কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

স্বর্গ এসেছে নেমে

 


(৪)  

আচ্ছা মা যা কিছু বলে তা কি অন্যায়? মনস্বিনী যুক্তি দিয়ে বোঝায় নিজেকে, সে যা কিছু বলে, সবই গ্রাম্য ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে। এর পেছনে রয়েছে সন্তানের জন্য অপরিসীম স্নেহ আর উৎকণ্ঠা। তা বলে একবিংশের মনস্বিনী তো আর ঊনবিংশের ছায়ায় পড়ে থাকতে পারে না। মা আর মেয়ের মধ্যে এটা যেন এক ধরনের ছায়াযুদ্ধ। যুদ্ধের ঘোষণা নেই কিন্তু জীবনচর্যায় প্রতি মুহূর্তের দ্বন্দ্ব যেন উভয়কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসাবে। সে যা হবার কাল দেখা যাবে। এখন মায়ের বাধ্য মেয়ে হয়েই থাকা যাক। মনস্বিনী হঠাত্ করেই মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়েকে বলে কুন্তলা, ‘মায়ের কথায় রাগ করতে নেই মনি। তুই যখন মা হবি তখন বুঝবি, সন্তানের ভালমন্দের জন্য মায়ের মন কতখানি উতলা হয়ে থাকে। নে, ওঠ এখন, চুল বেঁধে দি, তারপর কিছু খেয়ে পড়তে বসবি’। অবাক হল মনস্বিনী, মা তো তার পড়াশোনার কথা কোনদিন বলেনি! কলেজে ভর্তি হবার সময় সে কি তুলকালাম কান্ড করেছিল মা! রাগ করে সেদিন একটি দানাও তোলেনি মুখে। মনে পড়লে এখনো হাসি পায় মনস্বিনীর। মেয়ের কলেজে পড়ার প্রতিবাদে মায়ের হাঙ্গার স্ট্রাইক। অবশ্য বাবার হস্তক্ষেপেই মায়ের আন্দোলনের অবসান ঘটে। বাবা বুঝিয়েছিল মাকে, মেয়ের জন্য ভাল পাত্র পেতে গেলে তাকে পড়াশোনা করাতেই হবে।

আজকের ঘটনায় মনস্বিনীর যে ভূমিকা, অনঙ্গ সান্যালের বিশ্বাস, তার ভাবনাই সত্যি হতে চলেছে। কুন্তলার ক্রোধের মূল এখানেই আর কেবল মেয়ে নয় মেয়ের জন্মদাতাকেও সমান দোষে দোষী সাব্যস্ত করল কুন্তলা। বিয়ের পর থেকেই দেখেছে কুন্তলা, প্রতি বৎসর মাধ্যমিকের ফল বেরনোর পরেই বেরিয়ে পড়েন অনঙ্গ সান্যাল দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্রের খোঁজে। দু’একজন করে এমন ছাত্র প্রতিবারেই আশ্রয় পায় সান্যাল ভবনের আউটহাউসে। ওখানেই যত দ্বন্দ্ব, বলা যেতে পারে ঠান্ডা লড়াই, কুন্তলা আর অনঙ্গর মধ্যে। লড়াইতে যদিও প্রতিবারেই জয় ঘটেছে সান্যাল মশায়ের, কুন্তলাও দমে যাবার পাত্রী নয়। এবার যেন যুদ্ধ  জেতার মোক্ষম অস্ত্রটি হাতে এসে গেছে এমন মনোভাবই স্পষ্ট হল তার আচরণে ও কথায়। ধরা পড়ে গেছে মনি, যাকে সে তার গাঁভিত্তিক মানসিকতায় গড়ে তুলতে চেয়েছিল। গুড়গুড় করে উঠল বুকটা এক অজানা আশংকায়। এ মেয়ে ঘরসংসার করবে তো? না,  আজই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে, না হলে বাপ-মেয়ে মিলে সমস্ত আশায় ছাই ঢেলে দেবে তার। বেশ চেঁচিয়েই, যাতে দুজনেই শুনতে পায়, এমন উচ্চকন্ঠেই বলল কুন্তলা, ‘মেয়েমানুষের এত বিদ্যে অজ্জন ভাল লক্কন নয়’। অনঙ্গ সান্যাল আর তার আত্মজার মধ্যে কথা হয়ে যায় চোখে চোখে। মৌনভাব অবলম্বনই যে শ্রেষ্ঠপন্থা, এ ব্যাপারে বাপ মেয়ের মধ্যে ছোট্ট একটু বোঝাপড়া হয়ে গেল। না, কুন্তলার মুখে মুখে জবাব দেওয়া বা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা দুটিই এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অসম্ভব। কুন্তলা মুখিয়ে আছে, কখন বাপ মেয়ের কেউ একজন তার কথার মাঝে কথা বলবে, আর সে মনের মত করে তাকে অবহেলা করার শোধ তুলে নেবে। কিন্তু একি আজব ব্যাপার, এমন তো কিছু ঘটছে না। মনস্বিনী তার কাজে ব্যস্ত আর সান্যাল মশাই তার কাজে। অস্ত্রহীন কুন্তলা একসময় আত্মসমর্পনই করল যেন স্বামী কন্যার উদাসীনতার কাছে, কিন্তু শেষ কথাটি শুনিয়ে রাখল, তার কথা উপেক্ষা করার পরিণাম ভাল হবে না মোটেই।

আপাত শান্ত কুন্তলা বসেছে মনস্বিনীর প্রায় গা ঘেঁষে। মনস্বিনী আন্দাজ করে নেয় মায়ের পরবর্তী আচরণ। তাই হল। মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কেন বুঝিস না মা, আমি কি কারণে বকাঝকা করি! আমরা হচ্ছি গে মেয়ের জাত, আমাদের সব ব্যাপারে সমঝে চলতে হয়, না হলেই বদনামের ঢেঁড়া পিটিয়ে দেবে আশপাশের মানুষগুলো। একবার ভেবেও দেখবে না, সত্যি কি মিথ্যে’। মনস্বিনী শান্ত হয়ে শুনল সব। সে তো জানে, মায়ের এই অমূলক ভাবনার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। বাবা যেদিন বুঝিয়েছিল মাকে, দিন বদলেছে, ভাল পাত্র পেতে গেলে মেয়েকে পড়াশুনো করতেই হবে, তখন মা কোনমতে মেনে নিয়েছিল কথাটা, কিন্তু এখন মায়ের মনে হয়, বাবার কথা মেনে নিয়ে সেদিন ভুলই করেছিল সে। মেয়ে কলেজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত স্থির হয়ে বসতে পারে না কুন্তলা। আর আজকের ঘটনা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তাকে, কলেজে পড়ার শখ কি সর্বনাশের আগুন জ্বালাতে বসেছে মেয়ের জীবনে। কুন্তলা ভেবে বসে আছে, এমন একটা ঘটনার পর মেয়ে বুঝবে, কি ভুল করেছে সে কলেজে ভর্তি হয়ে। এক সময় কলেজ যাওয়া বন্ধই করে দেবে হয়তো।

দিনের অন্তিম আলোটুকু বিলীন হয়ে গেল সন্ধ্যার মৃদু আঁধারের আঁচলতলে। সন্ধ্যা ঠাঁই নিল ক্রমান্ধকার রাতের গহ্বরে। আজ আর পড়তে বসেনি মনস্বিনী। রাতের খাবার খেয়ে গড়িয়ে পড়েছে বিছানায়। কুন্তলা নিশ্চিন্ত, মেয়ে বুঝেছে তার কথা আর এই ভাবনাই তার মনে কি এক প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় যেন। সত্যিই কি তাই? এমনই যদি হত তবে মনস্বিনীর চোখে ঘুম নেই কেন? বার বার বৈশ্বানরের সেই দৃপ্ত প্রতিবাদী মুখটা যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে ওর ভেতরের নারীসত্ত্বাকে। তবে কি, তবে কি ---! না, অসম্ভব। বাবার স্বপ্ন, অনেক বড় হতে হবে তাকে। এমন কত ঘটনাই তো ঘটতে পারে জীবনকালে, তা নিয়ে পড়ে থাকলে তো তার বাবার স্বপ্ন নিজের স্বপ্ন কোনটাই পূরণ হবে না। এই সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যে কখন যে সে ঘুমের কোলে হারিয়ে গিয়েছিল! ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে, ‘ভোর হয়ে গেছে মা, উঠে পড়’। কুন্তলা বাধা দিল, ‘কেন ডাকছ ওকে, থাকুক না, যখন ইচ্ছে হয় উঠবে’। লক্ষ করেনি কুন্তলা মেয়ে কখন বিছানা গুছিয়ে ব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেছে। ভ্রূ কুঁচকে তাকালো কুন্তলা মেয়ের দিকে। তবে কালকের কথাগুলো সব বিফলে গেল! মেয়ে কলেজে যাবেই তবে? ভাবল কুন্তলা, নিজের অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে আজ আটকাবে মেয়েকে। বলবে, মনি যদি তাকে কাজকর্মে একটু সহযোগিতা করে তবে তার খাটুনি একটু কম হয়। বললও সে, ‘মনি আজ আমার শরীরটা ভাল নেই রে! আমার কাজে যদি একটু হাত লাগাস মা, তবে একটু স্বস্তি হয় আমার’। মনস্বিনী দেখলো, মা যে ভাবে রোজকার মত কাজ করে চলেছে তাতে বিন্দুমাত্র মনে হওয়ার কারণ নেই যে সে অসুস্থ। বুঝলো মনস্বিনী, এটা মায়ের ছল ছাড়া কিছু নয়। তাকে কলেজ যাওয়া থেকে বিরত করাই মায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য। অনঙ্গবাবু শুনে বললেন, ‘নে মা, তুই তৈরি হয়ে নে। তোকে কলেজে ছেড়ে দিয়ে তোর মাকে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে যাবো। ফেরার সময় হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসবো আমি’। কুন্তলার বুঝতে অসুবিধা হল না, সে ধরা পড়ে গেছে। বেশ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল সে, ‘থাক থাক, বাইরের খাবার খেয়ে আর শরীর খারাপ করতে হবে না, যার যা বাইরের কাজ সেরে ঘরে এসেই খায় যেন, আর ডাক্তার বদ্যির কোন দরকার নেই আমার জন্য’। মনস্বিনী বুঝল, মা পরোক্ষে অনুমতি দিয়ে দিল। কলেজের জন্য তৈরী হয়ে মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে তারপর ঢিপ করে একটা প্রণাম করে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো মায়ের সামনে। মা কিচ্ছুটি না বলে কেবল হাত রাখলেন মাথায়। অনঙ্গবাবু তাড়া দিলেন ‘চল চল, মা, অনেকটা দেরী হয়ে গেল’। বেরিয়ে গেল মনস্বিনী বাবার সাথে। কুন্তলা ফোন তুললেন তার মাসতুতো বোনকে কিছু বলার জন্য।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন