শেষ অভিসার
সুবোধ ঘোষের ‘ভারত প্রেম কথা’ গ্রন্থের ‘পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা’ গল্পের নাট্য-রূপান্তর।
সুবোধ ঘোষ জন্ম শতবর্ষে(২০০৯), নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, জামশেদপুর শাখা
পরিবেশিত শ্রুতিনাটক।
নাট্যরূপ - সুকোমল ঘোষ
চরিত্র
।।সুশোভনা– মন্ডুকরাজ আয়ু’র কন্যা।।সুবিনীতা-রাজকুমারী
সুশোভনা’র সহচরী।। পরীক্ষিৎ-ইক্ষাকু রাজা ।।
(১)
সুশোভনা– দেখেছ সুবিনীতা, সামনের নীলবর্ণ নিবিড় কানন, উত্তপ্ত
আকাশের দুঃসহ আশ্রয় থেকে পালিয়ে এসে কেমন
ভূতলে ঠাঁই নিয়েছে। বলাকামালার চিহ্নহীন তপ্ত তাম্রের মতো আকাশ, এই সরোবর প্রান্তে
এসে তাপ বিকিরণ করে এই প্রাসাদকে কেমন
শীতলস্পর্শ সুখের আস্বাদ দিচ্ছে — ছায়ানিবিড়
লতাবাটিকার নিভৃতে কোমল পুষ্পদলপুঞ্জ সুস্নাত দেহের স্নিগ্ধ আলস্য সঁপে দিয়েছে
প্রাসাদের চারিদিকে, মনে হচ্ছে... কী হলো সুবিনীতা? তুমি কি আমার কথায় অমনযোগী
হচ্ছো?
সুবিনীতা- আমিও দেখছি
রাজকুমারী সুশোভনা, তবে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ নয়।
সুশোভনা– তাহলে কী দেখছো
সুবিনীতা?
সুবিনীতা- তোমার রূপ দেখছি রাজনন্দিনী--
সুশোভনা– আমার রূপ! কেমন
লাগছে দেখতে?
সুবিনীতা- সুন্দর।
সুশোভনা– কী রকম সুন্দর?
সুবিনীতা- রত্নখচিত অসিফলকের মতো উজ্জল; কনক ধুতুরার আসবের মতো বর্ণমদির, পুস্পাচ্ছাদিত
কন্টকতরুর মতো কোমল। বস্তুহীনা প্রতিধ্বনির মতো তুমি সুন্দরস্বরা। তুমি শ্রাবণী
দামিনীর মতো ক্ষণলাস্যনটী বহ্নি।
সুশোভনা– আশ্চর্য! তুমি ভাষাবিদগ্ধা চারণীর মতো কথা বলছ
সুবিনীতা, কিন্তু তোমার কথার অর্থ আমি
বুঝতে পারছি না।
সুবিনীতা-রূপাতিশালিনী
রাজতনয়া, তোমার রূপ বড় নিষ্ঠুর। এই রূপ মুগ্ধ পুরুষের
হৃদয় বিদ্ধ করে, বিবশ করে, আর বিক্ষত করে। তোমার কন্ঠস্বরের আহ্বান প্রতিধ্বনির
ছলনার মতো শ্রবয়িতার হৃদয় উদভ্রান্ত করে
শূন্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। তুমি চকিত স্ফুরিত তড়িল্লেখার মতো পথিকজন নয়ন শুধু অন্ধ করে দিয়ে সরে যাও। রূপের
কৈতবিনী তুমি। সবই আছে তোমার, শুধু হৃদয় নেই।
সুশোভনা– সুবিনীতা, তোমার অভিযোগ শুনে আমার ক্ষুব্ধ হওয়া
উচিত ছিল। কিন্তু আমি উল্লসিত হচ্ছি। (সহাস্যে)
তুমি ঠিকই বলেছ সুবিনীতা - আমি হৃদয়হীন--। শুনে সুখী হলাম।
সুবিনীতা- কিঙ্করীর বাচালতা ক্ষমা কর রাজকুমারী, একটি সত্য কথা বলব?
সুশোভনা– বলো--
সুবিনীতা- আমি দুঃখিত।
সুশোভনা– কেন?
সুবিনীতা- তোমার এই রূপরম্যা মূর্তিকে
রত্নাভরণে সাজাতে আর আমার আনন্দ হয়
না। মনে হয়, বৃথাই এতদিন ধরে তোমাকে এত যত্নে সাজিয়েছি।
সুশোভনা– বৃথা?
সুবিনীতা- হ্যাঁ, বৃথা। একের পর এক, তোমার
এক একটি প্রেমহীন অভিসারের লগ্নে তোমার পদতল বৃথাই লাক্ষাপঙ্কে রঞ্জিত করেছি। বৃথাই এত সমাদরে পরাগলিপ্ত করেছি
তোমার বরতনু। বৃথাই সুচারু কজ্জলসম মসিরেখায় প্রসাধিত করে তোমার এই নয়নদ্বয়ে
মৃগলোচন-দর্পহারিণী নিবিড়তা এনে দিয়েছি।
সুশোভনা– তোমার কর্তব্য করেছো
কিঙ্করী, কিন্তু বৃথা বলছ কোন দুঃসাহসে?
সুবিনীতা- দুঃসাহসে না, অনেক দুঃখে বলছি
রাজনন্দিনী। তুমি আজও কারও প্রেমবশ হলে না, কোন প্রণয়ি-হৃদয়ের সম্মান রাখলে না। আমার
দু’হাতের যত্নে সাজিয়ে দেওয়া তোমার
প্রেমিকা মূর্তি শুধু প্রণয়ীর হৃদয় বিদ্ধ বিক্ষত ও ছিন্ন করে ফিরে আসে। আমার বড় ভয়
করে রাজনন্দিনী!
সুশোভনা– ভয়, কিসের ভয়
কিঙ্করী?
সুবিনীতা- এক একটি ছল
প্রণয়ের লীলা সমাপ্ত করে যখন তুমি ভবনে ফিরে আস কুমারী, তখন আমি তোমার ঐ পদতলের
দিকে তাকিয়ে দেখি। মনে হয়, তোমার চরণাসক্ত অলক্ত যেন কোনো এক হতভাগ্য প্রেমিকের আহত হৃৎপিণ্ডের রক্তে আরও শোণিত হয়ে
ফিরে এসেছে।
সুশোভনা– (উচ্ছসিত হাসিতে) তোমার মনে ভয় হয় মূঢ়া কিঙ্করী, আর আমার
মনে হয়, নারীজীবন আমার ধন্য হলো। এক একজন মহাবল যশস্বী ও অতুল বৈভবগর্ভে উদ্ধত নরপতি এই পদতললীন
অলক্তে কমলগন্ধ বিধুর ভুজঙ্গের মতো চুম্বনদানের জন্য লুটিয়ে পড়ে, পরমুহূর্তে সেই উদভ্রান্তের জন্য শুধু শূন্যতার কুহক পিছনে
রেখে দিয়ে চিরকালের মতো সরে আসি। বল দেখি সহচরী, নারীজীবনে এর চেয়ে বেশি সার্থক
আনন্দ ও গর্ব কি আর কিছু আছে?
সুবিনীতা- ভুল। ভুল রাজতনয়া। এমন জীবন কোনো নারীর কাম্য হতে পারে
না।
সুশোভনা– ভুল! (দৃঢ়তার সঙ্গে) নারী জীবনের কাম্য কী?
সুবিনীতা- বধূ হওয়া।
সুশোভনা– (অট্টহাসি) (বিদ্রুপের স্বরে) বধূ হওয়া! বেশ...। বধূ হওয়ার অর্থ পুরুষের কিঙ্করী হওয়া। তুমি
কিঙ্করী হয়েও কেন সেই ক্ষুদ্র জীবনের দুঃখ কল্পনা করতে পার না? আমাকে মরণের পথে যাবার
উপদেশ দিও না কিঙ্করী।
সুবিনীতা- শোন শোন
কুমারী, আমার অনুরোধ শোনো — পুরুষ-হৃদয় সংহারের এই নিষ্ঠুর
ছলপ্রণয়বিলাস বর্জন কর। প্রেমিকের প্রিয়া হও, বধূ হও, গেহিনী হও।
সুশোভনা– (বিদ্রুপের স্বরে) কী করে প্রিয়া-বধূ-গেহিনী হতে হয়
কিঙ্করী? তার কি কোনো নিয়ম আছে?
সুবিনীতা- আছে।
সুশোভনা– কি?
সুবিনীতা- প্রেমিককে হৃদয় দান কর, প্রেমিকের কাছে সত্য হও।
সুশোভনা– (সহাস্যে) আমার জীবনে হৃদয় নামে কোনো বোঝা নেই সুবিনীতা।
যা নেই, তা কেমন করে দান করব বল।
সুবিনীতা- (ব্যথিত স্বরে)আর কিছু বলতে চাই না রাজনন্দিনী। মহারাজের
দিকে তাকিয়ে দেখেছ? কন্যা তার নারীধর্মবিদ্রোহিণী হয়েছে — এই দুঃখ তিনি ভুলতে পারছেন না।
সুশোভনা– আমি তো পিতাকে বলেইছি, যোগ্যজনের পরিণয়োৎসুক জীবনে সমর্পণের
আশায় আমি স্বয়ম্বরা হবো না। তোমার স্নেহপিঞ্জরের শারিকার জন্য নতুন বীতংস রচনা কোরো
না পিতা, আমি সহ্য করতে পারবো না।
সুবিনীতা- কৌতুকিনী
কন্যার গোপন মূঢ়তার কাহিনী লোকসমাজে নিশ্চয়ই চিরকাল আবিদিত থাকবে না, আজও কেন এই
অগৌরবের কাহিনী জনসমাজে অবিদিত তার রহস্য তো তোমাতে আমাতে সীমিত রাজকুমারী। তবু,
লোকাপবাদের আশঙ্কায় ম্রিয়মান হয়ে আছেন মন্ডুক রাজ আয়ু। রাজকুমারী, আমি শুধু প্রার্থনা
করি, তোমার জীবনে হৃদয়ের আবির্ভাব হোক।
সুশোভনা– (বিরক্তির সঙ্গে)
তাতে তোমার কী লাভ?
সুবিনীতা- কিঙ্করীর জীবনেরও একটি সাধ তা’হলে পূর্ণ হবে।
সুশোভনা– কিসের সাধ?
সুবিনীতা- তোমাকে
বধূবেশে সাজাবার সাধ। ঐ সুন্দর হাতে বরমাল্য ধরিয়ে দিয়ে তোমাকে দয়িতভবনে পাঠাবার শুভলগ্নে এই মূর্খা ব্যজনিকার আনন্দ,
শঙ্খধ্বনি হয়ে একদিন বেজে উঠবে।
সুশোভনা– তোমার এই অভিশপ্ত
আশা অবশ্যই ব্যর্থ হবে কিঙ্করী, তাই তোমাকে শাস্তি দিলাম না। নইলে তোমার ঐ ভয়ংকর
প্রার্থনার অপরাধে তোমাকে আজই চিরকালের মতো বিদায় করে দিতাম।
(কিছুক্ষণ স্তব্ধতা)
সুবিনীতা- যদি মনোকষ্টের কারণ
হয়ে থাকি, তবে ক্ষমা যাচনা করি রাজতনয়া।
(কিছুক্ষণ স্তব্ধতা)
(হঠাৎ সুশোভনাকে) কী হলো, রাজকুমারী? মৃগয়াজীবি ব্যধিনীর দৃষ্টি
নিবদ্ধ করে কানন পথে কী দেখছো?
সুশোভনা– অশ্বারূঢ় এক
কান্তিমান যুবা পুরুষ। তাঁর রত্নসমন্বিত কিরীট সূর্যকরনিকর স্পর্শে দ্যুতিময়। মনে হয়,
কোনো রাজ্যাধিপতি নরশ্রেষ্ঠ। বোধ হয় পথভ্রান্ত কিংবা পিপাসার্ত, শীতলসরসীসলিলের
সন্ধানে ধীরে ধীরে চলেছেন--
সুবিনীতা- ঐ আগন্তুকের পরিচয় তুমি জান কি
রাজকুমারী?
সুশোভনা– না, তবে অনুমান করতে
পারি--
সুবিনীতা- অনুমান করতে পার! কে উনি?
সুশোভনা– বোধহয় ইক্ষাকুগৌরব
সেই মহাবল পরীক্ষিৎ। শুনেছি আজ তিনি মৃগয়ায় বের হয়েছেন।
সুবিনীতা- (বিস্ময়ে-শ্রদ্ধায়
) ইক্ষাকুগৌরব পরীক্ষিৎ? অযোধ্যাপতি, পরম প্রজাবৎসল, মহাবদান্য, ভীতজনরক্ষক,
আর্তজনশরণ – সেই ইক্ষাকু?
সুশোভনা– (লাস্যময়ী, যেন শিকারকে সম্মোহিত করতে চায়) হ্যাঁ
কিঙ্করী, সুরেন্দ্রসম পরাক্রান্ত ইক্ষাকু কুলতিলক পরীক্ষিৎ। ধনুর্বাণ ও তূণীরে
সজ্জিত, কটিদেশে দীর্ঘ অসি, দৃপ্ত তুরঙ্গের পৃষ্ঠাসীন বীরোত্তম পরীক্ষিৎ। কিন্ত...
কিন্তু... তুমি মূর্খা, তুমি কিঙ্করী মাত্র, কল্পনাও করতে পারবে না তুমি, ঐ
ধনুর্বাণতূণীরে সজ্জিত পরাক্রান্তের পুরুষ-হৃদয় একটি কটাক্ষে চূর্ণ করতে কী আনন্দ হয়--
সুবিনীতা- (সন্ত্রস্ত)
নিবৃত্ত হও রাজতনয়া। তোমার মিথ্যা প্রণয়কৈতবে বহু ভগ্নহৃদয় নৃপতির জীবনের সব সুখ
মিথ্যা হয়ে গিয়েছে। অনেক করেছ, কিন্তু প্রজাপ্রিয় ইক্ষাকুর সর্বনাশ কোরো না।
সুশোভনা– বৃথা মূর্খের মতো বিষণ্ণ হয়ো না। কিঙ্করীর কর্তব্য
সদাহাস্যমুখে পালন কর - তা হলেই সুখী হবে।
আমি যাই সুবিনীতা। আর শোনো, প্রতি
সন্ধ্যায় ইক্ষাকুর প্রাসাদলগ্ন উপবনের প্রান্তে চর ও শিবিকা অতি সঙ্গোপনে প্রেরণ
করতে ভুলবে না। এ আমার আদেশ কিঙ্করী -- আমি যাচ্ছি।
(২)
পরীক্ষিৎ- আহা কী মনোরম
কানন, বহুলবল্কল প্রিয়াল আর শিবাদ্রুম বিল্বের ছায়ায় সমাকীর্ণ। লতা পরিবৃত শত শত নক্তমাল
কোবিদার ও শোভাঞ্জন। চন্ড নিদাঘের ভ্রুকুটি তুচ্ছ করে এই নিবিড় বনভূমির প্রতিটি তৃণলতা ও পুষ্পের প্রাণ যেন বিহগস্বরলহরী হতে
উৎসারিত নাদপীযূষ পান করে সরসিত হয়ে রয়েছে —
কী অপরূপ! শ্রমক্লম অপনোদন হেতু নববকুলপল্লবের ছায়াতলে তৃণাস্তীর্ণ ভূমিতে
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাক।
(রমণীকণ্ঠের
শ্রুতি রমণীয় সুস্বর, সঙ্গীতের সুর)
সুমধুর
সঙ্গীত? উৎস কোথায়? ওই তো সরোবর তটে উপবিষ্ঠা চন্দ্রোপলপ্রভাসমন্বিতা এক নারী। ও কি কোনো মানব
নন্দিনী? অথবা প্রমূর্তা বনশ্রী? ভদ্রে, তোমার করবীগ্রথিত চন্দ্রপলের রশ্মির চেয়েও
বেশি সান্দ্র ও স্নিগ্ধ ওই এণলোচনের রশ্মি -- ক্ষমা করো, তোমার আমার প্রতি অপাঙ্গে
নিরীক্ষণের অনুসরণে আমার এই উক্তি। পরিচয় দাও এণাক্ষী।
সুশোভনা– পরিচয় জানি না।
পরীক্ষিৎ- তোমার পিতা? মাতা? দেশ?
সুশোভনা– কিছুই জানি না।
পরীক্ষিৎ- বিশ্বাস করতে পারছি
না বিম্বোষ্ঠী। সপ্তকীমেখলা ঐ কৃশকটিতট, মুক্তাবলীশোভিত ঐ কণ্ঠদেশ, কুঙ্কুমাঙ্কিত
ঐ কোমল বক্ষঃপট, তোমার কবরীর ঐ চন্দ্রপল আর এই সপ্তস্বরা বিপঞ্চী -- এ কি
পরিচয়হীনতার পরিচয়?
সুশোভনা– আমার পরিচয় আমি। এ ছাড়া কোনো পরিচয় জানি না। কী দেখছেন গুণবান?
পরীক্ষিৎ- দেখছি তুমি বিস্ময় অথবা বিভ্রম!
সুশোভনা– আপনি কে?
পরীক্ষিৎ- আমি ইক্ষাকু পরীক্ষিৎ।
সুশোভনা– ও, এইবার যেতে পারেন
নৃপতি পরীক্ষিৎ। বনলালিতা এই পরিচয়হীনার
কাছে আপনার কোনও প্রয়োজন নেই।
পরীক্ষিৎ- কর্তব্য আছে --
সুশোভনা– কী কর্তব্য?
পরীক্ষিৎ- নৃপতির
সুখসুন্দর মণিময় ভবনে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, এই বনবাসিনীর জীবন তোমাকে শোভা দান করে না সুনয়না।
সুশোভনা– বুঝলাম, রাজার কর্তব্য পালন করতে চাইছেন মহাবদান্য প্রজাবৎসল
পরীক্ষিৎ। কিন্তু রাজকীয় উপকারে আমার কোনো সাধ নেই নৃপতি।
পরীক্ষিৎ- মণিময় ভবনে নয়, আমার মনোভব ভবনে এস সুতনুকা। প্রণয়
দানে ধন্য কর আমার জীবন।
সুশোভনা– বেশ, তবে একটি প্রতিশ্রুতি চাই নৃপতি পরীক্ষিৎ।
পরীক্ষিৎ- বল--
সুশোভনা– আপনি জীবনে কখনও আমাকে সরোবর সলিল দেখাবেন না।
পরীক্ষিৎ- কেন?
সুশোভনা– অভিশাপ আছে আমার জীবনে। যদি আর কোনোদিন সরোবর সলিলে প্রতিবিম্বিত আমার মূর্তিকে আমি দেখতে পাই,
তবে আমার মৃত্যু হবে সেই দিন।
পরীক্ষিৎ- অভিশাপের
শঙ্কা দূর কর সুযৌবনা, তুমি থাকবে আমার প্রমোদ ভবনের ক্ষান্তিহীন উৎসবের চিরক্ষণের
নায়িকা হয়ে। কোনো সরোবরের সান্নিধ্যে
যাবার প্রয়োজন হবে না কোনোদিন। সন্নিধানে এস সুদর্শনা, গমনোদ্যত হই।
(৩)
পরীক্ষিৎ- কাননবালা,
বনশ্রী, আমার মনে আশঙ্কা ছিল পরিচয়হীনা মুক্ত বিহঙ্গ এই প্রমোদভবনের পরিবেশে
সুমধুর সঙ্গীত হয়তো বিস্মৃত হতে পারে — আমি
তৃপ্ত । তোমার সুমধুর গীত, ছন্দোময় মঞ্জীরনিক্কনে নৃত্য, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের
সান্নিধ্য - আমাকে বিহ্বল করে রাখে।
সুশোভনা– এতো যে কোনো
নৃত্য-গীত পটিয়সী নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
পরীক্ষিৎ- না ললিতে, এ
আমার অনুভূতি। তোমার হৃদয়ের স্পন্দন আমার হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টি করে — এ, যে কোনো নারীর পক্ষে অসম্ভব।
সুশোভনা– (চটুল
ভঙ্গীতে) আমার হৃদয়ের স্পন্দন! রাজা, আপনি কি নিশ্চিত?
পরীক্ষিৎ- হ্যাঁ
প্রিয়তমা। সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে যখন পূর্ণেন্দুশোভিত আকাশ হতে কুন্দধবল কৌমুদী
কণিকা এসে লুটিয়ে পড়ে প্রমোদভবনের অঙ্গনে,
সেই শান্ত জ্যোৎস্নালোকে তোমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের প্রাক্কালে আমি নিজেকে
হারিয়ে ফেলি, আমার হৃৎস্পন্দনে যুক্ত হয় তোমার হৃৎস্পন্দন।
সুশোভনা– এ আপনার ভ্রমও হতে পারে রাজন। আপনার বিহ্বলতা সত্য।
কিন্তু অনুভুতি? হয়তো তা ঐ বিহ্বলতা থেকেই উৎপন্ন।
পরীক্ষিৎ- কেন সুদর্শনা, আমার হৃৎস্পন্দন অনুরাগ হয়ে তোমার হৃদয়ে
আলোড়ন তোলে না?
সুশোভনা– আমি পরিচয়হীনা সামান্য নারী – আমার হৃদয়ের স্পন্দন শুধুমাত্র প্রাণধারণের। পুরুষের
লালসা’র বেশি আর কিছু সে হৃদয় জানে না।
পরীক্ষিৎ- তুমি কী
নিষ্ঠুর রমণী! আমি কিন্তু অপকট স্বীকার করি — আকাশের
ওই শশাঙ্কচ্ছবির মতো এই মুখচ্ছবিও কম সুন্দর নয়। পূর্ণচন্দ্রের মাঝে মৃগরেখার মতো ওই ললাটে কৃষ্ণ
চিকুরের ভ্রমরক সুনিবিড় ছায়া-লেখা অঙ্কিত
করে রেখেছে। আমি... আমি... (প্রগাঢ় স্বরে) প্রিয়া...!
সুশোভনা– কী বলতে চাইছেন রাজা?
পরীক্ষিৎ- তুমি আমার
মনোভব ভবনের নায়িকা নও প্রিয়া, তুমি আমার এই জীবনভবনের অন্তরতমা। আমার কামনার
আকুলতার মধ্যে এতদিনে এক প্রেমসুন্দর প্রদীপ জ্বলে উঠেছে, তাই মণিদীপ নিভিয়ে দিয়েও
শুধু হৃদয় দিয়েই দেখতে পাই, তুমি কত সুন্দর!
সুশোভনা– (স্বগতোক্তি) তুমি মরেছ রাজা।
পরীক্ষিৎ- কিছু বললে প্রিয়া?
সুশোভনা– না, ভাবছি;
অপরিচিত নারীকে হৃদয় দিয়ে চিরজীবনের মতো আপন করে নেবার বাসনা কি ইক্ষাকু গৌরব রাজা
পরীক্ষিৎ-এর পক্ষে সমুচিত?
পরীক্ষিৎ- কেন? এতে অপরাধ
কোথায়? কিসের অনুচৈত্য! প্রেমের গতি তো অবাধ – স্থান,
কাল, পাত্র বেষ্টিত নয়--
সুশোভনা– (হঠাৎ সুর
পাল্টে) চন্দ্রিকাবিহ্বল এমন বৈশাখী সন্ধ্যায় আজ আর ঘরে থাকতে মন চাইছে না প্রিয়।
চল তোমার উপবনে--
পরীক্ষিৎ- আমি উল্লসিত প্রিয়া -- চল তাই যাই।
(কিছুক্ষণ স্তব্ধতা)
সুশোভনা– আহা! কী মনোরম দৃশ্য! মৃণালভুক মরাল আর কলহংসের দল কী
সুন্দর অবাধ আনন্দে সরোবর সলিলে সন্তরণ করে চলেছে — আজ আমার মন চাইছে রাজা, কলহংসের মতো জলকেলি করে আপনার দুই চক্ষুর
দৃষ্টিকেকে নন্দিত করি।
পরীক্ষিৎ- তাই করো প্রিয়া--
সুশোভনা– (হঠাৎ কান্নায় ভেঙে
পড়ে) না আ আ — আমাকে এই সরোবর সলিলের সান্নিধ্যে
কেন নিয়ে এলেন রাজা পরীক্ষিৎ?
পরীক্ষিৎ- (অবাক হয়ে) তোমারি ইচ্ছায় এসেছি
প্রিয়া!
সুশোভনা– আপনার প্রতিশ্রুতি
স্মরণ করুন রাজা—
পরীক্ষিৎ- প্রতিশ্রুতি! বিধাতা, এই তোমার
মনে ছিল — আমার এই বিস্মৃতি এখন আমায় কোথায়
নিয়ে যাবে?
সুশোভনা– আপনি ভুল করে আমাকে
আমার অভিশাপের সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছেন রাজা। সলিল বক্ষে দেখেছি আমার প্রতিচ্ছবি। এখন
আমাকে বিদায় দেবার জন্য প্রস্তুত হন--
পরীক্ষিৎ- (সঙ্কল্পে কঠিন এক বলিষ্ঠের দৃঢ়
কণ্ঠস্বর ) তোমাকে বিদায় দিতে পারব না প্রিয়া, এই জীবন থাকতে নয়--
সুশোভনা–(শঙ্কাতুর) আবারও ভুল
করবেন না রাজা — দৈব অভিশাপের কোপ মিথ্যা করবার শক্তি
আপনার নেই।
পরীক্ষিৎ- সত্যই অভিশাপ, না অভিশাপের
কৌতুক! এসো প্রিয়া, বাহুবন্ধনে সর্বক্ষণকাল
বক্ষলগ্ন করে রাখি তোমাকে, দেখি কোন্ অভিশাপের প্রেত আমার কাছ থেকে কেমন করে তোমার প্রাণ হরণ করে নিয়ে
যেতে পারে।
সুশোভনা– (আতঙ্কিত) না, না, অনুরোধ করি রাজা পরীক্ষিৎ, কাছে আসবেন না — আমাকে স্পর্শ করবেন না -- অনুরোধ করি আমাকে এই স্থানে
একাকী থাকতে দিন--
পরীক্ষিৎ- একাকী! কতক্ষণ?
সুশোভনা– কিছুক্ষণ--
পরীক্ষিৎ- কেন?
সুশোভনা– বুঝতে চাই, ঐ অভিশাপ
সত্যই একটি মিথ্যার কৌতুক। বিশ্বাস করতে চাই, মিথ্যা হয়ে গেছে অভিশাপ। সরোবর তটের
নির্জন একান্তে দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করার সুযোগ দান করুন নৃপতি।
পরীক্ষিৎ- কিসের প্রার্থনা?
সুশোভনা– (কাতর কণ্ঠে) তোমারই
প্রেমিকা মৃত্যুশঙ্কা পরিহার করার জন্য প্রার্থনা করতে চায়, সুযোগ দাও প্রিয় --
পরীক্ষিৎ- তোমার অনুরোধ
প্রত্যাখানের স্পর্ধা আমি করি না -- বেশ, তাই হোক। আমি আম্র-বীথিকার ছায়ায় অপেক্ষা
করছি।
(৪)
সুবিনীতা- এ কোন্ নতুন সর্বনাশ করেছো
রাজপুত্রী?
সুশোভনা– কী হয়েছে কিঙ্করী?
সুবিনীতা- পরাক্রান্ত
পরীক্ষিৎ মন্ডুক-জনপদ আক্রমণ করেছেন। শত শত মন্ডুকের প্রাণ সংহার করে চলেছেন।
রাজ্যের প্রজা আর্তনাদ করছে আর রাজা আয়ু অশ্রুপাত করছেন। কোন্ কৌতুকে রাজ্যের এই
সর্বনাশ করলে নির্মম,? পরাক্রান্ত পরীক্ষিতের কাছে কেন তোমার পরিচয়
প্রকট করে দিয়ে এসেছ কপটিনী?
সুশোভনা– মিথ্যা অভিযোগ কোরো না বিমূঢ়া! নিমেষের মনের ভুলেও
নৃপতি পরীক্ষিতের কাছে আমি আমার পরিচয়
প্রকট করিনি।
সুবিনীতা- আমার সংশয় মার্জনা কর রাজপুত্রী;
কিন্তু...
সুশোভনা– কিন্তু! কিন্তু কী?
সুবিনীতা- কিন্তু, ভেবে পাই না মহাচেতা
পরীক্ষিৎ কেন অবৈরী মন্ডুকজাতির বিনাশে হঠাৎ প্রমত্ত হয়ে উঠলেন? আমি রাজসমীপে চললাম
কুমারী-- (প্রস্থান)
সুশোভনা– (স্বগতোক্তি) তবে কি
সত্যই তিনি জেনে ফেলেছেন আমার পরিচয়! কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব! তবে কি এই
প্রতিহিংসা তারই প্রতিফল? এই প্রতিহিংসার ঝড় তবে মন্ডুক জনপদের উদ্দেশ্যে নয়, একি
নারীধর্মদ্রোহিনী সুশোভনার গর্ব খর্ব করার জন্য... নাহ, একি দুর্ভাবনা আমার... দুর্বল
মনের আভাষ... বরং কিছুটা মাধুকীবারি সেবন করে মনকে সবল করা যাক--
সুবিনীতা- (প্রবেশ) রাজকুমারী...
সুশোভনা– আহ...! আবার কোন্
দুর্বার্তা নিয়ে এসেছো সুমুখী?
সুবিনীতা- দুর্বার্তাই নিয়ে এসেছি সুব্রতা
রাজকুমারী; তোমার ছলনায় ভুলেছেন রাজা পরীক্ষিৎ; কিন্তু মন্ডুকজাতির দুর্ভাগ্য
ভোলেনি। দৈবের ইঙ্গিতে তোমার অপরাধ আজ জাতির অপরাধ হয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে।
সুশোভনা– এ কথার অর্থ?
সুবিনীতা- নৃপতি পরীক্ষিৎ
দূত মুখে জানিয়েছেন — দৈব অভিশাপে ভীতিগ্রস্থা তাঁর প্রিয়তমা যখন মূর্ছিতা হয়ে সরোবর জলে ভেসে
গিয়েছিলেন, সেই সময় দুরাত্মা মন্ডুকেরা চন্দ্রপলপ্রভাসমন্বিতা তাঁর জীবনবাঞ্ছিতা সেই
নারীকে নিধন করেছে। তিনি স্বচক্ষে একজন মন্ডুক-চরকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন--
সুশোভনা– তোমার সুবার্তা শুনে আশ্বস্ত হলাম কিঙ্করী।
সুবিনীতা- আশ্বস্ত?
সুশোভনা– হ্যাঁ আশ্বস্ত ও আনন্দিত। এই অক্ষিতারকার কটাক্ষে, এই স্ফুরিতাধরের
হাস্যে, এই মুখমধুর চুম্বনের ছলনায় প্রখর বুদ্ধি ও প্রবল পরাক্রান্ত পরীক্ষিৎও কত
মূর্খ হয়ে গিয়েছে --
সুবিনীতা- তুমি কৃতার্থা
হয়েছ কৌতুকের রাণী, কিন্তু তোমার প্রেমিক আজ তোমারই বিচ্ছেদের দুঃখে কত নিষ্ঠুর
হয়ে নিরীহের শোণিতে যে ভয়াল উৎসব আরম্ভ করেছে, তার জন্য তোমার একটুও দুঃখ হয় না?
এই প্রকোষ্ঠের আলোদায়িনী এই দীপশিখারও হৃদয় আছে, তোমার নেই — ধিক তোমাকে। আমি যাই, তুমি বরং মাধুকিবারিই সেবন কর...
সুশোভনা– (স্বগতোক্তি) নারী হেতু নরসংহার! আঃ, ওই আর্তের মর্মভেদী
ধ্বনি, স্বজন হারানোর বিলাপ! কেন, কেন আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে — আমার মস্তিস্কের তন্ত্রীতে কেন, কেন তারা আঘাত করছে! ওঃ আমি যেন আমার নিজের ভার সহ্য করতে পারছি না--
(হঠাৎ)
সুবিনীতা, সুবিনীতা...!
সুবিনীতা- আজ্ঞা করো কুমারী—
সুশোভনা– আজ্ঞা করছি কিঙ্করী, এই মুহূর্তে দূত প্রেরণ কর শত্রু
পরীক্ষিতের শিবিরে — জানিয়ে দাও, কোনো মন্ডুক তার
আকাঙ্ক্ষার নারীকে নিধন করেনি। জানিয়ে
দাও, সে নারী হলো মন্ডুক দুহিতা সুশোভনা — যে এই
প্রাসাদের কক্ষে তার সকল সুখ নিয়ে বেঁচে আছে। ছল প্রণয়ে মুগ্ধ, মূর্খ ও উন্মাদ
নৃপতিকে এই সংহারের উৎসব ক্ষান্ত করে চলে যেতে বলে দাও --
সুবিনীতা- জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজকুমারী। স্বয়ং মন্ডুকরাজ আয়ু
ব্রাহ্মণ বেশে পরীক্ষিতের শিবিরে গিয়ে এই
কথা জানিয়ে দিয়ে এসেছেন।
সুশোভনা– (উদাস ও করুণ)বাহ, শুনে সুখী হলাম। পিতা এতদিন পরে আমার
উপর নির্মম হতে পেরেছেন। ভাবতে ভালো লাগছে কিঙ্করী, আমার অপরাধ প্রকাশ করে দিয়ে পিতা আজ তাঁর
প্রজাদের উন্মত্ত পরীক্ষিতের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন। এক নির্বোধ প্রেমিক আজ
ছল-সর্বস্বা কপটিনীকে ঘৃণা করে চলে যাবে, আমিও সেই মূঢ়ের প্রেমের গ্রাস থেকে
বাঁচলাম সুবিনীতা।
সুবিনীতা- প্রজা
বেঁচেছে রাজকুমারী, কিন্তু তুমি...!
সুশোভনা– আমি! আমি কি?
সুবিনীতা- তুমি মরেছ — প্রেমিক পরীক্ষিৎ প্রতীক্ষার দীপ জ্বেলে তোমারই আশায়
রয়েছেন --
সুশোভনা– (চীৎকার করে)না, তা হতে পারে না — এমন ভয়ঙ্কর আশার কথা উচ্চারণ কোরো না কিঙ্করী। সে
নির্বোধকে জানিয়ে দাও, আয়ুনন্দিনী সুশোভনার হৃদয় নেই, তাই হৃদয় দান করে পুরুষের
ভার্যা হতে সে জানে না। সুশোভনাকে ঘৃণা করে এই মুহূর্তে তাকে চলে যেতে বল।
সুবিনীতা- যদি তিনি ঘৃণা করতে না পারেন?
তবে?
সুশোভনা– (যন্ত্রণাক্ত) তবে, ঘৃণা এনে দাও সে নির্বোধের মনে। নারীধর্মদ্রোহিনী
কৌতুকিনী নারীর গোপন ইতিহাস তাকে শুনিয়ে দাও। সুশোভনার অপযশ ঘটিত হোক ত্রিভুবনে।
জানুক পরীক্ষিৎ, মন্ডুকরাজ আয়ুর চন্দ্রোপলপ্রভাসমন্বিত তনয়া হলো এক বহুবল্লভা
পরপূর্বা ও ভ্রষ্টা নারী।
সুবিনীতা- এতক্ষণে বোধহয় সে কথাও জানতে পেরেছেন রাজা পরীক্ষিৎ--
সুশোভনা– কেমন করে?
সুবিনীতা- পিতা আয়ু আজ
সত্যই তোমার উপর নির্মম হয়েছেন কুমারী, তিনি স্বয়ং অমাত্যবর্গদের সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষিতের
শিবিরে চলে গিয়েছেন ইক্ষাকুগৌরবের কাছে নিজমুখে নিজ তনয়ার অপকীর্তি-কথা জানিয়ে
দিতে। এ ছাড়া, মহাবল পরীক্ষিৎকে তোমার প্রণয়মোহ হতে মুক্ত করার আর কোনো উপায় ছিল
না দুর্ভাগিনী কুমারী।
সুশোভনা– আহ, মস্তিস্কের
তন্ত্রীতে কেন এ বীণার ঝঙ্কার -- আহ, আহ...
তুমি তুমি দূর হও বার্তাবহী কিঙ্করী-- (স্বগতোক্তি) অপযশ, অপযশ রটিত
হয়ে গিয়েছে — আকাশে কত তারা, যেন সিদ্ধকন্যাদের
সন্ধ্যাপুজার ফুলগুলি। না, জগতের কোনো অন্ধও এই রঙ্গময়ী কপটিনীকে চিনতে আর ভুল
করবে না। এত কালের সব গর্ব, সব উল্লাস আর
সব সুযোগ হারিয়ে শূন্য হয়ে গেল জীবন। এই তো মৃত্যু। এক হৃদয়হীনাকে এইবার ঘৃণা করে
ফিরে যেতে পারবেন পরীক্ষিৎ। জগতের সকল চক্ষুর ঘৃণা সহ্য করার জন্য এবং বিনা হৃদয়ের
এই জীবনটাকে শুধু শাস্তি দেবার জন্য আর ধরে রাখবার প্রয়োজন দেখি না-- ভরে উথুক এই
মাধুকিবারির পানপাত্র নীল গরলের বুদবুদে...
সুবিনীতা- রাজনন্দিনী, ক্ষান্ত হও—
সুশোভনা– কে? ও কিঙ্করী!
সুবিনীতা- পরীক্ষিতের কাছ থেকে বার্তা এসেছে রাজকুমারী--
সুশোভনা– কি বার্তা?
সুবিনীতা- তিনি তোমার অপেক্ষায় রয়েছেন--
সুশোভনা– এও কি সম্ভব?
সুবিনীতা- এ সত্য।
সুশোভনা– তিনি কি শোনেননি, আমি এক শুচিতাহীন মসীলেখা মাত্র?
সুবিনীতা- সব শুনেছেন। দাও, ও পাত্র আমার হাতে দাও।
সুশোভনা– সুবিনীতা, শত্রু শিবিরের ওই প্রদীপের জ্যোতি দেখতে
পাচ্ছ? প্রদীপের বিচ্ছুরিত আলো আমার হৃৎপিণ্ডের আঁধারকে স্পর্শ করছে-- আমার
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের ছন্দ ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে -- জাগছে হৃদয় -- আমার হৃদয়ে আরো
এক হৃদয়ের স্পন্দনের অনুরণন --আহ, পরীক্ষিৎ! কি সুন্দর শত্রু তুমি!
সুবিনীতা- কি বলছ রাজকুমারী!
সুশোভনা– আজ আমার জীবনের শেষ
অভিসারের লগ্ন এসে গিয়েছে সুবিনীতা। সাজিয়ে দাও কিঙ্করী, আর সুযোগ পাবে না।
সুবিনীতা- কোথায় যেতে চাও রাজনন্দিনী?
সুশোভনা– ঐ সুন্দর শত্রুর
কাছে।
সুবিনীতা- কি বেশে সাজাব?
সুশোভনা– বধূবেশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন