সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

০৬) শ্রাবণী দাশগুপ্ত

এক যাত্রায়
শ্রাবণী দাশগুপ্ত



হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখলাম, পাঁচটা পঞ্চাশ। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে মিনিট কুড়ি। ছ’টা পাঁচে ছাড়বে। ভাগ্নে আমার ছোট সুটকেস আর পেটমোটা ব্যাগটা বাঙ্কে তুলে দিয়ে ঢিপঢিপ প্রণাম ঠুকে “এলাম মেজমামা! সাবধানে যেও,” বলে দুদ্দাড় করে নেমে গেল। বাঁচল যেন। সোয়া সাত ঘন্টার জার্নি। জানালার ধার পাইনি। ওইদিকের তিনজনের সীটে এখন দুজন। নতুন স্বামী-স্ত্রী মনে হলো। মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছি। বাইরে আলো ফুটেছে সবে। সংবাদপত্র, জল দিয়ে গেল। ট্রেন ছাড়ল। মোবাইলে মিতার কল। “হ্যাঁ... চিন্তা কোরো না... ভূষণকে পাঠিও একটা নাগাদ... হ্যাঁ বেশ ভারী... দিদি অনেক খাবার বানিয়ে... তোমার জন্যে সিল্ক... সুন্দর... হ্যাঁ... রাখছি... কাটছে...।” সন্তর্পণে এদিক ওদিক তাকালাম। জোরে কথা বলছিলাম? না, সবাই মোবাইলগ্রস্ত।

“সুপ্রভাত,” আমার পাশের সীট থেকে দরাজ গলা। কাঁপা কাঁপা গলায় সুপ্রভাত ফিরিয়ে দিলাম। কাশি উঠবে উঠবে করছে। দমকা কাশিতে বুক চেপে হাঁফাচ্ছি। তলপেট ফেটে যাচ্ছে। দু’চার ফোঁটা বেরিয়ে এলো। সামলাতে সামলাতে টয়লেটে। স্পিড নিয়েছে ট্রেন। ফিরে এসে ঝপাং করে বসলাম। সঙ্কোচ হচ্ছিল। আমার গতিবিধি ভদ্রলোককে বিরক্ত করছে নাকি? দেখি, ওঁর হাতে বই। স্বামীজীর লেখা। বললাম, “কলকাতার কোথায় থাকেন? আপনার নাম?” হাসলেন, যেন হেলিকপ্টার থেকে নিচের বস্তির দিকে তাকিয়ে। “আমি সৌমিত্র উকিল। কলকাতায় না, বাইশ বছর ধরে টোরেন্টোতে... ইউএস। আপনি?” পা দু’টো একটু ছড়ানো ছিল। গুটিয়ে নিলাম। “আ-মি জ্যোতির্ময় নাগ। আমিও কলকাতায় থাকি না। দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম।” টেবিলে চা-প্রাতঃরাশ দিয়ে গেছে। হাত কাঁপে আমার সব সময়ে। ফ্লাস্কের গরম জল চল্‌কে পড়ল। আড়চোখে দেখলাম ওঁকে।

“আমি আপনার শহরে যাচ্ছি। প্রত্যেক জগদ্ধাত্রী পুজোতে এসে মিশনে থাকি। স্ত্রী চান না আসতে। বছর সাতেক আগে একবার এসে... ধুলো-ধোঁয়ায়...।” প্রত্যেকটি শব্দ আলাদা স্পষ্ট উচ্চারণ করছেন। মাথায় সাদা ধপধপে ঘন চুল। আমি পাতলা চুলে কলপ লাগাই। ওঁর সবুজ পাঞ্জাবি আর পায়জামা কি টোরেন্টো থেকে কেনা! একটু ভেবে বললাম, “ও! কখনো যাওয়া হয়নি ওইদিকটা। ডোন্ট মাইন্ড, আপনি বোধহয় আমারই বয়সী?” “আমি সেভেন্টি থ্রী। রোজ ঘণ্টা দুই হাঁটাহাঁটি মাস্ট।” ওঁর চোখ বইখানায়। মিইয়ে গিয়েছি, “স্যর, আমার সাতান্ন। আসলে একসাথে হাজার রোগ... ওপেনহার্টও দু’বছর আগে... বৌ একা ছাড়তে চায় না।” উনি বইতে বিশেষ মগ্ন হয়েছেন দেখলাম।

খেতে গিয়ে ডাল ওলটালো টেবিলে, সীটে, নিচে, আমার প্যান্টে। কোনো রকমে খবরকাগজ চাপা দিলাম। পেটে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। উনি ওয়েটারকে ডাকলেন, “সাফা কর্‌ দো। তুরন্ত্‌।” আমতা আমতা করলাম, “আ-চ্ছা দেবে’খন... দীজীয়েগা। ক্যা? ঠিক হ্যায়?” ওয়েটার ততক্ষণে মোছা শুরু করেছে। আমায় একগোছা পেপার ন্যাপকিন ধরিয়ে দিল। ওদিকে তিনজনের সীট খালি। আমি বদল করে সরে বসলাম। বড্ড ঝিমুনি আসছে।

কিছু ভাবছিলাম কি? হঠাৎ কাঁধে ভারী হাত, “স্টেশন আর মিনিট দশেক। আমি পনের দিন থাকছি এখানে। আপনি এলে, আই’ল বী হ্যাপ্পী।” চমকে উঠে, বিষম খেয়ে বললাম, “থ্যাঙ্কু্ স্যর! আমি যাব। নিশ্চয়ই”।

৩টি মন্তব্য: