অথ হনুমান কথা
[ চরিত্র : হরিসাধনবাবু –
বয়স ৮২ বছর, অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক, বিপত্নীক, একা থাকেন। নির্মলবাবু – বয়স ৭০ বছর,
হরিসাধনবাবুর প্রতিবেশি। নিত্য – বয়স ৪০ বছর, হরিসাধনবাবুর প্রাক্তন ছাত্র,
একটি হোটেলের মালিক। বল্টু – বয়স ১৮ বছর, নিত্যর হোটেলের কর্মচারী। বাবলু
– বয়স ৪৫ বছর, হরিসাধনবাবুর একমাত্র পুত্র, চাকুরি সূত্রে বাইরে থাকে।]
{রাত প্রায় শেষ হয়ে গেছে। একটা দুটো পাখি সবে ডাকা শুরু করেছে। অল্প আলোয়
দেখা যাচ্ছে একজন বৃদ্ধ শরীরের অর্ধেক চাদর ঢাকা দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। মাথার কাছে একটি ছোট্ট টেবিল, তাতে একটা জলের বোতল ও একটা গ্লাস রাখা আছে। খাটের
নিচে একজোড়া হাওয়াই চটি।
বৃদ্ধ প্রথমে একটু নড়ে উঠলেন, তারপর চিৎ হলেন। পরে আস্তে আস্তে উঠে বসে
হাই তুললেন। একটু পরে চটি পড়ে লাঠি হাতে
উঠে দাঁড়া্লেন এবং ভেতরের দিকে গেলেন।
ইতিমধ্যে মঞ্চ আলোকিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দেওয়ালে মালা পরানো এক মহিলার
ছবি। একটি টেবিলে বইপত্র রাখা আছে। খান তিনেক প্লাস্টিকের সুন্দর চেয়ার। একটু পরেই সেই বৃদ্ধ মঞ্চে ফিরে এলেন। এই সময় কলিংবেল
বেজে উঠলো। বৃদ্ধ দরজা খুলে দুটি সংবাদপত্র নিয়ে ফেরত এলেন। তাঁর মোবাইল বাজতে
শুরু করলো।}
হরিসাধনবাবু – (মোবাইল কানে চেপে ধরে)
হ্যাঁ নিত্য, বল্! হ্যাঁ উঠেছি, তবে ঘুম থেকে নয়, বিছানা থেকে। ঘুম থেকে শেষবার
উঠেছি (একটু হিসেব করে) গত ২১শে ডিসেম্বর। মনে হয় ওটা আমার ‘পেন আল্টিমেট’ ঘুম
ছিল। শোন্ তাড়াতাড়ি চা পাঠিয়ে দিস। মিষ্টি কম দিবি।
(হরিসাধনবাবু ফোন রেখে একটা খবরের কাগজ পড়া শুরু করলেন। আবার কলিং বেলের
আওয়াজ হলো। খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন--)
হরিসাধনবাবু – দরজা খোলা আছে বাঁটুল।
(চা ও বিস্কুট নিয়ে বল্টুর প্রবেশ। বল্টু টেবিলে চা ও বিস্কুট নামিয়ে
রাখে।)
হরিসাধনবাবু – কী রে বাঁটুল, চায়ে
ভালো করে চিনি দিয়েছিস তো?
বল্টু – আমার নাম বাঁটুল নয়,
বল্টু। তোমার না দাদু আজকাল কিছু মনে থাকে না। কালকে ডাকলে ফটিক বলে, তার আগে
একদিন ডেকেছো...
হরিসাধনবাবু – (বাধা দিয়ে) তোকে
কে বললো, আমার মনে থাকে না! সব মনে থাকে। শোন্ প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি মানুষ বদলে
যাচ্ছে, তুই তার খোঁজ রাখিস? আর আমি যদি দিনান্তে তোর নাম একবার পাল্টাই, তাতে
মহাভারত অশুদ্ধ হবে না, বুঝলি!
বল্টু – তাই বলে তুমি আমাকে
বাঁটুল বলে ডাকবে? আমি কি বেঁটে?
হরিসাধনবাবু – (হেসে) আরে গাধা, আমি
তোকে বাঁটুল বলে ডাকলাম যাতে তুই চা আর বিস্কুট বাঁদিকে টুলের ওপর রাখিস।
বল্টু – বা রে বা! একটা কিছু
বানিয়ে বললেই হলো? আচ্ছা, সেদিন আমাকে ফটিক বলে কেন ডেকেছিলে?
হরিসাধনবাবু – শুনবি কেন ডেকেছিলাম?
আগের দিন রাতে তুই আমাকে খাবার জল দিয়ে যেতে ভুলে গেছিলি। ভোরবেলায় জল তেষ্টায় গলা
শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল। উঠে দেখি একফোঁটা জল নেই। আমার মন তখন চাতক পাখির মতো ‘ফটিক
জল’ ‘ফটিক জল’ করছে। ঠিক সেই সময় তুই
জল নিয়ে ঢুকলি আর আমি তোকে ফটিক বলে ডাকলাম। কিছু বুঝলি? (চা খেতে খেতে) তবে
তোর বল্টু নামটা একদম ‘পারফেক্ট’ হয়েছে। নিত্য হলো গিয়ে ‘নাট’ আর তুই হলি তার
‘বল্টু’। নিত্য তোকে সারাদিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘টাইট’ দিচ্ছে।
বল্টু – (দু’কান ঢেকে, চোখ বুজে)
উঃ তোমার সঙ্গে না দাদু কথা বলে কেউ পারবে না! আমি যাচ্ছি, দেরি হলে ছোড়দা ‘টাইট’
দেবে।
(হরিসাধনবাবু চা শেষ করেন)
হরিসাধনবাবু – হ্যাঁ ঠিক আছে, যা। ও
ভালো কথা শোন্, নিত্যকে বলবি আমি ওকে সন্ধ্যেবেলা একবার ডেকেছি। দরকার আছে। দুপুরবেলায়
আমার জন্য শুধু ডাল ভাত আলুসেদ্ধ আর পটলভাজা দিতে বলবি। আমার অত মাছ ডিম খাবার
টাকা নেই। সব জিনিসের দাম বাড়ছে, কিন্তু ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের সুদ তো আর বাড়ছে
না!
বল্টু – আমি অতশত জানি না। আমাকে
বলতে বললে, আমি বলে দেব। এরপর কী পাঠাবে না পাঠাবে, ছোড়দার মর্জি।
হরিসাধনবাবু – (ক্ষেপে গিয়ে) কী বললি,
নেত্যর মর্জি! শোন্, ওকে বলবি, আমার কথা
না শুনলে ওর পিঠে আমি বেত ভাঙবো, বুঝলি! (হাঁপাতে হাঁপাতে) গাধা, রামছাগল কোথাকার!
(বল্টুর দ্রুত প্রস্থান)(নির্মলবাবুর প্রবেশ)
নির্মলবাবু – কী হলো সাধনদা! তুমি
বল্টুর ওপর সকাল সকাল এত ক্ষেপে গেলে কেন?
হরিসাধনবাবু – নির্মল! আয় আয় বোস্।
(হাসতে হাসতে) আরে না না, বল্টুর ওপর রাগ করিনি।
নির্মলবাবু – রাগ করনি? তাহলে ওকে যে
গাধা রামছাগল বলছিলে!
হরিসাধনবাবু – আরে নেত্যটা হচ্ছে একটা
আস্ত পাঁঠা। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো! ওর বাপকে অনেকদিন আগেই বলেছিলাম, “দেখ্,
নিত্যর পড়াশোনা হবে না। ওকে বরং মোড়ের
মাথায় একটা দোকান-টোকান করে দে”। তার উত্তরে শম্ভু দাঁত বের করে বলেছিল, “না মাস্টারমশাই, আপনার হাতে যখন
দিয়েছি, তখন ও ঠিক মানুষ হবে”। আমি বলেছিলাম, “আমার হাতে পড়লেই মানুষ হবে? তাহলে
তুই হলি না কেন?”
নির্মলবাবু – হাঃ হাঃ হাঃ! সত্যি সাধনদা,
তুমি পারোও বটে মস্করা করতে! তোমার শরীর
এত খারাপ, তার মধ্যেও তুমি এমন খোশ মেজাজে থাকো কী করে বলো তো!
হরিসাধনবাবু – দেখ্ নির্মল,
খোস হচ্ছে এক ধরনের চর্মরোগ। ওষুধ দিলে সারে, কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতে আবার হয়।
বড্ড নাছোড়বান্দা। এই খোশ মেজাজটাও এক ধরনের নাছোড়বান্দা রোগ, বুঝলি! এটাকে তুই
মর্মরোগ বলতেও পারিস।
নির্মলবাবু – কী বললে,
মর্মরোগ? হাঃ হাঃ হাঃ! এক্সেলেন্ট,
এক্সেলেন্ট!
হরিসাধনবাবু – থাকগে ওসব কথা, আসল কথা
শোন্।
নির্মলবাবু – কি ব্যাপার, খুব জরুরি কথা মনে হচ্ছে?
হরিসাধনবাবু – (একটু চুপ করে থেকে) কাল
সকালের ট্রেনে বাবলু আসছে।
নির্মলবাবু – একা, না বউমা, নাতি সবাই?
হরিসাধনবাবু – না না, বাবলু একাই আসছে।
বউমা-নাতি আসতে পারছে না। নাতির ফাইন্যাল
পরীক্ষা আসছে সপ্তাহ থেকে শুরু হবে।
নির্মলবাবু – দেখ সাধনদা, তুমি জেদ কোরো
না, বাবলু বেশি চাপাচাপি করলে রাজি হয়ে যেও।
হরিসাধনবাবু – দেখ নির্মল, ছেলের কাছে
গিয়ে থাকলে ওর পক্ষে আমাকে দেখাশোনা করার সুবিধে হবে ঠিকই, কিন্তু আমার সমস্যা
বাড়বে বই কমবে না।
নির্মলবাবু – তোমার সমস্যা বাড়বে কেন,
বুঝতে পারছি না।
হরিসাধনবাবু – বুঝতে পারছিস না? শোন্
পাশের ঘরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস কর, ‘কেমন
আছ?’ কী উত্তর দেয় আমাকে এসে বল্।
নির্মলবাবু – (হেসে) কী যে বলো না
সাধনদা! আমার আর তোমার সমস্যা কি এক হলো?
হরিসাধনবাবু – দেখ্ নির্মল, যে ভাবেই থাক
না কেন, কিছু না কিছু সমস্যা থাকবেই। এই দুনিয়াতে বুঝলি কারোর সঙ্গে কারোর মতের
মিল হয় না। তাই হয় সঙ্ঘাত হয়, নয় অ্যডজাস্টমেন্ট। এখন এই বয়সে এই দুটোর একটাও আমার
পোষাবে না।
নির্মলবাবু – ও কথা বোলো না, আমি বাবলু ও
মনিকা দুজনকেই খুব ভালো করে চিনি। ওদের সম্বন্ধে এসব অজুহাত একেবারেই খাটে
না।
হরিসাধনবাবু – তুই হয়তো ঠিকই বলছিস
নির্মল, কিন্তু আমি তো নিজেকে চিনি, আমার সব সময় মনে হবে আমার জন্য ওদের অসুবিধে
হচ্ছে, ওদের অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হচ্ছে। এইসব ভেবে আমি খুবই আড়ষ্ট হয়ে থাকব, আর
আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। তাই অনেক ভেবে দেখলাম, এই একাই বেশ ভালো আছি।
নির্মলবাবু – কী যে বল সাধনদা, এই বয়সে
কি এভাবে একা একা থাকা যায়!
হরিসাধনবাবু – খুব থাকা যায়। এই তো দিব্যি
আছি। পরে দেখা যাবে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
নির্মলবাবু – (ঘড়ি দেখে) সর্বনাশ, সাড়ে
ন’টা বাজে! আজ বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরলে যা মুখ ঝামটা খাব না!
হরিসাধনবাবু – সে তোকে মুখ ঝামটা দিলে তোর
কিচ্ছু যাবে আসবে না, ও তোর অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা
হচ্ছে, সেইসঙ্গে আমাকেও গালমন্দ করতে ছাড়বে না।
বলবে, ঐ বুড়োটা হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া।
নির্মলবাবু – ওরে বাবা, তোমার নাম
কিচ্ছুটি বলবে না! তখন বটঠাকুর দেবতুল্য লোক। চলি সাধনদা। বাবলু চাপাচাপি করলে
তুমি কিন্তু আর বেশি ঝামেলা কোরো না, বুঝলে!
(নির্মলের প্রস্থান)
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
{বিকেল পাঁচটা। কলিংবেলের আওয়াজ।}
হরিসাধনবাবু – দরজা খোলা আছে।
(নিত্যর প্রবেশ)
নিত্য – স্যার, ডেকেছিলেন?
হরিসাধনবাবু – হ্যাঁ, এদিকে শোন্, বোস্।
(নিত্য দু’পা এগিয়ে এসে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে
চেয়ারের পেছনে দাঁড়ায়)
হরিসাধনবাবু – কী হলো, বসতে বললাম না!
(নিত্য চেয়ারটা পেছনে টেনে একটু দূরত্ব বজায়
রেখে বসে)
হরিসাধনবাবু – (নিত্যর দিকে দু’চার
মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন। নিত্য চোখ নামায়।) তুই নিজেকে ভেবেছিস কি, খুব মাতব্বর
হয়েছিস?
নিত্য – কেন স্যার, আমি কি করেছি
স্যার?
হরিসাধনবাবু – কি করেছি মানে? আবার মুখে
মুখে কথা বলছিস?
নিত্য – মুখে মুখে কোথায় কথা বললাম?
ভুলটা কি হলো...
হরিসাধনবাবু – ন্যাকামি করছিস? সারা জীবন
কত ছেলেমেয়ে মানুষ করলাম, শুধু তোর কাছে আমি হেরে গেলাম, বুঝলি? আমি পই পই করে
বললাম, দুপুরে ডাল ভাত আলুসেদ্ধ আর পটলভাজা পাঠাতে, তবু তুই মাছ দিয়েছিস কেন?
নিত্য – বাজারে আজ ভালো পারশে মাছ উঠেছিল, বাবা বলল, তোর স্যার পারশে মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। তাই পাঠিয়েছি।
হরিসাধনবাবু – ও, বুঝতে পেরেছি। বাবলুর
সঙ্গে মিলে তলে তলে সাঁট করেছিস? বাড়তি পয়সা বাবলু দেবে? আর সেই জন্যই আমার মাসের
খাওয়ার বিল একই আছে, তাই না? তোকে কেন আমি নিত্য থেকে ‘নাট’ করেছি, বুঝতে পারছিস?
তুই হচ্ছিস আসল নাটের গুরু।
নিত্য – (অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে
থেকে) স্যার, একটা কথা বলব?
হরিসাধনবাবু – বল্।
নিত্য – স্যার, আপনিও তো সারা জীবন
মান্তুকে পড়িয়েছেন। ওর কাছ থেকে কি পয়সা নিয়েছেন? শুধু মান্তু কেন, আপনি কত
ছাত্রের যে কত উপকার করেছেন, সেকথা আপনি নিজের মুখে না বললে কী হবে, সবাই জানে।
এসব আপনি কেন করেছেন? স্যার, আপনি তো বলতেন সব কিছু পয়সা দিয়ে মাপা যায় না।
হরিসাধনবাবু – শোন্ বেশি মাতব্বরি করবি
না। না বুঝে শুধু পড়া মুখস্ত করে তত দূরই মানুষ পাশ করতে পারে, যতদূর তুই করেছিস।
এর বেশি পড়তে গেলে পড়া বুঝতে হয়, বুঝলি? শোন্ কাউকে তখনই সাহায্য করতে হয়, যখন সে
সাহায্যপ্রার্থী। গায়ে পড়ে কাউকে সাহায্য করতে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাকে যেচে অপমান করা, বুঝলি? কাউকে সাহায্য করতে যাওয়ার
আগে এই কথাটা মনে রাখবি।
নিত্য – কি সাহায্য করলাম, তাই তো
বুঝতে পারছি না। আপনি সারা জীবন মাছ ডিম দুধ খেয়ে এসেছেন। এখন হঠাৎ কেন একে একে সব
ছেড়ে দিচ্ছেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ডাক্তারবাবুকেও জিজ্ঞেস করেছি, উনি বললেন,
কই আমি তো মানা করিনি!
হরিসাধনবাবু – তুই সুধাংশু ডাক্তারের
কাছেও গিয়েছিলি? তোর আস্পর্দ্ধা তো কম নয়! সুধাংশু কি আমার গার্জেন যে, ওর কথা
আমাকে মেনে চলতে হবে?
নিত্য – (চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে) ঠিক
আছে, আমি যাচ্ছি। বাবলুদাও কালকে আসছে, দেখি বাবলুদা কী বলে!
হরিসাধনবাবু – (রেগে গিয়ে) তুই আমাকে
বাবলুর ভয় দেখাচ্ছিস? গাধা কোথাকার, দূর হ আমার সামনে থেকে!
(নিত্যর প্রস্থান)
(তৃতীয় দৃশ্য)
{পরদিন সকাল। হরিসাধনবাবু খবরের কাগজ পড়ছেন।
চায়ের খালি কাপ টেবিলের ওপর। হরিসাধনবাবু
মোবাইলে সময় দেখলেন, তারপর নিত্যকে ফোন করলেন।}
হরিসাধনবাবু – নিত্য, বাবলুর ট্রেন ক’টায়
রে? ও ট্রেন এসে গেছে? ও এখন রাস্তায়? আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই তাহলে দু’কাপ চা
পাঠিয়ে দিস। জলখাবারে বাবলুকে লুচি-তরকারি
দিবি। আর আমাকে রুটি দিবি, রোজ যেমন দিস।(বাইরে গাড়ির আওয়াজ) ঐ বাবলু এসে গেছে
বোধহয়, রাখছি।
(কলিংবেলের আওয়াজ। সাধনবাবু দরজা খোলেন। বাবলু
ঘরে ঢোকে। ব্যাগটা ঘরের পেছন দিকে রাখে, তারপর বাবাকে ভালো করে দেখে।)
হরিসাধনবাবু – (হেসে) কী দেখছিস? ছ’মাস
আগে যেমন দেখেছিলি, এখনো তেমনই আছি। শরীর কিছু খারাপ হয়নি। আগে বল, বউমা দাদুভাই
কেমন আছে?
বাবলু – এমনিতে তো খারাপ নেই, শুধু
দিনরাত তোমাকে নিয়ে প্যান পান করে।
হরিসাধনবাবু – কেন, আমাকে নিয়ে প্যান
প্যান কেন? আমি তো দিব্যি ভালো আছি। আমার শরীর একদম ‘ফিট’।
বাবলু – তোমার শরীর ভালো আছে না
খারাপ আছে, সে সব আমি জানি। আরে বাবা, আমাকে লুকিয়ে কী হবে, তোমার খবর পাওয়ার তো
কোনো অসুবিধে নেই।
হরিসাধনবাবু – জানি জানি, নিত্য আমার
শরীরের সব খবর রঙ চড়িয়ে তোকে পাঠায়।
বাবলু – শুধু নিত্য কেন, নিত্যর
বাবা শম্ভুকাকুর কাছে খবর পাই, নির্মলকাকুর কাছেও খবর পাই। ওনারা কেউই রঙ চড়িয়ে
বলার লোক নন। বরং আমি বলব, তুমি আমার কাছে
গোপন কর।
হরিসাধনবাবু – আমি গোপন করেছি? কী গোপন
করেছি?
বাবলু – কেন, গোপন করনি? এই যে
সকালে তুমি রুটি-তরকারি আর তার সঙ্গে দুধ
কলা ও ডিমসেদ্ধ খেতে, দুপুরে ভাতের সঙ্গে মাছ খেতে, এখন তো সব বন্ধ করে দিয়েছ। এসব
খবর কি তুমি আমাকে জানিয়েছ?
হরিসাধনবাবু – তুই তো আচ্ছা উজবুক! আমার
এখন বিরাশি বছর বয়স। জোয়ান ছেলের মতো এখন
খেতে পারি কখনও? না, খাওয়া উচিত? আমি যা খেলে আর যতটুকু খেলে সুস্থ থাকব, ততটুকুই
তো খাব, না কি?
বাবলু – দেখ বাবা, ডাক্তার
দত্ত যদি তোমাকে কম খেতে বলতো, তাহলে এক কথা; কিন্তু সে তো তোমাকে কম খেতে বা মাছ
ডিম ফল দুধ খাওয়া বন্ধ করতে বলেনি। তাই
তোমার যুক্তি আমি মানতে পারছি না।
হরিসাধনবাবু – (একটু রেগে গিয়ে) ডাক্তার
কি আমার গার্জিয়ান নাকি? সে আমাকে যা বলবে তা আমাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে?
ও তো একটা আস্ত হনুমান।
বাবলু –
কেন? হনুমান কেন?
হরিসাধনবাবু – কেন হনুমান,
শুনবি? প্রত্যেক বছর শীতের শুরুতে আমার একটু ঠান্ডা-ফান্ডা লাগে। তারপর ওষুধ খেলে
সেরে যায়। ও এবার আমাকে কি বলেছে জানিস?
বাবলু – কি?
হরিসাধনবাবু – বলেছে, কাকু এইবারের শীতে
আপনি প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় দু’চামচ করে ব্র্যান্ডি অবশ্যই খাবেন। আমি তো শুনে,
হাঁ!
বাবলু – (হেসে) হাঁ কেন, ঠিকই তো
বলেছে। এই বয়সে শরীর গরম রাখতে হলে যা দরকার তাই বলেছে।
হরিসাধনবাবু – তার মানে আমাকে এখন লাঠি
ঠুক ঠুক করতে করতে মদের দোকানে লাইন দিতে হবে? তুই তো দেখছি একটা রামছাগল!
বাবলু – আচ্ছা মুশকিল, তুমি কেন
যাবে? তুমি নিত্যকে বলবে, ও বল্টুকে দিয়ে আনিয়ে দেবে।
হরিসাধনবাবু – ওয়ান্ডারফুল! আমি নিত্যকে
বলব আমার জন্য মদ নিয়ে আসতে! শেষ বয়সে এটাই বাকি ছিল! শোন্, আমি বড় জোর আর বছর
দুই বাঁচব। ব্র্যান্ডি খেলেও আমি অমর হব না। হয়তো এক বছর বেশি বাঁচব। কিন্তু
সেজন্য আমি নিত্যকে দিয়ে মদ আনাতে পারব না, কিংবা নিজে গিয়েও মদের দোকানে লাইন
লাগাতে পারব না।
বাবলু – ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে
কারোর কথা শুনতে হবে না। তুমি তোমার জেদ নিয়ে থাকো। কিন্তু শুনে রাখো, আমি তোমাকে
নিয়ে কাল বিকেলের ট্রেনে ফিরে যাব।
হরিসাধনবাবু – আচ্ছা মুশকিল, আমাকে নিয়ে
ফিরে যাবি কেন? আমি এখানে কোন্ অসুবিধায় আছি?
বাবলু – ওসব বলে আর লাভ নেই। তোমার
যেমন জেদ আছে, আমারও জেদ আছে। দেখি কে জেতে!
হরিসাধনবাবু – কেন, আমার আবার কিসের জেদ
দেখলি?
বাবলু – জেদ নয়? এই যে তুমি এটা
খাবে না ওটা খাবে না -- এসব বায়না ধরো, খাওয়া অর্ধেক করে শরীরটাকে একেবারে নষ্ট
করে ফেলেছো, এটা জেদ নয়?
হরিসাধনবাবু – ওঃ, সেই এক কথা...
বাবলু – (বাধা দিয়ে) শোনো বাবা,
তুমি যতই লুকোবার চেষ্টা কর, আমি জানি তুমি কেন খাওয়া কমিয়ে দিয়েছ।
হরিসাধনবাবু – (অবাক হয়ে) মানে, তুই কি
জানিস? কার কাছ থেকে জেনেছিস?
বাবলু – আমার কারোর কাছ থেকে জানার
দরকার পড়ে না। আমি যেমন তোমার ছেলে বলে তুমি আমাকে হাড়ে হাড়ে চেনো, তেমনি তুমি
আমার বাবা বলে আমিও তোমাকে খুব ভালো করে জানি।
হরিসাধনবাবু – খুব ভালো কথা।
এবার কী জানিস বল্ !
বাবলু – গত কয়েক বছরে জিনিসপত্রের
দাম অনেক বেড়ে গেছে। অথচ নিত্য তোমার কাছ থেকে কিছুতেই বেশি টাকা নেবে না। আর তাই
তুমি তোমার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছ।
হরিসাধনবাবু – (একটু চুপ করে থেকে) ঠিক
আছে, তারপর?
বাবলু – খুব সোজা। নিত্য তোমার কাছ
থেকে বেশি টাকা নেবে না, আমি দিতে চাইলেও নেবে না। আবার তুমিও তোমার খাওয়া কমিয়ে
দেবে। সুতরাং এই সমস্যার একটাই সমাধান...
হরিসাধনবাবু – কি?
বাবলু – তুমি আমার সঙ্গে যাবে,
ব্যাস!
হরিসাধনবাবু – আশ্চর্যের ব্যাপার! নিত্য
আমার কাছ থেকে কেন বেশি টাকা নেবে না, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
বাবলু – বাবা কিছু মনে কোরো না,
তুমি প্রতিটা ব্যাপার সব সময় তোমার নিজের দৃষ্টিকোণে বিচার কর। তারপর যে
সিদ্ধান্তে পৌঁছাও, সেটাতেই জেদ ধরে বসে থাকো। মা যতদিন ছিল, ততদিন তুমি যা হোক
তবু একটু আধটু মায়ের কথা শুনে চলতে। এখন তো তোমার জেদ...
হরিসাধনবাবু – (বাধা দিয়ে) শুধু আমার নয়,
প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব যুক্তি, তর্ক, দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আমি তার ব্যতিক্রম নই।
আমার যুক্তি পরিষ্কার। জীবন থাকতে আমি কারও কোনো সাহায্য বা করুণার প্রত্যাশী হব
না, তাতে যা হবার হবে।
বাবলু – করুণার কথা কেন উঠছে!
কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তুমি কি আমারও সহায়তাটুকু নেবে না?
হরিসাধনবাবু – না, তোরও না।
বাবলু – ঠিক আছে, তাহলে এবার বল,
কোন্ যুক্তিতে তুমি আমাকে খাইয়ে পরিয়ে পড়াশোনা
করিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবনপাত করেছিলে!
হরিসাধনবাবু – খুবই সহজ ব্যাপার। এর কারণ
হচ্ছে, আমি তোর বাবা। আমার সব কিছুর বিনিময়ে তোকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা আমার সব
থেকে বড় কর্তব্য ছিল। তাই এটা আমাকে করতেই হয়েছে।
বাবলু – তোমার যুক্তি আমি মানি না।
হরিসাধনবাবু – মানিস না?
বাবলু – না, মানি না।
হরিসাধনবাবু – কেন?
বাবলু – কেননা, তোমার যুক্তি
সম্পূর্ণ ভুল।
হরিসাধনবাবু – বেশ তো, তোর যুক্তি বল!
বাবলু – দেখ বাবা, কোনো মানুষ
শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরে ছেলেমেয়ে মানুষ করে না। যদি তাই হতো, তাহলে তুমি আমার
জন্য শুধু প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করেই ক্ষান্ত হতে। ছোটবেলা থেকে বুকে ধরে আগলে রাখতে না।
সামান্য জ্বর হলে নার্ভাস হয়ে এই ডাক্তার সেই ডাক্তার করতে না। রাত জেগে মাথার
কাছে বসে থাকতে না। নিজেরা সাধারণ খাবার খেয়ে, সাধারণ পোশাক পরে, আমাকে ভালো ভালো
খাবার খাওয়াতে না, ভালো ভালো পোশাক পরাতে
না। এসব কেউ শুধুমাত্র কর্তব্যের টানে করে না।
হরিসাধনবাবু – তবে কিসের টানে করে?
বাবলু – কিসের টানে করে, সেটা তুমি
আমার থেকে অনেক ভালো জানো বাবা। ভবিষ্যতে সন্তান দেখবে, যদি সেই আশায়ও করতে,
তাহলেও তো তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকতে
অরাজী হতে না।
হরিসাধনবাবু – তবে কিসের জন্য করে?
ভালোবাসার টানে?
বাবলু – ঠিক বলেছ। সন্তানের প্রতি
অন্ধ ভালোবাসার টানে। এবং তার বিনিময়ে সে আর কিছুই প্রত্যাশা করে না, শুধু একটু
ভালোবাসা ছাড়া।
হরিসাধনবাবু – বেশ তাই যদি হয়, তাহলে আমার
কোনো কিছু প্রত্যাশা না করার মধ্যে ভুলটা কোথায়?
বাবলু – বাবা, এটা তো শুধু একটা
দিক, অন্য দিকটা দেখ!
হরিসাধনবাবু – অন্যদিক আবার কি?
বাবলু – তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা
থাকতে পারে, কর্তব্য থাকতে পারে; আর আমার তোমার প্রতি কোনো কর্তব্য, ভালোবাসা
কিচ্ছু থাকতে পারে না, তাই তো? কেননা আমি একটা অমানুষ, তাই?
হরিসাধনবাবু – বাবলু তুই আমার ওপর অহেতুক
রাগ করছিস। এই তর্কের শেষ হবে না। দেখ্ তোর কাছে গিয়ে থাকতে এমনিতে আমার কোনো
আপত্তি নেই। কিন্তু এই জায়গা, এই বাড়ি, এই
পরিচিত লোকজন – এত বছর ধরে থাকতে থাকতে এখানে আমার মন এমন ভাবে মিলেমিশে গেছে যে,
অন্য কোথাও গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে, আমি দু’দিনও থাকতে পারব বলে মনে হয় না। আর
তুই যে জন্য আমাকে তোর কাছে নিয়ে যেতে
চাইছিস, সেটাও তো কোনো ভাবে পূরণ হবে না, বরং তার উল্টোটাই হবে। এছাড়া দীর্ঘদিন
ধরে একা থাকতে থাকতে আমার একা থাকাটা একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। কারোও সঙ্গে
থাকাটা আমার পক্ষে মনে হয় আর সম্ভব হবে না। তুই কিছু মনে করিস না, আমি বাকি
দিনগুলো একাই থাকতে চাই, তোরা আমাকে এ ব্যাপারে জোর না করলেই আমি খুশি হব।
বাবলু – (একটু চুপ করে থেকে) ঠিক
আছে, বুঝলাম, কিছুতেই আমার কাছে গিয়ে তোমার তাহলে থাকা সম্ভব নয়!
(পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কথা বলে)
কে নিত্য? হ্যাঁ শোন, একটু আসবি? একটা জরুরি কথা আছে। ঠিক আছে পাঁচ
মিনিটের মধ্যে চলে আয়।
হরিসাধনবাবু – নিত্যকে ডেকে পাঠালি কেন?
কি ব্যাপার?
বাবলু – শোনো বাবা, নিত্যকে আমি
জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও কেন তোমার খাবারের দাম একই রেখেছে। তার উত্তরে নিত্য জানালো,
“আমি তো স্যারকে হোটেলের খাবার পাঠাই না, তাই দাম বাড়াবার কোনো প্রশ্নই নেই”। আমি
বললাম, “তাহলে তুই কোথা থেকে খাবার পাঠাস?” নিত্য বলল, “বাড়ি থেকে”। আমি বললাম,
“তার মানে!” ও বলল, “বাড়িতে আমাদের ঘরের সবার জন্য রান্না হয়, স্যারের জন্যও হয়।
ঘরের খাবারের কোনো দাম ধরা হয় নাকি?” আমি বললাম, “তাহলে মাসে মাসে বাবা যে তোকে
টাকা দেয়, সেটা তুই নিস কেন? উত্তরে নিত্য কি বলল জান?”
হরিসাধনবাবু – কি?
বাবলু – নিত্য বলল, “বাবা মাসে মাসে
পোস্ট অফিস থেকে সুদ বাবদ যে টাকা পায়, সেটা আমাকে দেয়, যাতে সংসার চালাতে আমার
একটু সুবিধে হয়। সেই রকম স্যারের টাকাও আমি নিই। সুদ তো আর বাড়ে না, তাই বাবাই বা
কোথা থেকে বেশি টাকা দেবে, আর স্যারই বা কোথা থেকে বেশি দেবে!” এখন তুমি বল, এর
উত্তরে আমি কি বলব?
(ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল। বাবলু দরজা খোলে।
নিত্য প্রবেশ করে।)
হরিসাধনবাবু – কিরে নিত্য! আয় বোস্।
(নিত্য দাঁড়িয়ে থাকে) কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোকে বসতে বললাম না!
(নিত্য সন্তর্পণে চেয়ারে বসে)
বাবলু – শোন্ নিত্য, আমার সঙ্গে
বাবার কথা হয়েছে।
নিত্য – তোমরা কি কালই চলে যাচ্ছ?
বাবলু – আমি কাল বিকেলের গাড়িতে চলে
যাব। কিন্তু বাবা এখানে তোর হেফাজতে যেমন
আছে, তেমনই থাকবে। তোর বাড়িতে যা রান্না হবে, বাবা তাই খাবে। মানে, তুই
সকাল-সন্ধ্যে যেমন বাবার কাছে গালাগাল খাচ্ছিলি, সেই রকমই খাবি আর কী!
হরিসাধনবাবু – (আস্তে আস্তে নিত্যর পাশে
গিয়ে দাঁড়িয়ে, ডান হাতটা নিত্যর মাথায় রেখে) বুঝলি বাবলু, নিত্যটাকে আমি বরাবর
রামছাগল বলেই জানতাম। কিন্তু ও যে কখন একটু একটু করে হনুমান হয়ে উঠেছে, তা বুঝতেই
পারিনি!
(বাবলু ও হরিসাধনবাবু হো হো করে হাসতে থাকে।
নিত্য স্যারকে প্রণাম করে।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন