বন্ধ কোরো না পাখা
(চরিত্র : সায়ন – ডাক্তার, বয়স প্রায় তিরিশ; অহনা – সায়নের স্ত্রী; তীর্থঙ্কর –
সায়নের বন্ধু; সুকান্তবাবু – সায়ন ও অহনার প্রাক্তন শিক্ষক, বয়স প্রায় সত্তর)
প্রথম দৃশ্য
[রবিবারের সকাল। অহনা ফুলদানির বাসীফুল সরিয়ে নতুন টাটকা
ফুল রাখছে। ঘড়িতে সময় ৯-৩০। কলিংবেল বাজলো। সায়ন বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকলো।]
অহনা— আজ বাজারে এতক্ষণ
লাগলো? মাংসের দোকানে ভিড় ছিল?
সায়ন— আরে না না, মাংস
আনিনি, মাছই এনেছি।
(অহনা সায়নের হাত
থেকে বাজারের থলি নিয়ে ভেতরে রাখতে গেল। সায়ন খবরের কাগজ নিয়ে সোফায় বসলো। একটু
পরেই অহনা এলো।)
সায়ন— কেন দেরি হলো,
জানো?
অহনা— (উৎসুক হয়ে)
কেন?
সায়ন— বাজারে আচমকা এমন
একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তুমি কল্পনাই করতে পারবে না!
অহনা— বারে! শুধু তোমার পরিচিত
হলে আমি কল্পনা করব কী করে?
সায়ন— (হেসে) উঁহু, শুধু আমার
পরিচিত নয়, তোমারও সমান পরিচিত। সত্যি কথা বলতে কী, তোমার সঙ্গেই আগে পরিচয়। তুমিই
আমাকে ওনার কাছে প্রথম নিয়ে গেছিলে।
অহনা— (অবাক হয়ে) আমি! তোমাকে
নিয়ে গেছিলাম!
সায়ন— শোনো, আমি জলখাবার খেয়ে
সাড়ে দশটার সময় নার্সিংহোমে যাব। ফিরতে ফিরতে দুপুর দেড়টা-দুটো হবে। কাল সকালে পর
পর তিনটে অপারেশন আছে। তাই আজ একটু কাজ আছে। দুপুরে ফিরে একসঙ্গে লাঞ্চ করব।
অহনা— সে তো বুঝলাম, কিন্তু
তুমি কার কথা বলছো, সেটাই তো মাথায় আসছে না।
সায়ন— (হাসতে হাসতে) তুমি বরং
সারা দুপুর চিন্তা করো। সন্ধ্যেবেলায় আমি ওনাকে নিয়ে আসব। তখন দেখবে।
অহনা— তাই বুঝি! তার মানে উনি
এখানে ডিনার করবেন তো?
সায়ন— নিশ্চয়ই। তীর্থঙ্করও আজ
সন্ধ্যেবেলায় আসবে। ওকেও এখানে ডিনার করতে বলেছি।
অহনা— ঠিক আছে। তুমি তাহলে
ব্রেকফাস্ট করে নাও।
সায়ন— তুমি রেডি করো। আমি স্নান সেরে আসছি।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(কলিংবেলের আওয়াজ। অহনা দরজা খুলেই খুব অবাক হয়ে গেল।)
অহনা— ও মাই গড! স্যার আপনি!
সারাদিন কত চিন্তা করলাম, কে আসতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই মাথায় এলো না।
সুকান্তবাবু— (হেসে) ভালো
আছিস?
অহনা— (সুকান্তবাবুকে প্রণাম
করে) খুব ভালো আছি স্যার!
সুকান্তবাবু— ভালো তো থাকবিই,
ভগবান তোদের দুজনকে দুজনের জন্য তৈরি করেছেন। এটা আমার প্রথম থেকেই মনে হতো।
(সবাই সোফায় বসল।)
সায়ন— স্যার, আপনার শরীর কেমন
আছে?
সুকান্তবাবু— তুই তো নাম করা
ডাক্তার, দেখে কী মনে হচ্ছে?
সায়ন— ওপর থেকে তো সবটা বোঝা
যায় না, তবে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। সেদিক দিয়ে বললে বলতে পারি, এই বয়সে অন্যান্য
মানুষের তুলনায় আপনি অনেক সুস্থ।
সুকান্তবাবু— (হেসে) তোর
আন্দাজ ঠিকই। এখনও পর্যন্ত কোনো অসুখ আমার ধরা পড়েনি। যতদিন সুস্থ আছি, কাজ করে
যাব। তারপর একদিন রোগেরা নিশ্চয়ই ছেঁকে ধরবে। সেইসঙ্গে ছেঁকে ধরবে ডাক্তার, তাদের
রকমারি চিকিৎসা। ফলে অবশ্যম্ভাবীর অনাবশ্যক
বিলম্ব। এও এক মস্ত বিড়ম্বনা।
সায়ন— স্যার, আপনার কিসের
চিন্তা? আমি কেন আছি! আমাদের নার্সিংহোমে প্রায় সব অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আছে। আপনি
আজ থেকে ওসব ভাবনা ছেড়ে দিন।
সুকান্তবাবু— তুই যেটা বলছিস,
সেটা শুধু নিজের ছেলেই হয়তো বলতে পারে। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে আমি মহা ভাগ্যবান।
কিন্তু আমি তো এখানে থাকি না। দু’চার দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। দিন কয়েক পরেই ফিরে
যাব।
সায়ন— তাতে কী! ওতে কিছু
আটকাবে না।
(কলিংবেলের আওয়াজ। সায়ন দরজা খোলে।)
সায়ন— আয় আয়, এত দেরি হলো কেন? স্যার এসে গেছেন।
(তীর্থঙ্কর প্রবেশ করে। ফর্সা, লম্বা চেহারা। চোখের
দৃষ্টি সোজা ও ঝকঝকে।)
সায়ন— স্যার, আমার ও অহনার
বিশেষ বন্ধু, তীর্থঙ্কর। ও আর আমি দুজনেই একসঙ্গে ডাক্তারি পাশ করেছি। তীর্থঙ্কর
খুব নামকরা সার্জন। আমরা দুজনে একই নার্সিংহোমে আছি।
(তীর্থঙ্কর এগিয়ে এসে সুকান্তবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করল।)
তীর্থঙ্কর— স্যার, আপনার কথা
সায়ন ও অহনার কাছে এত শুনেছি যে, মনে মনে আপনার একটা চেহারাও ভেবে রেখেছিলাম।
সুকান্তবাবু— তাই বুঝি! কিন্তু
তুমি একা কেন?
অহনা— (হেসে)ওর এখনও বিয়েই
হয়নি। আর ওর দ্বারা নিজে নিজে বিয়ে করাও হবে না। ও মেয়েদের সঙ্গে মিশতেই জানে না!
কেবল কথায় কথায় তর্ক করে।
তীর্থঙ্কর— তাই? ঠিক আছে, আজ
থেকে আর তর্ক করব না।
অহনা— থাক থাক, খুব হয়েছে!
তুমি আবার তর্ক করবে না! এই শুরু করলে বলে!
সুকান্তবাবু— তর্ক করা ভালো।
যুক্তিতেই তো মুক্তি।
সায়ন— মুক্তি! ও মুক্তি
ফুক্তিতে বিশ্বাস করে না স্যার! ও ঈশ্বরই মানে না! ওর থিয়োরি
হলো, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য...’
সুকান্তবাবু— এ কথা যে মনে
প্রাণে বিশ্বাস করে, তার আলাদা ভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী হওয়ার কোনো দরকারই তো নেই।
তীর্থঙ্কর— আসলে কী জানেন
স্যার, এই আলোচনাটাই আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। মনে হয়, এতে শুধুমাত্র অহেতুক সময়ের অপচয়।
তাছাড়া অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকালে দেখি, বলতে গেলে চিরটা কাল এই দুনিয়াটাকে পায়ের
তলায় চেপে রেখে শাসন করে চলেছে, না ঈশ্বর নয়, বরং শয়তান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা।
সায়ন— দেখ তুই যতই বল
সময়ের অপচয়, ঘুরে ফিরে মানুষ এই চিন্তায় ঠিক পৌঁছে যায়।
সুকান্তবাবু— মা্নুষ
চিন্তাশীল। বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করা মানুষের স্বভাব। বড় বড় মনীষীরা আমাদের শতগুন
কাজ করেও এ বিষয়ে অনেক গভীর চিন্তা করেছেন। এতে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে।
তীর্থঙ্কর— ঈশ্বর যদি থেকেও
থাকেন, তাতেও কার কী লাভ? তাতে কী এসে যায়? মানুষ স্রোতে ভেসে চলেছে। হাবুডুবু
খাচ্ছে আর নিরুপায় হয়ে বাঁচার জন্য খড়কুটোর মতো কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে।
কিন্তু তাতে কি বাঁচা যায়?
(সুকান্তবাবু মনোযোগ দিয়ে তীর্থঙ্করের কথা শুনতে থাকেন)
কিছু মনে করবেন না স্যার, আমার না মাঝে মাঝে
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’র কয়েকটি লাইন দুর্বল বলে মনে হয়;
মনে হয় সেগুলো বাস্তব অবস্থার সম্পূর্ণ
বিপরীত।
সুকান্তবাবু— (সচকিত হয়ে) কোন্
লাইনগুলো?
অহনা— (হেসে) স্যার, কী বলেছিলাম! দেখলেন তো শুরু করে দিয়েছে!
তীর্থঙ্কর— ওঃ অহনা, তুমি চা
নিয়ে এসো তো তাড়াতাড়ি!
(অহনা চা আনতে
গেল)
ঐ যে, “দেবতা
বিমুখ তারে
কেহ নাহি সহায় তাহার
মুখে করে আস্ফালন
জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে”।
সুকান্তবাবু— (হেসে) তোমার এই
জায়গাটা দুর্বল মনে হয়?
তীর্থঙ্কর— দেখুন স্যার,
এমনিতে কবিতাটি অসাধারণ। তবে খুব ভালো কবিতারও যেমন কোনো জায়গা একটু দুর্বল হয়, এও
ঠিক তাই।
সায়ন— হ্যাঁ, হতে পারে।
অনেক সময় কোনো কোনো সিরিয়াস পাঠকের হয়তো কোনো অতি বিখ্যাত কবিতার একটা কি দুটো
লাইন তুলনামূলক ভাবে হাল্কা মনে হতে পারে। আবার কেউ কেউ সেটা নাও মানতে পারে। আমার
যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার একটা লাইন – “অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ” – এই লাইনটা খুব দুর্বল বলে মনে হয়। কারণ অশ্বত্থের শাখা
কীভাবে প্রতিবাদ করবে? কিন্তু তার ঠিক পরের লাইনটা আবার অসাধারণ –
“জোনাকির ভীড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি”
সুকান্তবাবু— দেখ সায়ন, অনেকে
হয়তো এই নিয়ে তোর সঙ্গে একমত না হতেও পারে, কিন্তু তুই যে এইভাবে প্রতিটি ছত্র
মনোযোগ দিয়ে পড়েছিস, এটা খুবই ভালো।
আচ্ছা তীর্থঙ্কর,
তুমি বল তোমার কেন ঐ জায়গাটা দুর্বল লাগে।
তীর্থঙ্কর— প্রথমত দেবতা
বিমুখ কিনা, কে দেখতে গেছে! আর যদি বিমুখ হয়ও, তাতে ওদের ভারী বয়ে গেছে। ওরা জানে,
ঈশ্বর বলে কিছু নেই। উনি হচ্ছেন অসহায়ের খড়কুটো। দ্বিতীয়ত “কেহ নাহি সহায় তাহার” –
এর চেয়ে ভুল আর কিছু হতে পারে না। এরা সবচেয়ে সঙ্ঘবদ্ধ। তারপর “মুখে করে আস্ফালন” –
এটাও সম্পূর্ণ ভুল, কারণ এরা প্রকৃতই অসম্ভব শক্তিশালী। প্রায় যা খুশি তাই করতে
পারে।
সায়ন— কেন ন্যায়ের কাছে
কি অন্যায় কখনও পরাভূত হয়নি? সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে।
তীর্থঙ্কর— হ্যাঁ, খুঁজলে
অমন দু’চারটে উদাহরণ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু এর উল্টোটা খুঁজতে হয় না। চোখের
সামনে অহরহ অবাধে হয়ে চলেছে। না হলে যিশুর মতো মানুষ, যিনি সারা জীবন ন্যায় ও ভালোবাসার
প্রচার করেছেন, তাঁকে গুম খুন নয়, নির্মম ভাবে ক্রুশে বিদ্ধ করে – পথের পাশে –
সর্বসমক্ষে তিলে তিলে হত্যা করল, আর সারা পৃথিবী চেয়ে চেয়ে দেখল, কেউ টুঁ শব্দটি
করল না। আবার শ্রীচৈতন্য আচন্ডাল কোল দেওয়ার কথা প্রচার করায় তাঁকে গুম খুন করে
একটা অলৌকিক আষাঢ়ে গল্প রটিয়ে দেওয়া হলো, আর সাধারণ মানুষ এবং তাঁর ভক্তবৃন্দ তাই
বিশ্বাস করে পরম ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে তাঁর পুজো ও কীর্তনে মত্ত হলো।
সুকান্তবাবু— তোমার বক্তব্য
যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু শুরুর দিনগুলো থেকে আজ পর্যন্ত যদি একবার চোখ বোলাও, তাহলে
দেখতে পাবে এইসব মানুষ, যাঁদের আমরা মহামানব আখ্যা দিই, তাঁদের শিক্ষা ও জীবন
বিসর্জন বৃথা যায়নি। এঁদেরই নেতৃত্বে সাধারণ অসহায় মানুষ ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ
হয়েছে, অনেক অন্যায় প্রতিহত করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষ্মম হয়েছে।
তীর্থঙ্কর— হ্যাঁ, সামগ্রীক
ভাবে বিচার করলে সমাজ যে অগ্রসর হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আজও
ঈশ্বরের থেকে শয়তান শতগুন বেশি শক্তিশালী। সুতরাং ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, একথার কোনোই
অর্থ হয় না।
সায়ন— (হেসে)আচ্ছা
তীর্থঙ্কর, তুই ঈশ্বর কিংবা শয়তান বলতে কী বোঝাতে চাইছিস?
তীর্থঙ্কর— (দু’এক মুহূর্ত
থেমে) আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসই করি না।
সায়ন— তুই কি তবে
শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিস? এবং তাকেই সর্বশক্তিমান মনে করিস?
তীর্থঙ্কর— এই প্রশ্নটা
জটিল। চট করে জবাব দেওয়া ঠিক হবে না।
(চায়ের ট্রে নিয়ে
অহনার প্রবেশ)
অহনা— স্যার, চা নিন।
তীর্থঙ্কর চা নাও। দু চুমুক চা খেয়ে তারপর চিন্তা কোরো। সায়নকে আমি হাড়ে হাড়ে
চিনি, ওর কথার জবাব সহজে দেওয়া যাবে না।
সায়ন— দেখ, থাকলে দুটোই
আছে, আর না হলে কোনোটাই নেই।
সুকান্তবাবু— আমি কি মনে করি
জানো, ব্যাপারটা আদৌ জটিল নয়। বরং আমরা সবাই অহেতুক ব্যাপারটাকে জটিল করে ফেলি।
অহনা— স্যার, আপনি বলুন
আপনার কি মত।
সুকান্তবাবু— দেখ, ঈশ্বরের
অস্তিত্ব নিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশে প্রায় সব দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু
তাতে মানুষের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব যখন এখনও ঘোচেনি, তখন মনে হয় না কোনোদিন ঘুচবে।
রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় – ব্রক্ষ্ম এখনও এঁটো হয়নি। কিন্তু সে যাইহোক, ঈশ্বর-শয়তান
থাক বা না-থাক, যেটা অবশ্যই আছে সেটা হলো ভালো আর মন্দ। সহজ ভাবে বলতে গেলে, যে
মানুষ সমষ্টির স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, অন্য মানবিক
দোষ-ত্রুটি থাকলেও, আমরা তাকে ভালো বলতে পারি। আর যে মানুষ নিজের স্বার্থে অপরের
ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারে, সে অবশ্যই মন্দ। তবে হ্যাঁ, স্বাভাবিক ভাবেই
আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর মানুষের সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। কিন্তু
সেজন্য হতাশ হবার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
তীর্থঙ্কর— আপনার কথা খুবই
সহজবোধ্য ও খাঁটি হলেও বলি, বর্তমানে ব্যাপারটা যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা অসহনীয়। সাধারণের কথা না হয়
বাদ দিলাম, কিন্তু শিক্ষিত-পন্ডিত মানুষজন যখন দেখি ক্ষমতাবান অমানুষদের স্তাবকতা
আর তাঁবেদারি করছে, তখন মনে হয়, আমরা বোধহয় এক পা-ও এগোতে পারিনি।
সায়ন— (হেসে) এত ব্যস্ত
হলে কি চলে! থিওরি অফ এভোলিউশন-এর মতো এরও শম্বুকগতি। তাই ধৈর্য ধরা ছাড়া আর উপায়
কি! বলা যায় –
“রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনও অটুট
ছড়ানো সূর্যের কণা জড়ো ক’রে যারা
জ্বালাবে নতুন দিন, তারা আজও পলাতক
দলছাড়া ঘোরে ফেরে দেশে আর কালে”।
অহনা— তবু সূর্যকণা
বুঝি হারাবার নয়
থেকে থেকে জ্বলে ওঠে শানিত বিদ্যুৎ
কত ম্লান শতাব্দীর প্রহর বাঁচিয়ে
কোথা কোন লুকানো কৃপণে
ফেরারী সেনার”।
তীর্থঙ্কর— এক্সেলেন্ট অহনা!
সায়ন— আরেকটি অদ্ভুত
মজার ব্যাপার কি জানেন স্যার, আমরা প্রায় সবাই আজও কোনো বড় মানুষ বা মহাপুরুষ বলতে প্রথমেই ভাবি
কোনো অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সাধু-সন্ন্যাসী বা ধর্ম প্রচারক। তাঁকে নিয়ে কত মিথ্যা,
অবাস্তব গালগল্প ফাঁদি। একবারও ভাবি না, এইসব বলে তাঁদের প্রকৃত শিক্ষা ও অবদানকে
আমরা উপেক্ষা করছি, অবহেলা করছি।
তীর্থঙ্কর— শুধু তাই নয়,
আমাদের এখনও এই বোধ জন্মায়নি যে, এই সাধু-সন্ন্যাসীদের থেকেও অনেক বেশি অবদান
সেইসব মানুষদের, যাঁরা অনেক জাগতিক প্রলোভন উপেক্ষা করে বিজ্ঞান, অর্থনীতি,
ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্পকর্ম, প্রত্নতত্ত্বের মতো বিভিন্ন বিষয়ে বছরের
পর বছর অনলস পরিশ্রম করে চলেছেন মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। যে কোনো বড়
মাপের সাধু-সন্ন্যাসীর থেকেও নিউটন, আইনস্টাইন, পানিনি, কার্ল মার্ক্স,
রবীন্দ্রনাথ বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অবদান যে অনেক বেশি, সে কথা আমরা বুঝি
না।
অহনা— (হেসে) স্যার,
আমার মনে হচ্ছে, আমাদের আলোচনা শেষের দিকে। আমি তাহলে এবার ডিনার রেডি করি?
সায়ন— অহনা তুমি রেডি
কর, আমরা আসছি।
সুকান্তবাবু— তীর্থঙ্কর-সায়ন,
তোমরা আক্ষেপ কোরো না, হতাশ হয়ো না। তোমরা তোমাদের পেশায় শতকরা ১০০ ভাগ সৎ থেকে যে
ভাবে কাজ করছো, তাতে অবশ্যই অনেক মানুষ অনুপ্রাণিত হবে। এতদিন শিক্ষকতা করে আমি অত্যন্ত
আনন্দের সঙ্গে যেটা লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে আজকালকার ছেলেমেয়েরা গুণগত ভাবে আমাদের
সময়কার ছেলেমেয়েদের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট।
সুতরাং মানুষ সামনের দিকেই এগোচ্ছে, পেছনের দিকে নয়। সব শেষে একটা কথা বলি, জীবনের
সার সত্য বলে আমি যেটা মনে করি, তা হলো – “ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহ মোহ বন্ধন
ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা,
ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা বসে
ক্রন্দন—
ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ রচনা।
আছে শুধু পাখা, আছে মহানভঃ অঙ্গন
ঊষা দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা,
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা”।
(সায়ন ও
তীর্থঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে সুকান্তবাবুকে প্রণাম করতে গেল; সুকান্তবাবু বাধা দিয়ে
দুজনকে আলিঙ্গন করলেন।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন