মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

কেকি এন. দারুওয়ালার কবিতা

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

কেকি এন. দারুওয়ালার কবিতা

(ভূমিকা ও ভাষান্তর: গৌরাঙ্গ মোহান্ত)

 


কবি পরিচিতি : কেকি এন. নাসেরওয়ানজি দারুওয়ালা (২৪.০১.১৯৩৭--২৬.০৯.২০২৪) ভারতীয় ইংরেজি কবিতার একজন প্রভাবশালী অগ্রনায়ক। তাঁর কবিতায় মিথ ও স্মৃতির অনুরণন, সহিংসতার উত্তাপ, এবং নদী, ঋতু ও প্রান্তরের সৌন্দর্যের মেলবন্ধন ঘটেছে। মানুষের সংগ্রামের ইতিবৃত্ত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন; তাঁর কবিতায় সে অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট ছাপ অভিব্যক্ত। তাঁর কাব্যপ্রতিভা নিসিম এজিকিয়েলকে এতটা মুগ্ধ করেছিল যে তিনি দারুওয়ালাকে অজ্ঞাত দেবীর মস্তিষ্ক থেকে আবির্ভূত কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

দারুওয়ালার প্রথম কাব্যগ্রন্থ Under Orion (1970) থেকে শুরু করে Collected Poems 1970–2005 (2006) এর কবিতায় সজীব চিত্রকল্প, দীপ্র কথাবস্তু, সাঙ্গীতিক সৌন্দর্য ও অনমনীয় সত্যের সমন্বয় ঘটেছে।১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে পদ্মশ্রী-ভূষিত এই কবি ইতিহাস ও মানবহৃদয়ের টানাপোড়েনকে সাহিত্যকর্মে সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন।

অবিভক্ত ভারতের লাহোরে জন্ম নেওয়া দারুওয়ালা দেশভাগের আলোড়নের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। পরে তিনি ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন এবং জীবনের বহু দশক নিসর্গের বৈচিত্র্যে যেমন প্রাণিত হয়েছেন তেমনি মানুষের সামাজিক সংকটের প্রকৃতি অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছেন। জীবনের এ অভিজ্ঞতা তাঁর কল্পনাশক্তিকে গভীরভাবে আলোড়িত করেফলে তাঁর কবিতায় সহিংসতার বহ্নিজ্বালার পাশে মানবিকতার স্নিগ্ধতা অবলীলায় উন্মোচিত হয়। তাঁর কবিতার ক্যানভাস সুবিস্তৃত। কমলা দাসের কবিতা যেখানে স্বীকারোক্তিমূলক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতায় নিরুদ্ধ, দারুওয়ালার কবিতা সেখানে নাটকীয়, বহির্মুখী ও পরিব্যাপ্তইতিহাস, নিসর্গ ও মানবসংঘর্ষের বিচিত্র বর্ণে বিভাসিত।

দারুওয়ালা গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে কবি হিসেবেই তাঁর কণ্ঠস্বর সবচেয়ে সমাদৃত। তিনি নীরবতার ভেতর থেকে অমূল্য মুহূর্ত উদ্ধারে প্রমগ্ন ছিলেন। পাঁচ দশক ধরে তাঁর কবিতা ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েছেএকজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক, মানবসত্তার স্বরূপ উন্মোচক এবং সর্বোপরি ভাষার নিপুণ রূপকার হিসেবে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।

দেশত্যাগ (Migrations), আকাশ, নদী ( Sky, River) The Map-Maker (2002) থেকে,  বৈপরীত্যের মৃত্যু (The Death of Distinctions), মাছ (Fish) New Poems (2000–2005) থেকে, আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা (The Unrest of Desire) The Keeper of the Dead (1982) থেকে ও কবিতা (The Poem) Night River (2000) কাব্য থেকে গৃহীত হয়েছে।

 

দেশত্যাগ

 

দেশত্যাগ

সবসময় কঠিন:

খরাকে জিজ্ঞেস করো,

প্লেগকে জিজ্ঞেস করো;

জিজ্ঞেস করো ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দকে।

ঘটনাপঞ্জিকে জিজ্ঞেস করে দেখো

দেশত্যাগ না থাকলে

কচমচ করে চিবানোর

এতটা ইতিহাস কি থাকতো?

 

সময়ের দিকে ফিরে যাওয়াও দুঃসাধ্য।

যে-ই ফিরেছে সারগোধা,

অথবা ঝিলাম কিংবা মিয়ানওয়ালিতে,

সে-ই বলবে তোমাকে।

পুরোনো ইটের মাঝে নতুন মুখ;

আগন্তুকের ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ে

ভদ্রতা, ভাবালুতা

এ-ঘর এখনও আপনারই, স্যার।

 

আর যদি চিন্তা করো সেই সময়কে নিয়ে

যা আর সময় নয়,

(অতীত হিমশীতল, তা পাথর—

যা নড়ে না, স্পন্দিত হয় না,

তা সময় নয়)

যদি চিন্তা করো সময়ের ওই খণ্ডিত টুকরো নিয়ে

তাহলে মন হয়ে ওঠে বিষাদগ্রস্ত,

যেন বর্ষার মেঘ

জমে আছে আকাশে

কিন্তু ঝরছে না।

 

মা বলতেন, আমার মা-কে তোমার মনে নেই?

তুমি সারাক্ষণ রান্নাঘরে থাকতে,

আর তার দেওয়া আলুভাজা নিয়ে দৌড় দিতে,

যা থালার ওপর তখনো ছ্যাঁকছ্যাঁক  শব্দ করতো।

তাকে তোমার আদৌ মনে পড়ে না?

মার ঝুলে পড়া মুখ

আরও ঝুলে পড়তো

আমার ভাবলেশহীনতায়।

এখন আমার স্বপ্নরা জিজ্ঞেস করে

আমি কি আমার মাকে মনে রেখেছি

এবং আমি নিশ্চিত নই

কীভাবে তা মোকাবেলা করবো।

বছর থেকে বছরে পরিভ্রমণ করাও কঠিন।

 

বৈপরীত্যের মৃত্যু

 

ক্ষুধা ক্ষিপ্ত হলে

কলোসিয়ামের ভেতরে আর কোনো সিংহ থাকে না।

 

ক্ষুধাই সবকিছু

জঙ্গল সে এবং জঙ্গলের বন্য শূকরও।

 

ক্ষুধা ক্ষিপ্ত হলে

যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন অর্থহীন হয়ে ওঠে।

 

অমার্জিত ও মার্জিতের সঙ্গে ক্ষুধাকে পরিচিত করাও

প্রত্যক্ষ করবে বৈপরীত্যের মৃত্যু।

 

আমরা ক্ষুধার কথা বললে ভুলে যাও সবকিছু:

সম্মান, পদানুক্রম—তারা সীমা অতিক্রম করে।

 

ক্ষুধার্তকে বেষ্টন করে যে সুস্থিরতার চক্রবেড়

কখন তা খুলে যায় ভাঙা অক্ষদণ্ড থেকে ছিটকে পড়া চাকার মতো?

 

পরিহাসের বিষয়, ক্ষুধার প্রসঙ্গ এলে

ভাষা হয়ে ওঠে জোরালো।

 

আর ধনীরা হয়ে ওঠে ম্যালথাসীয়:

“ওরা এত সন্তান

জন্মায় কেন? কীভাবে খাওয়াবে অন্তহীন ছানাপোনাদের?”

 

অপদার্থ রাজার সংজ্ঞা দাও: যখন ক্ষুধা পৌঁছে যায় পরিখায়

তখন টানাসেতুটি তুলে নেয়া হয়।

 

মরুভূমিতে বৃক্ষের সংকট; বৃক্ষে পত্রের সংকট;

আর সর্বদা কন্দ-মূলের সংকট।

 

ক্ষুধা মাধ্যাকর্ষণের সমান ভারী

সে তোমাকে টেনে নামায়।

 

ক্ষুধাকে মোকাবেলার জন্য অন্ন-দেবতাদের নেমে আসা প্রয়োজন,

আর অন্ন-দেবতাদের অস্তিত্ব না থাকেলে তাদের সৃষ্টি করতে হবে।

 

মাছ

 

সমুদ্র এলো তার সাথে আর তার বাঁকানো নাক-মুখ,

টিন-রঙা গুগলি-শামুক

ও নকশা-করা লম্বা সুতোয় জড়ানো গোলাপি তিল ছড়িয়ে আছে তার শরীরে।

 

সমুদ্র তাকে নিয়ে এলো এবং তার বাঁকানো নাক-মুখ

ও তার গোলাপি তিল ও স্বচ্ছ চোখ

যেন তার শরীরের অবস্থা সম্পর্কে

অর্ধেক জাগ্রত, অর্ধেক বিস্মৃত।

 

সমুদ্র এলো তার সাথে এবং তার খঞ্জরাকৃতি নাক-মুখ নিয়ে,

আর তার স্বচ্ছ চোখ

ধূসর হয়ে পাথরে পরিণত হল।

 

শৈবালের আস্তরণে মুড়িয়ে

সমুদ্র তাকে নিয়ে এলো,

তারপর ছুড়ে দিল বালির ওপর,

তার আঁশের বর্ম

আর গোলাপি তিলের আলঙ্কারিক কারুকার্যসহ

তার পুরো পাঁচ ফুট দেহ।

 

জোয়ার আসতেই থাকল,

কিন্তু তাকে বা তার

বিশ্রামের জায়গাকে বিশৃঙ্খল করতে পারল না—

সে খুব ভারী ছিল।

 

সমুদ্র সরে গেল, তবু যখন

সরু প্রান্তময় ফেনার রেখা পিছিয়ে গেল ,

সে আরেকবার তার কাছে গেল

সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায়,

তার গুগলি-শামুকের ভেতর তল্লাশি চালিয়ে

ফিরে গেল।

 

আকাশ, নদী

 

একটি স্বপ্ন-ধ্যান

না স্বপ্ন, না ধ্যান।

স্থির নদীর দিকে তাকিয়ে, যা স্থির  নয়,

আমি সেখানে আকাশকে অনুবাদিত দেখি।

স্থির নদীর পাশাপাশি, যা স্থির নয়,

আকাশ চলাচল করে এবং করে না,

কারণ এটি নদীর তলদেশে

জলভর্তি একটি নীল পাত্রে অবস্থিত ছিল।

 

জলে ঝরে পড়লে রঙ বদলে যায়।

আয়নার চোখে, জলের চোখে,

তুমি কোনোভাবে অন্য এক

আকাশের সাথে সম্পর্ক রাখো।

 

কী এখানে আকাশকে স্পন্দিত করে?

নদীর স্থিরতার নিচ দিয়ে ধাবমান স্রোত কি?

 

স্বপ্ন তোমাকে উত্তর জানায়;

ধ্যান তোমাকে উত্তর জানায়।

স্বপ্ন-ধ্যান নদীর স্নায়ুবিক স্থিরতার

ভেতর তোমাকে কেবল

কম্পমান একটি আকাশ দেয়।

 

আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা

 

চোখেই উদ্ভাসিত হয় আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা।

মুখে যতই মুখোশ পরো না কেন,

জীবনের কোমল কণ্ঠ ছিঁড়ে ফেলো,

এবং লোনা রক্তে রোখালো জিহ্বা ডুবিয়ে খোঁজো

চোখই প্রকাশ করবে আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা।

 

যতই হৃদয়ে ছায়া চাপিয়ে রাখো

কংক্রিটের ফলক ও অস্থিকুণ্ডলীর নিচে

অথবা তাড়নার গুহামুখ যতই বন্ধ করো

তা আঘাত করে প্রাচীর ভেঙে মুক্ত হবে,

যতই হৃদয়ে ছায়া চাপিয়ে রাখো।

 

তুমি গুহা-প্রাচীরে আঁকতে পারো সে ছায়া,

এবং আদিম শিল্পে রূপায়িত করতে পারো তোমার তাড়নাকে:

চারকোল রেখায় ছুটে চলা বাইসন ও হরিণ।

দগ্ধক্ষত মুছে ফেলতে পারবে না, তা তোমার স্বপ্নকে ঝলসিয়ে দেবে—

যতই হৃদয়ে ছায়া চাপিয়ে রাখো।

 

কবিতা

 

কোথাও, রাত্রির অন্তর্গত ছায়ার মতো

মৃত্তিকার মধ্যস্থিত কালো খনিজের মতো

কোথাও আয়নায় তোমার স্বপ্ন দেখতে পাও

একটি কবিতা নিপুণভাবে বক্রায়িত

 

আলোর অপেক্ষায় রয়েছে।

 

খড়খড়ি-পাতের ভেতর দিয়ে আসা সে আলোর রেখা

সময়ের শীতল বিস্মৃতি থেকে কবিতাকে পুনরুজ্জীবিত করবে

আর তার অঙ্গারগুলোকে উষ্ণতায় ঠেলে দেবে।

 

এ কবিতাটি উন্মেষণের জন্য নিজের মিষ্টি সময় নিয়েছে;

শব্দের অপেক্ষায় ছিল যা

প্রতিধ্বনিতে আচ্ছাদিত হয়ে পবিত্র গুহা থেকে বেরিয়েছিল;

 

যখন উপভাষা কোনো মৌখিক রসায়নের মাধ্যমে

ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছিল;

যখন স্বৈরাচারের প্রথম ঝাঁকুনি

কর্তৃপক্ষের মুখে ক্ষতচিহ্ন রেখে গিয়েছিল।

 

এত দীর্ঘ সময় এ ভ্রূণ নিদ্রায় ছিল,

অর্ধেক অনন্তকাল ধরে,

এবং হঠাৎ আর অপেক্ষা করতে পারল না।

এখন এটি বহির্মুখী,

দুরারোহ আকাঙ্ক্ষায়,

একটি আত্মা, একটি দেহ খুঁজছে

যার ভেতর দিয়ে উচ্চারণ সম্ভব।

 

রক্তের কবিতা রয়েছে, যা তোমাকে নিয়ে যায় ছুরির কাছে,

মৃত্যুর কবিতা রয়েছে যা তোমাকে দেয়

শকুনের চোখে দেখা দৃশ্য;

এবং রয়েছে বিশেষ ঘটনাস্থলের জন্য

চিহ্নিত কবিতা: তোমার পেছনে

ধূসর প্রাচীর ও সামনে বন্দুক।

 

এমন কবিতা বিপন্নদের ওপর

বিপজ্জনকভাবে নেমে আসে।

স্তালিনকে নিয়ে রচিত কবিতাটি ছিল

এমনই এক কবিতা।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন