মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


প্ল্যাটফর্মের গল্প

দয়াময়ের ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। সচরাচর পেচ্ছাপ পেলেই ওর ঘুম ভাঙে। এজন্য ও রাতে ঘুমোনোর আগে বেশী জল খায় না। কারণ একবার চটকে গেলে ঘুম আসতে দেরী হয়। মাথার সামনে জলের বোতল একটা রাখা থাকে বটে। পরদিন সকালে উঠে জলটা খেয়ে নিলেই দয়াময়ের পেয়ে যায়।

একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনেই ঘুমটা ভেঙেছিল, যেন কাউকে বোবায় ধরেছে। দয়াময় শব্দটা খেয়াল করে শুনে বুঝতে পারল, “মায়া না!” কিন্তু বোবাকে আবার বোবায় ধরবে কী! ও উঠে পড়ল। হাঁক দিল – “মায়া? ও  মায়া। কী হয়েছে রে মা?” শব্দটা থেমে গেল। দয়াময় আন্দাজ করে হেঁটে গেল মায়া যেখানটায় শোয়, সে  পর্যন্ত। হাত বাড়িয়ে দিল মায়ার মাথায় হাতটা রাখতে। এক শব্দহীন কান্না ও ব্যথায় ভেঙেচুরে যাচ্ছিল মায়ার শরীরটা। ও দয়াময়ের ছোঁয়া থেকে সরে গেল।

“স্পষ্ট শুনলাম। কিন্তু আর তো কোন আওয়াজ নেই! গেলই বা কোথায় মেয়েটা! আজ কি শোয়নি এখানে? নাকি বাইরে গেছে? নাকি ভুলই শুনলাম?” জায়গাটা হাতড়ে মায়াকে না পেয়ে দয়াময় নিশ্চিত হয়ে গেল যে ও ভুল শুনেছে। ও ফিরে গিয়ে জল খেল, তারপর শুয়ে পড়ল। চোখদুটো লেগে এসেছে কি আসেনি, আবার ঘুম ভাঙিয়ে দিল লালুর অবিরত ডাক।

“এই রাতবিরেতে চেঁচানোর আর জায়গা পেলি না রে হতচ্ছাড়া? যা দূর হ।” বলে দয়াময় ওপাশ ফিরে শুতে গিয়ে বুঝতে পারল লালু লুঙ্গিটা কামড়ে ধরে টানছে।

“আরে ছাড়। খুলে যাবে যে। কী হয়েছেটা কী?” দয়াময়ের বিরক্তিকে আমল না দিয়ে লালু একইভাবে টানতেই  থাকল। দয়াময় জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যেতে হবে? ছাড়। চ যাচ্ছি।” লালু দয়াময়কে যেখানে এনে দাঁড় করালো, সেখানে পা বাড়াতেই কিছুর সঙ্গে পা ঠেকল। দয়াময় নীচু হয়ে ছুঁয়ে দেখল একটা শরীর। শরীরটা হাতড়ে বুঝতে পারা গেল একটি নারীদেহ।

“এ কে? কী হয়েছে এর?” বিড়বিড় করতে করতেই দয়াময়ের হাত ভিজে উঠল রক্তে। দয়াময় বুঝতে পারল  লালু এতক্ষণ কী বোঝাতে চাইছিল। কিন্তু রেললাইনে তো হামেশাই কাটা পড়ছে কত লোক। কেউ আবার  নিজে থেকেও… হঠাৎ কী একটা মনে পড়ায় দয়াময় আবার শরীরটা হাতড়াতে শুরু করল। পরনের কাপড়  এলোমেলো হয়ে রয়েছে। বাঁ হাতের কবজিতে থাকা একটা বিশেষ চুড়িতে হাত ঠেকতেই দয়াময় চীৎকার করে কেঁদে উঠল –“মায়া রে!” লালু আর কোন শব্দ করছে না। শুধু দয়াময়ের গায়ে মুখটা ঘষছে। দয়াময় বলল, “মায়াটা চলে গেল রে লালু!” নিশুতি রাতের অন্ধকারকে স্টেশন চত্বরের আলো-আঁধারি আরো আবছা করে তুলেছে। কেউ কোত্থাও নেই। এমনকি গুডস ট্রেন পাস করিয়ে দিয়ে কেবিনম্যানও ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ জানতেও পারল না একটি উপেক্ষিত মৃত্যুও অশ্রুর দাবী রেখে যায় কখনো কখনো।

পরদিন সকাল হতেই জানাজানি হয়ে গেল ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই। সবাই অবাক হয়ে গেল - প্ল্যাটফর্মের পাগলি কীভাবে রেলে কাটা পড়ল! একইসঙ্গে এ প্রসঙ্গও উঠল যে, বহুদিন আগে দয়াময়ের মেয়েটাও…!

রেল-পুলিশ এসে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বেওয়ারিশ বডিটা নিজেদের হেফাজতে নিল। রাতে  ঘটনাটা ঘটেছে। কেউ স্বাক্ষীও নেই ধরে নিয়ে পুলিশ যখন অনুমান অনুযায়ী রিপোর্ট লিখছে, দয়াময় এগিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে লালুও।

লালুকে দেখিয়ে দয়াময় বলল, “স্যার ও দেখেছে। আমি অন্ধ, কিন্তু ও দেখতে পেয়েই আমায় টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল। বাঁ-হাতের ওই চুড়িটা আমারই দেওয়া। আমার মেয়ে চলে যাওয়ার পর ওর শেষ চিহ্নটা মায়া-মাকেই দিয়েছিলাম স্যার।” একজন জন্মান্ধ মানুষের হাহাকার যে কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে,   পুলিশের অনুসন্ধানকারী অফিসাররা প্রত্যেকে উপলব্ধি করলেন।

“এ অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে তুমি কিছু বলবে?”

“এটা তো অ্যাক্সিডেন্ট নয় স্যার! খুন।”

স্টেশন চত্বরের দোকানদাররা অনেকেই বলে উঠল, “আাঃ! কী যা তা বলছ? এই অন্ধ ভিখিরির কথা ধরবেন না, স্যার!”

পুলিশের অনুসন্ধানকারী অফিসারদের যিনি প্রধান, তিনি তাঁর অধস্তনদের নির্দেশ দিলেন, “এর স্টেটমেন্ট রেকর্ড করে নিন।”

তারপর দয়াময়কে বললেন, “আর কিছু বলবে?”

“আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে এই প্ল্যাটফর্মেই রাতে শুয়ে থাকি। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে। হতভাগা আমি আর মায়া-মা ছিলাম। আর এই লালু।” দয়াময় ডুকরে উঠল। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “আমার মেয়েটাকেও ওরা একইভাবে নষ্ট করেছে, তারপর ঠেলে ফেলে দিয়েছে চলন্ত ট্রেনের তলায় এমনই এক রাতের অন্ধকারে।”

উপস্থিত সবাই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছিল, “মৌচাকে ঢিল মারল! বুড়োটাও এবার যাবে। এতবার করে বারণ করলাম!”

পুলিশ অফিসারটি যখন দয়াময়কে বলছে, “মনখারাপ করে আর কী হবে বল? তুমি সাবধানে থেকো।” অন্ধ দয়াময় লুঙ্গির খুঁট থেকে বের করে অফিসারের হাতে তিনটে কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলল, “ওর সৎকারের জন্য এই সামান্য টাকাটা খরচ করবেন, স্যার!”

এ ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। অন্ধ দয়াময়কে আর দেখতে পাওয়া যায় না। কেউ জানেও না কোথায় চলে গেছে। এমন কোন প্রয়োজনীয় মানুষ তো নয় যে সবাই মনে রাখবে! লালু যদিও এখনো প্ল্যাটফর্মেই থাকে।

সেদিন রাতে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। খারাপ ওয়েদার এবং যেহেতু জনবসতি নয়, এসব জায়গা আগেই সুনসান হয়ে যায়। এমনকি চুল্লুর ঠেকও ফাঁকা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ পর গুডস ট্রেনটা যাবে।

প্ল্যাটফর্মের আলোটা আজ সন্ধ্যে থেকেই খারাপ হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে টলতে টলতে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো একটা অবয়ব। তারপর এগিয়ে এল। আজ রাতেই কোত্থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে আরেকজন। কেউ খেয়াল করেনি। একটানে তার কম্বলটা সরিয়ে দিতেই… সেই অবয়ব কী যেন দেখে বিদ্যুৎবেগে ছিটকে পালিয়ে যেতে গিয়ে লালুর ওপর ধাক্কা খেয়ে মুখথুবড়ে পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মের মেঝেতেই। যে সাঙ্ঘাতিক আওয়াজটা হল, মনে হল চোয়ালটা ভেঙেই গেল বোধহয়। অথচ এক অকথিত ভয়ে তার মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বেরোল না। বহুদিন পর চেনা মানুষকে দেখে ঘুম ভেঙে ওঠা লালু অবাক হয়ে গেল। তারপর মারাত্মক আনন্দে একটানা লেজ নাড়াতে শুরু করল। ওর মুখ দিয়ে কুঁইকুঁই করে একটা আনন্দধ্বনি বেরিয়ে আসছিল।

সেই অবয়ব জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে রেল লাইনের ওপরে একটা ঝুপসি অন্ধকার মত জায়গায়। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই। লালুও না।

গুডস ট্রেনটা এগিয়ে আসছে…

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন