মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

কাজল সেন

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৪০


ঠাম্মা

নিজের দশ বছরের জীবনকালে কারও মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিতি ঘটেনি সুরঞ্জনার। মৃত্যু শব্দটির সঙ্গে অবশ্য অপরিচিত থাকার কথা নয়, শব্দটি সে শুনেছে বিভিন্ন আলোচনাসূত্রে, পড়েছে পাঠ্যবইয়ের পাতায়। কিন্তু সরাসরি চোখের সামনে ঠাম্মার মৃত্যুদৃশ্য এবং পরমুহূর্তে ঠাম্মার জীবন্ত শরীরটা মৃতদেহে রূপান্তরিত হওয়া, সুরঞ্জনাকে একধাক্কায় বিপর্যস্ত ও বিমূঢ় করে ফেলেছিল। সুরঞ্জনা বুঝে উঠতে পারছিল না, ব্যাপারটা  কী ঘটল, কেন ঘটল, এবার সে কী করবে! বস্তুত ঠাম্মার বেঁচে থাকাটাই তার কাছে একমাত্র স্বাভাবিক ঘটনা ছিল, কিন্তু সেই ঠাম্মা যে কোনোদিন মরে যেতে পারে, এটা তার অনুভূতি ও উপলব্ধির বাইরে ছিল। তাই বাড়ির সবার সাথে ঠাম্মার মৃত্যুশয্যার পাশে বসে সে লক্ষ্য করছিল, তার প্রচন্ড ঘনিষ্ঠ আদরের ঠাম্মা, একটু একটু করে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না বরং গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে, চোখের দুইপাতা আস্তে আস্তে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, আর সেই মুহূর্তে তার বাবা ঠাম্মার সামান্য খোলা মুখে একটা গ্লাস থেকে খুব সন্তর্পণে জল ঢেলে দিচ্ছে এবং আর্তনাদ করে উঠছে, ‘মা! মাগো!’ আর সঙ্গে সঙ্গে ঠাম্মাকে ঘিরে সজল চোখে যারা বসেছিল, তারা সমস্বরে কান্নায় লুটিয়ে পড়ছে।

হ্যাঁ, এই প্রথম সুরঞ্জনার জীবনে কারও মৃত্যুদর্শন এবং মৃতদেহদর্শন। কিন্তু সে আর সবার মতো কাঁদতে পারল না, কোনো কথাও মুখ থেকে উচ্চারিত হলো না, কেমন যেন বোবা হয়ে গেল। তার সব অনুভূতিই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল! আর তারপর সেই ঘর থেকে বেরিয়ে কখন যে আনমনে বাড়ির চিলেকোঠায় একটা চেয়ারে বসেছিল, আর নামেনি নিচে। ঠাম্মাকে সৎকারের জন্য শশ্মানে নিয়ে যাবার আগে সবাই খুঁজতে খুঁজতে চিলেকোঠাঘরে এসে সুরঞ্জনাকে নিচে নিয়ে যাবার জন্য অনেক চেষ্টা করল, শেষবারের মতো ঠাম্মাকে দেখতে, সুরঞ্জনা স্থবির হয়ে বসে থাকল চেয়ারে। আর যে কখনও ঠাম্মার শরীরের সঙ্গে দেখা হবে না, এই ভাবনাটাই তার মনে জাগল না।

দিন গড়াল। শ্রাদ্ধশান্তি, নিয়মভঙ্গ একে একে মিটে গেল। কিন্তু সুরঞ্জনা সেই যে বোবা হয়ে গেছিল, সেভাবেই থাকল। সবাই বুঝল, ঠাম্মার চলে যাওয়াতে মেয়েটা এতটা মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছে যে, তার স্বাভাবিক  বোধশক্তি সাময়িকভাবে হারিয়ে গেছে। কোনো ব্যাপারেই তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারই মধ্যে একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আচমকা চিল চিৎকার করে উঠল। সে একাই একটা ঘরে শোয়। পাশের ঘরে মা-বাবা। মেয়ের চিৎকারে তাদেরও ঘুম চটকে গেল। তড়িঘড়ি তারা দৌড়ে এলো সুরঞ্জনার ঘরে। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বেলে তারা চমকে উঠল, সুরঞ্জনা বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে দেওয়াল ঘেঁষে উন্মাদিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এবং ঘরে রাখা একটা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বকছে, আমি যাব না, তোমার সঙ্গে কিছুতেই যাব না। তুমি চলে গেছিলে কেন? আমি তো তোমাকে চলে যেতে বলিনি! বরং তোমাকে আঁকড়ে ধরেই তো আমি ছিলাম। তাহলে আজ আমাকে নিতে এসেছ কেন? আমি যাব না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন