![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
গরম লুচি বা প্রতিদিনের
গল্প
প্রসন্নময়ী অপ্রসন্ন মুখে বেরোলেন পুজোর ঘর থেকে। ঘড়ি দেখলেন। না দেখলেও চলত। কর্তাবাবুর বাতিকগ্রস্ত একটা থুড়থুড়ে পেন্ডুলাম ঘড়ি বসার ঘর থেকে একটু খক খক করে গলা সাফ করে নিয়ে আটবার বলল ঢং ঢং। আড়চোখে দেখলেন টেবিলে দুটি লেড়ো বিস্কুট, পাশে এককাপ গরম চায়ের ধোঁয়া - নেড়ি কুকুরের ল্যাজের মত নড়ছে। মানে বৌমা এনে রেখেছে এখুনি। মেয়ে তো খারাপ নয়, তবে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখতে হয়েছে। বারান্দায় হাল্কা ব্যায়াম করছে ছেলে। ইদানীং প্যান্টের মাপ বাড়ছে তার, তাই নতুন এই হাত পা ছোঁড়া। শাটল কারে গাঁতিয়ে যায়, সহযাত্রীরা বোধহয় হুড়ো দিয়েছে। শনি রবি হলেই অনলাইনে আনা ছাইভস্ম খাওয়ার তো কমতি নেই। দেখা যাক কদিন থাকে সু-অভ্যেস। এ বাড়ির মদ্দদের হাড়ে হাড়ে জানা আছে তার। নেহাত তিনি শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছেন সবার ঘেঁটি, তাই এখনো এ বাড়িতে চারটে পাত একসঙ্গে পড়ে। নইলে ছেলে বৌমার বিয়ে হতে চলল নয় নয় করে চারবছর। দুজনেই চাকুরে, বোধহয় ভালোই মুঠো গরম হয়। সংসার খরচ মাসের প্রথমে বিনা বাক্যব্যয়ে তার হাতে আসে, টুকটাক বেড়েও যায় একটু গলা খাঁকারি দিলেই। পালে পার্বণে উপহার আসে ওনিডা টিভির মত, মানে প্রতিবেশীর ঈর্ষা। এমন বোঁটা পাকা ফল কবেই টুপ করে খসে পড়ত। একদিন ছলছল চোখে নতুন ফ্লাটের চাবি হাতে নিয়ে পাখি ফুড়ুত। যায়নি তো! একটা গান শুনেছিলেন কিছুদিন আগে 'ধরবে মুঠোয় আর রাখবে থাবায়'। কী গানের ছিরি! কিন্তু তার জন্যে লাগসই। 'দাবায়ে রাখতে' জানতে হয়।
তবু তার নামটা যেন একটা স্ট্যান্ডআপ
কমেডি। তিনি প্রসন্ন থাকতেই পারেন না। দুর্জনে বলে লর্ড কার্জনের পরে কেউ তাকে হাসতে
দেখেনি। অতটা না হলেও কিছুটা ঠিক। সব ঠিকঠাক তবু এক খোঁচা কাউকে একটা। যেমন আজ। চায়ে
একটা চুমুক দিয়ে হালকা গর্জন করলেন - 'শ্যামা'? তটস্থ রান্নার মহিলা এসে আঁচলে হাত
মুছতে মুছতে দাঁড়াল সামনে-
- 'কিছু বলছেন মাসীমা'?
- 'না বললে আর ডাকছি কেন বাছা,
তোমার সঙ্গে কি আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক? বলি ঘরে কি আদার গাছ হয়েছে যে এত আদা দিয়েছ
চায়ে? জানো না তোমার মেসোর অর্শের ব্যামো? সেটাকে সাত তাড়াতাড়ি না বাড়ালেই নয়'?
শ্যামা ঢোঁক গিলে বলল-
- 'না মাসীমা, মেসোর চায়ে আদা দিইনি।
ওনার চা তো সকাল সকাল আলাদা করে দিতে হয়'।
ঘুম তার একটু দেরীতে ভাঙ্গে বলে
এ বেটি ঠেস দিল না কি? প্রসন্নময়ী মুখে তার অপ্রসন্নতা আরো গাঢ় করে বললেন-
- 'মাথা কিনেছ তবে। কাল থেকে আমার
চায়েও আদা কম দেবে, যাও এখন'।
শ্যামাও রান্না ঘরে ফেরত গেল। এই
কই মাছ ভাজার মত চিড়বিড়ে চাকরি পারলে আজই ছাড়ে সে, কিন্তু মাইনে অন্য বাড়ির দেড়া। তাছাড়া
গিন্নী-মা বেশী চোখ রাঙ্গালে বৌদি আবার সঙ্গোপনে বিশ পঞ্চাশ আলাদা হাতে গুঁজে দেন,
তাই। বসার ঘরে খবরকাগজে মুখ ঢেকে বাড়ির কত্তা গাইলেন 'আদার আসায় ভবে আসা, আসা মাত্র
হল'। ভ্রু কুঁচকে সে দিকে তাকালেন প্রসন্নময়ী। কথাটা তো 'আশা' কেমন যেন 'আদা'র মত শোনাল!
এই একটা জায়গায় হার হয় প্রসন্নময়ীর।
এমন ভিজেকাঁথা ব্যাটাছেলে জীবনে দেখেননি তিনি। পুরুষমানুষ হবে একটু দাপা-খ্যাপা। মানছেন
যে তার নিজের প্রতাপ একটু বেশী। কাউকেই তার সঙ্গে হা ডু ডু ডু খেলতে দেন না। তবু...
একটু প্রতিবাদ করবে তো! কথা শুরু থেকে শেষ মিটিমিটি হাসবে শুধু। কী যে ম্যানেজারি করেছে
চল্লিশবছর - খোদা জানেন। গা জ্বলে যায়। কথাগুলোয় কেমন যেন চিমটি আছে, সবকথা ঠিক ধরতে
পারেন না, কিন্তু বোঝেন কাপড়ের ভাঁজে পিঁপড়ে একটা আছে ঠিকই। বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে রেখেই
হাঁক পাড়লেন-
- 'এত গানের কী হল, কিসের খুশি
সাত সকালে'?
কত্তা বললেন-
- 'জোরে বলা যাবে না, কাছে এসো
বলছি কানে কানে'।
ঢং! হাতের বিস্কুটটা লজ্জায় ডুবে
গেল চায়ের কাপে। 'ধুত্তোর' বলে উঠে বসার ঘরে গেলেন। সোফায় জমিয়ে বসে বললেন-
- 'এবার বল'।
কর্তা আড়চোখে এদিক ওদিক দেখে বললেন-
- 'আমার বন্ধু সীতানাথ ... চেন
তো ... গোয়ালপাড়ায় পাশাপাশি ঘরে থাকতাম ... ভেলোর গিয়েছিল পেটে ব্যথা নিয়ে, ডাক্তার
কি বলেছে জান'?
গিন্নীর কোঁচকানো ভুরু পরেশনাথ
থেকে হিমালয়ে চড়ল-
- 'বলি অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে
গেছে, তাতে তোমার এত ফুর্তি আসে কিসে'?
কর্তা আর একটু মুখ নামিয়ে বললেন-
- 'আরে কারণটা শুনবে তো! পরের পর
মিটিং করত তো - সারাদিন বাতকম্ম চেপে রাখতে গিয়ে বৃহৎ অন্ত্রে ফুটো হয়ে গেছে। ফুলকো
লুচির হাওয়া টোকা মেরে বের না করলে যেমন নেতিয়ে পড়ে, তেমনি নেতিয়ে পড়েছিল ব্যাটা। ভাবতে
পারো? পূজ্যপাদ লোক একজন'।
গিন্নী দুবার হাঁ করলেন, আবার
বুজলেন। চৌষট্টি বছর হল, ঘরে ছেলে-বৌমা, এখনো এরকম ছ্যাবলামি? একগাদা নীতিশিক্ষা মাথায়
সোডার মত ভসভসিয়ে এলো কিন্তু জুতসই করে কিছু বলতেই পারলেন না 'তুমি একটা ... সহবত বলে
কিছু... ' শেষ করতে পারলেন না কারণ কত্তা এবার গলা ছেড়ে হেসে উঠেছে। বললেন-
- 'আরে ও এখন ভালো আছে, রোগ ধরা
পড়ে গেছে, সুচিকিৎসা হবে, কিন্তু ডাক্তার বলেছে নিয়মিত পবনমুক্তাসন করতে হবে। ও নাকি
বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেছল তো বৌ বলেছে ... ডিভোর্স দেবে। বোঝো ঠেলা! বিয়ে বাঁচালে
প্রাণ যায় আর প্রাণ বাঁচালে বিয়ে - গন। সবাই তো আর তোমার মত বুঝদার নয়! আচ্ছা আমার
এরকম হলে কি তুমি ...'?
বারান্দায় ছেলেটার মুখটা হাসি হাসি।
পায়রার খোপের মত ফ্ল্যাট, নামেই চৌদ্দশো স্কয়ার ফিট। শুনল কিছু নাকি? মাকে দেখেই গম্ভীর
হয়ে সেঁধিয়ে গেল নিজের ঘরে। এ বাড়িতে মায়ের সামনে আর কারো হাসা বারণ। দ্বিতীয়বার অপ্রসন্ন
হয়ে প্রসন্নময়ী হাঁক পাড়লেন-
- 'বলি আর এক কাপ চা কি পাওয়া যাবে'?
দিন শুরু হল, যেমন হয়।এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না। কিন্তু গেল না। এক রবিবার সকালে প্রসন্নময়ীর নিজের হাতে ভাজা নিখুঁত ব্যাসার্ধের গরম লুচি পড়েছে সবার পাতে - সঙ্গে যেন বোমাই পড়ল একটি। ছেলে - একটা পৃথিবীর মত দু মেরুতে একটু চাপা ফুলকো লুচির মাথায় টোকা মেরে বলল 'আমাকে কিছুদিনের জন্যে ম্যারিকা যেতে হবে। এই ধর বছর চারেক'। ঠিক এগারো সেকেন্ডের মাথায় কত্তার আদিখ্যেতা ঢাকের মত বেজে উঠল। এঁটো হাতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আর কী! কাছাখোলা লোক একটা। ভাগ্যিস পাজামার আবিষ্কার হয়েছে তাই আজও এদের লজ্জা রক্ষা হয়। আড়চোখে একবার বৌমার দিকে তাকালেন প্রসন্নময়ী। কিছুই ভাব পরিবর্তন নেই, যেন টিভিতে দুর্নীতির গল্প শুনছে বঙ্গবাসী। অসহ্য। খাবার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, তবু একটুকরো লুচি ছিঁড়ে সাদা আলুর তরকারিতে ফেললেন প্রসন্নময়ী। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন-
- 'হুম। তাহলে বৌমা এখানে আর তুই
ওখানে? আমি কিন্তু একা দুটো সংসার টানতে পারব না, এই বলে দিলাম'।
- ' আরে না। তোমাকে এত চাপ দিতে
পারি?’
- ' তবে? ওরও বদলি হয়েছে?’
- 'না, না। হয়নি এখোনো। তবে আপাতত
আমার সঙ্গেই ছুটি নিয়ে যাবে। ওয়ার্কিং ভিসা তো নেওয়াই আছে। জব খুঁজবে ওখানে। ওর ট্রেডের
খুব ডিমান্ড, পেয়েই যাবে। তখন ধীরে সুস্থে এই চাকরিটা ছাড়লেই হবে'।
ছেলে বলল ধীরে সুস্থেই। যেন নিশ্চিত
ভোটে জেতার টিকিট পেয়েছেন কোনো চিত্রতারকা, শুধু ক’বার 'মানুষের জয়' বলে হাসতে হাসতে
স্টুডিওতে ঢুকে গেলেই হবে, ব্যাস। বৌমাকে এ বাড়িতে বরণ করার পরে কম কথা বলার শিক্ষাটি
তিনিই দিয়েছিলেন বেঁকিয়ে চুরিয়ে। আজ মনে হচ্ছে সব সঠিক শিক্ষাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়
না। জিজ্ঞেস করতে হয় তাই বললেন-
- 'কবে যাবি'?
ছেলে সপ্তম লুচিটা বেগুন ভাজার
পুর ভরে তুড়ি মারার ভঙ্গিতে তুলল তারপর বলল-
- 'দিন পনেরো সময় লাগবে জরুরী কাগজপত্র
গোছগাছ করে নিতে। তা ধরো ... এই মাসের শেষে'।
শুধু কাগজ গোছানোই জরুরি? আর কিছুই নয়? কোনরকমে দুটি লুচি শেষ করে প্রসন্নময়ী গেলেন শ্যামার এস্পার কি ওস্পার করতে। শ্যামার অবশ্য তাতে অসুবিধে নেই। যত বেশী গাল তত বেশী টাকা। টিভি দেখে দেখে বেশ রপ্ত করে নিয়েছে ব্যাপারটা। ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটানোর আগেই বাড়ি হালকা হয়ে গেল।
কিন্তু তার পরের ক্যালেন্ডারের
পাতাটি উল্টানোর আগেই শ্যামা খানিকটা অবসাদে চলে গেল। এ নয় যে তার রোজগার কমে গেছে।
বরং যাবার আগে বৌদি-মনি তার ব্যাঙ্ক অ্যাক্যাউন্ট নম্বর নিয়ে গেছেন, পই পই করে বলে
গেছেন যেন কিছুতেই সে এই বাড়ির কাজ না ছাড়ে। মাঝে একবার ফোনও করেছিল। অসুবিধে সে দিকে
নয়। গিন্নী-মার গর্জন প্রথম প্রথম বেশ বাড়লেও ইদানীং কেমন ঝিম মেরে যাচ্ছেন। গরম লুচি
যেন জুড়িয়ে ঠাণ্ডা কচুরি হয়ে যাচ্ছে। প্রায় বছর সাতেকের অভ্যাস - নিয়মিত ছ্যাঁ কল কল
তেলে ভাজা হবার, এরকম নীরব বুদ্ধিজীবী হওয়া অন্তত শ্যামার ধাতে সইবে না। কত্তামশাই
সেই রকমই মিটিমিটি হাসির মধ্যে মজে আছেন। গিন্নী-মা সাঁইত্রিশ বছর পর তাকেও ছাড় দিয়েছেন।
কাগজওয়ালা দেড়কেজি কাগজে হাত ঘুরিয়ে সাড়ে সাতশো মেরে দিল, গিন্নীমা চুপ। মাছ-ওয়ালা
দেখি না দেখি না করে রুইমাছে সিলভার কাপ প্রায় চালিয়ে দিচ্ছিল, শ্যামা না ধরলেই কেলেঙ্কারি
হত একটা। কাজের মাসী টেবিলের তলাটা মোছা ছেড়েই দিয়েছে - কেউ তো বলে না কিছু। শান্তি
লোকে চায় বৈকি কিন্তু তাই বলে শ্মশানের শান্তি! শ্যামা মনে মনে মনসা মায়ের থানে একটা প্রণাম ঠুকে
বলে, 'হেই মা আগের মত ফাতরা প্যাঁচাল ফিরিয়ে দাও এ সংসারে'।
একদিন সকালবেলা প্রসন্নময়ী গিয়ে বসলেন ঘরের আর একমাত্র স্থায়ী সজীব পদার্থের কাছে। মিটি মিটি হাসি কর্তামশাই খবর কাগজ নামিয়ে বললেন-
- 'জব্বর খবর বুঝলে। কানাডার ক্যালবেরি
শহরে এক মহিলা বাথটবে শুয়েছিলেন, তো তার প্রতিবেশীর পোষা পাইথন সাপটা বাথরুমের জানলা
গলে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তিনি তো আল্লা, জিশু, ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে ছুটে ঘর থেকে
বেরিয়ে একেবারে রাস্তায়। সেখানে পথচারীরা তাকে দেখে আর্কিমিডিস, আর্কিমিডিস বলে খুব
চ্যাঁচামেচি করেছে। মহিলাটি পরে কেস করতে গিয়েছিল কিন্তু আদালত পাইথনের বিরুদ্ধে কেস
নেয়নি। সে নাকি কোন ক্ষতি করেনি আর কানাডায় সাপ পোষা নিয়ম বিরুদ্ধ নয়। বরং মহিলাটিই
ওই অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে সভ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। বোঝো কাণ্ড - যদি তোমার এমন হত'?
প্রসন্নময়ী চোখ নামিয়ে বসে থাকলেন।
পলতেয় আগুন লাগল না দেখে কত্তামশাই তার গলকম্বল চুলকোলেন খানিক। তারপর বললেন-
- 'কী ব্যাপার বল তো'? প্রসন্নময়ী
অনির্দিষ্টভাবে মাথা নেড়ে বললেন, 'না তেমন কিছু না। তাছাড়া তোমাকে বলেই বা কী হবে?
কোনদিন আমার কথা কানে তুলেছ?’
এ এক অনন্ত জিজ্ঞাসা। 'গুড মর্নিং'এর
পর সব থেকে বেশী বার উচ্চারিত হয়। কর্তা ত্রিশ বছর 'রা' কাড়েননি। কিন্তু আজ বললেন-
- 'আমার একটা অভিনব পরিকল্পনা আছে
জানো! যখন বৌএর সঙ্গেই জীবনের অধিকাংশ কাল কাটাতে হবে তখন ... বছর পাঁচেক বয়স হলেই
সব ব্যাটাছেলেকে মায়ের কোল ছাড়িয়ে তার বৌদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। শুরু থেকেই ভালো
করে ঝাড়াই বাছাই করে নেবে, পরে আর সমস্যা নাস্তি। কি বল? যুগান্তকারী ভাবনা নয়?’
- ‘আচ্ছা তোমার বাড়িটা খালি খালি
লাগে না'।
কত্তা যেন তার শঙ্খ-টাকে ভুল করে
একটি দুটি চুল খুঁজলেন তারপর বললেন-
- 'হ্যাঁ লাগে, কিন্তু এর জন্যে
আমি অনেকদিন থেকেই মনে মনে তৈরি। তুমি সেটা হওনি'।
প্রসন্নময়ী মাছি তাড়ানোর মত হাত
ঘুরিয়ে বললেন-
- 'কেন হতে যাব? এ দেশে কি ভাত
জুটছিল না? কত টাকা লাগে মানুষের এক জীবন কাটাতে? এর থেকে অনেক কম টাকায় কি আমরা সংসার
চালাইনি? এখনও তো ছেলেপিলেও হয়নি, আদৌ হবে কিনা তাই বা কে জানে, চলল দেশ ছেড়ে! এটা
একরকম স্বার্থপরতা, নয়?’
এতগুলো জিজ্ঞাসা চিহ্ন একটি সংলাপে!
কত্তামশাই একটু সময় নিলেন, তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন-
- 'যদি সত্যিই শুনতে চাও ... ওদের
এ দেশে স্বাধীনতা ছিল না'।
ব্রুটাসের হাতে ছুরি দেখে যেমন
হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলেন সিজার, তেমন এই অসাময়িক বজ্রাঘাতে জিভ জমে গেল প্রসন্নময়ীর। অন্তত
একমিনিট অস্বস্তিকর চুপচাপ চৌদিক। তারপর প্রসন্নময়ী বললেন-
- 'স্বাধীনতা ... ছিল ... না'!
- 'না। দেখো - তুমি বা আমি কেউ
ভারতের পরাধীনতা দেখিনি, বহু কষ্টে একে উপার্জন করিনি। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মূল্য
বোঝা দায়, তাই দিতেও পারিনি'।
একটু দম নিলেন, তারপর সোজা তাকালেন
গিন্নীর দিকে, বোধহয় তিরিশ বছর পর, এবং আবার খেই ধরলেন-
- 'আমাদের মা বাবারা স্বল্পায়ু,
তোমাকে সংসার চালিকার আসনে বসতে হয়েছিল বেশ তাড়াতাড়ি। ওদিকে আমি ব্যস্ত চাকরি নিয়ে।
ধীরে ধীরে সংসার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তোমাকে। আলাদা থাকল না কিছু। অনেক চাটুকার - বড় নেতার সম্বন্ধে যেমন বলে ইনিই
ভারতবর্ষ। তিনিও তেমন মনে করে বসেন। তাই তুমি ব্যাটন বদলের সম্ভাবনা আসতেই ইমারজেন্সি
ডিক্লেয়ার করে দিলে। কিন্তু ছাড়তে তো শিখতে হবে! সন্তান হিসেবে ওরা আমাদের সম্মান রেখেছে। আলাদা বাড়ি
নিয়ে চলে যেতেই পারত, কিন্তু একটা এমন সমাধান বেছে নিয়েছে যাতে কেউ আঙুল তুলতে না পারে।
সন্ত্রাসবাদ নয়, সাম্যবাদ। তোমার তো খুশিই হওয়া উচিৎ'।
আবার কিছুক্ষণ শুধু পাখার আওয়াজ
চারিদিকে। তারপর গলা সাফ করে প্রসন্নময়ী বললেন-
-'সে ... ধরো যদি আমারই ভুল হয়
... ওরা কি তবে আর ফিরবে না?’
কত্তামশাই কাঁধ ঝাঁকালেন-
- 'হ্যাঁ ও হতে পারে নাও হতে পারে।
তিমির থেকে বাঁচতে অক্টোপাসের কাছে যাওয়া। ভালো, আরো ভাল জীবনের মোহ - দাঁড়া দিয়ে যদি
সাপটে ধরে - এই পোড়াদেশে তবে আসবে কেন? হয়ত বহুদিন পরে মাতৃভূমির জন্যে প্রাণ কাঁদবে,
তখন সেই প্রভাতে তুমি আমি থাকবো কিনা ... দেবা ন জানন্তি। ছাড়ো, ভালোটাই ভাবো। আসবে
বৈকি। চারবছর দেখতে দেখতে দু’দশ কাপ চায়ের মত ফুরিয়ে যাবে। তুমি কিন্তু এরমধ্যে নিজেকে
বদলে রাখো। কীভাবে সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি জানি না। এর কোনো মেড ইজি বাজারে
পাওয়া যায় না। এটুকু বলতে পারি – ‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়’। শঙ্খ ঘোষ থেকে টুকে
দিলাম'।
আর একবার ঠাকুরঘরে যাবেন বলে প্রসন্নময়ী
উঠলেন। পা বাড়াবেন, তখনি কত্তার মুখে আবার তার নিজস্ব প্রতীক ফেরত এলো, মিটমিটে হাসি।
বললেন-
- 'একটা ঘরোয়া উদাহারণ দিই শোনো
- মনে আছে বিয়ের পর তুমি গোল লুচি বেলতে পারতে না, ঠিকঠাক ময়ান হত না, ফুলত না। একেক
দিন রাতের বেলা আমার কাছে কেঁদে ফেলতে। তুচ্ছ কথা, কিন্তু সেই তুমি - আজ তেত্রিশটা
লুচি বেললে, তেত্রিশটাই গোল হয়। গরম তেলে ফেললে চিড়বিড় করে ফুলে ওঠে গ্লোবের মত। আর যখন সেই লুচি আসে পাতে, ছোট্ট একটা টুস্কি
তার মাথায়, ফুস-স করে বেরোয় অল্প গরম ভাপ। তারপর কার যেন শিরদাঁড়ার মত নরম বেগুন ভাজায় জড়িয়ে গোটাগুটি মুখে
- আহা - স্বর্গ যদি কোথাও থাকে ... । ধরো সব মিলিয়ে জীবন এরকমই, একটা নিখুঁত
লুচির মত। বেলা থাকতে থাকতে বেলতে শিখে নাও। পারবে - নিশ্চয়ই পারবে!’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন