়েছি... না বলছি দাদামনি, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি... এই শোন শোন, একটু বৌদিকে দে তো... এই বৌদি, তোমার সেই অসাধারণ Fish-পোলাওটা SMS করে দাও তো, আজ অরিন্দমকে রেঁধে খাওয়াবো... কি! Fish-পোলাও SMS করা যাবে না, recipe SMS করতে পারো.... আরে ধ্যাৎ, আমি তো তাই বল্লাম... হিঃ...হিঃ...হিঃ... না না, অরিন্দমকে রান্না করতে যাব কেন! রান্না করে ওকে খাওয়াবো। এই leg pull কোরো না বলে দিচ্ছি বৌদি... রাখছি এখন... হিঃ...হিঃ...হিঃ...

অরিন্দম - হেসো না...হেসো না। অসহ্য লাগে তোমাদের এই বন্দী জীবনের আনন্দ...
আবিরা -   আচ্ছা বাবা, আর হাসব না, হয়েছে? তুমি না শিল্পী! কেমন শিল্পী, মানুষের হাসি সহ্য করতে পার না! হাসির দাম কত, সে খবর রাখো?
অরিন্দম - ভয় তো সেখানেই। পাছে অবহেলার ব্যবহারে এমন দুষ্প্রাপ্য জিনিষটা হারিয়ে যায়। পাছে অমূল্যের অবমাননা হয়!
আবিরা -   বাব্বাঃ, কথায় তোমার সাথে পেরে ওঠা দেখছি আজও একই রকম কঠিন রয়ে গেছে।
অরিন্দম - অতব বিরাবাই, যা যা জানতে চাইছি তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও দেখি।
আবিরা -   ‘বিরাবাই’... কতদিন পরে নামটা শুনলাম। ও নামে যে আমায় কেউ কখনো ডাকতো তাই আজ আর মনে পড়ে না... বেশ, বল কি কি জানতে চাও।
অরিন্দম - অসিতের খবর কি?
আবিরা -   ঠিক বলতে পারব না। বোধহয় দুর্গাপুরেই আছে।
অরিন্দম - আশ্চর্য!
আবিরা -   কেন, এতে অবাক হবার কি আছে? এটাই তো স্বাভাবিক।
অরিন্দম - না, এটা স্বাভাবিক নয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনে দুটো মানুষ দু-প্রান্তে ছিটকে গেলেই তাদের আত্মিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না।
আবিরা -   উৎসের মুখই যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে নদীর প্রবহমানতা আশা করি কী করে বল তো!
অরিন্দম - তোমাদের দুজনের সম্বন্ধে আমার ধারণাটা একটু অন্যরকম ছিল।
আবিরা -   আসলে তোমার চোখে আমাদের পনের বছর আগের পুরনো রূপটাই ধরা ছিল। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না – আমি কিন্তু ওর কথা কখনো ভাবিনি। জানতে চাইনি – ও কেমন আছে? কি করছে? বিয়ে করেছে কি না? কিচ্ছু না।
অরিন্দম - জানি না কি বলা উচিৎ! এ তোমার হীনতা, দৈন্য, নাকি মহত্ত্ব!
আবিরা -   তোমার মনে পড়ে, একসময় আমি কবিতা লিখতা?
অরিন্দম - লিখতাম, তার মানে – এখন আর লেখ না?
আবিরা -   তুমিও তো বোধহয় আর আঁকো না শিল্পী? তোমার নাম তো কই শিল্পীমহলে শোনা যায় না!
অরিন্দম - আঁকি। মাঝে মাঝে আঁকি। তবে সব সময় ঠিক ঠিক রঙ জুটিয়ে উঠতে পারি না বিরাবাই। রঙের দর বড্ড চড়া।
আবিরা -   অথবা আমাদের জীবনের রঙটাই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
অরিন্দম - তোমার সেই কবিতাটা মনে আছে – ‘রেশমি শাড়ি

একটা রেশমি শাড়ি ছিল আমার
হয়তো অনেক অনেক দিন
কোমল শরীর জড়িয়ে বেঁচে থাকতো।

মনের সোনা রঙে রাঙানো
হৃদয়ের খাঁচা ছিল একটা।
একটা পোষমানা কাকাতুয়া ছিল তাতে
নাম দিয়েছিলাম – আকাশ,
আমার আকাশ।

আবিরা -            যে ইমারৎ তৈরি হয়েছিল
                   সুবিশাল – আকাশচুম্বী,
                   কি করে বিশ্বাস করি –
                   এমন অদ্ভুত ভাবে ভেঙে পড়বে তা!

          ধুৎ, কেন যে ওসব মনে করিয়ে দাও, দিলে তো সব তালগোল পাকিয়ে! নাঃ,  এরপর একটু চা না হলে আর কিছুতেই চলে না। দাঁড়াও, করে আনি, তারপর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। অন্য কোনো programme হাতে নিয়ে আসনি তো?
অরিন্দম - না।
আবিরা -   বেশ, তাহলে এখানেই খেয়ো। তবে খুব উপাদেয় কিছু আশা কোরো না।
অরিন্দম - একটা কথা বলব বিরাবাই, বিশ্বাস করবে?
আবিরা -   ওমা, কথাটা কি তা আগে শুনি! না শুনেই বিশ্বাস করব কি না, সে কথা বলি কি করে!
অরিন্দম - দেখ, হোটেলের chef ধরাবাঁধা গতে, কেতাবি ঢঙে রান্নাটা করতে পারে। Steward সে রান্না সাজিয়ে গুছিয়ে হয়তো অত্যন্ত পরিশীলিত ব্যঞ্জনায় পরিবেশনও করতে পারে। তাতে ব্যাবসা থাকে। ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও থাকে না। কে কতটা খেল, বা আদৌ পেট ভরল কি না – সে কথা ভাবতে তাদের বয়েই গেছে! তাই সে উপাদেয় খাদ্যের থেকে, তোমাদের হাতের ঝোল-ভাতই আমায় বেশি তৃপ্তি দেয়।
আবিরা -   আচ্ছা মশায়, না হয় তাই খাওয়াবো। নুনে পোড়া ঝোল খেয়ে কেমন তৃপ্তি পাও দেখা যাবে।

অরিন্দমের প্রাণখোলা অট্টহাসি ঘরের ভেতর যেন একমুঠো বসন্তের বাতাস ছড়িয়ে দেয়।

অরিন্দম - হাঃ... হাঃ... হাঃ... আপাততঃ চা, এবং চিনির শরবৎ নয়... হাঃ... হাঃ... হা...

(আবিরাও হেসে ফেলে। বাঁশি বেজে ওঠে। আলো গুটিয়ে আস্তে থাকে। আবিরা চা আনতে চলে যায়। অরিন্দম এক কোণের একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে যায়। আলো তাকে অনুসরণ করে। সামনের Showcase’এর ওপরে রাখা একটা ফ্রেমে বাঁধা ছবি হাতে নেয়। চেয়ারটায় বসে। মঞ্চে শুধু একটিমাত্র আলো তাকে ধরে থাকে। তার ছবির দিকে এগোবার মুহূর্ত থেকেই আবহ fade-out করে  একদল ছেলে-মেয়ের কোলাহলে switchover করবে, এবং mike’এ ঘোষণা শোনা যাবে।)

ঘোষণা -   আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান – স্বরচিত কবিতা পাঠ। বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আবিরা চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে শুনুন তারই লেখা কবিত।

আবিরা -   নমস্কার। কবিতার নাম – ‘বিলম্বিত সুর’

                  
                    একদিন অনেক সময়
আমরা নিয়েছি কেড়ে জীবনের উচ্ছলতা থেকে
তখন তোমার মন ভোরের আকাশ
কিশলয় আমার জগৎ।

যেখানে মানুষ-পোড়া গন্ধ বয় বাতাসের ঘ্রাণে
বহতা নদীর কান্না মিশে যায় হাজার হুতাসে
মাছের শিকার সেরে ঘরে ফেরে সারিবদ্ধ বক
শেয়াল আজান দেয় কর্কশ উল্লাসে
সেখানেও গেয়েছিলে গান,
গেয়েছি আমিও।

জীবন জীবন খেলা তারপর,
তুমি চলে গেলে দূরে তোমার জগতে
জীবিকা রাখাল হলো আমার জীবনে।

আজও সব একই আছে
-   নদীর চোখের জল
-   সিঁড়ির উপল বুক
-   মৎস শিকারি বক
-   বাতাসের ঘ্রাণ
একই আছে সব।

জীবন জীবন খেলা সাঙ্গ হবে যেদিন আবার
তোমার আমার গন্ধ বয়ে যাবে বাতাসের সাথে
সেদিনও কি গান হবে ঐ সব
জল – বুক – বক – ঘ্রাণ, সব?
কিম্বা আমার গন্ধ তোমার আগেই, অথবা তোমার...
সেদিনও কি বিলম্বিত সুর হবে তারা!

(নেপথ্যে খুব জোরে সম্মিলিত হাততালি বেজে উঠবেক্রমশ তা fade-out করে আবার বাঁশি fade-in করবে। প্রায় সবার অলক্ষ্যে আবিরা চা নিয়ে এসেছে। তার ডাকের সাথে-সাথে আবহ বন্ধ হবে ও মঞ্চে আবার স্বাভাবিক আলো ফিরে আসবে।)

আবিরা -   শিল্পী...
অরিন্দম - হুঁ...
আবিরা -   কী ভাবছ?
অরিন্দম - না সেরকম কিছু না... এটা তোমার সেই collage social’এ তোলা ছবি না?
আবিরা -   মনে আছে তোমার!
অরিন্দম - অসিতের তোলা, তাই না?
আবিরা -   হুঁ... নাও, চা টা খেয়ে নাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
অরিন্দম - Oh yes...  তার সাথে ‘morning shows the day’theory’তে দুপুরে কপালে কী  ঝুলছে তারও একটা আগাম আভাষ পাওয়া যাবে, হাঃ... হাঃ... হাঃ...
আবিরা -   আদৌ না মশায়, আমি যথেষ্ট ভালো রান্না করি। সব্বাই তাই বলে।
অরিন্দম - চিন্তা নেই আমিও তাই বলব। এভাবে যদি একবেলা খাবার খরচ বাঁচিয়ে ফেলা যায়, তাহলে কত প্রশংসা চাও বল না! চাই কি এটা নিয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলতে পারি। হাঃ... হাঃ... হা...

(আবিরা প্রায় ঝঁপিয়ে পড়ে অরিন্দমের চুল দু-মুঠোয় ধরে ঝাঁকাতে থাকে। আবিরার –‘তবে রে’ আর অরিন্দমের ‘ছাড় ছাড়, লাগছে’ যুগপৎ চলতে থাকে। নেপথ্যের বাঁশিতে তখন দ্রুৎএকসময় আবিরা তাকে রেহাই দেয়।)

অরিন্দম - এই চুল-দাড়ি দিয়ে বেশ একটা আঁতেল আঁতেল look দিয়েছি, সেগুলোও যদি এমন উপড়ে নাও...
আবিরা -   বেশ করেছি।
অরিন্দম - বাপ রে, প্রশংসা না করলে মহিলারা যে এমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, সেটা একেবারেই         জানা ছিল না!
আবিরা -   এখন বুঝলে তো? অতব সামলে, এ তোমার canvas নয় যে, যা খুশি রঙের আঁচড় বুনে যাবে। নাও চা টা খাও। তবে ওটা বোধহয় আর খাওয়ার মতো নেই। একটু গরম করে দেব?
অরিন্দম - না থাক। এই বেশ আছে। তুমি বরং বল। আমি শুনতে চাই।
আবিরা -   ওমা, আমি কী বলব?
অরিন্দম - তোমার কথা বল। দীর্ঘ ১৫ বছরের কথা। জীবনের নদীটা কোন কোন ঘাট ছুঁয়ে কোন কোন খাতে বইতে লাগলো, সেই কথা।
আবিরা -   বলার কিই বা আছে? তেমন বিশেষ কিছু তো নয়! তাছাড়া সে সব নিয়ে আজকাল আর বেশি ভাবতেও পারি না।
অরিন্দম - তবু...

(কয়েকটা second কেউ কোনো কথা বলে না। একটা নিশ্ছিদ্র নীরবতার মধ্যে খুব আস্তে-আস্তে বাঁশি fade-in করে পরবর্তী অভিনয়ের বেশ কিছুটা সময় ধরে বেজে যায়।)  

আবিরা -   অসিত সেই যে গেল, আর এলো না। তখনও তো mobile phone’এর এমন ছয়লাপ হয়নি। প্রথম-প্রথম কয়েকটা চিঠির উত্তর দিয়েছিল, পরে তাও আর দিল না। আমার জগতে ভাঙনের শুরু এখান থেকেই। তারপর একদিন হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন। শেষবারের মতো আমায় নিয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়ে অসিতকে চিঠি লিখলাম। একরাশ সান্ত্বনা আর নিজের অক্ষমতা জানিয়ে উত্তর দিল সে। দ্বিতীয়বার ভেঙে পড়লাম। বাবার মৃত্যুতেও ততটা কাঁদিনি, যতটা কেঁদেছি ওর চিঠি পেয়ে। লজ্জায়, ক্ষোভে, নিজের ওপর ঘেন্নায় নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার। তারপর বছর না ঘুরতেই উকন্ঠিত guardian’রা বিয়ে ঠিক করে বসলেন। আমি আর পারছিলাম না শিল্পী! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছিল। পারিনি। আবার হার। ছিঃ! কিন্তু তবু, বিশ্বাস করো শিল্পী, তবু আমি সেই বাধ্যতার মধ্যেও একটু তৃপ্তি  খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছিলাম –
অরিন্দম - সেটাই হয়তো বা আমাদের বিড়ম্বনা বিরাবাই। আমরা আমাদের ইচ্ছের ছাঁচে জীবনটাকে গড়তে চেয়েছি। ফলে বিশাল মাপের জীবনটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেছে। মানুষের প্রাপ্তির তুলনায় চাহিদার মাত্রাটা সবসময়ই অনেক বেশি। কখনই তৃপ্ত নই আমরা। কক্ষনো না। আরও বেশি বা অন্য কিছু পাওয়ার চাহিদা আমাদের অতৃপ্ত করে রাখে সব সময়অদ্ভুত এক হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়ি।
আবিরা -   কিন্তু আমি তো শুধু একটু শান্তি চেয়েছিলাম! সেটা কি বড্ড বেশি চাওয়া? জানো শিল্পী, আমি রোজ নতুন-নতুন করে চুল বাঁধতাম। সাজতাম, ঘরদোর গোছগাছ করে রাখতাম, যাতে কর্মক্লান্ত মানুষটাকে একটু তৃপ্তি দিতে পারি। তখন তো আমার মন আর ততটা বিরূপ নয়! অসিতের ব্যবহারের জ্বালা তখনও রয়েছে। তাই আমার সমস্ত সম্বল উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম মানুষটাকে। আজ বুঝি, কী বোকাই না ছিলাম! মানুষ আসলে ভীষণ স্বার্থপর –
অরিন্দম - না, তা নয়। হতেই পারে না! এভাবে দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে তুমি সমস্ত মানুষ জাতি সম্বন্ধে একটা ভুল সিদ্ধান্তে আসতে পার না। সেটা মস্ত অন্যায় হবে।
আবিরা -   আস্তে... আস্তে..., এতে এত অসহিষ্ণু হবার কী আছে! বেশ, আমি না হয় আমার ভুল স্বীকার করছি। আমি কখনই খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, ভুল-ভ্রান্তি থেকেই যায়, সে কথাটা ঠিক, তবে তার থেকেও বড় ঠিক হলো – হাজার চেষ্টা  করেও অন্ততঃ ঐ মানুষটার সাথে আমি বিন্দু মাত্র মতের মিল ঘটাতে পারিনি।
অরিন্দম - হ্যাঁ সে কথা শুনেছি গাবলুর কাছে। আর সেখানেই আমার যাবতীয় সংশয়! তোমার মতো একটা মেয়ে কেন পারল না সেটা? তা কি এতটাই কঠিন ছিল?
আবিরা -   হ্যাঁ ছিল শিল্পী। বড্ড কঠিন ছিল সে কাজ। আসলে মানুষটা ছিল চূড়ান্ত careeristএকজন successful software specialist, আর আপাদমস্তক লাভ-ক্ষতির হিসেবে মোড়া career ছাড়া আর কখনো কিছু বোঝেনি, বুঝতেও চায়নি। অথচ তুমি তো জানো – একসময় আমি কবিতা লিখতাম। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসতাম। ভাব থেকে বাস্তবে নামারও তো একটা সীমা আছে! সে সীমানা আমি ডিঙ্গিয়ে যেতে পারিনি শিল্পী।
অরিন্দম - সে দায় একান্তই তোমার। তার বোঝা তুমি অন্য কারো ওপর চাপিয়ে দিতে পার না! সেটা অত্যন্ত অন্যায় হবে।
আবিরা -   কিসের অন্যায়? কোন্‌ দায়-দায়িত্বের কথা বলছ? পারিবারিক সমতা বজায় রাখার  দায় শুধুমাত্র আমাদের ওপরই কেন থাকবে বলতে পারো? তোমরা পুরুষেরা কেন শুধু কর্তা হয়েই থাকবে? কেন বন্ধু হবে না? কেন সমস্যাগুলো আমাদের সাথে সমান ভাবে ভাগ করে নেবে না? কেন তোমাদের মনে থাকে না, যে শুধু কোনো কর্তা নয়, বরং দুটো শরীরের তাৎক্ষণিক তৃপ্তির ফল হিসেবে কো্নো না কোনো মায়ের সুদীর্ঘ তপস্যার ফসল আমরা সবাই? তবু সমস্ত দায় আমাদেরই! সমস্ত অন্যায়ের বোঝা আমাদেরই কাঁধে! আর একজনের হঠকারিতার বোঝা আমায় কেন বয়ে বেড়াতে হবে বল তো? এ তোমাদের কেমন ন্যায়?
অরিন্দম - এও অন্যায় বিরাবাই, আমি তা অস্বীকার করি নাআবার বাস্তবে যে এমনটাই চিরদিন ধরে হয়ে আসছে, সে কথাও ঠিককিন্তু আমার প্রশ্ন তো তা নয়...
আবিরা -   প্রশ্নটা তাহলে কী শিল্পী? কী জানতে চাও তুমি? কেন অন্ততঃ আমি সব মানিয়ে নিলাম না?
অরিন্দম - ঠিক তাইসব কিছু বল আমায়, এমন ধাঁধায় রেখ না
আবিরা -   কিছুঅন্য কেউ এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন তুললে কী বলতাম জানি না; না, সেভাবে নিও না আমার কথা, তোমায় বলববলব কারণপ্রথমতঃ, দাদামনি নিশ্চয়ই নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী একটা ব্যাখ্যা দিয়ে তোমায় এর মধ্যেই বিভ্রান্ত  করে দিয়েছে, আর দ্বিতীয়ত, অন্ততঃ একজনেরও সত্যিটা জানা উচিৎএমন একজন, যাকে আমি বন্ধু ভাবতে পারি, যে আমায় বিশ্বাস করবে

(আলো আস্তে-আস্তে গুটিয়ে মঞ্চে একটা আধো অন্ধকার পরিবেষ তৈরি করে। আবহেও তার ছোঁয়া। অরিন্দম ও আবিরা দুজন মঞ্চের দুই প্রান্তে। আবিরার কন্ঠ যেন কোনো দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয়।)   

আবিরা -   আমরা খুব অসুখী পরিবার ছিলাম। সংসারে আমি আর ও ছাড়া আমাদের আর কেউ ছিল না। ও নিজেই সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেছিল। তবু আমি ওকে জড়িয়েই  বাঁচতে চেয়েছিলাম। অথচ সে মানুষটা শুধু career গড়ার স্বপ্নেই মশগুল। শুধু career’এর লাভের কড়ি গুনেই খালাস। আমার অস্তিত্বই অস্বীকার করে গেছে বরাবরRobot’র সাথে সহবাসে আর যাই থাক, শান্তি পাওয়া যায় না শিল্পী! বিয়ের একটা বছরের মধ্যেই তোমাদের কবি বিরাবালি, জীবন্ত শব হয়ে গেছিল।  গতানুগতিক একই নিয়মের চাকায় বাঁধা জীবন। তবু আমি রোজ লোকটার অপেক্ষায় থাকতাম – রোজ। প্রত্যেক দিনই ভাবতাম – আজ নিশ্চয়ই দেরি করবে না, আজ নিশ্চয়ই সময়মতো ফিরবে, আজ নিশ্চয়ই...

          আমি আমার ভালোবাসার আকাশ সাজিয়ে রাখতাম। একটা একটা করে তারা বেছে মালা গেঁথে রাখতাম। কিন্তু আমার প্রতীক্ষার পালা আর শেষ হয় না। রাত গভীর থেকে আরও গভীর হয়। এক এক করে প্রতিবেশীদের ঘরের আলো নিভতে থাকে। পুবের চাঁদ পশ্চিমে পাড়ি দেয়। Balcony’তে একা-একা বসে সে সব দেখতাম আমি। দেখতাম আর কাঁদতাম। একসময় আমার ঘুম পেত। আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। Calling Bell’এর শব্দে যখন ঘুম ভাঙত, তখন আর রাত বেশি বাকি নেই। টলতে টলতে ঢুকে কোনো রকমে জুতোমোজা খুলে বাইরের কাপড়েই শুয়ে পড়ত। আমার আর ঘুম আসতো না। চোখ বুজলেই তারাগুলো সর্বাঙ্গে বিঁধত। পাশে অসাড় মানুষটাকে নিয়ে অসহ্য জ্বালায় ছটফট করতাম সারাটা রাত। সে দিনটা ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী...

(আবিরার গলা কান্নায় বুজে আসে। কথা শেষ করতে পারে না। বাঁশির সুরও তখন কান্না-ঝরা পঞ্চমে। আলো গুটিয়ে এসে মঞ্চ অন্ধকার হয়। এই আবহই নাটককে পরবর্তী দৃশ্যে নিয়ে যায়।)   






দ্বিতীয় দৃশ্য

(এটা অন্য ঘর। মঞ্চে যৎসামান্য পরিবর্তন ঘটিয়েই সেটা বোঝাতে হবে। যেমন – পর্দাগুলো বদলে যেতে পারে, দু-একটা আসবাব বদলে যেতে পারে, cushion’গুলো পাল্টে যেতে পারে, ছোট frame’এ বাঁধানো ছবিটায় এখন দুজনের মুখ, একটা telephone থাকতে পারে, একটা ফুলদানীতে কিছু ফুল  থাকা আবশ্যক, একটা ছোট টবে Indoor Plant থাকতে পারে, ইত্যাদি... ইত্যাদি। Sofa’তে এলিয়ে বসে আছে আবিরা। পরনে একটা উজ্জ্বল শাড়ি। বুকের ওপর রাখা একটা বই। বোঝা যায় সে ঘুমিয়ে পড়েছে। Calling Bell’এর কর্কশ শব্দে ধড়মড় করে ওঠে। বইটা বুক থেকে পড়ে যায়। প্রথম দৃশ্যের Calling Bell ও বর্তমান দৃশ্যের Calling Bell সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। কৌশিক ঢোকে। ঈষৎ বেসামাল।

এ দৃশ্যে Deep Detail’এর কাজ হিসেবে - কৌশিকের জুতো খুলে ঘরের ভেতর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া,  Laptop’টাকে প্রথমে একজায়গায় রাখা ও পরে ভেতরে রেখে আসা, পর্দার আড়ালে গিয়ে পোশাক পাল্টে চেক-চেক পাজামা ও ঢিলেঢালা T-shirt পড়ে আসা, কোনো কোনো সংলাপ পর্দার আড়াল  থেকেই চেঁচিয়ে বলা, আবার পর্দা সামান্য ফাঁক করে শুধু মাথা বার করে কোনো কোনো সংলাপ বলা, ইত্যাদি থাকাতেই পারে। তবে তা কখন কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সেটা একেবারেই পরিচালকের বিবেচনা সাপেক্ষ।)   

কৌশিক - ঘুমোচ্ছিলে বুঝি? সারাদিন তো ঘরেই থাকো, এত ঘুম আসে কোত্থেকে!
আবিরা -   এভাবে চলতে পারে না –
কৌশিক - What do you mean?
আবিরা -   এই যে দিনের পর দিন তুমি তোমার career নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, আর জীবনের সমস্ত সাধ বিসর্জন দিয়ে আমি শুধু এই চার দেয়ালের ভেতর বন্দী হয়ে থাকব, এ একেবারে অসহ্য। এটাই চলতে পারে না।
কৌশিক - কী হলে তোমার সহ্য হবে শুনি!
আবিরা -   আমি তোমার স্ত্রী, অথচ তোমার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই -! এমনকি আজকের দিনটাও...
কৌশিক - কী? আজকের দিনটা কী? আমাদের বিবাহ বার্ষিকী, এই তো? তাতে তুমি আর আমি ছাড়া আর কার কী যায় আসে, বলতে পারো?
আবিরা -   আমি তো আর কারো কথা বলছি না! আমি তোমার-আমার কথাই বলছি।
কৌশিক - জানি জানি, you don’t have to teach me thatকিন্তু তুমি যেটা বুঝতে পার না, তা হলো – এই আর পাঁচজনকে নিয়েই তুমি আর আমি।
আবিরা -   তাই বুঝি? তা কই, বিয়ের এই এক বছরের মধ্যে তো তেমন একজনকেও দেখলাম না!
কৌশিক - হ্যাঁ দেখনি। দেখনি কারণ তারা কেউ আমার এগিয়ে চলার পথে কোনোদিন কোনোরকম ছাপ রেখে যাবে না। চাকরি করাটাই সব কথা নয়। একটা Lower Division Clerk’ও তাই করে। কোনো prospect থাকে না, কোনো ambition থাকে না। সারাদিন শুধু কলম পিষে যায়, আর ৫টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বৌ’এর আঁচলের তলায় ফষ্টিনষ্টি করতে office থেকে বেরিয়ে পড়েIs that a life? I want to grow… want to go high… sky is my limit… আর তার জন্যে যে কী অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়, কী ভয়ঙ্কর tension নিতে হয়, সেটা এই চার দেয়ালের আরামে বসে কল্পনাই করতে পার না!
আবিরা -   তাই বল। তার মানে তোমার career Prospect’এর ছকে তারা ব্রাত্য। তা আমিও কি তাই?
কৌশিক - Look dear, the hard truth is তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, আমার সৌভাগ্যও নয়, আবার আমার দুর্ভাগ্যও নয়। একটা সংযোগ বলা যেতে পারে। An incidence… a mere incidence…
আবিরা -   তুমি মাতাল হয়ে গেছ...
কৌশিক - বেশ করেছি... নিজের পয়সা খরচ করে মাতাল হয়েছি, বেশ করেছি।
আবিরা -   ঠিক আছে, চলো এবার দুটি খেয়ে নাও...
কৌশিক - No…don’t go, পুরোটা শুনে যাও...
আবিরা -   পরে কোনো এক সময় এ নিয়ে আমরা কথা বলব কৌশিক, আজ থাক...
কৌশিক - কেন থাকবে কেন? যখন শুনতে চেয়েছ তখন শোন yes, that was an incidenceবাজারে পছন্দমতো সব্জি পাওয়া বা না পাওয়ার মতোই তুচ্ছ ব্যাপার।  But the important thing is  তুমি একজন নারী, an opposite sex. That’s just what you are to me…
আবিরা -   চুপ কর। এভাবে কোনো মানুষ তার স্ত্রী’কে বলতে পারে না। এ তো গালাগালি দেওয়া। তোমার লজ্জিত হওয়া উচিৎ।
কৌশিক - Certainly not… যা বলেছি that’s my own feeling, আর তা এতটাই সত্যি যে সম্ভবতঃ কোনো পুরুষই তা অস্বীকার করতে পারবে না। Yet, তোমার যখন ভালো লাগেনি, am sorry…
আবিরা -   ‘Sorry’ শব্দটা কি এতটাই তুচ্ছ বলে মনে কর?
কৌশিক - বিদ্যের অহঙ্কার করছ?
আবিরা -   না, ভাবছি – সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে আমাদের যে সংযমের প্রয়োজন, তার শুরুটা কোথা থেকে হওয়া উচিৎ!
কৌশিক - এর থেকে সুস্থ কোনো জীবনের প্রয়োজন আমার অন্ততঃ নেই।
আবিরা -   আমার তো আছে! এভাবে আমার জীবনটা দুর্বিষহ করে তোলার কোনো অধিকার নেই তোমার।
কৌশিক - চেঁচিয়ে যদি আরাম পাও, আমার কোনো আপত্তি নেই –
আবিরা -   তুমি চোখ থাকতেও অন্ধ, না হলে দেখতে – আমি হাসতে ভুলে গেছি। আমার একটাই স্বপ্ন ছিল। ভাবতাম – প্রতিটা সমস্যাই আমি মিটিয়ে নেব আমার বোধ দিয়ে, আমার সহানুভুতি দিয়ে। কিন্তু এখন যেদিকেই তাকাই, শুধু অন্ধকার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না...
কৌশিক - How funny… সেটা আবার এমন কি জিনিষ যা তুমি বুঝে উঠতে পার না! অন্ধকারটা তোমার কাছে স্পষ্ট তো?
আবিরা -   হ্যাঁ, আর তার কারণ তুমি।
কৌশিক - Come on আবিরা, enough is enough… মাঝরাতে একটা simple issue নিয়ে পাড়ার আর পাঁচজনকে disturb কোরো না। They are gentlemen after all…
আবিরা -   To hell with your gentlemen… simple না? তোমার যেটা সহজ সরল বলে মনে হচ্ছে, আমার কাছে তা মৃত্যুর সামিল। দমবন্ধ হওয়া পরিবেশেও তুমি নিশ্চেতন  হয়ে সিগারেট খেয়ে যেতে পারো! আমায় যখন চার দেয়ালের বন্ধন গলা টিপতে  এগিয়ে আসে, তখনও তুমি তোমার career’এর লাভের কড়ি গুনতে ব্যাস্ত থাকো –
কৌশিক - সেটাই তো স্বাভাবিক। কটা পুরুষ এর ব্যতিক্রম!
আবিরা -   না, এটা স্বাভাবিক নয়। জীবনের যে সমস্ত প্রেরণা অত্যন্ত গভীরে দানা বাঁধে, তাদের শুধু মাত্র লাভ-লোকসানের রাশ টেনে বেঁধে রাখা যায় না। তুমি বড্ড বেশি  আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছ কৌশিক। বড্ড বেশি বস্তুবাদী আড়ষ্টতা গ্রাস করেছে তোমায়। আবেগকে পরিপূর্ণ ব্যাঞ্জনা দিতে ভয় পাও তুমি। পাছে তোমার লাভের কড়িতে টান পড়ে! সবকিছুই দেখতে চাও তোমার ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভোঁতা নজর দিয়ে। এদিকে আমার পৃথিবী সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর য়ে চলেছে, দিন-রাত্রি কাটছে উদাসীন যন্ত্রের চাকায় – তুমি দেখতেই পাও না!
কৌশিক - Why don’t you try to understand আবিরা – জীবনটা শুধুমাত্র আবেগের নির্দেশ মেনে চলতে পারে না। তাতে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না –
আবিরা -   And why don’t you try to understand কৌশিক – জীবনটা শুধু লাভ-ক্ষতির হিসেবের খাতা নয়। সেটার অন্য আর অনেক বড় অর্থ আছে। সেটাকে এমন ভাবে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীতে বেঁধে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। Please কৌশিক, আমায় একটু বোঝার চেষ্টা কর। দেখ, নদীতে বাঁধ দিলেই তো তা ডোবা হয়ে যায় না!  বাধার দেয়াল তো থাকবেই। সেটাই স্বাভাবিক। তা বলে ছন্দটুকু হারিয়ে ফেলব কেন বল তো! অর্ধেক মাধুর্য যে সেখানেই লুকিয়ে থাকেসেই অর্ধেকটা খুঁজে পাওয়াও তো লাভ! এই সহজ অঙ্কটা তুমি কেন বুঝতে পার না বল তো?
কৌশিক - এমন অদ্ভুত করে analysis করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু বুঝি – যা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, এমন প্রাপ্তির মধ্যেই লাভ, আর সবই ক্ষতি। Wastage… wastage of time, wastage of energy, wastage of money, বা অন্য কিছুর wastage…
আবিরা -   তোমাদের সমস্ত পুরুষ জাটার দোষ কোথায় জানো? তোমরা অত্যন্ত স্বার্থপর। তোমাদের প্রয়োজনে একদিন তোমরা কল্পনার ছবি এঁকে আমাদের মন জয় করার হাজার চেষ্টা কর। তারপর যখন প্রয়োজন মিটে যায়, তখন ‘কেমন আছ’ – এ প্রশ্নটাও করতে ভুলে যাও। অথচ আমরা মেয়েরা তখনও তোমাদের মুখে ভালোবাসার  ঐ তুচ্ছ প্রশ্নটুকু শোনার জন্যে ভিখিরির মতো উন্মুখ আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। কারণ তখন সেটুকুই আমাদের  জীবন, আমাদের বেঁচে থাকার সম্বল। তা থেকে অন্তত আমায় বঞ্চিত কোরো না!
কৌশিক - O.K., এ ব্যাপারে আমরা পরে একসময় আলোচনা করতে পারি। আপাতত রাত্রি অনেক হয়েছে...
আবিরা -   কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না –
কৌশিক - What shall I do then? Tell me, what? আমার সংস্পর্শে তুমি জেলখানার বন্ধন অনুভব কর, আমি  তোমায় বঞ্চিত করেছি, তোমার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করেছি, then what more do you want out of me? Divorce?
আবিরা -   Stop it, just stop it.
কৌশিক - Why shall I? আমার চিন্তাধারা, মতামত, সব তোমার থেকে আলাদা – তুমি তাই বলতে চাও তো? Yes it is, প্রতিটা জিনিকে তোমার মতো romantic পোশাক পরানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার সমস্যাগুলো অদ্ভুত খামখেয়ালীতে ভরা। যার সাথে আমি পাল্লা দিতে পারি নাআমার ধারণা কো্নো বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। অথচ তবু আজ দীর্ঘদিন ধরে এই একই ব্যাপারের ওপর আমরা debate চালিয়ে যাচ্ছি। Believe me, প্রত্যেক দিনের এই debate’এ  আমি tired হয়ে পড়েছি। আমায় মুক্তি দিতে পারো না?
আবিরা -   আমি তোমায় মুক্তি দেব! মুক্তি দেবার মালিক আমি?
কৌশিক - ঠিক আছে, আমিই তোমায় মুক্তি দিলাম। Hence forth you are free… absolutely free…
আবিরা -   বেশ, এখন থেকে আমি নিজের মতো করেই বাঁচব... নিজের মতো করেই...
কৌশিক - Do whatever you wish… চাইলে ইচ্ছেমতো বাঁচতেও পারো, চাইলে ইচ্ছেমতো মরতেও পারো don’t care, but for God sake, leave me alone. আমায়  আমার মতো করে বাঁচতে দাও।

(কৌশিকের কর্কশ চিৎকারের আকস্মিকতায় আবিরা প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়তার এমন ভয়ঙ্কর রূপ এর আগে কখনো দেখেনি সে। কয়েকটা মুহূর্ত তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উদ্গত কান্না রোধ করতে করতে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। আবহের সুরে সেই কান্না স্পষ্ট। কৌশিক পকেট থেকে সিগারেট বার করে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও দেশলাই ধরাতে পারে না। সেটা সজোরে মাটিতে আছড়ে ভয়ঙ্কর জোরে পা দিয়ে থেঁতলে চিৎকার করে ওঠে –‘FUCK OFF’

তার চিৎকারের সাথে-সাথে আলো এক ঝটকায় কেটে যাবে। আবহ নাটককে তৃতীয় দৃশ্যে নিয়ে  যাবে। দ্বিতীয় দৃশ্যে যে সমস্ত উপকরণ মঞ্চে রাখা হয়েছিল, তা সরিয়ে মঞ্চকে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখন এটা আবার আবিরার ঘর। আবিরার একার।)  








তৃতীয় দৃশ্য

(মঞ্চের দু-কোণে দুজনকে রেখে যেভাবে প্রথম দৃশ্য শেষ হয়েছিল, আলো এলে দুজনকে আবার সেই একই অবস্থায় একই যায়গায় দেখা যাবে।)  

আবিরা -   অগত্যা, আবার সেই স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ। Court, উকিল, রায়, আর আবার আবিরা চট্টোপাধ্যায়। তারপর এই Schoolপ্রথম প্রথম কদিন ক্লান্তি, তারপর অভ্যেস। এখন সেই অভ্যেসের দাসী। এখন আমার এতেই শান্তি।
অরিন্দম - কিন্তু তাতেও তো কোনো সমাধানে পৌঁছনো গেল না। এতেই বা তোমার ভাব কতটুকু দানা বাঁধল বলতে পারো! মনিব পাল্টালো, কিন্তু দাসত্ব ঘুচল কি? তোমার কলম তো আর কোনো নতুন সৃষ্টির সন্ধান দিতে পারল না!
আবিরা -   ওসব কথা থাক না শিল্পী –
অরিন্দম - এবার কিন্তু তুমিই এড়িয়ে যেতে চাইছ!
আবিরা -   না হয় তাই... কিন্তু শুধু কি আমার কথাই শুনবে, না নিজের কথাও কিছু বলবে?
অরিন্দম - কী জানতে চাও বল?
আবিরা -   এতদিন কোথায় ছিলে? কী করছ? সংসারি হয়েছ কি না? হলে তিনি  কী  করেন? কটা ছেলে-মেয়ে? এই সব আর কি!
অরিন্দম - বাবা, এ তো লম্বা listবেশ এক এক করে জবাব দিই। কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো রকম চাকরি করেছ। প্রথমে ভাগলপুরে ছিলাম। Medical Representative’এর চাকরি নিয়ে। বেশি দিন ভালো লাগল না। Journalist’এর চাকরি নিয়ে মুম্বই চলে গেলাম তাও পোষাল না ফিরে এসে Art Collage’এ ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে Commercial Artist’এর একটা চাকরি নিয়ে দিল্লী চলে গেলামবছর তিনেকের মাথায় সেই company’র কাজ নিয়েই চলে গেলাম Franceসত্যিই দেশটা শিল্পের স্বর্গ! চুটিয়ে কিছুদিন কাজ করলাম। তারপর একদিন মেয়াদ ফুরোলো, আমিও ফিরলাম। আবার সেই একই গতানুগতিক জীবন। একই ফরমায়সি কাজের ভিড়। গ্রাহক তুষ্ট করা আর মানুষকে বোকা বানানোর নানান কৌশল। খুব ক্লান্ত লাগছিলতাই সব ছেড়ে ছুড়ে একটু শান্তির খোঁজে বেরিয়েছি।
আবিরা -   আর সংসার?
অরিন্দম - সে বাঁধন থেকেই তো এতদিন পালিয়ে বেড়িয়েছি।
আবিরা -   তুমি কি সত্যিই আর নিজের মতো করে আঁক না?
অরিন্দম - বিরাবাই, মাঝে মাঝে আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, একদিন আমারই  ছবির প্রদর্শনী দেখতে ভিড় করে মানুষ এসেছিল। লোকে আমার আঁকা ছবি দাম দিয়ে কিনেওছিল। তোমাদের দেওয়া শিল্পী নামটা আর মানায় না আমায়। কেমন যেন উপহাসের মতো শোনায়।
আবিরা -   সত্যি, আমরা কি ছিলাম – আর কোথায় এসে ঠেকলাম!
অরিন্দম - অথচ যাদের আমরা অনেক পেছনের মানুষ বলে ভাবতাম, তারা অনেকেই আজ আমাদের পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অনেক দূর। প্রায় আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ...পিনাকীকে মনে আছে তোমার? আমরা বলতাম common room’common class, France যাবার আগে হঠাৎ একদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল। ও এখন National Insurance’এর জুহু branch’এর Managerজোর করে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। সমুদ্রের ধার ঘেঁসা company’র দেওয়া ছিমছাম flatসাগর আর আকাশের নীল যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, ও সেখানে রোজ সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখে। বৌ আর একটা ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে মিষ্টি পরিবার। ঢ্যাঁড়শ দেবজ্যোতি, একটা নামি ওষুধ company’Area Managerমৌসুমি নয়, তৃপ্তি নামের নতুন বিয়ে করা বৌ নিয়ে উটিতে honeymoon সারতে গেছিল। আমি company’র কাজে ঝটিকা সফরে। হঠাৎই আমার সাথে দেখা হয়ে গেল। যেন আঁতকে উঠল! যদি জিজ্ঞেস করে বসি, ‘কি করে এটা পারলি রে’! কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ভুল, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। আমরা কি সত্যিই পিছিয়ে পড়েছি?
আবিরা -   এভাবে নাই বা ভাবলে!
অরিন্দম - আর কিই বা ভাবতে পারি এ ছাড়া? পনেরটা বছর ধরে একুল ওকুল ঘা খেতে-খেতে আজ আবার আমায় নতুন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার উপায় খুঁজতে হচ্ছে। ওদের যায়গায় আমার থাকা উচিত ছিল এ কথা বলছি না, কিন্তু অন্ততঃ ওদের মতো করে আমারও আজ নিজের ক্ষেত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, সে কথা ভাবায় তো কোনো ভুল নেই! সে যোগ্যতা তো আমার ছিল!
আবিরা -   ছিল কেন বলছ শিল্পী! আমি বিশ্বাস করি তোমার যে ক্ষমতা যে যোগ্যতা আমরা দেখেছি, তা হারিয়ে যাবার নয়। সময়ের আস্তরণ পড়ে হয়তো একটু ম্যাটম্যাটে হয়েছে। রোদের তাতে চারা গাছের মতো। যেই তাতে জল দেবে, দেখবে আবার তা সতেজ হয়ে উঠেছে। জীবনটাকে নতুন করে সাজাবার সুযোগ পাচ্ছ শিল্পী।
অরিন্দম - Medical Representative থাকাকালীন একবার Law পড়ার ইচ্ছে হয়েছিল। University’তে গেছিলাম। আমার প্রিয় Professor Dr. Kumar’এর সাথে দেখা করেছিলামকী ভেবে যেন উনি বললেন – ‘Boy, you have finished yourself’সে সময় খুব তর্ক করেছি ওনার সাথে। প্রমা করতে চেয়েছি যে আমি তখনও আগের মতোই আছি। পরতে পরতে রঙ সাজানো টাটকা প্রাণ। কিন্তু এত বছর পর এখন মনে হচ্ছে – উনিই হয়তো ঠিক। আমি সত্যিই শেষ হয়ে গেছি।
আবিরা -   না, তা নয়। এই অসহিষ্ণুতা, এই সৃষ্টি না করতে পারার বেদনা, এ সব আসলে maturity’র লক্ষ্মণ
অরিন্দম - তোমার কি ধারণা, তোমার এই সব টিপ্পনী আমায় খুব উৎসাহিত করছে?
আবিরা -   আমার কথায় দুঃখ পেয়ো না শিল্পী। আসলে আমাদের গলদটা রয়ে গেছে একেবারে গোড়ায়। প্রথম চোখ মেলার দিনগুলোতেই আমরা আমাদের নিজেদের সীমা নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলাম। আমি, তুমি, অসিত, সোমনাথ, দূর্বা, তুহিন, মৌসুমি, আরও অনেকে, যাদের নামও আজ আর মনে পড়ে না, আমরা সবাই আমাদের অপরিণত চিন্তাধারা দিয়ে স্বপ্নের ইমারত গড়তে চেয়েছিলাম। সেই স্বপ্ন অনুযায়ী আমার হওয়া উচিৎ ছিল একজন বিখ্যাত কবি, শিল্পীমহলে তোমার নাম হওয়া উচিৎ ছিল ভাস্বর।
অরিন্দম - হ্যাঁ, ঠিক তাই। আর তাই আমার বিশ্বাস, আমরা একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি। হয়ে গেছি কারণ, আমরা যেভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম, আমাদের বাঁচতে হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত ভাবে।
আবিরা -   ভুল, তুমি ভুল করছ শিল্পী। জীবনের যে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা একেবারে মনের গভীর থেকে উঠে আসে, তাদের এভাবে গলাটিপে মেরে ফেলা যায় না। কে বলে তুমি নিঃশেষ হয়ে গেছ? তোমার রক্তে রঙের virus, তার থেকে মুক্তি নেই তোমার। আঁকতে তোমাকে হবেই। পরের জন্যে এঁকেছ অনেক, এবার তোমায় নিজের  জন্যে আঁকতে হবে। ভুল কোরো না – নক্সা কাটা আর ভিৎ গড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য।
অরিন্দম - কিন্তু কেন? কেন তা হবে বিরাবাই? নক্সা কাটাটা যদি ঠিক-ঠিক হয়, তাহলে তার সাথে ভিৎ গড়ার পার্থক্য হবে কেন? আমাদের জীবনটা কি শুধু মাত্র অপটু হাতের অবাস্তব আঁকা-বাঁকা রেখা ছাড়া আর কিছুই নয়? যা কখনই কোনো  স্থিরতায় এসে পৌঁছতে পারবে না, উন্মাদের মতোই কেবল ভাঙনের দিকে এগিয়ে যাবে? আমরা তার ভারবাহী হয়েই থাকব! যদি বল – আমাদের সেই ভালোবাসা, মহত্তাকাঙ্ক্ষা, উপলব্ধি, সে সব শুধুই ভুল নক্সা ছিল, তাহলে তুমি তো অন্ততঃ সংসার পেতেছিলে, তবু তো সেই ভাঙন!  
আবিরা -   হ্যাঁ ছিল বৈকি। বড় কাঁচা ভিৎ ছিল। তার ওপর কি কোনো ইমারত দাঁড়িয়ে  থাকতে পারে কখনো! তা তো ভেঙে পড়বেই...এ কী, কোথায় চললে?
অরিন্দম - এবার যাব আমি –
আবিরা -   সে কি! খেয়ে যাবে বললে যে! আমার কথায় রাগ করলে?
অরিন্দম - না না, তা নয়তুমি ঠিকই বলেছ। আজও তো কত কবিই কবিতা লেখেন। আজও তো অনেক শিল্পীই রঙের দুনিয়ায় তন্ময় থাকেন। কোনো-কোনো মানুষ তো আজও নিজের মতো করে বাঁচে। আমার বিড়ম্বনা সেটা নয়। আমি তো এটাও ভালো করে জানি না – এখান থেকে বেরিয়ে আমি কোথায় যাব! কোথায় যাওয়া উচিৎ আমার!
আবিরা -   তাহলে কেন যাচ্ছ?


(দাঁড়িয়ে পড়ে অরিন্দম। একটু সময় নেয়। তারপর বলে –)

অরিন্দম -     কোন্‌ অধিকারে থাক?

(ইঙ্গিতটা অত্যন্ত পরিষ্কার। ফলে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আবিরা বলে –)

আবিরা -   তোমার ব্যাগটা ফেলে যাচ্ছ!

(এবারও ইঙ্গিতটা অত্যন্ত স্পষ্ট। অরিন্দম কোনো কথা না বলে শুধু একটু মাথা নেড়ে এগিয়ে গিয়ে  ব্যাগটা তুলে নেওয়ার মুহূর্তে –)

আবিরা -   একটা কথা বলি – পরিস্থিতির চাপে জীবনের একটা নিশ্চিত গণ্ডি টেনে ফেলা, একরকম ভাবে নিজের মনের ছবিটাকে নিজের হাতে গুঁড়িয়ে ফেলারই সমান। আমি যখন বার-বার সেই ভাঙনের পাড় জোড়া দিতে ব্যস্ত, তুমি তখন বার-বার নতুন করে জীবনটাকে সাজাবার সুযোগ পাচ্ছ। প্রসস্থ পথ তোমায় হাতছানি দিচ্ছে, পেছন ফিরে তাকাবার সময় এ নয় । এগিয়ে যাও –
অরিন্দম - কিন্ত আমি একা কেন? আমরা কেন নই?
আবিরা -   ছুঁয়ো না আমায়... আমার শরীরটা সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলেছে শিল্পী।
অরিন্দম - বিরাবাই...!
আবিরা -   আমি এক অনিকেত প্রাণ। স্মৃতির ঝুলিতে দু-দুটো ঘর ভাঙার সঞ্চয় নিয়ে আর কি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা যায়, বল? তার চেয়ে এই বেশ আছি। স্বাধীন জীবন। কোনো দায়ও নেই, কো্নো দায়িত্বও রইল না। শুধু যখন আকাশে খুব বড় করে চাঁদ ওঠে, রাস্তার ওপারের কদম গাছটায় রূপোলী জরির আলপনা আঁকা হয়, তখন একটা মেয়েকে খুব মনে পড়ে। যে কবিতা লিখত। যে বোকার মতো জীবনটাকে বহতা নদীর ছন্দ কল্পনা করে মনের canvas’এ স্বপ্নের ছবি আঁকত।

(এ সংলাপের মাঝে আবিরা অরিন্দমের দিকে ঘুরে মুখোমুখি হয়। ওর পাঞ্জাবীর একটা খোলা বোতাম লাগিয়ে দেয়। সংলাপ শেষ হবার সাথে-সাথে অরিন্দম কিছু বলতে গেলে আবিরা আলতো করে নিজের হাত তার মুখে চেপে ধরে। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। তারপর দু-পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। যেন চলে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। অরিন্দম বুঝতে পারে সেটানিঃশব্দে দরজার দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ-)  

আবিরা -   শিল্পী... আর কখনো এসো না, কেমন!

(অরিন্দম কেমন থমকে যায়। আবিরা ঠিক কী বলতে চায়, তা বুঝতে পারেনি। খানিক্ষন যে যার জায়গায় অনড় থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরিন্দম দরজার দিকে এগিয়ে যায়। যতক্ষণ না সে দরজা পেরিয়ে যায়, ততক্ষণ আবিরা নিজের যায়গায় স্থানু হয়ে থাকে। তারপর দৌড়ে দরজায় যায়। যেন অত্যন্ত ভুল হয়ে গেছে। লোকটাকে এক্ষুণি ফেরানো দরকার! কিন্তু সে ততক্ষণে  সম্ভবতঃ রাস্তার ওপারে! আর ডাকা হয় না। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে-আস্তে দরজাটা বন্ধ করে। আর পারে না। হাউ-হাউ করে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মঞ্চের সমস্ত আলো গুটিয়ে কেবল একটিমাত্র আলো তার মুখের ওপরCell phone’টা হঠাৎ বেজে ওঠে। বেজেই যায়আজ আর কোনো ডাকেই সাড়া দেওয়া হবে না তার। আবহে সেই বাঁশি, যা সাধারণ অবস্থাতেও মানুষের চোখে জল ঝরাতে পারে।)  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন