কাহিনী – অনিল ঘোষ
নাট্যরূপ – ঊষসী ভট্টাচার্য
( প্রথম দৃশ্য )
সুধীনবাবু- কই হে রথীন, বাড়ি আছ নাকি?
রথীন- আরে, সুধীনবাবু যে, আসুন আসুন!
সুধীনবাবু- না না, আজ বেশি সময় নেই ভাই, আমি একটি বিশেষ দরকারে তোমার কাছে এসছিলাম।
রথীন- ও, বলুন কি দরকার?
সুধীনবাবু- তোমার একটি কাজের মেয়ে দরকার, বলছিলে না?
রথীন- হ্যাঁ তো! আসলে মীরার মিসক্যারেজের পর, সংসারটা একবারে অচল হয়ে পড়েছে। মীরার দেখাশোনা ও ঘরের কাজের জন্য একজন মহিলা খুবই দরকার। আমি আর কতটুকুই বা থাকতে পারি! স্কুল, তারপর টিউশানি, তাই আর কি!
সুধীনবাবু- সে তো খুবই সত্যি। তা বুঝলে ভায়া। আমার জানা একটি মেয়ে আছে। নাম লক্ষ্মী, বিধবা, এক ছেলে, কাছেই বাড়ি। আমি বলেওছি, ও রাজি আছে কাজ করতে। সারাদিন থাকবে। আর রাতে শুধু বাড়ি যাবে। কি, তোমার আপত্তি নেই তো?
রথীন – আপত্তি? কী যে বলেন দাদা! এতো সোনায় সোহাগা। কী যে উপকার হলো, সে ভাষায় বলার নয়।
সুধীনবাবু- দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার কৃতজ্ঞতা পরে জানিও খন, আগে পুরোটা শোনো, এখানে আমারও কিছু স্বার্থ আছে কিন্তু!
রথীন – আপনার স্বার্থ?
সুধীনবাবু- হ্যাঁ, স্বার্থও বলতে পারো, ইচ্ছেও বলতে পারো।
রথীন- কি?
সুধীনবাবু- লক্ষ্মীর ছেলে বিশু। ওকে আমি বটতলার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। শারীরিক একটু প্রতিবন্ধকতা আছে বটে, রোগা অপুষ্ট চেহারা, হাত পা কাঠি কাঠি, মোটা পেট, বড় বড় চোখ। কিন্তু ভারি শার্প ব্রেন ছেলেটির। বয়স বছর সাতেক। তুমি যদি ওর লেখাপড়ার দায়িত্বটা নাও! আমিই পড়াতাম, কিন্তু, আমার ছেলে-বউ এর কাছে দিল্লী যেতে হবে, এখানে না থাকলে তো এটা সম্ভব নয়। তাই, তুমিই পারবে ভাই। তোমার বাড়ির পরিবেশও আদর্শ ওর কাছে। ছেলেটাকে, হাতে নিয়ে দেখ, আমি ভুল বলেছি কিনা! মিলিয়ে নিও!
রথীন – বেশ। তাই হোক, নিয়ে আসুন কাল একবার ওদের।
( দ্বিতীয় দৃশ্য )
(রথীনের ভাড়া বাড়ির ঘরে)
লক্ষ্মী – দাদাবাবু, আপনার চা।
রথীন- হ্যাঁ দাও, আচ্ছা লক্ষ্মী, বিশু কই? ওকে দেখছি না যে, স্কুল থেকে ফেরেনি এখনও?
লক্ষ্মী – হ্যাঁ ফিরেছে তো, এখানেই তো ছিল, আছে হয়তো কোথাও, ডাকবো দাদাবাবু ওকে?
রথীন – না থাক। তোমার বৌদি উঠেছে?
(মঞ্চে রথীনের স্ত্রী মীরার প্রবেশ)
মীরা- না উঠলে সুবিধা হয় বুঝি তোমার?
রথীন – তুমি এখন যাও লক্ষ্মী, বিশু ফিরলে পাঠিয়ে দিও।
লক্ষ্মী – আচ্ছা দাদাবাবু ( লক্ষ্মীর প্রস্থান )।
মীরা- আমার কথার উত্তর করলে না যে?
রথীন – অনর্থক, তাই।
মীরা – হ্যাঁ, তা তো বলবেই, আমার বেঁচে থাকাটাই তো তোমার কাছে অনর্থক। আমি না থাকলেই তো সুবিধা হয় তোমার।
রথীন – সুবিধে হয়! মানে?
মীরা – মানে আর কী, লীলাখেলার কোনো বাধা থাকে না। পথের কাঁটা দূর হয়।
রথীন – আহ! মীরা, কী আজে বাজে বলছ? কিসের লীলাখেলা? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
মীরা – তুমি কাজের মেয়ের সাথে ঢলাঢলি করবে, তার ছেলেকে নিয়ে আদিখ্যেতা করবে, আর আমি বললেই দোষ?
রথীন – ভুলে যেও না মীরা, লক্ষ্মীকে তোমার অসুস্থতার জন্যই রাখা হয়েছে। তুমি সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে, এসবের কোনো দরকারই হতো না। আর আমি একজন শিক্ষক, এটাও ভুলে গেছ বোধহয়। ভালো ছাত্র পেলে, তাকে পড়ানো, মানুষ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি সেটাই করছি।
মীরা- হ্যাঁ, সঙ্গে তার মায়ের সোহাগ-সেবাও ফ্রি পাওয়া যায়, সে তো আরও মজার! (হা হা হা হা)
রথীন – স্টপ ইট মীরা! তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। রোগ তোমার শরীর থেকে মনে এসে বাসা বেঁধেছে। ক্রমশ রুচিহীন হয়ে পড়ছ।
মীরা – কী বললে তুমি? আমি রুচিহীন?
রথীন – শুনতেই তো পেলে!
(বাড়িওয়ালা হরেনবাবুর স্ত্রী প্রভাদেবীর প্রবেশ)
প্রভাদেবী – রথীন, ও রথীন!
রথীন – আসুন মাসিমা।
প্রভাদেবী – আরে বৌমা, এখানেই যে, তোমার শরীর কেমন আছে মা?
মীরা- একটু ভালো।
রথীন – মীরা, মাসিমাকে নিয়ে ভেতরে যাও। আমি লক্ষ্মীকে চা দিতে বলছি।
মীরা – চলুন মাসিমা আমরা ভেতরে যাই।
প্রভাদেবী – বেশ মা, চলো।
(মীরা এবং প্রভাদেবীর প্রস্থান)
(বাইরে থেকে বিশুর গলার আওয়াজ)
বিশু – মামা, ও মামা, একবারটি বাইরে এসো, মামাআআআ! ও মামা...
রথীন – আরে হলোটা কী, চেঁচাচ্ছিস কেন খামোখা? একি! এটা কি তোর হাতে?
বিশু- অশ্বত্থচারা, উঠোনে পুঁতব মামা, দেখবে কেমন ছায়া হবে!
রথীন - উফ বিশু! তুই কি আমায় পাগল না করে ছাড়বি না? সেদিন একটা ছাগল এনে হাজির হলি, পুষবি বলে, আজ আবার এই? একে তো হরেনবাবু আমায় তাড়াতে পারলে বাঁচেন। তারপর তুই আবার একটার পর একটা ঝামেলা জুড়ছিস।
বিশু – বুড়োর বারান্দায় দেব পুঁতে মামা, বেশ জব্দ হবে, তোমার ওপর গালাগাল করা বেড়িয়ে যাবে।
রথীন – আহ বিশু! উনি না গুরুজন হন, এমন করে বলতে আছে?
বিশু- উঠোনে লাগাই, দেখ না মামা, খুব ভালো লাগবে।
রথীন – ফ্যাল বলছি শিগগির, ফ্যাল ওটা।
বিশু – কেন?
রথীন – বাড়ির মধ্যে এসব কেউ লাগায়?
বিশু- না লাগানোর কি আছে, তুমি লাগাও মামা, দেখবে তোমার দেখাদেখি সবাই পুঁতবে।
রথীন – খালি অবাধ্যতা, বারণ করছি, কথা কানে যাচ্ছে না? তোকে এখন অশ্বত্থ গাছের ক্যাম্পেনিং করতে হবে না। যা, এটা ফেলে আয়। হাত ধুয়ে পড়তে বসবি আয়। লক্ষ্মীকে বলে দেব আমি, তোর দ্বারা কিসসু হবে না। সারাদিন খালি বাঁদরামি। কী হলো এখনও দাঁড়িয়ে রইলি যে? যা ফেলে আয়!
(এক দৌড়ে বিশু ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল)
রথীন – (আত্মোক্তি) ছেলেটা আমায় পাগল করে ছাড়বে। একে তো হরেনবাবু তেলে বেগুন, (দর্শকের দিকে তাকিয়ে) আপনারাই বলুন, এ বাজারে চারশ টাকা ভাড়ায় দু’কামরার ঘর কে ফেলে রাখতে চায়! কিন্তু এই ১৬ বছরে ঘরগুলো, এই বারান্দা, এই এক চালি রান্নাঘর কেমন যেন নিজের হয়ে গেছে। মা এ বাড়ি থেকেই শেষ যাত্রা করলেন, মীরা এই বাড়িতেই বউ হয়ে এলো। আমাদের নুন-পান্তার কষ্টের দিন, ভাড়া বাড়ির ঘরে সুখ-দুঃখ, সন্তানের স্বপ্ন দেখা -- আবার তা ভেঙে যাওয়ার মীরার আর্তনাদ, সবই তো এ বাড়ির আনাচে কানাচে ছুটে বেড়ায়। এ বাড়ি কি ছেড়ে যাওয়া যায়? নাহ! কিন্তু লক্ষ্মী, বিশু আসার পর এ ভারী বিড়ম্বনা। মীরার লক্ষ্মীকে নিয়ে অযথা সন্দেহ, আর বিশুর বাঁদরামি। কিন্তু, কিন্তু, সত্যি কি মীরার সন্দেহ অহেতুক? আচ্ছা আমার মধ্যে কোনো লাম্পট্য নেই তো? রাতে মীরার কাতর রুগ্ন শরীর যখন পাশে পড়ে থাকে, স্বপ্নের আবেশে কখনো লক্ষ্মীর সুঠাম বুকের আলিঙ্গন কি পেতে চাইনি? কখনো কি নিজের অগোচরে ওকে... না না না...! ছিঃ ছিঃ... কি ভাবছি এগুলো?
(আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে)
তুমি একজন শিক্ষক রথীন, ভুলে গেলে চলবে না! লক্ষ্মী তোমার কাজের মেয়ে। সে তোমায় দাদা ডাকে। তার ছেলেকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছ তুমি। মীরা অসুস্থ, ওকে সুস্থ করে জীবনে ফেরানোর দায়িত্ব তোমারই। আর তুমিই…?
(পিছন দরজায় টোকা পড়ে, রথীন ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে)
রথীন – কে?
লক্ষ্মী – (দরজার বাইরে থেকেই) দাদা, আপনার কাছে কে একজন আসছে।
রথীন – পাঠিয়ে দাও।
(ঘরে রথীন বিভাসের প্রবেশ)
বিভাস- বাব্বা, তোর ঘরে ঢুকতে গেলেও আজকাল মহিলা দারোয়ান পেরোতে হয়?
রথীন- (অন্যমনস্ক ও ভীত ভাবে তাকিয়ে) একি তুই?
বিভাস- এ কি রে? তুই তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলি?
রথীন – না, তোকে এক্সপেক্ট করিনি তো, ছাত্ররা পড়তে এসছে ভেবেছি। তা তুই, জেল থেকে ছাড়া পেলি কবে? এখানেই বা কী মনে করে?
বিভাস- কী মনে করে মানে কিরে রথীন? বন্ধু, বন্ধুর কাছে আসবে না? জেলে একদিনও দেখা করতেও এলি না রথী? আমি কিন্তু তোকে এক্সপেক্ট করেছি। তোর চোখেও কি আমি ক্রিমিনাল?
রথীন – দ্যাখ বিভাস, আমি নিজের জীবন নিয়েই বিপর্যস্ত, প্লিজ এসব...
বিভাস- নিজের জীবন? তুই, তুই এসব কথা বলছিস? আর একদিন তুইই স্টুডেন্ট ইউনিয়নে দাঁড়িয়ে এক হয়ে বাঁচার কথা বলতিস? বলতিস, ‘বাঁচতে হলে পরের জন্যে বাঁচব, মরতে হলে দেশের জন্যে মরব’! এই তুই, সেই কি? তুইও এসকেপিস্ট হয়ে গেলি?
রথীন – চুপ কর, চুপ কর। দু’বেলার ছাত্র পেটানো জীবনে এসব ভাবতে ভালো লাগে রে, বলতে ভালো লাগে, করা যায় না। কিসসু করা যায় না। তুই কী করতে পেরেছিস? আন্দোলন করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে গেলি। তোর মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। শেষটা তোর মুখটাও উনি দেখতে পাননি। এটা তোর রিভিলিউসান? নাহ! তোরা বিপ্লবী হ! আমার জন্য ওসব নয়।
বিভাস- তবু, তুই একদিন এসবকে জীবনের সর্বস্ব ভাবতিস।
রথীন – দ্যাট ওয়াস পাস্ট। আমি এখন এসব ভাবি না। আর তুইও এসব ছাড়। মানুষের মতো বাঁচতে হলে এসব ভাবতে নেই রে!
বিভাস – না রে, আমার আর মানুষ হওয়া হবে না রে! তোরা মানুষ হ ভাই! আমি আজ চলি।
রথীন – না, আমি তা বলিনি রে! শোন।
বিভাস – না, আজ যেতে হবে। নদীর ওপারে আজ একটা মিটিং আছে। ভেবেছিলাম তোকেও নিয়ে যাব। যা হোক গে! পরে আর একদিন এসে বরং তোকে অমানুষ করার চেষ্টা করব। আজ আসি... (হা হা হা)
(রথীন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে)
(‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’ গাইতে গাইতে বিভাসের প্রস্থান)
( তৃতীয় দৃশ্য )
(বিশু একটা মগ আর বালতি নিয়ে হেলতে দুলতে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে)
রথীন – ওকি বিশু, কোথায় চললি?
বিশু – তুমি যাবে মামা?
রথীন – কোথায় যাব?
বিশু- চলো না মামা, চলো ...
(রথীনের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাড়ির পাশের পুকুর ধারে নিয়ে যায়, সেখানেই বিশু অশ্বত্থ গাছ পুঁতেছে)
রথীন – একি রে তুই এখানে...?
বিশু – হ্যাঁ মামা। এটা তোমার হরেন বুড়োর (জিভ কেটে) ইয়ে হরেন দাদুর নয়। তাই পুঁতেছি। বেশ মানিয়েছে না মামা?
রথীন – (হাহাহা হাহাহা) তুই পারিসও বিশু, তা এখানে এভাবে গাছ লাগালে হয় নাকি রে? বেড়া দিতে হবে যে! নয়তো ছাগলে মুড়ে খাবে তো!
বিশু- তাই মামা, আচ্ছা দাঁড়াও…
(দৌড়ে গিয়ে কিছু বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে আনল, আর সেই কঞ্চিগুলো দিয়ে বেড়া বাঁধতে লাগলো)
এবার ভালো হবে না মামা?
রথীন – হ্যাঁ হবে। হ্যাঁরে বিশু, তুই আজ স্কুল যাসনি? (বিশু হাতের কাজ থামিয়ে চুপ করে রইল) কী রে, কি হলো, বল? যাসনি কেন?
বিশু- আমি আর স্কুলে যাব না মামা।
রথীন – যাবি না! মানে?
বিশু- ওরা খুব খারাপ মামা।
রথীন – খারাপ কেন? কি হয়েছে?
বিশু – ওরা আমায় ঝি-এর ছেলে বলে ক্ষ্যাপায়। বাজে বাজে কথা বলে। স্কুলের কাজ করায়।
রথীন – সে কি! দাঁড়া আমি তোর স্কুলে যাব। (বিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে) তুই কিছু ভাবিস না বাবা, আমি ওদের খুব করে বকে দেব। আর এমন করবে না ওরা।
বিশু – (হেসে) আচ্ছা মামা, এখন চলো গাছের বেড়া বাঁধবে আমার সাথে। চলো, ও মামা!
( চতুর্থ দৃশ্য )
(রথীনের ঘরের বাইরে বারান্দায়)
হরেনবাবু- (চেঁচিয়ে) বলি, এটা কি খোঁয়াড়? বলি, হচ্ছেটা কি?
(ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে রথীন)
রথীন- কি হয়েছে হরেনবাবু, আপনি এত উত্তেজিত কেন?
হরেনবাবু- আপনি যা খুশি তাই করবেন, আর আমি বললেই দোষ?
রথীন – আমি? আমি আবার কি করলাম?
হরেনবাবু – বলি, পুকুর পাড়ে অশ্বত্থ গাছটা কে পুঁতেছে? কে পুঁতেছে, শুনি?
রথীন- ও তো বিশু...
হরেন বাবু – ও, ও, বিশু! তবে তো সাত খুন মাপ। আপনার পোষ্যপুত্র বলে কথা। কিন্তু, শুনুন, এখানে এসব চলবে না। আমি সাফ বলে দিচ্ছি, এসব করতে হলে নিজের বাড়ি করে করুন। আমার এখানে আমি হতে দেব না।
রথীন- পুকুর তো কারুর ব্যাক্তিগত না হরেনবাবু, সেটা তো সরকারি বলেই জানি।
হরেনবাবু – সরকারি! কি জানেন, মশাই আপনি? আপনি একটা... ইয়ে। আপনি চলে যান, ছেড়ে দিন আমার বাড়ি। এতো সরকারি না!
রথীন- অন্য বাড়ি পেলে আমি ছেড়ে দেব।
হরেনবাবু- আর গাছ? ওই গাছ কি বাড়বে আপনার ওই পোষ্যপুত্রের মতোই...! হুম!
রথীন – বাচ্চা ছেলের খেয়াল, দু’দিন বাদেই তুলে ফেলে দেবে।
(হরেনবাবু গজ গজ করতে চলে যান। রথীন বাড়ি থেকে বেরোতে যায়। বিভাস এসে দাঁড়ায়।)
রথীন – তুই?
বিভাস- হ্যাঁ রে, আবার এলাম, কুকুরের লেজ ভাই। তা কোথাও বেড়োচ্ছিলি?
রথীন – হ্যাঁ, ওই পুকুর পাড়েই একবার যাব।
বিভাস- বেশ তো, চল্! (যেতে যেতে) তা কিছু ভাবলি?
রথীন – কি ভাবব?
বিভাস- আমাদের সাথে আসবি?
রথীন – কোথায়?
বিভাস- আমাদের দলে, আমাদের কাজে... আসবি?
রথীন – তোরা পারবি? কিছু করতে পারবি? পারবি এই পোড়া সমাজের অসুখ সারাতে? পারবি অসহায় ছেলেগুলোর শিক্ষার অধিকারটুকু ফিরিয়ে দিতে? পারবি বিভাস?
বিভাস – তোর কিছু হয়েছে রথীন? আজ এত অস্থির লাগছে কেন?
রথীন – ওই ছেলেটাকে দেখছিস?(ইতিমধ্যেই ওরা পুকুর পাড়ে আসে, সেখানে বিশু গাছটাকে জল দিচ্ছিল, তার দিকেই নির্দেশ করে রথীন)
বিভাস- কে ও?
রথীন – আমার কাজের মেয়ে লক্ষ্মীর ছেলে, বিশু। ওকে আমি মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছি। জানিস, স্কুলে ওকে ঝি-এর ছেলে বলে ব্যাঙ্গ করে, অপমান করে। ভাবতে পারিস আজকের যুগেও... উফ!
বিভাস- (রথীনের পিঠে হাত রেখে) তোর চোখে দেখা দুনিয়ার বাইরে এমন অনেক বিশু আছে রে! তাদের পাশে তোর মতো কোনো মাস্টারও নেই। আছে কেবল অন্ধকার, চোরা পথ। আর অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। তাই তো বলছি রথীন, আমাদের সঙ্গে আয়। আমাদের অনেক কাজ রে! অনেক কাজ।
রথীন – না না, হয় না, আর হয় না। তুই যা, আমার কাজ আছে।
(বলে বাড়ির পথে হাঁটা লাগায় রথীন, পেছন থেকে বিভাস চেঁচাতে থাকে)
বিভাস- কাল আমাদের মিটিং, বিকেল পাঁচটায়। আমি অপেক্ষা করব তোর জন্য, নদীর ওপারে।
( পঞ্চম দৃশ্য )
(ঘরের ভেতর)
মীরা – তোমার জন্য কি গলায় দড়ি দেব?
রথীন – মানে?
মীরা- কাল তোমার কাছে বিভাসদা এসেছিল কেন? ওই ক্রিমিনালটা...
রথীন – আহ মীরা, কাকে ক্রিমিনাল বলছ? রথীন বিপ্লবী।
মীরা- (মুখ বেঁকিয়ে) বিপ্লবী! থাক। আর বিপ্লব মাড়াতে হবে না তোমায়। শোনো, ওসব তোমার মতো টিকটিকির জন্য নয়। তুমি এক্কেবারে ওসবে যাবে না।
রথীন – (হেসে) বেশ তো, তবে কুমীর হওয়ার চেষ্টাটা করি। মন্দ কি?
(হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে রথীন বাইরে আসে)
রথীন - কি ব্যাপার? এত গোল কিসের?
(হরেনবাবু তেড়েমেরে এগিয়ে আসেন)
হরেনবাবু- বাড়িতে খুনে বদমাশ এসে ভয় দেখাবেন? এসব মানব না, চলবে না এসব!
রথীন – খুনে বদমাশ! কে?
হরেনবাবু- কেন, বিভাস চাটুজ্যে! ব্যাটা রাম শয়তান। দশ বছর জেল খেটে আশ মেটেনি। আবার আপনার পোঁ ধরেছে? আমি পুলিশে যাব... দেশে কি বিচার নেই? আজ গাছ উপড়ে ফেলেছি, কাল আপনাকেও উপড়ে ফেলব, এই আমি বলে রাখলাম!
রথীন – সে কি? গাছ ফেলেছেন, সে কি?
(বলে বাড়ি থেকে এক দৌড়ে পুকুর পাড়ে ছুটে যায় রথীন। সেখানে গিয়ে দেখে, উপড়ে ফেলা গাছের পাশে হাপুস নয়নে বিশু কেঁদে চলেছে)
রথীন – কাঁদিস না বিশু, থাম!
বিশু- মামা, গাছটা উপড়ে ফেলে দিল ওরা। আর বড় হবে না এটা। আর ছায়া দিতেও পারবে না।
রথীন- আমি আবার একটা পুঁতে দেব। তুই ভাবিস না, চারা বড় আমি করবই।
বিশু- (চোখ মুছে) সত্যি মামা?
রথীন – হ্যাঁরে সত্যি! এখন তুই যা, আমি নদীর ওপারে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে। চারা নিয়েই আমি ফিরব রে...
বিশু- আচ্ছা মামা।
(রথীন নদীর ওপারে যাত্রা করে, মঞ্চে পর্দা পড়তে থাকে, নেপথ্যে গান বাজে)
(‘আমরা করব জয়, আমারা করব জয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয়... ...)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন