কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

বিমান মৈত্র

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৮


সমাপিকা ক্রিয়া

আলিফা ছেলেবেলা থেকেই কিছু চুপচাপ, গলার স্বর নিচু, কথা প্রায় শোনাই যায় না – কিন্তু বোঝা গেল না কেন, কলেজের ফার্স্টইয়ারে ওঠার পর সেটা আরও গুরুতর হল। অনেক কসরত করেও যখন আলিফার মুখ থেকে এ ব্যাপারে কিছু জানা গেল না, বাবা বললেন, ও তো ছোট থেকেই অমন, রোগে ভোগে আরও বেড়েছে। কোনক্রমে গ্রাজুয়েশনটা শেষ হলেই বিয়ে দিয়ে দেব। স্থির হল, আপাতত কলেজ-ছুট হবার আগে তাকে কিছু জানানো হবে না।

আলিফা একটু সুযোগ পেলেই প্রিয় পাশবালিশটা দুই হাঁটুর মাঝখানে গুঁজে তার একান্ত বিছানার দেয়াল ঘেঁষে মাথাটা যথাসম্ভব হাঁটুর কাছে এনে একটি বৃত্তাকার আকৃতি দিত এবং অন্ধকারে তার নিঃশব্দ বিচরণে যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে কাঁথামুড়ি দিয়ে নিজেকে একপ্রকার অদৃশ্য করে রাখত।

গ্রাজুয়েশন শেষ হবার কিছু আগেই আলিফার বিয়ের পাত্র দেখার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কিন্তু, দুপক্ষের পছন্দ, রোজগার, কুষ্ঠি, গোত্র ইত্যাদিকে এক বিন্দুতে আনা বড় সহজ ছিলো না। কোথাও না কোথাও একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছিল। শেষে ব্যাপারটা যখন এমন জাগায় দাঁড়ালো – রাজা মশাই ভাবেন আর নয়, সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ – ঠিক সেইসময় একটি পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। ছেলেটি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করেছে, সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ছেলে বাবা-মাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে চান। শর্ত একটাই, পাত্র মেয়ের সাথে আলাদা করে আলাপ করবে। সংস্কারে বাঁধলেও পরিস্থিতির চাপে মেনে নিতে হল।

এখানে একটা কথা বলার, আলিফাকে যখনই পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করা হত আলিফার ফর্সা মুখটা বিবর্ণ, রক্তশূন্য মনে হত – যেন মৃত্যুর থাবা থেকে বেরিয়ে আসা প্রাণীকে আবার মৃত্যুর সামনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। একমাত্র আলিফার সদ্য বিবাহিত দিদি সুতপার চিন্তাটা যেন একটু বেশিই ছিল। ও জানে কলেজ মানেই একটা খোলা ময়দান, বিভিন্ন উৎসবের আড়ালে সেখানে যে একটা আবছা অন্ধকারের জন্ম হয়, সেখানে অনেক ঘটনা ঘটে যা অন্তরালেই থেকে যায়।

 যাইহোক, পাত্রপক্ষ এল। কিন্তু আলিফাকে সামনে আনতেই তার সমস্ত মুখ জুড়ে আতঙ্ক – শিকারীর সামনে হঠাৎ শিকার পড়লে যেমন হয় – দেখা গেল। সময় যেন থমকে দাঁড়াল। এসময় সবাইকে অবাক করে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, ঘাবড়াবেন না, আমি ওর সাথে কথা বলছি। আলিফা চেয়ারের হাতলটা চেপে সমস্ত শক্তি একত্রিত করে চোখদুটো বন্ধ করেছিল। সুতপা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বোনকে রাজি করিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ছেলেটিকে বলল, তুমি কিন্তু দরজা বন্ধ করবে না। সুতপা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রায় একঘন্টা কেটে গেল। উপস্থিত প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করছিল। ছেলের মা প্রায় অধৈর্য হয়ে আমি দেখছি, বলে বন্ধ দরজার কড়া নাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা বেরিয়ে এল। জানা গেল ছেলেটির পছন্দ হয়েছে। আলিফাকেও অনেক স্বাভাবিক দেখা গেল।

শুধু সুতপার সারারাত ঘুমাতে পারেনি। রাতের আবছা অন্ধকারে সে কী কোনো কিছুর হদিস পেল?


1 কমেন্টস্: