শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

১৪) অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

লোকটা ও হাশমির ঘোড়া




লোকটা গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটতো।

একদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে হঠাৎ সে আবিষ্কার করল, তার হাঁটার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমটায় সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি যে, অন্যরকম কিছু হচ্ছে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে লোকটা হাঁটছিল। একটা ভাবনার পেট থেকে আরেকটা ভাবনার হাত-পা ধরে ফেলছিল সে। ভাবনাগুলো ফুটতে থাকা জলের বুদবুদের মতো ক্রমাগত হয়ে যেতে থাকায়, লোকটা কতগুলি যুক্তি সাজানোর জন্য বা হয়তো ভাবনাগুলো ঠিকঠাক নিজের মধ্যে গুছিয়ে বুঝে ওঠার জন্য, বিড়বিড় করতে করতে হাঁটছিল। হাতের বোতামখোলা ফুলহাতা জামার হাতার পেছনে তার হাতের আঙুলগুলো মাঝে মাঝেই সেই বিড়বিড়ের সাথে শূন্যে নড়েচড়ে যুক্তিগুলোকে সাজাচ্ছিল। এইভাবে সে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে খুব এলোমেলো ভাবে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন সে তার নিজের হাঁটা নিয়েও ভাবতে শুরু করে। তখনই সে লক্ষ্য করে, তার হাঁটার পরিবর্তন হয়েছে। অনেক আগে সে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতো। সে অনেক ক্যালেন্ডার আগে। যদিও অনেকে সেকথা এখনও বলে, তবে বেশির ভাগেরই হয়তো সেসব আর মনে টনে নেই, অনেকে জানেও না। কেননা তারপর অনেকদিন হয়ে গেছে। এরমধ্যে সে কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটেছে। কখনো শুধু বুড়ো আঙুলে ভর ক’রে। কখনো বা গোড়ালিতে ভর দিয়েও হেঁটেছে। একসময় সে চেষ্টা করেছিল শুধু পায়ের পাতার মাঝখানের অংশটুকু মাটিতে ফেলে হাঁটতে। এই তো কিছুদিন আগে সে সামনে তাকিয়ে পেছন দিকে হাঁটাও অভ্যেস করেছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই লোকটা জানতো তার হাঁটাকে অন্য সবার মতো হনহন ক’রে হাঁটা বা পনপন ক’রে ছোটার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তার হাঁটার মধ্যে একটা রঙের মজা কীভাবে যেন সে খুঁজে পেয়েছিল। এটাই তার কাছে একমাত্র নেশা। হাঁটতে হাঁটতে ধীরে ধীরে নেশা চড়ে। ঝিঁঝিঁ ধ’রে যায় পায়ে। ঘাড় ভারি হয়ে যায়। লালা শুকোয় মুখের ভেতরে। বিড়বিড় করতে করতে তার ভাবনাগুলো জাল ফেলতে শুরু করলে, এই নেশায় চেপে সে সারা শহর হেঁটে বেড়ায়। বিভিন্ন রঙের রঙীন রঙীন সব হাঁটা। নিঃসন্দেহে বলা যায় এই হাঁটাকে সে উপভোগ করত। কিন্তু মাঝে মাঝে হাঁটার ওপরে তার পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে তা’ প্রভাব ফেলত তার ভাবনায়। ব্যাঘাতও ঘটাত। চিন্তায় ভাঙচুর হতো। ফলে সে স্থিতাবস্থা এনেছিল তার হাঁটায়। একটা সময় সে দীর্ঘদিন গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটতো। এই ব্যাপারটা তার বেশ ভালো লেগেছিল। মাথা থেকে পা, সমস্ত কিছুকে নিয়ে, বেশ কীরকম সারা শরীর দিয়ে হাঁটা। এইভাবে সে অনেকদিন হাঁটছিল। রাস্তার খানাখন্দ-গর্ত আর নুড়ি কাঁকড় নিয়ে এই হাঁটা-টা সত্যিই ভালো। একটু অন্যরকম। তাই সে গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটতো। হাঁটতে হাঁটতে ভাবত। আর হাঁটতো। হাঁটতে হাঁটতে খিদে পেলে, ফুটের দোকানের সামনে দাঁড়াত। তারপর কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে, একটু হেঁটে এসে, খাবার কিনে, খেতেই খেতেই হাঁটতো। মাঝে মাঝে কেউ কেউ তার হাঁটার সঙ্গীও হতো। কিন্তু তার ঘন ঘন হাঁটা-পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য কেউই তার সঙ্গে বেশিদিন হাঁটতো না। বরং রাস্তার ধারে, রোয়াকে, বিপুলদার চায়ের দোকানে কেউ বসে থাকলে, লোকটাকে থামিয়ে ওর সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করত। কখনো কখনো লোকটা থামতো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতো না। কেননা সেখানে সবাই হাঁটাবিরোধী আলোচনা করত। যা তার পছন্দ নয়। যদিও লোকটা তার চারপাশে বসে থাকা বা গাড়িতে চড়া মানুষদেরই বেশি দেখতো; তবু, সে তার দেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে নিজের একটা যোগ খুঁজে পেত। কেননা, কোথাও কোনো জায়গায় সে শুনেছিল, বোধহয় এক অর্থনীতিবিদ তাকে বলেছিল, তার দেশের অধিকাংশ লোকই গ্রামে থাকে। সে তার চারপাশের লোকজনদের গ্রামের লোককে হেটো বলতে শুনেছে। লোকটা মনে করত, গ্রামের লোকেরা যেহেতু দিনের অনেকটা সময় হেঁটে-চ’লে বেড়ায়, তাই তাদের হেটো বলা হচ্ছে। আবার, তাদের জীবনের অনেকটাই হাট কেন্দ্রিক। আর সে কোথাও একটা শুনেছিল, সম্ভবত একজন ঐতিহাসিক তাকে বলেছিল, একসময় হাটের বিক্রেতারা নাকি সারা দেশে ঘুরে ঘুরে হাট বসাতো। এখনো বসায়। এজন্যেও গ্রামের লোককে হেটো বলা হতে পারে। আর, সে নিজেও তো খালি হাঁটছে। তাই তার সাথে দেশের বেশির ভাগ লোকের মিল থাকাটা স্বাভাবিক বলেই লোকটা মনে করত। ছেলেবেলায় এই হাঁটা ব্যাপারটা কীভাবে তার ভালোলাগায় ঢুকে পড়েছিল, আজ সে মনে করতে পারে না। যখন সে তার গ্রামের খামারবাড়িতে থাকত, তখন খুব ভোরবেলা, চারটের সময়, রাস্তা দিয়ে মাথায় ভারি জিনিসপত্র নিয়ে অনেক লোকের হেঁটে যাবার শব্দ পেত লোকটা। তারা হেঁটে যাবার সময় মুখ দিয়ে একসাথে অদ্ভুত শব্দ করে যেত। এছাড়া রেলস্টেশনেও সে অনেক লোককে হেঁটে যেতে দেখত। যে জায়গাটা ছিল অস্বাভাবিক নিচু আর পুরোটাই ঘাসে ঢাকা। সন্ধ্যে সেখানে নামতো খুব ইনোসেন্ট ভাবে আর ঝপ্ ক’রে।



তার খামারবাড়ির সামনে বালি-বজরি-নুড়ি-সুড়কির উঁচু উঁচু অনেক ঢিপি থাকত। তার চোখের দৃষ্টিরেখা থেকে এতটাই উঁচু ছিল সেই ঢিপিগুলো যে, সেগুলো ছিল তার কাছে বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন পাহাড়। এই পাহাড়গুলোর পায়ের কাছে লোকটা একা, নিজের মনে ঘুরে বেড়াত। কোনোটা টুকটুকে লাল। কোনোটা কালো। কোনোটা ছাই রং। দেখতে দেখতে কি ক’রে যেন পাহাড়গুলো লোকটার বন্ধু হয়ে গেল। ওদের আশেপাশে, গা ঘেঁষে, লোকটা তৈরি করতে থাকল কত্ত গল্প। কোনো পাহাড়ের নিচে গুপ্তধন। তো, কোনোটায় ভয়ংকর ডাকাত। সে সব এক বিকেল গেছে লোকটার। পড়শি কিম্বা বাড়ির বড়রা, কেউ টেরও পেত না, রোজ তাদের সামনেই কত কি ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির পেছনে, ফাঁকা মাঠে, সে স্বপ্ন দেখত একটা বেঁটে ঘোড়া নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর। তার খুউউব মনে পড়ে, শীতকালের সকালের রোদে সে তার ঘোড়ার বাদামি চামড়ায় মনে মনে হাত বুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোত। অনেকদিন আগে, সে তার বাবার সাথে কি একটা বিরাট মাঠে গিয়ে সেরকম একটা ঘোড়ায় চড়েছিল। হাশমি নামের একটা ছেলে ছিল ঐ ঘোড়াটার মালিক। তার কাছ থেকেই ওই ঘোড়াটা কিনে নেবার কথা সে ভাবত। আর বিকেল থেকে রাত, লোকটা তার নানা রঙের পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। গুপ্তধন খুঁজত। তখন সারাদিনের মধ্যে এটুকু সময়েই সে অনেকক্ষন হাঁটতো। পরে হাশমির সাথে আর দেখা না হওয়ায়, সে তার ঘোড়াটা বেচবে কিনা আর জিগ্যেস করা হয়নি। তাছাড়া হাশমির মুখটাও তার মনে ছিল না। ফলে লোকটার আর ঘোড়া কেনা হয়ে ওঠেনি। সম্ভবত, এরপর থেকেই সে হাঁটায় মন দেয়। হয়তো ঘোড়া না পাওয়ার দুঃখটাই তাকে হাঁটার নেশা দিল। তার পাহাড়ের রংগুলোকে সে তার হাঁটায় ঢোকালো। আর হেঁটে যেতে লাগলো। তার বিচিত্র হাঁটার সময়ে, সে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিল যখন একবার সে দেখল, সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সেদিনই সে বুঝতে পারলো, তার হাঁটার পরিবর্তনের সবটাই তার নিজের ইচ্ছেয় হয় না। তা’ অনেকটাই তার চারপাশের নানান জিনিস ও ঘটনাগুলোর পরিবর্তনের সাথে বা প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়। কেননা, খুঁড়িয়ে হাঁটতে তো সে কোনোদিনই চায়নি। তাই তার হাঁটার এই বদলগুলোকে লোকটা দিনরাত্রির মতোই মেনে নিয়েছিল।

যখন খুব মন খারাপ হতো, তখন লোকটা তার ছেড়ে যাওয়া সঙ্গীদের কথা ভাবত। যারা সম্ভবত তার ঘন ঘন হাঁটা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তাদের সবাইকে যে লোকটা ধ’রে এনে তার হাঁটার সঙ্গী করেছিল এমনটা নয়। অনেকে নিজে থেকেই তার সঙ্গ নিয়েছিল। তারা হয়তো লোকটার রঙীন রঙীন হাঁটাকে দেখে, সে-সবের আকর্ষণে এসেছিল। যদিও, তাদের মধ্যে অনেককেই লোকটা তার হাঁটার সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল। তবে, তারা প্রায় সবাই-ই লোকটার হাঁটায় নানারঙের টানেই এসেছিল, এটা হয়তো ঠিক। তারা হয়্তো ভেবেছিল, এই লোকটার সঙ্গে হাঁটলে নিজেদের হাঁটাতেও অনেক রং পাওয়া যাবে। কিন্তু লোকটা যেহেতু তার হাঁটাকে ক্রমাগত আরও রঙীন করার জন্য ভাবনার জাল ফেলছিল এবং যার ফলে সে বিড়বিড় করতে করতে হাঁটতো; তাই ঘরে তো নয়ই, এমনকি গাইনোর চেম্বার থেকে গয়নার দোকান, তার সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলা যায় না। সম্ভবত এই ব্যাপারে তারা একঘেয়ে হয়ে, আশাহত হয়ে চলে যায় বলে লোকটা মনে করে। তবু, মন খারাপের অনেকটা সময়ই লোকটা তাদের নিয়ে ভাবে।

লোকটার মনে পড়ে, তার সঙ্গীরা যখন তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একঘেয়ে, ক্লান্ত ও বিরক্ত হতো, তখন সে তার হাঁটায় বৈচিত্র্য আনার জন্য মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করত। যেটা সে শুনেছিল ছেলেবেলায়, গ্রামের খামারবাড়িতে থাকার সময়। কখনো সে তার স্বপ্নের কথা শোনাত। কখনো আবার রঙীন পাহাড়ের গুপ্তধনের লোভও দেখাত। কিন্তু, এসবের কোনোটাতেই কোনো কাজ হয়নি। কেননা, ঐ সময় তার সঙ্গীদের কেউই এরকম কোনো স্বপ্ন বা গুপ্তধনের হদিস নিয়ে ভাবেনি। তখন তারা সময় কাটাচ্ছিল মাঠে ফুটবল ম্যাচ দেখে, কিম্বা মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য ক’রে। তাছাড়া, লোকটা যখন রঙীন পাহাড়ে গুপ্তধনের কথা ভাবছিল, ভাবছিল হাশমির ঘোড়ায় চেপে মাঠে ঘুরে বেড়াবার কথা, তখন তার সঙ্গীদের কেউ তাকে চিনতও না। তাই লোকটার কথায় ওরা কেউ বিশ্বাসই করেনি। তবুও লোকটা, তার মন খারাপ হলে, বেশির ভাগ সময়েই তার পুরনো সঙ্গীদের নিয়ে ভাবত।

এইভাবে একদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে সে যখন দেখল স্থিতাবস্থা ভেঙে তার হাঁটায় আবার পরিবর্তন এসেছে, তখন সে বদলটাকে বোঝার চেষ্টা করল। পরিবর্তনটা ঠিক কোন্‌ জায়গায় হয়েছে, এটা ভাবতে ভাবতে যখন সে হাঁটছিল, সে খেয়াল করল তার ডান পায়ের নিচের দিকে, পেছনে, একটা সুড়সুড়ি লাগছে। কি হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য লোকটা সেই জায়গায় হাত দিতে, তার হাতেও একই সুড়সুড়ি লাগলো। তার হাঁটার এতদিনের পর্বে এর’ম অভিজ্ঞতা তার কক্ষনো হয়নি। একটা ঝালর যেন ঝুলছে! কোমরের নিচ থেকে! ব্যাপারটা বুঝতে লোকটা নিচু হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল জিনিসটা কি! এবারে সে একই সাথে একটা জিনিস দেখতে ও আরেকটা জিনিস শুনতে পেল। সে দেখল, তার পেছন দিক থেকে একটা অনেক লোমযুক্ত লম্বা লেজ গজিয়েছে, ও তার হাঁটায় একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে এখন। অদ্ভুত, দারুণ, ছন্দ লাগানো, বুনো গন্ধের নেশার শব্দ সেটা…….





ছবি : ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

২টি মন্তব্য: