কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৯ |
চক্র
দীপা পখন স্টেশনে নামল তখন আকাশ একেবারে সেজে আছে। যেন অকাল রাত্রি এলো। পাতাগুলো স্থির কালচে আরো। বিরহিণীর চোখের কোলে জল এক ন্যানোসেকেণ্ডে গড়িয়ে পড়বে বড় ফোঁটা এমন হয়ে আছে আকাশ। দীপা স্টেশনের বাইরে এসে ঝপ করে গাড়িতে উঠে পড়ল। ভাড়াগাড়ি। মাসকাবারি ব্যবস্থা। যে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সেই স্কুল স্টেশন থেকে অনেকটা দূরে। প্রথম ট্রান্সফার হওয়ার পর তো মাথায় হাত। বর বলেছিল, ছেড়ে কলকাতার প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জয়েন করে নাও কোচিং সেন্টার খোলো। অবশ্য বলাটাই স্বাভাবিক। ট্রেনে দু ঘন্টা তারপর বাস তারপর রিকশ বা ভ্যান। ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরা। দীপা সেই সময় বলেছিল, এভাবেই তার মতো আরও অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা যাতায়াত করে দীর্ঘ পথ, না হলে গ্রাম গঞ্জের গরিব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে কী করে! তার এই ভাবনাকে কেবল তার মা ছাড়া কেউ স্বীকৃতি দেয়নি সেদিন।
ঝড় উঠেছে। গাড়ির সামনে শুকনো
পাতা উড়ছে। একবার মোবাইলটা চেক করে নিল দীপা। প্রমথেশ আই সি ইউ তে গত দশদিন। অঝোর
বৃষ্টি পড়ছে। এডমিনিস্ট্রেটিভ কাজের বহু ঝামেলা, কাজের চাপ, দশদিন ছুটি নেওয়া অসম্ভব। প্রথম দিনটা ছুটি নিয়ে
সে সারাদিন হাতে হাত রেখে চুপচাপ বসেই ছিল। কারোরই কিছু করার নেই। কাঁচের ঘরে নানা
তারে জর্জরিত হয়ে নিথর প্রমথেশ। বেঁচে আছে কিনা সহসা বোঝা যায় না। সামনেটা ঝাপসা। অমিত চোয়াল শক্ত করে স্টিয়ারিং
ধরে আছে। অমিত আজ দশবছর তার সারথি। মেয়েটা ইস্কুলে ক্লাস ফোর তখন মা মরে গেলো। অমৃতাকে
প্রায় বুকে জড়িয়ে সেই থেকে মানুষ করেছে দীপা। এখন সে পুনেতে পড়ে। অন্যমনস্ক হলে
দীপার ঠোঁট কামড়ানো স্বভাব। প্রমথেশ তখনও জনপ্রিয় কবি নয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের
চৌকাঠ। তখনও তো বৈশাখী সেন আসেনি দুজনের মাঝে। ভেন্টিলেশনে চলে গেছে কবেই সম্পর্ক,
শুধু সফল দাম্পত্যের বিজ্ঞাপন করতে পত্নীনিষ্ঠ দৃষ্টান্তমূলক চরিত্রবানের ছবি তুলতে
মাঝে মাঝে পাশে দাঁড়ানো। ফেসবুকে দিতে বউয়ের
জন্মদিনে বিবাহবার্ষিকির ছবিতে রয়ে গেছে বিবাহিত জীবন। অমিত প্রমথেশ এবং দীপা যেন
একটা সমবাহু ত্রিভুজ। নাকি সমবাহুও নয়। একটা বাজ পড়ল জোরে। আমেরিকা থেকে এসেছে ছেলে
সুমিতেশ। অমিত বলেছিল স্বভাবসিদ্ধ মৃদুস্বরে, একবার এইসময় ক’টা দিন নাহয় না এলে!
এত বছর পরেও তার ব্যক্তিত্বের কাছে একটু কুন্ঠিত হয়ে থাকে অমিত। আচমকাই ফোনটা বাজছে। অমিত চমকে পেছন ফিরল। দীপা স্থির তাকিয়ৈ
আছে ফোনের দিকে। যেন বোম। স্পর্শ করলেই...।
কথা থাকে না তবু ঘটে। এই পথে লরি
থাকে না। হঠাৎ একটা লরি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এলো যেন আকাশ থেকে হঠাৎ। গাড়িটা একপাশে
পড়ে আছে থেঁতলে। বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। মোবাইটা বেজে যাচ্ছে তীব্র স্বরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন