ধুলোঝাড়া আয়না
রিমা দাস
বিদীপ্তামিতার দুটো হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে গভীর চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে নার্সের সাথে ওটির দিকে চলে গেল। এই নার্সিং হোমের এ তল্লাটে বেশ সুনাম আছে, গাইনীর ডাক্তারটিরও পশার খুব ভালো। বলেছে, আধঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। দু’ঘণ্টার পর পেশেন্ট বাড়ি চলে যেতে পারবে। বিদীপ্তা নিজের রিস্কে সব কিছু করলেও, উপস্থিত সাক্ষী একমাত্র সে। যদি কিছু হয়... কী এক টেনশানে বিন্দু বিন্দু সময়। পৃথিবীতে তার মতোন অভাগা ক’জন মহিলা হবে যাদের এইরকম পরিস্থিতির সামনা সামনি হতে হয়!
সাতবছর আগে বিদীপ্তা জলপাইগুড়ি থেকে জে এন ইউ-তে পড়তে এসেছিল। সুমনের সাথে আলাপ হয়েছিল ম্যাক্সমূলারভবনে। কখনও একা কখনও অন্য বন্ধুদের সাথে সে বহুবার তাদের বাড়িতে এসেছে। জড়তাহীন ঝরঝরে এই মেয়েটি গল্প করতে ভালোবাসে বলে মিতার সাথেও বেশ বকবক করত। মিতা ও তার স্বামীর মধ্যে হেট–লাভ সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সুমন বড় হবার পর নিজের বৃত্ত তৈরি করে নেয়। তাই পরিবার থেকেও মিতা সারাজীবন একা। সেই একাকী সময়ে মাঝে মাঝে বিদীপ্তার সঙ্গ তাকে আনন্দ দিত। যখন ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল তখন মনে মনে খুশি হলেও কোনও উচ্ছ্বাস সে দেখায় নি। ছেলের বউয়ের কাছ থেকে কোনও আশাও সে রাখে নি। কিন্তু মিতার সমীকরণ মিললো না। বুদ্ধিমতী বিদীপ্তা সংসারে মিতার অবস্থানটা আগেই বুঝে গিয়েছিল। বিয়ের পর মা-ছেলে কিংবা শ্বশুর–শাশুড়ির জীবনে জোড়া দেবার ক্যাটালিস্ট না হয়ে সে অন্য ভূমিকা নিল। মিতার একাকীত্বের বন্ধু হলো। কনফিডেন্সহীন মিতাকে সাথে নিয়ে ভর্তি হলো মিউজিক ক্লাসে। গ্যারেজের একপাশে জিনিসপত্র জোগাড় করে শেখাল ছোট ছোট পটারির কাজ। লেডিস-পার্লারে নিয়ে গিয়ে নতুন মোড়কে ঢেকে দিল তাকে। ছুটিতে মাঝে মধ্যে বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডায় ডেকে নিত মিতাকে। মিতার বন্ধ পাপড়িগুলো বিদীপ্তার স্পর্শে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল। যখন একদিকে গড়ার নেশায় বিদীপ্তা মত্ত, তখন ভাঙন দেখা দিল অন্য কূলে। রাহুল সুমনের বহুদিনকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুখে দুঃখে একে অপরের আশ্রয়। না, সে নিজেও কোনোদিন কিছু টের পায় নি। বিদিপ্তার কাছে ধরা পরে গেল তাদের সেই সম্পর্কের বুনোট। কিছুদিন চাপা অশান্তি, তর্কাতর্কি -- তারপর একদিন বিদীপ্তা চলে গেল ওয়ার্কিং ওম্যানদের হস্টেলে। ডিভোর্সের মামলা সে ঐখান থেকে ফাইল করবে।
দিন দশেক পর এক অসুবিধার কথা জানিয়ে বিদীপ্তার ফোন এলো। তার জীবনের ঐ বড় ধাক্কায় সে আর এখন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ব্যতিক্রম মিতা। ছেলের বউয়ের কথা সে মন দিয়ে শুনল। মিতা জানে, বিদীপ্তার আত্মসম্মান প্রবল, সে কোনও সাহাহ্য চাইছে না, শুধু একটা ঘটনার কথা তাকে জানিয়ে রাখছে। যদি কিছু হয়, জলপাইগুড়িতে তার বিধবা মা যেন জানতে পারে। আজ বিদীপ্তা ছেলের বউকে নয়, অসমবয়সী এক বন্ধুর বিপদে মানসিকভাবে তাকে সাহায্য করতে এই নার্সিং হোমের ওটির বাইরে বসে আছে। লাল আলোটা নিভে গেল।
- পেশেন্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে, আপনি দেখা করতে পারেন।
এক হাতে আড়াআড়ি ভাবে চোখ ঢেকে বিদীপ্তা শুয়ে আছে। মিতার ডাকে হাত সরিয়ে চোখ খুলল। যতই চেপে রাখার চেষ্টা করুক, মানসিক ভাবে যে সে কতটা বিপর্যস্ত, তা ওর চোখের নিচে কালি দেখেই অনুমান করা গেল। মিতাকে দেখে দু’চোখ দিয়ে জল বিনা বাধায় বেরিয়ে এলো। মিতাও কোনও কথা না বলে বিদীপ্তার কপালে হাত রাখল।
ঘণ্টা তিনেক পর বিদীপ্তাকে হস্টেলের রুমে পৌঁছে দিয়ে ওষুধগুলো আর জল সাইড- টেবিলে রেখে মিতা বলল--
- ওষুধগুলো মনে করে খেয়ে নিস। দু’দিন পর পিরিয়ড না হলে সাথে সাথে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবি, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, তখন কিন্তু আর দেরি করিস না। রাত্রে হাল্কা খাবার খাস। অনেকক্ষণ বাড়িছাড়া, টমিটাও না খেয়ে রয়েছে, এবার যাই রে। ফোন করিস।
ও হো তোকে একটা কথা বলা হয়নি, নেহেরু প্লেসের লেডিস পলিটেকনিক কলেজের আর্ট এন্ড ক্র্যাফট ক্লাসে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্সটায় গতকাল ভর্তি হয়ে গেছি। আগামী সোমবার থেকে ক্লাস শুরু হবে। পেন্টিংগুলো কিন্তু তোকেই বেচবো। বিদীপ্তা একহাত বাড়িয়ে দিল... বেস্ট অব লাক!
মিতার চলে যাওয়ার সময় বিদীপ্তা এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মা পাখির আর চিন্তা নেই, শাবক পাখি উড়তে শিখে গেছে।
বিদীপ্তামিতার দুটো হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে গভীর চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে নার্সের সাথে ওটির দিকে চলে গেল। এই নার্সিং হোমের এ তল্লাটে বেশ সুনাম আছে, গাইনীর ডাক্তারটিরও পশার খুব ভালো। বলেছে, আধঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। দু’ঘণ্টার পর পেশেন্ট বাড়ি চলে যেতে পারবে। বিদীপ্তা নিজের রিস্কে সব কিছু করলেও, উপস্থিত সাক্ষী একমাত্র সে। যদি কিছু হয়... কী এক টেনশানে বিন্দু বিন্দু সময়। পৃথিবীতে তার মতোন অভাগা ক’জন মহিলা হবে যাদের এইরকম পরিস্থিতির সামনা সামনি হতে হয়!
সাতবছর আগে বিদীপ্তা জলপাইগুড়ি থেকে জে এন ইউ-তে পড়তে এসেছিল। সুমনের সাথে আলাপ হয়েছিল ম্যাক্সমূলারভবনে। কখনও একা কখনও অন্য বন্ধুদের সাথে সে বহুবার তাদের বাড়িতে এসেছে। জড়তাহীন ঝরঝরে এই মেয়েটি গল্প করতে ভালোবাসে বলে মিতার সাথেও বেশ বকবক করত। মিতা ও তার স্বামীর মধ্যে হেট–লাভ সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সুমন বড় হবার পর নিজের বৃত্ত তৈরি করে নেয়। তাই পরিবার থেকেও মিতা সারাজীবন একা। সেই একাকী সময়ে মাঝে মাঝে বিদীপ্তার সঙ্গ তাকে আনন্দ দিত। যখন ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল তখন মনে মনে খুশি হলেও কোনও উচ্ছ্বাস সে দেখায় নি। ছেলের বউয়ের কাছ থেকে কোনও আশাও সে রাখে নি। কিন্তু মিতার সমীকরণ মিললো না। বুদ্ধিমতী বিদীপ্তা সংসারে মিতার অবস্থানটা আগেই বুঝে গিয়েছিল। বিয়ের পর মা-ছেলে কিংবা শ্বশুর–শাশুড়ির জীবনে জোড়া দেবার ক্যাটালিস্ট না হয়ে সে অন্য ভূমিকা নিল। মিতার একাকীত্বের বন্ধু হলো। কনফিডেন্সহীন মিতাকে সাথে নিয়ে ভর্তি হলো মিউজিক ক্লাসে। গ্যারেজের একপাশে জিনিসপত্র জোগাড় করে শেখাল ছোট ছোট পটারির কাজ। লেডিস-পার্লারে নিয়ে গিয়ে নতুন মোড়কে ঢেকে দিল তাকে। ছুটিতে মাঝে মধ্যে বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডায় ডেকে নিত মিতাকে। মিতার বন্ধ পাপড়িগুলো বিদীপ্তার স্পর্শে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল। যখন একদিকে গড়ার নেশায় বিদীপ্তা মত্ত, তখন ভাঙন দেখা দিল অন্য কূলে। রাহুল সুমনের বহুদিনকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুখে দুঃখে একে অপরের আশ্রয়। না, সে নিজেও কোনোদিন কিছু টের পায় নি। বিদিপ্তার কাছে ধরা পরে গেল তাদের সেই সম্পর্কের বুনোট। কিছুদিন চাপা অশান্তি, তর্কাতর্কি -- তারপর একদিন বিদীপ্তা চলে গেল ওয়ার্কিং ওম্যানদের হস্টেলে। ডিভোর্সের মামলা সে ঐখান থেকে ফাইল করবে।
দিন দশেক পর এক অসুবিধার কথা জানিয়ে বিদীপ্তার ফোন এলো। তার জীবনের ঐ বড় ধাক্কায় সে আর এখন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ব্যতিক্রম মিতা। ছেলের বউয়ের কথা সে মন দিয়ে শুনল। মিতা জানে, বিদীপ্তার আত্মসম্মান প্রবল, সে কোনও সাহাহ্য চাইছে না, শুধু একটা ঘটনার কথা তাকে জানিয়ে রাখছে। যদি কিছু হয়, জলপাইগুড়িতে তার বিধবা মা যেন জানতে পারে। আজ বিদীপ্তা ছেলের বউকে নয়, অসমবয়সী এক বন্ধুর বিপদে মানসিকভাবে তাকে সাহায্য করতে এই নার্সিং হোমের ওটির বাইরে বসে আছে। লাল আলোটা নিভে গেল।
- পেশেন্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে, আপনি দেখা করতে পারেন।
এক হাতে আড়াআড়ি ভাবে চোখ ঢেকে বিদীপ্তা শুয়ে আছে। মিতার ডাকে হাত সরিয়ে চোখ খুলল। যতই চেপে রাখার চেষ্টা করুক, মানসিক ভাবে যে সে কতটা বিপর্যস্ত, তা ওর চোখের নিচে কালি দেখেই অনুমান করা গেল। মিতাকে দেখে দু’চোখ দিয়ে জল বিনা বাধায় বেরিয়ে এলো। মিতাও কোনও কথা না বলে বিদীপ্তার কপালে হাত রাখল।
ঘণ্টা তিনেক পর বিদীপ্তাকে হস্টেলের রুমে পৌঁছে দিয়ে ওষুধগুলো আর জল সাইড- টেবিলে রেখে মিতা বলল--
- ওষুধগুলো মনে করে খেয়ে নিস। দু’দিন পর পিরিয়ড না হলে সাথে সাথে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবি, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, তখন কিন্তু আর দেরি করিস না। রাত্রে হাল্কা খাবার খাস। অনেকক্ষণ বাড়িছাড়া, টমিটাও না খেয়ে রয়েছে, এবার যাই রে। ফোন করিস।
ও হো তোকে একটা কথা বলা হয়নি, নেহেরু প্লেসের লেডিস পলিটেকনিক কলেজের আর্ট এন্ড ক্র্যাফট ক্লাসে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্সটায় গতকাল ভর্তি হয়ে গেছি। আগামী সোমবার থেকে ক্লাস শুরু হবে। পেন্টিংগুলো কিন্তু তোকেই বেচবো। বিদীপ্তা একহাত বাড়িয়ে দিল... বেস্ট অব লাক!
মিতার চলে যাওয়ার সময় বিদীপ্তা এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মা পাখির আর চিন্তা নেই, শাবক পাখি উড়তে শিখে গেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন