বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

০৪ কাজল সেন

বিস্ময় কারে কয় কাজল সেন



বিস্ময়! খুব ছোট শব্দ। কিন্তু শব্দটি যে কতটা গভীর ও ব্যাপক, তা আমরা মাঝে মাঝেই বিস্মৃত হই। এবং ইদানীংকালে নতুন ও নতুনতর প্রজন্মের কাছে শব্দটির গরিমা যে ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কখনও কখনও মনে হয়, আর কিছুদিন পর শব্দটিকে হয়তো বাতিল কাগজের ঝুড়িতে পাচার করে দেওয়া হবে। কেননা, আজকের ছেলেমেয়েরা কোনো ব্যাপারেই আর তেমন ভাবে বিস্মিত হচ্ছে না। বিস্ময়ের ঘনত্ব ও আপেক্ষিক গুরুত্ব কমে যাচ্ছে তাদের কাছে। আমরা, মানে তথাকথিত প্রবীণরা, যখন কোনো ব্যাপারে বা বিষয়ে বিস্মিত হই বা অবাক হই, তখন নবীনরা প্রায় ধমক দিয়েই বলে –- ‘এতে এ্যাতো অবাক হওয়ার কী আছে? যত সব আদিখ্যেতা!’

আজকের ঘোষিত বাক স্বাধীনতার যুগে অবাক হওয়ার সত্যিই কোনো মানে নেই। তবু ‘বিস্ময়’ শব্দটির মানে ও প্রতিশব্দ খুঁজতে বসে শ্রদ্ধেয় অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সমার্থশব্দকোষ’এ অনেকগুলি শব্দ খুঁজে পেলাম, যেমন –- চমকানো, হকচকানো, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া, থতমত খাওয়া, আক্কেলগুরুম হয়ে যাওয়া, তাজ্জব মানা, গালে হাত দেওয়া, মুখে রা না কাড়া, হাঁ হয়ে যাওয়া, চোখ কপালে তোলা, চোখ ছানাবড়া হওয়া, চক্ষু চড়কগাছ হওয়া, চক্ষু স্থির হওয়া, ধাঁধিয়ে যাওয়া, ভেবড়ে যাওয়া এইরকম আরও কত কী! এছাড়াও আছে –- অলৌকিকতা, অবাস্তবতা, যুক্তিহীনতা, ভেলকিবাজি, ভোজবাজি, আজগুবি, অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় এবং সেইসঙ্গে আরও আছে –- অবাক, হতবাক, নির্বাক, মূঢ়, বিমূঢ়, হতভম্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। না, প্রতিশব্দ বাড়িয়ে আর লাভ নেই। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আমরা আমাদের ছেলেবেলা থেকে প্রতি পদে পদে অনেক কিছু বুঝতে না পেরে, মানে খুঁজে না পেয়ে, সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লিখতে না পেরে চমকে চমকে উঠতাম, ঘাবড়ে যেতাম। বোকার মতো স্বপ্নমাখা চোখদুটো বড় বড় করে মেলে ধরে বলতাম –- ‘তাই তো, কী করে হলো ? এমনও কি হয় ? কেমন করে হয় ?’ আজকের ছেলেমেয়েরা কিন্তু আমাদের মতো ছেলেমানুষী করে না। তারা বলে –- ‘হয়। এমনই হয়। কার্য-কারণ সূত্র মেনেই হয়। প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিয়ম মেনে সব কিছু হয়। এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। চোখ কপালে তুলে চোখের অবস্থান পাল্টানোও ঠিক নয়। তাতে চোখ ও কপাল, দু’য়েরই বিড়ম্বনা।’
       


খুব কম বয়সেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ পড়ার সুযোগ হয়েছিল। কম বয়স মানে, অপুর থেকে খুব একটা বড় ছিলাম না তখন। তা সেই বয়সে অপুই ছিল আমার হিরো। অপুর মতো চোখ অবশ্য আমার ছিল না। ক’জনেরই বা থাকে! তাছাড়া আমি থাকতাম শহরে, অপুর মতো গ্রামে নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপু যখন গ্রামের ও অরণ্যের সৌন্দর্য এবং রহস্যময়তা দেখে সমানেই বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, আমিও তখন তা পড়তে পড়তে উপন্যাসটির আর কিছু বুঝতে না পারলেও কেমন যেন রোমাঞ্চিত, শিহরিত, সম্মোহিত হয়ে পড়ছিলাম, সে কথা আজও মনে করতে আছে। উপলব্ধি করতে পারি, ঠিক তখন থেকেই হয়তো বিস্মিত হওয়ার বা অবাক হওয়ার মনটা একটু একটু করে আমার বুকের ভেতর জায়গা করে নিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে যেটুকু পড়াশোনা করেছি, যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি, তাতে প্রকৃতি ও জীবনের অনেক রহস্যই জানা-বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই অবাক হওয়ার বা চমকে ওঠার পালা শেষ হয়নি আজও। হয়তো হবেও না কোনোদিন। নবীন প্রজন্ম যতই খোঁটা দিক না কেন!

একথা ঠিক যে, আমাদের জীবন প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়যাত্রা এবং কল্যাণে। সাইবার যুগের এই কালখন্ডে বাস করে আমরা বিশ্ব ও ব্রক্ষ্মান্ডকে একটু একটু করে আমাদের মুঠোয় ধরতে পারছি। এবং এই সামগ্রীক ব্যাপারটাই আমাদের মনকে করে তুলছে আরও আধুনিক, উত্তর আধুনিক। যার আন্তরিক প্রভাব পড়ছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, কলা, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সব কিছুর ওপর। তথ্য ও প্রযুক্তির সমকালীনতায় বাস করে তাই আর কারও কাছে কোনো উপায় থাকছে না কিছু না জানার, না বোঝার। যে চায়, সে নিজের জ্ঞানভান্ডার বাড়িয়ে নিতে পারে, যতটা সে চায়। আর তাই তো নবীনরা অনায়াসে বলতে পারে –- ‘বিস্মিত হবার কী আছে? যা জানো না, তা জেনে নাও, তাহলেই তো হলো! অবাক হবে কেন?’  

একদম ঠিক কথা। বর্তমান জীবনযাত্রায় বিস্ময়বোধ ব্যাপারটাই কেমন যেন ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছে। কেউ আর অবাক হচ্ছে না, কারও চোখ আর চড়কগাছ হচ্ছে না, সব কিছু ঠিকই হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যেন এরকমই হয়, এটাই বাস্তব। সবচেয়ে বড় কথা –- অসম্ভব বলে কিছু হয়, এটা মেনে নিতে পারছে না নতুন প্রজন্ম। তাদের কাছে সব কিছুই সম্ভব। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, বিস্ময়বোধ যদি আমাদের জীবন থেকে একেবারেই বিদায় নেয়, তাহলে কি এমন একদিন আসবে, যেদিন একে একে বিদায় নিতে চাইবে এর আনুষঙ্গিক আরও কিছু বোধ, যেমন –- সৌন্দর্যবোধ, রমণীয়তাবোধ, মুগ্ধতাবোধ ইত্যাদি? সেদিন কি ভাটার টান ধরবে না আমাদের কল্পনাপ্রিয়তায় ও রোমান্টিকতায়? এমন দিনও কি আসবে, যেদিন তরতাজা ছেলেমেয়েদের পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে শরীরে জাগবে প্রেমের শিহরণ, কিন্তু মনে জাগবে না তার অনুরণন? সৃষ্টির সব রহস্য জেনে বুঝে আমরা কি তবে থাকব সৃষ্টির প্রতি একান্ত বিস্ময়বোধহীন এবং উদাসীন?  

কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম ভূস্বর্গ কাশ্মীর। অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল, একদিন যাব, দু’চোখ মেলে দেখব তার অপরূপ রূপ ও সৌন্দর্য। কিন্তু শখ থাকলেও সব সময় সুযোগ হয় না। সুযোগ থাকলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকে না। তাছাড়া পাহাড়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন তো ছিলই। তা গত ২০০৯ সালের মে মাসে হঠাৎই সপরিবারে যাওয়ার সুযোগ হলো আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু পূর্ণেন্দুশেখর মিত্রর আমন্ত্রণে ও আতিথেয়তায়। পূর্ণেন্দু ছিল ‘Ircon’এর ফিনান্সের জেনারেল ম্যানেজার। এই ‘Ircon’ই কাশ্মীরে দীর্ঘতম রেলওয়ে টানেল তৈরি করেছে পাহাড়ের বুকের ভেতরে প্রবেশ করে। যাইহোক আমি ও শিল্পী ভূদেব ভকত, সপরিবারে, কাশ্মীর গেছিলাম। আর গিয়েই উপলব্ধি করতে পারলাম, কেন কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলা হয়। সবটা যে উপলব্ধি করতে পারলাম, তাও নয়। অনি:শেষ রূপ ও সৌন্দর্যের সম্পূর্ণ উপলব্ধি কেউ কি করতে পারে! আমি শুধু দেখেছি, প্রাণ মন ভরে দেখেছি, আর বিস্ময়ে চমকে চমকে উঠেছি। এ্যাতো রূপ, এ্যাতো সৌন্দর্য –- এও কি সম্ভব! কেমন করে সম্ভব! 

তা সেই ভূস্বর্গের রূপ ও সৌন্দর্যের কথা একদিন কথায় কথায় বিগলিত মনে বলেছিলাম নবীন প্রজন্মের এক প্রতিনিধিকে। সে আমার সব কথা শুনল, মন দিয়েই শুনল, তারপর নেহাৎই সাদামাটা গলায় বলল –- ‘হ্যাঁ, শুনেছি কাশ্মীর খুব সুন্দর জায়গা। শুনেছি সুইৎজারল্যান্ডও খুব সুন্দর জায়গা। পৃথিবীতে এরকম অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। তা কোনো সুন্দর জায়গা দেখতে তো সুন্দর লাগবেই, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? সৌন্দর্য দেখে চমকানোর কোনো যুক্তি তো খুজেঁ পাচ্ছি না আমি!’ যা: বাবা! আমার বিস্ময় ও বিহ্বলতার এপিসোড শুনে শেষপর্যন্ত এই প্রতিক্রিয়া! এবং এই যে নবীন প্রজন্মের এক প্রতিনিধি, যে আমার অভিজ্ঞতা শুনে একটুও বিস্মিত হলো না, চমকে উঠল না; তার এই বিস্মিত না হওয়া দেখে বা চমকে না ওঠা দেখে আমি খুব বিস্মিত হলাম এবং চমকে চমকে উঠলাম। মনে হলো, তাই তো, অনেকদিন হলো, অপুর সাথে দেখা হয়নি আমার। অপুর কাছে যাওয়া হয়নি বহুদিন। একবার যাওয়া দরকার। খুব দরকার। আমি ঘরে ফিরে কতদিন পর যে আবার ডুব দিলাম ‘পথের পাঁচালি’তে!

জীবনে রেলগাড়ি তো কতই না দেখেছি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। কিন্তু অপু আর দুর্গার হাত ধরে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার রোমাঞ্চ ও আনন্দটাই তো আলাদা! আলাদা তার মাত্রা! সেখানে বিস্ময়ের প্রবল ঘনঘটা। বিস্ময়ে বারবার চমকে চমকে ওঠা। আমার সত্যিই ভেবে খুব কষ্ট লাগে, অপুরা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ থেকে!  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন