নিরর্থক
চরিত্র : প্রণবেন্দু (বয়স ৭০, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বর্তমানে নিজের আশ্রমে থাকেন, অকৃতদার), শ্যামল (প্রণবেন্দুর ভাগ্নে), অনিমা (শ্যামলের স্ত্রী), অম্লান (প্রণবেন্দুর সহযাত্রী), ছন্দা (অম্লানের স্ত্রী)।
(প্রথম দৃশ্য)
(দিল্লী-হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর বাতানুকুল কুপে তিনজন ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে মিনিট দশেক বাকি। এমন সময় শ্যামল, প্রণবেন্দু ও অনিমার প্রবেশ, সঙ্গে একটি স্যুটকেশ ও একটি সাইডব্যাগ।)
শ্যামল – মামাবাবু!
প্রণবেন্দু – বল্!
শ্যামল – এত তাড়াহুড়ো করে তোমার সাধনের কাছে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না।
প্রণবেন্দু – (হেসে) অনেকদিন আগেই ওর কাছে এই সময় যাব বলে ঠিক হয়ে আছে। অহেতুক যাওয়া পিছিয়ে দেব কেন?
অনিমা – কয়েকটা দিন আপনার সঙ্গে কী ভালো যে কাটলো!
প্রণবেন্দু – (ঘড়ি দেখে) ট্রেন ছাড়ার সময় হলো, এবার তোরা আয়!
(স্বামী-স্ত্রী দুজনে প্রণবেন্দুকে প্রণাম করলো)
শ্যামল – আমরা ঠিক করেছি, এপ্রিল নাগাদ ছেলেকে নিয়ে তোমার আশ্রমে গিয়ে কয়েকদিন থাকব।
অনিমা – তুমি আশীর্বাদ কোরো, ও যেন মানুষ হয়।
প্রণবেন্দু – (হেসে) আজকাল সবার এই এক রোগ। ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে ভেবে ভেবেই মরলো। তরুণ তো ভালো ছেলে, এত ভাবছিস কেন? বাড়ি যা। চিন্তা করিস না। এপ্রিল মাসে আসিস। দেখা হবে।
অনিমা – সাবধানে যাবে। পৌঁছে একটা ফোন করবে।
প্রণবেন্দু – তোরা শান্তিতে থাকিস। আনন্দে থাকিস।
(স্বামী-স্ত্রীর প্রস্থান)
(অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়লো। কম বয়সের তরুণটি বাঙ্কের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন। প্রণবেন্দু লক্ষ্য করলেন, ভদ্রমহিলা একটি পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন, আর তাঁকে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করছেন। ভদ্রলোক একটি খবরের কাগজ পড়ছেন।)
ছন্দা – (প্রণবেন্দুকে) নমস্কার!
প্রণবেন্দু – নমস্কার!
অম্লান – (খবরের কাগজ পাশে রেখে) আপনাকে নমস্কার জানাই।
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, আপনাকেও নমস্কার জানাই। তা আপনারা কোথায় থাকেন? দিল্লী?
ছন্দা – গত বছর পর্যন্ত দিল্লীতেই ছিলাম, এ বছর কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছি আমরা। ছেলে দেরাদুনে পড়ে, তার সঙ্গে দেখা করে ফিরছি।
প্রণবেন্দু – তাই নাকি! ছেলের বয়স কত?
ছন্দা – এই সবে বারো পেরিয়েছে।
অম্লান – (বাধা দিয়ে) এই তিন মাস হলো তেরো পেরিয়েছে, এখন চোদ্দ চলছে।
ছন্দা – মোটেও না!
প্রণবেন্দু – (হেসে) কোন্ ক্লাসে পড়ে?
ছন্দা – এ বছর ক্লাস নাইনে উঠলো।
প্রণবেন্দু – আপনাদের একটি মাত্র ছেলে, তাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়, তাই না?
(ছন্দা নিরুত্তর)
অম্লান – আসলে আমার বদলির চাকরি, এছড়া কোনো উপায়ও নেই। আর একসময় আমিও ঐ স্কুলে পড়েছি। আর তাই ঐ স্কুলটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।
ছন্দা – আপনি কি দিল্লীতেই থাকেন?
প্রণবেন্দু – দিল্লীতে আমার ভাগ্নে থাকে, একটু আগে যাকে দেখলেন। আমার বাড়ি হরিদ্বারে। আগে, চাকরিজীবনে দিল্লীতেই ছিলাম। এখন আমি বছরে প্রায় দশমাস হরিদ্বারে থাকি, বাকি মাস দুয়েক আমার কয়েকজন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাই।
ছন্দা – তাঁরা আপনার শিষ্য বুঝি?
প্রণবেন্দু – (হেসে) আপনি শিষ্য বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, তা নয়। আমি কাউকে কোনো দীক্ষা দিই না। আমার সেই যোগ্যতাই বলুন বা বিশ্বাসই বলুন, কোনোটাই নেই। আসলে ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও ওদের খুব ভালোবাসি। মাঝে মাঝে ওদের দেখতে খুব ইচ্ছে করে। তাই দেখা করতে যাই।
ছন্দা – আশ্রমে কি আপনি এবং আপনার শিষ্যরা থাকেন?
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি যেখানে থাকি, সেটাকে আশ্রম না বললেও চলে। আমি একা মানুষ। চাকরি থেকে অবসরের পর আজ বারো বছর হলো হরিদ্বারে জমি কিনে একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকি। এমনিতে আমরা ওখানে তিনজন থাকি। তবে কিছু পরিচিত মানুষজন আছেন, তাঁরা নিয়মিত আসেন।
অম্লান – আপনি দিল্লীতে কোথায় চাকরি করতেন?
প্রণবেন্দু – আমি (একটু থেমে) জে এন ইউ-তে দর্শনের অধ্যাপক ছিলাম। বারো বছর হলো অবসর গ্রহণ করেছি।
অম্লান – (খুব খুশি হয়ে) যদি কিছু মনে না করেন, আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনার এ ব্যাপারে অভিমত জানতে চাইলে, কোনো আপত্তি নেই তো?
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। বেশি লেখাপড়া জানি না। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাব।
ছন্দা – জানেন, আমার না এই রকম কোনো আশ্রম, একটা ছোট্ট মন্দির, যেখানে লোকজনের ভিড় নেই, নিরিবিলি, সেখানে চুপ করে সারাটা সন্ধ্যে বসে থাকতে খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে।
প্রণবেন্দু – বাঃ বাঃ, খুব ভালো। তা আপনারা এসে দিন কয়েক আমার ওখানে ঘুরে যান না! কোনো অসুবিধে হবে না।
অম্লান – আপনার যদি কোনো কার্ড থাকে, তাহলে আমাকে দেবেন?
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ আছে। (ব্যাগ হাতড়ে একটা কার্ড বের করে অম্লানকে দিলেন)। হ্যাঁ, আপনার কী প্রশ্ন আছে বলছিলেন!
অম্লান – আচ্ছা, আমাদের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য কী?
প্রণবেন্দু – (দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁরা খুব উৎসুক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হেসে বললেন) দেখুন, মানুষের জীবনের কাজকর্ম, গতিপ্রকৃতি, বিশেষত শেষ পরিণতির কথা ভাবলে, যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষের মনে হতে বাধ্য যে, এই জীবনের কোনো অর্থ হয় না বা এর কোনো দরকার ছিল না। যেমন ধরুন, অনেকটা সেই ছোটবেলায় করা ‘সরল করো’ অঙ্কের মতো আর কী! অনেক লম্বা অঙ্ক, করতে করতে শেষ পর্যন্ত উত্তর বের হলো ‘শূন্য’ কিংবা ‘এক’।
অম্লান – উপমাটা মন্দ দেন নি! জানেন, আমারও একই মত, জীবনের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই।
প্রণবেন্দু – (একটু চুপ করে থেকে) না, তা নয়। জীবনের কোনো উদ্দেশ্যই নেই, সেটা অবশ্য আমি মানি না।
ছন্দা – (ফ্লাস্ক থেকে দু’কাপ চা দু’জনকে দিয়ে এবং নিজে এক কাপ নিয়ে) একটু ডিসটার্ব করছি আপনাদের। আগে চা খাওয়া যাক, তারপর আমারও একটা প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।
প্রণবেন্দু – তাই নাকি! বলুন, বলুন! আগে আপনার প্রশ্ন শুনি।
ছন্দা – আচ্ছা, আপনি অনুমান করতে পারেন, বুদ্ধদেব সুদীর্ঘকাল তপস্যা করে শেষপর্যন্ত কী উপলব্ধি করেছিলেন?
প্রণবেন্দু – ওরে ব্বাবা, এতো সাংঘাতিক প্রশ্ন! দেখুন, তিনি কী দেখেছিলেন সেটা তো বলে যাননি, তবে তাঁর উপদেশ আর কর্ম দেখে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
ছন্দা – হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার অনুমানটাই শুনতে চাই।
প্রণবেন্দু – আমার মনে হয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বা বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু জন্মের ওপর যেহেতু নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই জন্যই তিনি নির্বাণ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।
ছন্দা – এই নির্বাণ তত্ত্বে বা হিন্দুদের মুক্তির তত্ত্বে যাঁদের আস্থা আছে তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু যাঁদের নেই তাঁদের কী করণীয়?
অম্লান – (হেসে) তাহলে তো শেষ পর্যন্ত হাতে থাকলো ‘চার্বাক’!
প্রণবেন্দু – দেখুন আপনি হাসছেন বটে, কিন্তু চার্বাকের উক্তির শেষ অর্ধেকটা বাদ দিলে যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেই কথাটি খুব খাঁটি কথা। চার্বাকের যে উক্তিটি প্রচলিত আছে, “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ / ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ”, আমার তো মনে হয়, চার্বাককে লঘু করে দেখাবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা শেষ অংশটা নিজেরা জুড়ে দিয়েছিলেন।
অম্লান – (হেসে) মনে হচ্ছে আপনি চার্বাকে বিশ্বাসী!
প্রণবেন্দু – ওই যে বললাম, চার্বাকের উক্তির প্রথম অংশটি সবারই কাম্য। আর আমি যদি চার্বাকে বিশ্বাসী হইও, তাহলেও কি কোনো সুবিধা হবে? সুখ কি হাতের মোয়া?
ছন্দা – তাহলে?
অম্লান – তাহলে আবার কী, আমরা আবার সেই সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’র ‘আমড়া তলার মোড়ে’ এসে পৌঁছলাম!
প্রণবেন্দু – (হাই তুলে) এবার কিছু খেয়ে শুয়ে পড়া যাক, কেমন! অনেক রাত হলো। কাল বরং আবার গল্প করা যাবে।
ছন্দা – ওমা, সত্যিই তো অনেক রাত হয়েছে। কথায় কথায় খেয়ালই নেই। আপনি বয়স্ক মানুষ, শুধু শুধু আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।
প্রণবেন্দু – না না, তা কেন! আমার তো ভালোই লাগছিল।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
(প্রণবেন্দু ঘুম থেকে উঠে ট্রেনের জানালার দিকে চেয়ে বসে আছেন। অম্লান তখনও ঘুমোচ্ছেন। ছন্দা এইমাত্র উঠেছেন।)
প্রণবেন্দু – সুপ্রভাত!
ছন্দা – (হেসে) হ্যাঁ, সুপ্রভাত!
প্রণবেন্দু – রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
ছন্দা – আমার ট্রেনে খুব একটা ভালো ঘুম হয় না। ওনার আবার ট্রেনেই নাকি ভালো ঘুম হয়। আপনি ঘুমিয়েছিলেন?
প্রণবেন্দু – না, আমার এমনিতেই কখনও ভালো ঘুম হয় না। খামোকা ট্রেনকে দোষ দিয়ে কী লাভ!
(ইতিমধ্যে অম্লানের ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠে নমস্কার বিনিময়ের পর চা-ওয়ালাকে ডেকে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো।)
ছন্দা – আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে আরও ঘন্টা কয়েক বোধহয় বাকি আছে। তার আগে আমাদের আলোচনাটা শেষ করলে ভালো হয়।
প্রণবেন্দু – (হাসতে হাসতে) শেষ করতে হবে? এই আলোচনার কি শেষ আছে? আসলে নানা মুনির নানা মত। অনেক জটিল তত্ত্ব। অনেক মোটা মোটা বই। অনেক রকম ব্যাখ্যা।
অম্লান – তা হোক, আমরা আপনার অভিমত জানতে আগ্রহী।
প্রণবেন্দু – ঠিক আছে। তা কাল আমরা আলোচনাটা কোথায় যেন স্থগিত রেখেছিলাম?
অম্লান – (হাসতে হাসতে) আমড়াতলায়।
প্রণবেন্দু – (অবাক হয়ে) আমড়াতলায়! (তারপর মনে পড়তে) হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমড়াতলায়।
ছন্দা – বলুন আপনি!
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমাদের সবারই আসলে হাত পা বাঁধা। জন্ম গ্রহণে যেমন আমাদের কোনো হাত নেই, তেমনি মৃত্যুতেও কোনো হাত নেই। সুখ বলুন, শান্তি বলুন, কোনো কিছুতেই মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। (একটু থেমে জল খেলেন, তারপর জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন) তবু সামনে দুটো পথ আছে।
অম্লান ও ছন্দা – কী পথ?
প্রণবেন্দু – প্রথম পথ হচ্ছে, “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় / আরও-এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে / খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে; / ক্লান্ত, ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে / সেই ক্লান্তি নাই”।
(অম্লান ও ছন্দা একদৃষ্টিতে প্রণবেন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রণবেন্দু চোখ বুজে আছেন।)
অম্লান – (ধীরে ধীরে) শেষ লাইনে কিন্তু আছে, “আমরা দু’জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”।
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, জীবনের ভাঁড়ার যা আছে, সে সব যারা পছন্দ করে তারা তা নিয়ে সব কিছু ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো জীবনের মানে বা উদ্দেশ্য হতে পারে না! প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের জন্মানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
ছন্দা – শুনেছি সব ধর্মেরই সার কথা, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ।
প্রণবেন্দু – তা মানলাম। কিন্তু এই ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ বলতে আপনি কী বোঝেন? আর সেটা কী করেই বা সম্ভব?
অম্লান – বিষয়টা নিঃসন্দেহে জটিল। যাইহোক আপনি আপনার আর একটি পথের কথা বলুন।
প্রণবেন্দু – ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য বা তাঁর কৃপা পাওয়ার জন্য পুজো-আচ্চা, ঘন্টানাড়া, চরণামৃত খাওয়া আমি নিরর্থক বলে মনে করি। কারণ কাজের কাজ না করে শুধুমাত্র স্তাবকতায় ঈশ্বর তো দূর, কোনো প্রকৃত সজ্জন মানুষেরও কৃপালাভ করা যায় না। আমি এসবকে নিছকই পন্ডশ্রম মনে করি।
ছন্দা – একটা প্রশ্ন করব? আপনি তো আপনার আশ্রমে মন্দির স্থাপন করেছেন। সেখানে পুজো-আচ্চা হয় না?
প্রণবেন্দু – না, সে সব কিছু হয় না। শুধু বছরে একদিন, আমার উপাস্য মহাপুরুষের জন্মদিনটি আমরা কয়েকজন মিলে ‘সেলিব্রেট’ করি।
ছন্দা – ব্যাস! সারাদিন মন্দিরে আর কিছু হয় না?
প্রণবেন্দু – মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা আমি মন্দিরে বসে থাকি। মনে মনে তাঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা, তর্ক করি। কিন্তু কে আর কবে তাঁর সঙ্গে তর্কে এঁটে উঠেছে? শেষ পর্যন্ত তাঁর কথায় ‘কনভিন্সড’ হয়ে ফিরে আসি। এছাড়া আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। আসল কথাটি কী জানেন, “রুদ্ধ দ্বারে দেবালয়ের কোণে / কেন আছিস ওরে / অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে / কাহারে তুই খুঁজিস সঙ্গোপনে / নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে / দেবতা নেই ঘরে”। আর তাই দ্বিতীয় বা একমাত্র অবশিষ্ট পথ হচ্ছে, এই জীবনকে উৎসর্গ করা।
অম্লান – কিন্তু কী ভাবে?
প্রণবেন্দু – “ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির, / মূক সবে, ম্লান মুখে / লেখা শুধু শত শতাব্দীর / বেদনার করুণ কাহিনী...। এই সব মূঢ়, ম্লান, মূক মুখে দিতে হবে ভাষা...”।
অম্লান – এবার শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে, জীবনের এই যে জটিলতা, আপনি যাকে অঙ্কের সরলীকরণ বলেছেন, তার উত্তরটা কী? শূন্য, নাকি এক?
প্রণবেন্দু – (প্রাণখোলা হাসি হেসে) না, না, কখনই শূন্য নয়, এক। সব এক। সবাই এক। এটাই শেষ কথা। এটা উপলব্ধি করাই বোধহয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
অম্লান – কিন্তু এই উপলব্ধিতে পৌঁছনো কি আদৌ সম্ভব?
প্রণবেন্দু – অসম্ভব বলব না, তবে প্রায় অসম্ভবও। বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, বিদ্যাসাগর এই ধরনের কিছু মানুষই এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজের মতো করে কাজ করে গেছেন। (একটু থেমে) এবার উঠুন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। (একটা ফোন এলো) হ্যাঁ, ডাক্তার সেন, বলুন! আরে কী মুশকিল, আপনি আবার স্টেশনে আসতে গেলেন কেন? না না, আমার আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
ছন্দা – আমরা আগামী অক্টোবরে হরিদ্বার যাব। আপনার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে দেখা করব।
প্রণবেন্দু – স্বাগতম! আমি অপেক্ষায় থাকব। নমস্কার!
চরিত্র : প্রণবেন্দু (বয়স ৭০, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বর্তমানে নিজের আশ্রমে থাকেন, অকৃতদার), শ্যামল (প্রণবেন্দুর ভাগ্নে), অনিমা (শ্যামলের স্ত্রী), অম্লান (প্রণবেন্দুর সহযাত্রী), ছন্দা (অম্লানের স্ত্রী)।
(প্রথম দৃশ্য)
(দিল্লী-হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর বাতানুকুল কুপে তিনজন ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে মিনিট দশেক বাকি। এমন সময় শ্যামল, প্রণবেন্দু ও অনিমার প্রবেশ, সঙ্গে একটি স্যুটকেশ ও একটি সাইডব্যাগ।)
শ্যামল – মামাবাবু!
প্রণবেন্দু – বল্!
শ্যামল – এত তাড়াহুড়ো করে তোমার সাধনের কাছে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না।
প্রণবেন্দু – (হেসে) অনেকদিন আগেই ওর কাছে এই সময় যাব বলে ঠিক হয়ে আছে। অহেতুক যাওয়া পিছিয়ে দেব কেন?
অনিমা – কয়েকটা দিন আপনার সঙ্গে কী ভালো যে কাটলো!
প্রণবেন্দু – (ঘড়ি দেখে) ট্রেন ছাড়ার সময় হলো, এবার তোরা আয়!
(স্বামী-স্ত্রী দুজনে প্রণবেন্দুকে প্রণাম করলো)
শ্যামল – আমরা ঠিক করেছি, এপ্রিল নাগাদ ছেলেকে নিয়ে তোমার আশ্রমে গিয়ে কয়েকদিন থাকব।
অনিমা – তুমি আশীর্বাদ কোরো, ও যেন মানুষ হয়।
প্রণবেন্দু – (হেসে) আজকাল সবার এই এক রোগ। ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে ভেবে ভেবেই মরলো। তরুণ তো ভালো ছেলে, এত ভাবছিস কেন? বাড়ি যা। চিন্তা করিস না। এপ্রিল মাসে আসিস। দেখা হবে।
অনিমা – সাবধানে যাবে। পৌঁছে একটা ফোন করবে।
প্রণবেন্দু – তোরা শান্তিতে থাকিস। আনন্দে থাকিস।
(স্বামী-স্ত্রীর প্রস্থান)
(অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়লো। কম বয়সের তরুণটি বাঙ্কের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন। প্রণবেন্দু লক্ষ্য করলেন, ভদ্রমহিলা একটি পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন, আর তাঁকে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করছেন। ভদ্রলোক একটি খবরের কাগজ পড়ছেন।)
ছন্দা – (প্রণবেন্দুকে) নমস্কার!
প্রণবেন্দু – নমস্কার!
অম্লান – (খবরের কাগজ পাশে রেখে) আপনাকে নমস্কার জানাই।
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, আপনাকেও নমস্কার জানাই। তা আপনারা কোথায় থাকেন? দিল্লী?
ছন্দা – গত বছর পর্যন্ত দিল্লীতেই ছিলাম, এ বছর কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছি আমরা। ছেলে দেরাদুনে পড়ে, তার সঙ্গে দেখা করে ফিরছি।
প্রণবেন্দু – তাই নাকি! ছেলের বয়স কত?
ছন্দা – এই সবে বারো পেরিয়েছে।
অম্লান – (বাধা দিয়ে) এই তিন মাস হলো তেরো পেরিয়েছে, এখন চোদ্দ চলছে।
ছন্দা – মোটেও না!
প্রণবেন্দু – (হেসে) কোন্ ক্লাসে পড়ে?
ছন্দা – এ বছর ক্লাস নাইনে উঠলো।
প্রণবেন্দু – আপনাদের একটি মাত্র ছেলে, তাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়, তাই না?
(ছন্দা নিরুত্তর)
অম্লান – আসলে আমার বদলির চাকরি, এছড়া কোনো উপায়ও নেই। আর একসময় আমিও ঐ স্কুলে পড়েছি। আর তাই ঐ স্কুলটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।
ছন্দা – আপনি কি দিল্লীতেই থাকেন?
প্রণবেন্দু – দিল্লীতে আমার ভাগ্নে থাকে, একটু আগে যাকে দেখলেন। আমার বাড়ি হরিদ্বারে। আগে, চাকরিজীবনে দিল্লীতেই ছিলাম। এখন আমি বছরে প্রায় দশমাস হরিদ্বারে থাকি, বাকি মাস দুয়েক আমার কয়েকজন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাই।
ছন্দা – তাঁরা আপনার শিষ্য বুঝি?
প্রণবেন্দু – (হেসে) আপনি শিষ্য বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, তা নয়। আমি কাউকে কোনো দীক্ষা দিই না। আমার সেই যোগ্যতাই বলুন বা বিশ্বাসই বলুন, কোনোটাই নেই। আসলে ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও ওদের খুব ভালোবাসি। মাঝে মাঝে ওদের দেখতে খুব ইচ্ছে করে। তাই দেখা করতে যাই।
ছন্দা – আশ্রমে কি আপনি এবং আপনার শিষ্যরা থাকেন?
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি যেখানে থাকি, সেটাকে আশ্রম না বললেও চলে। আমি একা মানুষ। চাকরি থেকে অবসরের পর আজ বারো বছর হলো হরিদ্বারে জমি কিনে একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকি। এমনিতে আমরা ওখানে তিনজন থাকি। তবে কিছু পরিচিত মানুষজন আছেন, তাঁরা নিয়মিত আসেন।
অম্লান – আপনি দিল্লীতে কোথায় চাকরি করতেন?
প্রণবেন্দু – আমি (একটু থেমে) জে এন ইউ-তে দর্শনের অধ্যাপক ছিলাম। বারো বছর হলো অবসর গ্রহণ করেছি।
অম্লান – (খুব খুশি হয়ে) যদি কিছু মনে না করেন, আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনার এ ব্যাপারে অভিমত জানতে চাইলে, কোনো আপত্তি নেই তো?
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। বেশি লেখাপড়া জানি না। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাব।
ছন্দা – জানেন, আমার না এই রকম কোনো আশ্রম, একটা ছোট্ট মন্দির, যেখানে লোকজনের ভিড় নেই, নিরিবিলি, সেখানে চুপ করে সারাটা সন্ধ্যে বসে থাকতে খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে।
প্রণবেন্দু – বাঃ বাঃ, খুব ভালো। তা আপনারা এসে দিন কয়েক আমার ওখানে ঘুরে যান না! কোনো অসুবিধে হবে না।
অম্লান – আপনার যদি কোনো কার্ড থাকে, তাহলে আমাকে দেবেন?
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ আছে। (ব্যাগ হাতড়ে একটা কার্ড বের করে অম্লানকে দিলেন)। হ্যাঁ, আপনার কী প্রশ্ন আছে বলছিলেন!
অম্লান – আচ্ছা, আমাদের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য কী?
প্রণবেন্দু – (দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁরা খুব উৎসুক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হেসে বললেন) দেখুন, মানুষের জীবনের কাজকর্ম, গতিপ্রকৃতি, বিশেষত শেষ পরিণতির কথা ভাবলে, যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষের মনে হতে বাধ্য যে, এই জীবনের কোনো অর্থ হয় না বা এর কোনো দরকার ছিল না। যেমন ধরুন, অনেকটা সেই ছোটবেলায় করা ‘সরল করো’ অঙ্কের মতো আর কী! অনেক লম্বা অঙ্ক, করতে করতে শেষ পর্যন্ত উত্তর বের হলো ‘শূন্য’ কিংবা ‘এক’।
অম্লান – উপমাটা মন্দ দেন নি! জানেন, আমারও একই মত, জীবনের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই।
প্রণবেন্দু – (একটু চুপ করে থেকে) না, তা নয়। জীবনের কোনো উদ্দেশ্যই নেই, সেটা অবশ্য আমি মানি না।
ছন্দা – (ফ্লাস্ক থেকে দু’কাপ চা দু’জনকে দিয়ে এবং নিজে এক কাপ নিয়ে) একটু ডিসটার্ব করছি আপনাদের। আগে চা খাওয়া যাক, তারপর আমারও একটা প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।
প্রণবেন্দু – তাই নাকি! বলুন, বলুন! আগে আপনার প্রশ্ন শুনি।
ছন্দা – আচ্ছা, আপনি অনুমান করতে পারেন, বুদ্ধদেব সুদীর্ঘকাল তপস্যা করে শেষপর্যন্ত কী উপলব্ধি করেছিলেন?
প্রণবেন্দু – ওরে ব্বাবা, এতো সাংঘাতিক প্রশ্ন! দেখুন, তিনি কী দেখেছিলেন সেটা তো বলে যাননি, তবে তাঁর উপদেশ আর কর্ম দেখে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
ছন্দা – হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার অনুমানটাই শুনতে চাই।
প্রণবেন্দু – আমার মনে হয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বা বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু জন্মের ওপর যেহেতু নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই জন্যই তিনি নির্বাণ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।
ছন্দা – এই নির্বাণ তত্ত্বে বা হিন্দুদের মুক্তির তত্ত্বে যাঁদের আস্থা আছে তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু যাঁদের নেই তাঁদের কী করণীয়?
অম্লান – (হেসে) তাহলে তো শেষ পর্যন্ত হাতে থাকলো ‘চার্বাক’!
প্রণবেন্দু – দেখুন আপনি হাসছেন বটে, কিন্তু চার্বাকের উক্তির শেষ অর্ধেকটা বাদ দিলে যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেই কথাটি খুব খাঁটি কথা। চার্বাকের যে উক্তিটি প্রচলিত আছে, “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ / ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ”, আমার তো মনে হয়, চার্বাককে লঘু করে দেখাবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা শেষ অংশটা নিজেরা জুড়ে দিয়েছিলেন।
অম্লান – (হেসে) মনে হচ্ছে আপনি চার্বাকে বিশ্বাসী!
প্রণবেন্দু – ওই যে বললাম, চার্বাকের উক্তির প্রথম অংশটি সবারই কাম্য। আর আমি যদি চার্বাকে বিশ্বাসী হইও, তাহলেও কি কোনো সুবিধা হবে? সুখ কি হাতের মোয়া?
ছন্দা – তাহলে?
অম্লান – তাহলে আবার কী, আমরা আবার সেই সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’র ‘আমড়া তলার মোড়ে’ এসে পৌঁছলাম!
প্রণবেন্দু – (হাই তুলে) এবার কিছু খেয়ে শুয়ে পড়া যাক, কেমন! অনেক রাত হলো। কাল বরং আবার গল্প করা যাবে।
ছন্দা – ওমা, সত্যিই তো অনেক রাত হয়েছে। কথায় কথায় খেয়ালই নেই। আপনি বয়স্ক মানুষ, শুধু শুধু আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।
প্রণবেন্দু – না না, তা কেন! আমার তো ভালোই লাগছিল।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
(প্রণবেন্দু ঘুম থেকে উঠে ট্রেনের জানালার দিকে চেয়ে বসে আছেন। অম্লান তখনও ঘুমোচ্ছেন। ছন্দা এইমাত্র উঠেছেন।)
প্রণবেন্দু – সুপ্রভাত!
ছন্দা – (হেসে) হ্যাঁ, সুপ্রভাত!
প্রণবেন্দু – রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
ছন্দা – আমার ট্রেনে খুব একটা ভালো ঘুম হয় না। ওনার আবার ট্রেনেই নাকি ভালো ঘুম হয়। আপনি ঘুমিয়েছিলেন?
প্রণবেন্দু – না, আমার এমনিতেই কখনও ভালো ঘুম হয় না। খামোকা ট্রেনকে দোষ দিয়ে কী লাভ!
(ইতিমধ্যে অম্লানের ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠে নমস্কার বিনিময়ের পর চা-ওয়ালাকে ডেকে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো।)
ছন্দা – আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে আরও ঘন্টা কয়েক বোধহয় বাকি আছে। তার আগে আমাদের আলোচনাটা শেষ করলে ভালো হয়।
প্রণবেন্দু – (হাসতে হাসতে) শেষ করতে হবে? এই আলোচনার কি শেষ আছে? আসলে নানা মুনির নানা মত। অনেক জটিল তত্ত্ব। অনেক মোটা মোটা বই। অনেক রকম ব্যাখ্যা।
অম্লান – তা হোক, আমরা আপনার অভিমত জানতে আগ্রহী।
প্রণবেন্দু – ঠিক আছে। তা কাল আমরা আলোচনাটা কোথায় যেন স্থগিত রেখেছিলাম?
অম্লান – (হাসতে হাসতে) আমড়াতলায়।
প্রণবেন্দু – (অবাক হয়ে) আমড়াতলায়! (তারপর মনে পড়তে) হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমড়াতলায়।
ছন্দা – বলুন আপনি!
প্রণবেন্দু – দেখুন, আমাদের সবারই আসলে হাত পা বাঁধা। জন্ম গ্রহণে যেমন আমাদের কোনো হাত নেই, তেমনি মৃত্যুতেও কোনো হাত নেই। সুখ বলুন, শান্তি বলুন, কোনো কিছুতেই মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। (একটু থেমে জল খেলেন, তারপর জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন) তবু সামনে দুটো পথ আছে।
অম্লান ও ছন্দা – কী পথ?
প্রণবেন্দু – প্রথম পথ হচ্ছে, “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় / আরও-এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে / খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে; / ক্লান্ত, ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে / সেই ক্লান্তি নাই”।
(অম্লান ও ছন্দা একদৃষ্টিতে প্রণবেন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রণবেন্দু চোখ বুজে আছেন।)
অম্লান – (ধীরে ধীরে) শেষ লাইনে কিন্তু আছে, “আমরা দু’জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”।
প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, জীবনের ভাঁড়ার যা আছে, সে সব যারা পছন্দ করে তারা তা নিয়ে সব কিছু ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো জীবনের মানে বা উদ্দেশ্য হতে পারে না! প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের জন্মানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
ছন্দা – শুনেছি সব ধর্মেরই সার কথা, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ।
প্রণবেন্দু – তা মানলাম। কিন্তু এই ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ বলতে আপনি কী বোঝেন? আর সেটা কী করেই বা সম্ভব?
অম্লান – বিষয়টা নিঃসন্দেহে জটিল। যাইহোক আপনি আপনার আর একটি পথের কথা বলুন।
প্রণবেন্দু – ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য বা তাঁর কৃপা পাওয়ার জন্য পুজো-আচ্চা, ঘন্টানাড়া, চরণামৃত খাওয়া আমি নিরর্থক বলে মনে করি। কারণ কাজের কাজ না করে শুধুমাত্র স্তাবকতায় ঈশ্বর তো দূর, কোনো প্রকৃত সজ্জন মানুষেরও কৃপালাভ করা যায় না। আমি এসবকে নিছকই পন্ডশ্রম মনে করি।
ছন্দা – একটা প্রশ্ন করব? আপনি তো আপনার আশ্রমে মন্দির স্থাপন করেছেন। সেখানে পুজো-আচ্চা হয় না?
প্রণবেন্দু – না, সে সব কিছু হয় না। শুধু বছরে একদিন, আমার উপাস্য মহাপুরুষের জন্মদিনটি আমরা কয়েকজন মিলে ‘সেলিব্রেট’ করি।
ছন্দা – ব্যাস! সারাদিন মন্দিরে আর কিছু হয় না?
প্রণবেন্দু – মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা আমি মন্দিরে বসে থাকি। মনে মনে তাঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা, তর্ক করি। কিন্তু কে আর কবে তাঁর সঙ্গে তর্কে এঁটে উঠেছে? শেষ পর্যন্ত তাঁর কথায় ‘কনভিন্সড’ হয়ে ফিরে আসি। এছাড়া আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। আসল কথাটি কী জানেন, “রুদ্ধ দ্বারে দেবালয়ের কোণে / কেন আছিস ওরে / অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে / কাহারে তুই খুঁজিস সঙ্গোপনে / নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে / দেবতা নেই ঘরে”। আর তাই দ্বিতীয় বা একমাত্র অবশিষ্ট পথ হচ্ছে, এই জীবনকে উৎসর্গ করা।
অম্লান – কিন্তু কী ভাবে?
প্রণবেন্দু – “ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির, / মূক সবে, ম্লান মুখে / লেখা শুধু শত শতাব্দীর / বেদনার করুণ কাহিনী...। এই সব মূঢ়, ম্লান, মূক মুখে দিতে হবে ভাষা...”।
অম্লান – এবার শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে, জীবনের এই যে জটিলতা, আপনি যাকে অঙ্কের সরলীকরণ বলেছেন, তার উত্তরটা কী? শূন্য, নাকি এক?
প্রণবেন্দু – (প্রাণখোলা হাসি হেসে) না, না, কখনই শূন্য নয়, এক। সব এক। সবাই এক। এটাই শেষ কথা। এটা উপলব্ধি করাই বোধহয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
অম্লান – কিন্তু এই উপলব্ধিতে পৌঁছনো কি আদৌ সম্ভব?
প্রণবেন্দু – অসম্ভব বলব না, তবে প্রায় অসম্ভবও। বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, বিদ্যাসাগর এই ধরনের কিছু মানুষই এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজের মতো করে কাজ করে গেছেন। (একটু থেমে) এবার উঠুন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। (একটা ফোন এলো) হ্যাঁ, ডাক্তার সেন, বলুন! আরে কী মুশকিল, আপনি আবার স্টেশনে আসতে গেলেন কেন? না না, আমার আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
ছন্দা – আমরা আগামী অক্টোবরে হরিদ্বার যাব। আপনার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে দেখা করব।
প্রণবেন্দু – স্বাগতম! আমি অপেক্ষায় থাকব। নমস্কার!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন