কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৯ |
দাগ
ক্ষমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অন্ধকারের শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কোন আধ্যাত্মিক শয়তানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, সেটাই জীবন। তখন ভেবেছিল এতসব! সেই সকালের দিনগুলোয়!
দরজাটা
ক্রমে
বন্ধ হয়ে গেল। তাই হয়। আলো, যেটুকু ছিল, নিভলো। সেটাই স্বাভাবিক।
অশেষ, পাঁচ দশ,
দাড়ি, চুল, চওড়া চোয়াল নিয়ে জীর্ণ ইজিচেয়ারটা ছেড়ে এখন উঠবে
কিনা ভাবছিলো। হাতের দশটা আঙুল টিপলো খানিকক্ষণ। শীত চলে যাচ্ছে। লেপটা কি ঘুমিয়ে!
কতো
ঘুমোয়! স্বপ্ন দ্যাখে? সেই
স্বপ্নটা? দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে।
উষ্ণতার জন্য আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে। নরম পায়ের গোছা, হালকা রোমশ
স্পর্শ চাইছে আঙুল। ভিজে উঠছে কোথাও। হালকা বৃষ্টির মতো। খুব ইচ্ছে করছে একটু
অন্ধকারের উষ্ণতা।
কারখানার
ম্যানেজার, ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, শ্লা সব এক। এই ঘরেই মদের টেবিলে টপকে দিয়েছিল দুটোকে। উপায়
ছিল না। দুটোতে
মিলে সব ছারখার করে দিচ্ছিলো। মালিক কিছুই খবর রাখতো না। মাসে
মাসে মুনাফাতেই সুখ। সে রাতটা খুব অন্ধকার ছিল। বৃষ্টি। ছুরিটা কলাবাগানে আর ও নাইট শিফটে। নিয়ম মেনেই। দরজাটা
আবার যেন খুলছে! বাতাস? আসছে
কিছু। আর কিছু? সাদাকে
কালো, কালোকে নীল করছে বাতাস। খেলা
করছে বাতাস। কালকেও এমন ছিল না। উঠবে কিনা,
অশেষ ভাবছে। স্থবিরতা থেকে। অন্ধকার থেকে। অসহ্য ঘন্টাধ্বনি আর প্রার্থনার আড়ালে
তাবৎ কুৎসিত জিজীবিষা থেকে। ও এখন শাসিত হতে চায়। শঙ্খমাছের লেজের চাবুক চায়। ঘোড়ার
মতো। পিঠে নেবে। সেই নারীকে। যে
মৃত্যুকে চেনেনি। যে সমাপ্তি জানে না। পতন বোঝেনি। চলবে দুলকি
চালে। যাতে মাংসের সবটুকু স্বাদ পাওয়া যায়। অশেষ এখন চলন চায়। ফোঁটা ফোঁটা।
লাভালাভ-ই কেবল ভেবেছে অশেষ! না হলে মসৃণ একটা জীবন ছেড়ে ও আজ এখানে থাকে! এই একা
একটা ঘরে! একদিন সবকিছু ছিল। তারপর কারখানা ছেড়ে ঐ পথ। স্রেফ পয়সার জন্য। নেওয়া আর
দেওয়া। ঝকঝকে ছোটবড়ো অস্ত্র। টাকা তখন উড়তো। অফুরন্ত মদ, হরেক মেয়েছেলে, নিত্যনতুন
ফুর্তি। কেউ
ধরার নেই।
কিন্তু অশেষ আজ ক্লান্ত। বড়ো একঘেয়ে, বড়ো নিচুপনা। বড়ো ভয়!
কখনও বা বাঘ, কখনও ক্ষমতার পায়ের কাছে বসে মিউমিউ। আর পারছিল না। নতুবা এখন বিড়াল কোলে বন্ধ ঘড়ির
দিকে কেবল থাকিয়ে
থাকে! বিড়ালের গলায় আদুরে শব্দ। ওর এখন দ্যাখে, এক চলে যাওয়া।
একমাত্রিক। একটা ছুরির ঝলসে ওঠা। দরজার ওপাশে। ও দ্যাখে। অহরহ। আশ্চর্য! এখনো ছুরি কেন! সে গল্প তো কবেই
শেষ হয়ে গেছে! কার্পেট পর্যন্ত পালটে ফেলেছিল। একটা দেয়াল-ও তুলেছিল। তাহলে এখন কেন আবার! এতদিন পরে! শীত
করছে। হালকা
অন্ধকারে হাতের তালুর দিকে তাকালো। আঙুলগুলো দেখলো। দাগ? সেদিনই কেটেছিলো ভাঙা গ্লাসে। নাঃ এখন আর নেই।
বিড়ালটা লাফ দিয়ে কোল থেকে নামলো।
ওর
এই মুহূর্তে সঙ্ঘমিত্রাকে দরকার। এক্ষুনি। ওর
সবটুকু। ঐ পেলব আশ্রয়টুকু। সেই অতিপরিচিত পারফিউম। ও একটা হাত বাড়িয়ে দিলো।
অন্ধকার আর আলো যেখানে মিশে যাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন