শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

০৬ লিপিকা ঘোষ

ঘর
লিপিকা ঘোষ


‘কি জাত?’

‘অ্যাঁ? হিন্দু’

‘উ তো নোয়া সেন্দুর দেইখ্যেই বুঝনু তুমি মোদের হেঁদু ঘরের বহু বিটি, জাত কি?’

রমা অস্বস্তি নিয়ে আসেপাশের সহযাত্রীদের দিকে তাকায়। সকলেই নির্বিকার। কেউ ট্রেকারের দুলুনিতে ঢুলুনি নিচ্ছে।

‘ঠাকুর?’

‘অ্যাঁ? না তো’

রমা বোস বিয়ের পর রায়চৌধুরী। কোনো কুলেই ঠাকুর পদবী নেই। যে সহযাত্রীটি এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জিজ্ঞেস করছেন, তাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল রমা। গ্রাম্য দরিদ্র প্রৌঢ়া। মাথায় ডগডগে সিঁদুর। কপালে আবার তিলক কাটা। গলায় কণ্ঠি। রমা’র বড় ননদ ও’র সিঁদুর পরা দেখে বলত ‘মাসকাবারি সিঁদুর লাগবে রে ভাই তোর বউয়ের’। সে বড়ই ঝাঁ চকচকে আধুনিকা। দুর্গা পুজোর অঞ্জলি দেওয়ার সময় ছাড়া দিদিভাইয়ের মাথায় সিঁদুর দেখেনি রমা।

‘তা লি মাহিষ্য?’

কী মুশকিলেই না পড়ল সে!

‘আমরা চাঁই মোড়ল’

‘ও, আমরা কায়স্থ’। এতক্ষণে বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি জবাব দিল রমা।

‘কি বুইল্যে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিও ঠাকুর’ -– জবাব দিলেন সদ্য ঢুলুনি ভাঙা সহযাত্রীটি। অবাক হয়ে তাকাতে উনি বললেন, ‘এ দেশে বামুন কায়েত ভাগ নেই দিদি, উঁচু গেরস্থ ঘর মানেই ঠাকুর’।

রমা ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে না পেরে সেই চাঁই গিন্নিকে বলল, ‘যা ভাব কাকী, ঠাকুর ভাবলে ঠাকুর, নইলে তোমারই ঘরের মেয়ে’।

‘তয়? বুইল্যেছিলাম না, এ মেইয়্যে ঠাকুর ঘরের বহু বিটি’

হঠাৎ ট্রেকারের পেছন থেকে পুরুষ আওয়াজ। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে, গেরুয়া ধরনের ময়লা এক ফতুয়া পরা গ্রাম্য প্রৌঢ়ো। দরবেশ সাধু তো নয়! বেশ গৃহস্থ। কপালে সেই তিলক, গলায় কণ্ঠি। ইনি তবে বোধহয় চাঁই কর্তা ।

‘শিক্ষে দিইক্ষে কইরেছো, লয়?’ চাঁই গিন্নির প্রশ্ন।

‘অ্যাঁ?’

রমাকে দেখে কি এদের খুব অশিক্ষিত মূর্খ গোছের কিছু মনে হয়েছে? লাল ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে মেরুন স্কার্ফটা দিয়ে মাথা ঢেকে নিল রমা। শাড়ির আঁচলে সামাল দেওয়া যায় না।

‘তয় মোদের ভাষায় বুইলছো যি?’

আবার ঢুলুনি থেকে জেগে পাশের যাত্রীটি উত্তর করেন, ‘ওরা জানতে চাইছে আপনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত কি না’!

‘ওঃ, না গো কাকী’, এবার একটু মজা করেই বলল রমা, ‘বোষ্টুমি আর হতে পারলাম কৈ’

‘দেইখল্যে, এ মেইয়্যে মেইয়্যে লয় গো’ আবার চাঁই কাকার গলা।

সব্বোনাশ, প্রথমে ঠাকুর, এখন কি বলে বসবে না কি ‘দেবতা নিশ্চয়’! ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে একশা রমা। এ কোন্‌ দেশে চাকরি করতে এলো সে!

এবার একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেকারটা থামল স্টেশন মোড়ে। হুড়মুড় করে একরাশ পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে ট্রেকারের পেছন দিকের সিট থেকে নামল চাঁই কর্তা। রমার সঙ্গে সঙ্গে চাঁই কাকীও নামে। হঠাৎ হাত জোড় ক’রে সামনে চাঁই কর্তা, ‘আমি জগন্নাত মন্ডল। হুই যি ফুলারপুর গিরামে বাস। বিপিএল-এ নাম আছে। কিন্তুক তুমার কাকীর নামে ঘরের টাকাটুক এখুনও পাইনি। তুমি একটুক দেইখ্যো বিটি’।

হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে রমা।

‘তুমার কাকীর নাম ছিরিমতি মন্ডল, টিরেন এল আমরা যাই গো বিটি...’ বলতে বলতে দৌড় লাগালো জগন্নাথ আর শ্রীমতি মন্ডল। ‘তুমার কাকীর নামটা মুনে রেইখ্যো বিটি...’

ঢুলুনি যাত্রীটি ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মিটি মিটি হাসি। ‘কি বুঝলেন? ওরা ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘরের কথা বলছে। ওরা জানে, আপনি এখানে কোন্‌ ডিপার্টমেণ্টে এসেছেন, একটু সামলে চলবেন’, বলেই হন হন ক’রে হাঁটা লাগালেন ভদ্রলোক।

রমা ধীরে ধীরে রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকে। ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর পাওয়ার প্রথম অধিকার শুধু মেয়েদেরই। কৃষ্ণচূড়ার গাছ লালে ঢেকে আছে। একটু উড়ে এসে পড়ল ওর সিঁথি বেয়ে। মাসকাবারি সিঁদুর। হাসি পেয়ে গেল ওর। বড় ননদ মস্ত আর্কিটেক্ট। বিশাল এক নিজস্ব অফিস। মস্ত বড় বড় ইমারত বানায়।

কৃষ্ণচূড়ার লালে বিকেলের পড়ন্ত রোদের লাল মিশছে। তীব্র হুইসল। ‘টিরেন’ ছেড়ে যায় জগন্নাথ মন্ডলের। ফুলারপুর গ্রামের শ্রীমতীর সিঁথির লালে এ জগন্নাথ ঘর খোঁজে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন