বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

০৩ স্বপন রায়

কাওয়ালিওয়ালাস্বপন রায়

 

এক শীতের রাতে আমি চললাম কাওয়ালি শুনতে। আমার কাওয়ালি তখন আজিজ নাজা আর জানি বাবু কাওয়ালে সীমাবদ্ধ। শাবরি ব্রাদারস, ফতে আলি, আবিদা পারভীন ইত্যাদিদের নামই শুনিনি! আজিজ নাজা’র “ঝুম বরাবর ঝুম শরাবি” মনে আছে? আমি গান বা কবিতাকে কোনো নান্দনিক ‘চিলমনে’ বা ‘চিকে’র আড়ালে খুঁজতে যাইনি, অশিক্ষিত হলে যা হয়! আমার তো আটকে যাওয়া এই উচ্চারণেই। “আজ আঙুর কি বেটি সে মুহব্বত কর লি / সেখ সাহাব কে নসিহত পে বগাবত কর লি / উনকি বেটি নে উঠা রক্ষি হ্যায় সর পে দুনিয়া / ইয়ে তো আচ্ছা হুয়া আঙুর কো বেটা না হুয়া... আঙুর কি বেটি” যে মদালসার হয়ে ওঠার কারণ, জানা হয়ে গেছে আমার, সেই কারণটি অর্থাৎ ‘কারণবারি’র কারণে এই কাওয়ালি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। 


তো রাউরকেলার হননাবৃত শীতে আমি গা ছম ছম জড়িয়ে নিতে গিয়ে কালো জ্যাকেটে লুপ্ত হয়ে যাই! আর কাওয়ালির আহ্বানে সাইকেলের চাকায় ছড়িয়ে দিতে থাকি অষ্টম শতাব্দীর ‘সমা’কে পারস্য থেকে (ইরাণ এবং আফগানিস্তান) এনে এই রাউরকেলার অতিসক্রিয় শীতের মেহফিলে! আমীর খুসরু পারস্য থেকে ‘সমা’র ঘরাণা নিয়ে এসে ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে এক অপূর্ব ফিউশনের মাধ্যমে শুরু করলেন ‘কাওয়ালি’র জয়যাত্রা। ঊর্দুর মতো কাওয়ালিও ভারতমাতার সন্তান। 

আজ আজিজ নাজা এবং পরভীন সাওয়া’র কাওয়ালি-যুদ্ধ, সেক্টর-৬এর স্টেডিয়ামে আমি আর আমার ২৬ বছর চলেছে শীতের পিনিং না মেনে, শীতকে তার দাঁতের দান্তেপনায় আটকে রেখে ক্রমশ ‘সমা-এ-মেহফিল’ কাওয়ালি’র দিকে, একাই। কারণ, আমি ছাড়া কাওয়ালিওলা বাঙালি বন্ধুদের মধ্যে কেউ ছিলো না। 

পৌঁছে দেখলাম স্টেডিয়ামে ভালোই ভিড় আর আমি একা! একা আমি কাওয়ালি’র ঊর্দু বিরাসতে ঢুকবো কী করে? আমার ঊর্দু এখনো তেমন কিছু নয়, আর তখন তো ইকরার, ইজহারই গুলিয়ে যেত! তবে কাওয়ালিতে পাঞ্জাবি শব্দের প্রয়োগ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ থাকায় আম জনতার কাছে তার বোধগম্যতা বরাবরই বরকরার ছিলো। কিন্তু আমার কী হবে রে কালিয়া? একজন ইন্টারপ্রিটার ছাড়া এই সারারাতের কাওয়ালি তো আলুনি হয়ে যাবে!

কাওয়ালির পরিসর নদীর মতো ক্রমশই বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু এই প্রবাহের চলনেও আছে একটি গঠনপ্রবাহ। কাওয়ালি এগারো শতক থেকেই এই দেশের দরগাগুলিকে কেন্দ্র করে গীত হতো। এই ধারার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ হলো চিস্তি(সুফি) ঘরাণার কাওয়ালি। তবে কাওয়ালি শুধু দরগায় থেমে থাকেনি, একে একে অনুভূতির প্রায় সবকটি অভিঘাত কাওয়ালিতে মিশে গেছে। কাওয়ালির শুরুতেই আল্লাহ’র বন্দনা করা হয় ‘হমদ’ দিয়ে (“খুগর-এ-হমদ-সে থোড়া সা গিলা ভি শুনলে / ইকাবাল”; কথাটা ‘হমদ’ অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দ্যেশে বলা -- “তোমার পূজায় যে অভ্যস্ত / তার কিছু অনুযোগও না হয় শুনলে!)

এরপর মসিহা মহম্মদের স্তুতি করা হয় ‘নাত’এর মাধ্যমে। এই প্রাথমিক স্ট্রাকচার এখনো অনুসরন করা হয়... কিন্তু আমি কী করবো? সারারাত কাওয়ালি শুনে বুঝতে হলে একজন বুঝদার শ্রোতা খুঁজতে হবে। আমি মাথার টুপি ঠিক করে, জ্যাকেটের কলার উঠিয়ে চারদিকে দেখতে থাকি। চোখ সেই রাতের স্টেডিয়ামে এমন একজনকে খুঁজতে থাকে, যার মধ্যে সমঝদারি রয়েছে আর পেয়েও যায়। মেহেন্দি রাঙানো চুল, দাড়ি। কুরতা আর চোস্ত পাজামায় মুঘলত্ত্বের খানদানী আবেশ, হাসিটাও শাহজাহান টাইপের, যাত্রায় যেমন দেখেছি আর কি! 

মঞ্চে এসে গেল কাওয়াল আর কাওয়ালিনের বাজনদাররা। আমি সেই মুঘলাই ব্যক্তিটির কাছে যাই, হেসে বলি, “জনাব,ম্যায় ক্যা আপকে পাস বয়েঠ সক্তা হুঁ?”

জনাব, জনাবে-আলি হাসলেন, শাহজানীয় একেবারে, আমি ঈত্ত্বরের (আতর) গন্ধও পাছিলাম। এখন হলে হয়তো বলতাম, “তাব লায়ে-হী বনেগী, গালিব / বাকেয়া সখত হ্যায় ঔর জান আজীজ” (পারতেই হবে, গালিব / সঙ্কটে পড়েছি আর প্রাণও তো প্রিয়)... যাইহোক হাসির লাই পেয়ে বসে গেলাম ওই শাহজাহানের পাশে, যে পরে নাম জিগগেস করায় বললো, জাহাঙ্গীর!

আজিজ নাজা আর পরভীন সাবা মঞ্চে আসা মাত্র শীতের হিমে হাততালির ওম পড়তে শুরু করলো। দুজনে বসেই আদাব জানালেন, আজিজের চেয়ে পারভীনেই তখন চোখ অপলক হয়ে একাকার, সারারা আর চোলি আর কী সব গহনার চাকচিক্য, আমি দৃষ্টান্তমূলক ভাবে হাঁ, জাহাঙ্গীরও তেহজীব ভুলে হাঁ! যাইহোক আজীজ এবং পারভীন প্রথমে নিজেদের হাজিরি জানান দিলেন হামদ, নাত, মনাকিব, মারসিয়া এবং গজলের নানা আঙ্গিক পেশ করে। তারপর তাঁদের দ্বৈরথ শুর হলো। আমি এর মধ্যেই খাবি খেতে আরম্ভ করেছি। ওরা দুজনে যত একে অপরকে ছোট করার চেষ্টা করেন, আমি ততই বোকাস্য বোকা হতে থাকি। মাথার ওপর দিয়ে ‘খুদদারি-এ শাহিল’, ‘উকদহ-এ-দিল’, ‘রুখসত’, ‘কারফরমাঁ’, ‘অশক’, ‘দরমিয়াঁ’, ‘অদাবত’’, ‘কফস’, ‘গুলফাম’ ইত্যাদি শব্দগুলো সাঁই সাইঁ করে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আমি আমার পাশে বসা মুঘলিয়তের প্রতিনিধি জাহাঙ্গীরকে যতবার জিগগেস করি, “মতলব ক্যা?” জাহাঙ্গীর ততবারই জাহাঙ্গীরি হাসি হাসে আর বাদাম খায়...। ওই বাদাম চিবোনোর ফাঁকেই সে আলগোছে বলে, “মু তো ভাই ওড়িয়া লোকো, মু কেমিতি ভাই তুমহকু মানে বুঝেইবি?” (আমি তো ভাই ওড়িয়া, আমি তোমায় মানে বোঝাবো কী ভাবে?)

-মানে? তমে ঊর্দু জানিণ? (মানে? তুমি ঊর্দু জানো না?)  

-না

- তেভে মু যেতে বেলে পচারিলি ঊর্দু জানিছ কী? তমে হঁসিল কাহিঁকি? (তাহলে আমি যখন জিগগেস করলাম, ঊর্দু জানো কিনা, তুমি হাসলে কেনো?)

-ভদ্রলোকো হসিব নুহে তো কণ করিবো? (ভদ্রলোক হাসবে না তো কী করবে?) 

এরপরে আমার আর কী বলার থাকতে পারে! আমার কাওয়ালি অভিযানের এহেন করুণ রসের শৈত্যে হঠাৎই আমার এক পুরনো বন্ধু আমায় ডাক দেয়, বন্ধুর নাম মজিদ। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বাকি রাতটুকু ঊর্দু জানা মজিদের সৌজন্যে জমে ওঠে ক্রমশ... কাওয়ালির মেহফিলে ধীরে ধীরে রাত বাড়ে... শেষ রাতে আজিজ নাজা স্বরক্ষেপণের চূড়ান্তে গিয়ে রাতের শেষযাত্রাকে মহিমান্বিত করে গেয়ে ওঠেন, “ঝুম বরাবর ঝুম শরাবী...” 

আমার দীক্ষা হয় কাওয়ালিতে ভোর ঝুমিয়ে আসে রাউরকেলায় আড় ভাঙে গানের দুনিয়া...
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন