মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

অচিন্ত্য দাস

 

ভ্রমণিকা (৪)

 


তুষার দেশের রেলগাড়ি

আলাস্কার সিওয়াডে এসে কাঠের বাড়িটা বাইরে থেকে সাধারণই মনে হয়েছিল। ভেতরটা কিন্তু বেশ – সুন্দর করে সাজানো দুটো শোবার ঘর, খাওয়া এবং রান্নার জন্য অনেকটা জায়গা সেখানে ফ্রিজ, মাইক্রো, ইলেক্ট্রিক উনুন সব আছে। ফ্রিজে খাবার আছে, তাকে রাখা আছে রান্না করার মশলাপাতি। সব থেকে মন কেড়েছিল বসার ঘরটি। দেয়াল জোড়া কাচের জানালা। আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখার জন্য ডিভান গোছের গদি আঁটা বিছানা। আমাদের থাকার ঘরগুলো ছিল বাড়ির পেছনের দিকটা, রাস্তার উল্টোদিকে। ডিভানে হেলান দিয়ে দেখা যায় তুষারাবৃত পাহাড়। বাড়ির কাছেই একটি গির্জা। গির্জার ক্রসচিহ্ন লাগানো সরু লম্বা উঁচু চূড়োটা ঠিক যেন পাহাড়ের পটে আঁকা ছবি।

গির্জার চূড়া পাহাড়ের উচ্চতার কাছে কিছুই নয়, তবু জানালা দিয়ে দেখলে মনে হয়, গির্জার ক্রসচিহ্ন লাগানো চূড়া যেন পাহাড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূর আকাশের সাদা মেঘ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। এ বাড়িতে আজই শেষ দিন। “যাবার সময় হলো বিহঙ্গের…” এবার বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ফেরার পথ ধরতে হবে। মাত্র সাড়ে দিন ছিলাম, তাতেই বাড়িটির ওপর বেশ মায়া পড়ে গেছে। সাতমহলা রাজবাড়ি বা কুঁড়েঘর যাই হোক না কেন, বাড়ির ছাদের নিচে যে একবার আশ্রয় পেয়েছে বাড়ির সঙ্গে তার একটা মায়া-জড়ানো স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এ আমি আগেও বহুবার টের পেয়েছি।

অরণ্য আর পাহাড়ের সারি দুদিকে রেখে মাঝখানের রাস্তা ধরে অ্যাঙ্করেজ থেকে সিওয়াডে এসেছিলাম মোটর গাড়িতে। ফিরব রেলগাড়িতে। আলাস্কা রেলরোডের যাতায়াত পরিষষেবা রয়েছে এখানে – অবশ্য শীতের সময়টুকু বাদ দিয়ে। রেলগাড়ির পথ শুনলাম হাই-ওয়ের মতো নয়, রেললাইন গেছে অরণ্য আর তুষার-প্রান্তরের ভেতর দিয়ে।

বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি, গাড়িও জমা দিয়ে দেওয়া হলো। আমরা নিজের নিজের চাকা লাগানো বাক্স রাস্তা দিয়ে ঘরঘর করে টেনে রেল-স্টেশনে এলাম। খুবই ছোট স্টেশন। আমাদের নিমপুরা বা বাঁশতলা গোছের স্টেশনও এর থেকে বড়। আসলে এ দেশে বড় বড় শহরের মেট্রোরেল ছাড়া যাত্রী ট্রেন চলাচল নেই বললেই চলে। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও সামান্য। সকলে গাড়ি অথবা উড়োজাহাজেই যাওয়া-আসা করে। কিছু কাজ-না-থাকা মানুষ, বা ছুটিতে বেড়াতে আসা লোকজন রেলগাড়ি চড়ে। আমি এর দুটোর মধ্যেই পড়ছি।

এখানে আসার আগে কয়েকজন বলেছিলেন আলাস্কা রেলরোডের রেলগাড়িতে সফর করতে ভুলো না, ট্রেনে না চড়লে অনেক কিছু দেখা বাকি থেকে যাবে। কথাটা ঠিকই। এদেশে বা অন্য দেশের জায়গায় জায়গায় রেলগাড়িতে ঘুরেছি তবে আলাস্কার মতো রেলযাত্রা আমি সত্যিই কখনো করিনি।

ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, সময় হলে দরজা খুলবে, যাত্রীরা উঠবে। তার দেরি আছে। আমি স্টেশনের দেয়ালে কাচ-বাঁধানো লেখা আর ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। আলাস্কা রেলরোডের ইতিহাস। এই রেলপথ শ-খানেক বছর আগে, ১৯২৩ সালে সম্পূর্ণ হয়েছিল। দক্ষিণে সিওয়াড থেকে উত্তর দিকে অ্যাঙ্করেজ হয়ে আলাস্কা প্রদেশের মাঝখানের শহর ফেয়ারব্যাঙ্কস অবধি চলে গেছে। মোট চারশ সত্তর মাইল মত। প্রথম দিকে সোনার টানেই মানুষজন এখানে এসে বসতি করেছিল। কিন্তু সোনা তো খাওয়া যায় না আর বাজারে সোনা কেনার লোক না থাকলে সোনা সেরকম কোনো কাজেও লাগে না। স্বর্ণসন্ধানীরা যাতায়াত করবে এবং তাদের খাবার-দাবার, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সোনা-পাগলদের জন্যও সেই লোহাই ভরসা! পাতা হলো লোহার লাইন আর সে লাইনে চলাচল শুরু করল ‘লৌহশকট’ মানে রেলগাড়ি। আগে কীরকম ছিল জানি না, তবে এখন সে রেলগাড়ির কামরায় বড় বড় কাচের জানালা। যে যেখানেই বসুক না কেন, দৃষ্টি বাধা পায় না। জলযানে যেমন এখানেও প্রকৃতিবিদ আছেন, তবে এবার এক মহিলা প্রকৃতিবিদের গলা শুনলাম। এখানেও দিক-নির্দেশের জন্য ঘড়ির কাঁটার ব্যবহার। যেদিকে ট্রেন যাচ্ছে সে দিকটা বারোটার ঘর ধরে নিয়ে ঘড়ির হিসেবে যা বলা হচ্ছে সেদিকে ততটা ঘাড় ঘোরাতে হবে!

গাড়ি সবে ছেড়েছে এমন সময় শ্রীমতী প্রকৃতিবিদ বলে উঠলেন “নটায় দেখ, নটায় দেখ…” সকলে তাকালো। আমি বাঁ দিকের জানলায় ছিলাম, মাথা ঘোরাতে হলো না। “দেখ দুটো মুস হরিণ…” কোথায় মুস হরিণ? আমি দেখতে পেলাম না। দু-একজন নজর করতে পেরেছিল, বাকিরা আমার মতোই। হয়তো হরিণ দম্পতি গাছপালার আড়ালে ছিল। গাড়ি মাঝারি গতিতে চলেছে, আমি নটার দিকে চেয়েই রইলাম, যদি দেখা যায়। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম কতটা বোকামি করছি। হরিণরা তো ‘ওহে যাত্রীরা, আমাদের দেখ আমাদের দেখ’ বলতে বলতে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে আসবে না! তারা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।

ট্রেন একটু গতি বাড়িয়েছে। ঘেসো জমি আর বড় বড় গাছের পাতায় না-গলা বরফের আস্তর। মাঝে মাঝেই জল দেখা যায় – কোন লেক বা নদী নয়, সমুদ্রের জল কোনোভাবে ঢুকে পড়েছে। প্রকৃতি-মহাশয়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম – ১৯৬৪ সালে আলাস্কায় একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। যখন থেকে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প মাপা শুরু হয়েছে এত তীব্র ভূমিকম্প পৃথিবীর কোথাও কখনো হয়নি। রিখটার মাপকাঠিতে ৯.২! আর এ কম্পন পুরো পাঁচ মিনিট ধরে চলেছিল। এর থেকে অনেক কম তীব্রতার ভুমিকম্প দশ-পনেরো সেকেণ্ডেই যে সব ধূলিসাৎ করে দিতে পারে তা তো আমরা দেখেছি। আলাস্কায় লোকজন না থাকাতে প্রাণহানি নিশ্চয় তেমন কিছু হয়নি। তবে বাসুকি নাগের মাথা নাড়ার ফলে এ অঞ্চলের অনেক কিছুই আমূল পাল্টে গিয়েছিল। ট্রেন চলছিল একটা বিশাল জলভাগের পাশ দিয়ে। তা দেখিয়ে মহাশয়া বললেন, এখানে আগে গাছপালা ছিল, কিন্তু ওদিকের একটা পাহাড় ভূমিকম্পের ফলে ছাব্বিশ ফুট সরে গিয়েছিল। ওপারের সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা নোনা জলের বানে গাছপালারা কিছুদিনের মধ্যেই বীরগতি পেয়ে যায়।

মনে মনে ভাবছিলাম, একটা পাহাড়কে এক-আধ ইঞ্চি নয়, একেবারে ছাব্বিশ ফুট সরিয়ে দিলে!! নজরুলের সেই গানটার মতো – ‘খেলিছ, এ বিশ্ব লয়ে / বিরাট শিশু, আনমনে…’ কাহিনীতে বাধা পড়ল, মহাশয়া বলে উঠলেন, “থ্রি্ ও ক্লক, ব্ল্যাক বেয়ার…”

মুস হরিণ আমার চোখকে ফাঁকি দিয়েছে, কিন্তু কালো ভাল্লুক বিশ্বাসঘাতকতা করল না। স্পষ্ট দেখলাম একটা গাছের নিচে হালকা ঝোঁপঝাড়ে কালো কালো কী যেন নড়াচড়া করছে। আর একটু ভালো করে দেখতে পেলে বেশ হতো… আমার এবং হয়তো অন্য যাত্রীদের মনের কথা বুঝে নিয়ে ড্রাইভারবাবু ট্রেন থামিয়ে দিলেন। দেখলাম বড় ভালুকের সঙ্গে ছানা রয়েছে – ট্রেন থামতেই একটা ছানা গাছ বেয়ে ওপরে উঠে গেল, তার পেছন পেছন আরেকটা। মা ভালুক নিচেই রইল।

আমি ততক্ষণে মনে মনে কাচের জানালার মধ্যে দিয়ে, জলা জমি পেরিয়ে সটান ভালুকের কাছে চলে গিয়েছি । শুনতে পেলাম মা-ভালুক বলছে, “এই, তোদের বলেছি না, দু-পেয়েরা মায়াবী রাক্ষস – ওই দ্যাখ, সাপের মতো লম্বা জিনিসটা নিজে থেকেই গুড়গুড় করে চলতে পারে। এসব ওদের ভোজবাজি। ওরে, কী সর্বনাশ, ওটা থেমে গেল রে, ওর ভেতর অনেকগুলো দু-পেয়ে আছে যে … পালা পালা! তোরা দুটোতেই গাছের মগ ডালে গিয়ে লুকিয়ে পড়। নিচে আমি পাহারা দিচ্ছি। মানুষের থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকবি, ওদের মতো বদ জানোয়ার আর হয় না।”

ভালুক তিনটেকে এখনো নজর করা যাচ্ছে, ট্রেনও থেমে আছে। বাঃ, বেশ ট্রেন তো!

আমার খড়্গপুর – টাটা প্যাসেঞ্জারের কথা মনে পড়ে গেল। সে অনেক দিন আগে ‘উচ্চশিক্ষা’ লাভের ঝোঁক হওয়াতে এই ট্রেনে প্রায় রোজই চড়তাম। খড়্গপুর থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ছেড়ে ঝাড়গ্রাম অবধি গাড়ি চলত কাঁটায় কাঁটায়। তারপর অন্ধকার নেমে গেলেই তিনি কোনো এক মাঠে নিজের মর্জিতে দাঁড়িয়ে পড়তেন! সে ট্রেনের বেশিরভাগ কামরায় জানালার কাচ বা গরাদ কিছুই থাকত না। ছাদে আলো লাগানো থাকলেও জ্বলতে দেখিনি। কেউই ঠিক করে জানতো না গাড়ি কেনো থেমে আছে। এক রসিক আদিবাসি যাত্রী বিড়ি টানতে টানতে একবার আমাকে বলেছিল, “লাইনের উদিকে ডেরাইভারের শ্বশুর বাড়ি। দিখা কইরতে যাঁইছে।”

আলাস্কার ট্রেনে চড়ে এই এত বছর পরে বুঝলাম সে প্যাসেঞ্জারের ড্রাইভারেরও হয়তো এ ধরনের প্রকৃতিপ্রেম ছিল। মেঠো চাঁদের আলোতে ট্রেন থামিয়ে কবি জীবনানন্দের মতো ‘খড় নাড়া পোড়ো জমি মাঠের ফাটল / শিশিরের জল’ দেখত বসে বসে! যাত্রিদেরও দেখার সময় দিত যথেষ্ঠ।

ভালুক পরিবার পেরিয়ে আর একটু যেতেই গাড়ি এসে পড়ল স্পেনসর ভ্যালি নামে একটি অঞ্চলে। বাপ রে, চারিদিক সাদা হয়ে আছে। যদিও ট্রেনের ভেতরে উষ্ণ আরামে বসে আছি তবু যেন শীত করছে! লাইনের দুপাশেই তুষারের থাক – মনে হয় একটু আগেই হয়তো দু-এক পশলা তুষার পাত হয়ে গেছে।

বিস্তীর্ণ তুষার-প্রান্তরে দু-একটা ছোটখাটো উদ্ভিদ কোনো রকমে বরফের স্তর অবজ্ঞা করে মাথা বার করতে পেরেছে। আলাস্কায় এসে বরফ তো কম দেখলাম না। পদব্রজে, জলপথে, এমনকি আকাশ থেকে উড়োজাহাজের জানালা দিয়েও অনেক দেখেছি। তবে এ রেলগাড়ি আমাদের যেন সরাসরি তুষার-ক্ষেত্রের মধ্যেই এনে ফেলেছে! গা শিরশির করে।

ট্রেনটা একটা নব্বই ডিগ্রীরও বেশি বাঁক নিল। বাঁক নেওয়াতে জানালা দিয়ে গোটা ট্রেনটা দেখা যাচ্ছিল, যেন একটা খেলনার রেলগাড়ি। নজরুলের সেই ‘বিরাট শিশু’র খেলনা হতে পারে! এরকম জায়গায় যদি খেলনাটি খারাপ মানে অচল হয়ে পড়ে, তাহলে? তাহলে অবিশ্যি অনেক কিছুই হতে পারে। একবার মনে হলো আসার সময় তো দক্ষিণ দিক বরাবর মোটামুটি সোজা রাস্তাই ছিল। এখন এতটা বাঁক নেবার কী দরকার পড়ল! প্রকৃতিপ্রেমিক ড্রাইভার তুষার পাহাড়ের দৃশ্য দেখে বিভোর হয়ে রাস্তা ভুল করল না তো!

বলা হলো এই অঞ্চল থেকে কী একটা বিশাল গ্লাসিয়ার বেরিয়েছে। জায়গাটা এতই ঘন বরফে ঢাকা ছিল যে বুঝতে পারলাম না সে গ্লেসিয়ার ঠিক কোথা থেকে জন্ম নিয়েছে আর কোন রাস্তা ধরেই বা নেমেছে। শুনলাম এখানে একটা গুহা আছে। স্নো কেভ বা তুষার গুম্ফা। অনেকে সেখানে অ্যডভেনচার করতে যায়। ফোন নিয়ে এদিক সেদিক আনাড়ির মতো একগাদা ছবি কচকচ করে তুললাম, যেমন সবাই তুলছিল। তবে এখন দেখে মনে হচ্ছে ছবি আর আসল দৃশ্যের ভেতর বিস্তর তফাৎ। ফোনের পরদায় আটকে পড়া তুষার-প্রান্তরের অবস্থা অনেক সময় বড় করুণ! মনে হচ্ছে সাদা রং করা একটা উঁচুনিচু জায়গা ছাড়া কিছু নয়।

ক্লান্ত রেলগাড়ি ঘুটুর ঘুটুর করে চলছে। বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল ট্রেন যে রকম পাণ্ডব-বর্জিত মাঠঘাট জোলো জায়গার পাশ দিয়ে চলেছে তাতে কতক্ষণে পৌঁছোবে! অ্যাঙ্করেজ তো শহর, এখন পর্যন্ত কোনো শহুরে বাড়িঘরের চিহ্ন দেখছি না। কামরার অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে, বাকিরা ঝিমোচ্ছে। প্রকৃতিমহাশয়া বললেন দুটোর কাঁটায় দুটো পাহাড়ি ছাগল। প্রায় এগারোটা বাজে, ছাগল দুটো হয়তো ট্রেন আসবে বলে ছবি তোলার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই অবেলায় কেউই দেখলাম পকেট থেকে ফোন বার করল না। ছাগল ভারি নিরীহ জন্তু – দুনিয়ার সব দেশেই ছাগল আছে, কিন্তু সরল-সাধারণ স্বভাবের বলে কোথাও তেমন খাতির পায় না! ভালুক, কম করে শেয়াল-টেয়াল হলেও হয়তো লোকে ছবি নেওয়ার চেষ্টা করত।

এইবার ড্রাইভারজি একটি ঘোষণা করলেন। আমর কানে কথাটা একটু অদ্ভুত ঠেকল। বললেন, “আমাদের গাড়ি ঘণ্টা খানেক বিলম্বে চলছে। কামরায় কামরায় সহায়তার জন্য যে কর্মচারীরা আপনাদের সঙ্গে ছিল, তাদের কাজের অবধি শেষ হয়েছে। এবার তাদের বিশ্রাম নেবার সময়। আমরা দুঃখিত যে বাকি ঘণ্টাখানেক এদের ছাড়াই আমাদের চলতে হবে।”

টাটা-কলকাতা-টাটা যেতে আসতে ট্রেন বহুবার বিচ্ছিরি রকমের দেরি করেছে। যারা কামরা পরিষ্কার-টরিষ্কার করে তারা নীল জামা-প্যাণ্ট পরে ঘুম চোখেও কাজ করে যায়। অত দেরিতে পৌঁছলে তারা বাড়ি যায় কী করে? দু-একবার জিগেস করাতে তারা বলেছিল, বাড়ি যাওয়ার সময় নেই, আবার ভোরের ট্রেনে ডিউটি। স্টেশনে শুয়ে থাকবে। কিন্তু একথা তো কখনো মনে হয়নি যে সকলের মতো এদেরও কাজের সময়সীমা থাকা উচিত। তা কি আছে? ট্রেন দেরি করলে কি তারা বাড়তি টাকা পায়?

সাড়ে এগারোটা বাজল। প্রকৃতিবিদও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি নিজেই দেখলাম সাড়ে এগারোটার কাঁটায় সূর্যদেব জলে ডুব দেবার আয়োজন করছেন। বুঝলাম অ্যাঙ্করেজ পৌছোতে বারোটা পার হয়ে আজকের দিন শেষ হয়ে যাবে।

রাত বারোটার কিছু পরে মৃদু ঝটকা দিয়ে ট্রেন থামল অ্যাঙ্করেজ স্টেশনে। এদেশের দিন-রাতের খেলায় অবশ্য তখন ‘সন্ধে বারোটা! চাকা-লাগানো বাকস টানতে টানতে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দেখলাম গোধূলির আলো আকাশে তখনো লেগে আছে। রাস্তার আলোগুলো একটা একটা করে জ্বালানো হচ্ছে। হোটেল ঠিক করা ছিল, আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম।

আলাস্কা ভ্রমণের শেষ ধাপে এসে মনে হচ্ছিল – কত কী যে দেখলাম! দেখার সঙ্গে কিছু ভূগোল কিছু ইতিহাস আর চারটি চারটি বিজ্ঞান মিশে দারুণ এক উপভোগ্য যাত্রা সম্পন্ন হলো। ছবি তোলা হয়েছে বিস্তর। এসব ছবি অন্যকে দেখানো যায়, জড়ো করে বিবরণ খাড়া করা যায়। হয়তো বা একটু আধটু মশলা সহকারে আড্ডাও জমানো যায়। তবে ছবি, ভিডিও, টুকরো-টুকরো তথ্য – এসবের বাইরেও কি কিছু থাকে?

পৃথিবীর দূরপ্রান্তে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে উন্মুক্ত প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়ালে প্রথমেই  বিস্ময়ের এক প্রবল ঝাপটা মনপ্রাণ অবশ করে দেয়। সে সম্মোহন ক্রমে কেটে যায় তবে  মনে হয় আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। আরও আরও কিছুক্ষণ। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম থেকে, হয়তো বা আকাশ এবং মাটি থেকেও কোনো এক সূক্ষ্ম তরঙ্গ ভেসে আসছে। কে যেন কিছু বলতে চায়। এখানে এসেছি বলে এ বার্তা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে? কী বলতে চাইছে? সে তরঙ্গের ভাষা জানি না তাই ঠাহর হয় না।

নাকি এসব স্রেফ মনের ভুল? হতেই পারে তবে তা সত্ত্বেও এই অব্যক্ত অনুভূতিটুকু কী করে যেন স্মৃতিতে জায়গা করে নেয়। হাজার ছবি, ভিডিও, পাতার পর পাতা অনেক যত্নে সাজানো বাক্য-বিন্যাস – এসব কিছুতেই একে ধরা যায় না।

হোটেলে পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণে রাত্তির নামল, আলাস্কা যাত্রা শেষ। আলাস্কা ভ্রমণিকার চার-চারটে পর্ব ধরে যা যা লেখার ছিল তাও শেষ।

আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো…।

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন