রেখো মা দাসেরে মনে
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
এই রকম একটা কিছু দেওয়ার জন্য আঁকুপাকু বেশ কিছুদিন ধরে, যদিও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রচুর সন্দেহ, দ্বিধা এবং ভয়ও একেবারে যে নেই, তাও কি বলা যায়? মার খাওয়া, তাই বা আটকাচ্ছে কে? ‘নমো যন্ত্র’ যুগে হাতে না হোক্ ভাতে- পাতে না হোক্, মনে তো মার খাবই... গালি শুনব। তখন ভাবব কেন যে অযথা, বোকার মতো!
ভাষা বাঙলা মরেছে। মরছে। উদারচরিতানাম্ তু বসুধৈবকুটুম্বকম্ -- এই রোগে। এত উদারতা? দূরকে করিলে নিকট বন্ধু / পরকে করিলে ঘর। আধুনিক হতে হতে, সকলের কথা ভাবতে ভাবতে, বেনোজল ঢুকছে সেই অনেকদিন আগে থেকে, তবু সমৃদ্ধ করেছে, ফসল ফলিয়েছে মাঠ ভরে। বাঙালি সার্থক সাহিত্য দিয়েছে পৃথিবীকে। সংস্কৃতের গা-ভরা ভারি অলঙ্কারে নড়েচড়ে বসার সুযোগ অপ্রতুল, আর চর্যাপদও কি তেমন করে পালন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল?
প্রথম আধুনিক মানুষটি গয়না-টয়না খুলে দিয়ে প্রথম চেষ্টা করে দেখেছিলেন ভাষাটা নিশ্বাস নিতে পারছে কিনা, তা তুমুল কষ্টসাধ্য হলেও অন্তত খানিকটা নড়েচড়ে পাশ ফিরে...। তারপর উণিশ শতকের শেষে যিনি বর্ণপরিচয়ের আলো নিয়ে দোরে দোরে ঘুরে আমাদের চোখ খুলছিলেন, তাঁর শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা কিম্বা ভ্রান্তিবিলাস আর মনে পড়ে কই? ভাষাসম্রাট তাকে রাজকীয় ঐশ্বর্যে পালন পোষণে, কমলাকান্তের দপ্তরে হাজির হওয়ার মতো সপ্রতিভ করে গেলেন। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক বাঙলা মায়ের এ্যাংলো তালপাতার সিপাইরা ক্যাট-ম্যাট-ফ্যাট-ব্যাট লড়াই করতে করতে নতুন যুগ। বেপথু কবিও শেষ অবধি “মধুহীন কোরো না গো তব মনঃ কোকনদে” ক্ষমাটমা চেয়ে নতুন ছাঁদের গয়নাগাঁটি গড়িয়ে দিলেন। বাঙালাভাষা শ্বাস ফেলে নতুন কায়দায় চুল বাঁধল, ফুরফুরে সুগন্ধ মাখল। ওদিকে বাঙলার আটপৌরে ঘরোয়া হুল্লোড়ে আলালের দুলাল, কিম্বা রসকলি হুতোম প্যাঁচার নতুন নক্সায়...! তারপর? নোবেল-মুকুট পড়ল বাঙলা। অতিবৃষ্টি বহুসৃষ্টির সরস বানে সোনার তরীর পালে হাওয়া। পথের নতুন পাঁচালি কিম্বা পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিঞার স্বপ্ন বা দিগন্তজোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ আমাদের বুকের মধ্যে। বিশ শতকের পুরোটাই বাঙলার সোনার ফসল... প্রাণ ভরে সেই সুস্বাদু সুগন্ধিত জলপান আপনি, আমি, আমরা সবাই। ভাষা আড়মোড়া ভেঙেছে নতুন সাজ করতে চেয়ে -- কিন্তু তখনো ‘আ মরি বাঙলাভাষা’।
ঔপনিবেশিক বেনোজল বিদেশি হলেও তার সারাৎসার ছিল এবং বাঙলা তখন নিজের ফসলের গন্ধ নিতে ব্যস্ত বলে তৎসম, তদ্ভব আর বিদেশি বিষয়ে সচেতন। কত শব্দ, তাদের স্পর্শ ও রূপ নতুন অভিধান ভরল... বাঙলা অভিধান। আমাদের সমৃদ্ধির অহঙ্কার কূল ছাপিয়ে গেল!
বিশ শতকের শেষে বিশ্বায়িত বাঙালি কী যে ভাবল জানি না... বোধকরি বাঙলা ভাবল এবার মরা গাঙে বান... যে তরীটা শুধু বাঙলার ঘাটে ঠেকে আছে, তাকে দেওয়া যাক সবর্জনের কর্ যাতে তরতরিয়ে বয়! কিনা, যাতে জাতে ওঠে। এ মোহ আবরণ বড় ঘোর অমানিশা! বিশিষ্টতা বজায় রাখলে ব্রাত্য, বহুজাতিকের মার্কা না পরলে জমানায় কে কদর করে? তাই বাঙলা নিজেকে বদলাতে উঠে পড়ে খড়ভূষি, এঁটোকাঁটা, কাকের পালকটালক যা পাওয়া যায়; বাছাবাছি ধোয়াধুয়ি সংস্কারের দরকার রইল না, গুঁজে দিলেই আধুনিক! বাঃ! কী ঔদার্য, কী ঔদার্য! স্বচ্ছন্দে ঢুকিয়ে দেওয়া অর্গাজম্, ইক্যুইপমেন্ট, ফেসিলিটি কিম্বা এপিসোড (তালিকা বড্ড লম্বা), ধামাকা, মস্তি, একা ছেড়ে দাও, আওয়ারা, (এখানেও বড় বিশদ তালিকা)! ব্যতিক্রমী ভাষায় বাঙলা লেখা আগেও ছিল, কিন্তু বাঙলাই।
যদিও সংবিধানে জাতীয় ভাষা বলে নেই কিছু, কিন্তু ওই দেশি ভাষাটি ক্রমাগত উদারতার ভাঙা বেড়া টপকে ঢুকছে তো ঢুকছেই। অসহ্য ভুলে-ভরা বাঙলায় কথা বললে বাঙালিরা বিগলিত হেঁ হেঁ, সুচিত্রা মিত্রের একলা চলো রে ছাপিয়েছে মেগাস্টারের হেঁড়ে গলায় একলা চলো রে... আমরা হলাম বারোয়ারি থুড়ি সার্বজনীন, আহা হা হা হা! উর্দূভাঙা জাতপাতহীন সেই ভাষার ভাষাভাষী সহজেই বলে, “বাঙ্লা একটি অতি শ্রুতিকটু ভাষা।” ওই সেই ভাষাটাই এখন আকণ্ঠ গিলছে বাঙলার বর্তমান পুত্রকন্যারা। বাঙলায় বাক্যালাপ লজ্জার বিষয়, সত্যজিত রায়ের ইংরেজি অনুবাদে “কী চাইছি/কী পাচ্ছি না” বোঝে। বিস্ময়! এখন বাঙালির কাছে সাধুভাষা ‘অতীত ভাষা’। হোক্ না তাই... সুন্দরী সুসজ্জিতার আভিজাত্য তাও গেল বুঝি?
পৃথিবীর আর কোন্ ভাষা এমন দুর্ভাগিনী? কোনো একদিন কোন্ এক ধূসর সন্ধ্যায় চাপা পড়ে যাবে এই ভাষা, তার খবর পেতে চাই না আমি। তবে আলো নিভে আসছে, কবর খোঁড়া দ্রুততর, দেখছি। অনুপায়, নিরুপায় কষ্টভয় তীব্রতর, হাতে রয়েছে বর্ণপরিচয়-এর আলো! হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি...!
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
এই রকম একটা কিছু দেওয়ার জন্য আঁকুপাকু বেশ কিছুদিন ধরে, যদিও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রচুর সন্দেহ, দ্বিধা এবং ভয়ও একেবারে যে নেই, তাও কি বলা যায়? মার খাওয়া, তাই বা আটকাচ্ছে কে? ‘নমো যন্ত্র’ যুগে হাতে না হোক্ ভাতে- পাতে না হোক্, মনে তো মার খাবই... গালি শুনব। তখন ভাবব কেন যে অযথা, বোকার মতো!
ভাষা বাঙলা মরেছে। মরছে। উদারচরিতানাম্ তু বসুধৈবকুটুম্বকম্ -- এই রোগে। এত উদারতা? দূরকে করিলে নিকট বন্ধু / পরকে করিলে ঘর। আধুনিক হতে হতে, সকলের কথা ভাবতে ভাবতে, বেনোজল ঢুকছে সেই অনেকদিন আগে থেকে, তবু সমৃদ্ধ করেছে, ফসল ফলিয়েছে মাঠ ভরে। বাঙালি সার্থক সাহিত্য দিয়েছে পৃথিবীকে। সংস্কৃতের গা-ভরা ভারি অলঙ্কারে নড়েচড়ে বসার সুযোগ অপ্রতুল, আর চর্যাপদও কি তেমন করে পালন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল?
প্রথম আধুনিক মানুষটি গয়না-টয়না খুলে দিয়ে প্রথম চেষ্টা করে দেখেছিলেন ভাষাটা নিশ্বাস নিতে পারছে কিনা, তা তুমুল কষ্টসাধ্য হলেও অন্তত খানিকটা নড়েচড়ে পাশ ফিরে...। তারপর উণিশ শতকের শেষে যিনি বর্ণপরিচয়ের আলো নিয়ে দোরে দোরে ঘুরে আমাদের চোখ খুলছিলেন, তাঁর শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা কিম্বা ভ্রান্তিবিলাস আর মনে পড়ে কই? ভাষাসম্রাট তাকে রাজকীয় ঐশ্বর্যে পালন পোষণে, কমলাকান্তের দপ্তরে হাজির হওয়ার মতো সপ্রতিভ করে গেলেন। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক বাঙলা মায়ের এ্যাংলো তালপাতার সিপাইরা ক্যাট-ম্যাট-ফ্যাট-ব্যাট লড়াই করতে করতে নতুন যুগ। বেপথু কবিও শেষ অবধি “মধুহীন কোরো না গো তব মনঃ কোকনদে” ক্ষমাটমা চেয়ে নতুন ছাঁদের গয়নাগাঁটি গড়িয়ে দিলেন। বাঙালাভাষা শ্বাস ফেলে নতুন কায়দায় চুল বাঁধল, ফুরফুরে সুগন্ধ মাখল। ওদিকে বাঙলার আটপৌরে ঘরোয়া হুল্লোড়ে আলালের দুলাল, কিম্বা রসকলি হুতোম প্যাঁচার নতুন নক্সায়...! তারপর? নোবেল-মুকুট পড়ল বাঙলা। অতিবৃষ্টি বহুসৃষ্টির সরস বানে সোনার তরীর পালে হাওয়া। পথের নতুন পাঁচালি কিম্বা পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিঞার স্বপ্ন বা দিগন্তজোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ আমাদের বুকের মধ্যে। বিশ শতকের পুরোটাই বাঙলার সোনার ফসল... প্রাণ ভরে সেই সুস্বাদু সুগন্ধিত জলপান আপনি, আমি, আমরা সবাই। ভাষা আড়মোড়া ভেঙেছে নতুন সাজ করতে চেয়ে -- কিন্তু তখনো ‘আ মরি বাঙলাভাষা’।
ঔপনিবেশিক বেনোজল বিদেশি হলেও তার সারাৎসার ছিল এবং বাঙলা তখন নিজের ফসলের গন্ধ নিতে ব্যস্ত বলে তৎসম, তদ্ভব আর বিদেশি বিষয়ে সচেতন। কত শব্দ, তাদের স্পর্শ ও রূপ নতুন অভিধান ভরল... বাঙলা অভিধান। আমাদের সমৃদ্ধির অহঙ্কার কূল ছাপিয়ে গেল!
বিশ শতকের শেষে বিশ্বায়িত বাঙালি কী যে ভাবল জানি না... বোধকরি বাঙলা ভাবল এবার মরা গাঙে বান... যে তরীটা শুধু বাঙলার ঘাটে ঠেকে আছে, তাকে দেওয়া যাক সবর্জনের কর্ যাতে তরতরিয়ে বয়! কিনা, যাতে জাতে ওঠে। এ মোহ আবরণ বড় ঘোর অমানিশা! বিশিষ্টতা বজায় রাখলে ব্রাত্য, বহুজাতিকের মার্কা না পরলে জমানায় কে কদর করে? তাই বাঙলা নিজেকে বদলাতে উঠে পড়ে খড়ভূষি, এঁটোকাঁটা, কাকের পালকটালক যা পাওয়া যায়; বাছাবাছি ধোয়াধুয়ি সংস্কারের দরকার রইল না, গুঁজে দিলেই আধুনিক! বাঃ! কী ঔদার্য, কী ঔদার্য! স্বচ্ছন্দে ঢুকিয়ে দেওয়া অর্গাজম্, ইক্যুইপমেন্ট, ফেসিলিটি কিম্বা এপিসোড (তালিকা বড্ড লম্বা), ধামাকা, মস্তি, একা ছেড়ে দাও, আওয়ারা, (এখানেও বড় বিশদ তালিকা)! ব্যতিক্রমী ভাষায় বাঙলা লেখা আগেও ছিল, কিন্তু বাঙলাই।
যদিও সংবিধানে জাতীয় ভাষা বলে নেই কিছু, কিন্তু ওই দেশি ভাষাটি ক্রমাগত উদারতার ভাঙা বেড়া টপকে ঢুকছে তো ঢুকছেই। অসহ্য ভুলে-ভরা বাঙলায় কথা বললে বাঙালিরা বিগলিত হেঁ হেঁ, সুচিত্রা মিত্রের একলা চলো রে ছাপিয়েছে মেগাস্টারের হেঁড়ে গলায় একলা চলো রে... আমরা হলাম বারোয়ারি থুড়ি সার্বজনীন, আহা হা হা হা! উর্দূভাঙা জাতপাতহীন সেই ভাষার ভাষাভাষী সহজেই বলে, “বাঙ্লা একটি অতি শ্রুতিকটু ভাষা।” ওই সেই ভাষাটাই এখন আকণ্ঠ গিলছে বাঙলার বর্তমান পুত্রকন্যারা। বাঙলায় বাক্যালাপ লজ্জার বিষয়, সত্যজিত রায়ের ইংরেজি অনুবাদে “কী চাইছি/কী পাচ্ছি না” বোঝে। বিস্ময়! এখন বাঙালির কাছে সাধুভাষা ‘অতীত ভাষা’। হোক্ না তাই... সুন্দরী সুসজ্জিতার আভিজাত্য তাও গেল বুঝি?
পৃথিবীর আর কোন্ ভাষা এমন দুর্ভাগিনী? কোনো একদিন কোন্ এক ধূসর সন্ধ্যায় চাপা পড়ে যাবে এই ভাষা, তার খবর পেতে চাই না আমি। তবে আলো নিভে আসছে, কবর খোঁড়া দ্রুততর, দেখছি। অনুপায়, নিরুপায় কষ্টভয় তীব্রতর, হাতে রয়েছে বর্ণপরিচয়-এর আলো! হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি...!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন