শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


পুনশ্চ

হরিবাবু কা আসলি সোনাচাঁন্দি কা দুকান-এর সামনের ফুটপাতে পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটিটার সামনে টাঙানো ট্রাপিজিয়াম আকৃতির প্লাস্টিকের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেটটা ধরিয়েছিল তমাল। সারা দুপুর খেটে এ মুহূর্তে বেশ ঢিলে হয়ে আছে। পরের ভিজিট পাঁচটায়। এখন সবেমাত্র চারটে পনেরো। কোথাও বসে শুধু মোবাইল ঘেঁটেই যদিও কাটিয়ে দেওয়া যায় এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট! কিন্তু সময়টাকে কোনভাবে কাজে  লাগাতে পারলে বেশ হত, ভাবতে ভাবতে তমাল উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে আর সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছিল আয়েশে। ট্রামলাইনের ওপর দিয়ে টানা রিক্সা যাচ্ছে, বাসও যাচ্ছে, লোকজন হেঁটে যাচ্ছে – ব্যস্ত শহরজীবন পার হয়ে যাচ্ছে শেষ বিকেলের তন্বী শরীর। সিগারেটের আয়ু ফুরিয়ে এল। শেষ অংশটা ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছে, হঠাৎ নজর পড়ে গেল মেয়েটার ওপর।

“আরে! সেই মেয়েটা না!”

ও হনহনিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এপাশে চলে এল। সোজা ফুটপাত ধরে ধাক্কা খেতে খেতে, ধাক্কা দিতে দিতে হাঁটতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্যও মেয়েটার দিক থেকে নজর সরালো না। মেয়েটা সম্ভবত বুঝতে পেরেছে। এমন চকিত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল যে একেকসময় তমালের মনে হচ্ছিল, আর বুঝি ওর আওতায় থাকা গেল না। এভাবে কখন যে পাঁচটা বেজে গেছে, খেয়ালই রইল না। মেয়েটার পায়ে কি চাকা লাগানো আছে! তমাল মাঝেমাঝেই পেরে উঠছে না। তখনই ওর ভেতর থেকে একটা তীব্র রোখ বেরিয়ে আসছে। আরও দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে ফেলার জন্য যেন এক অলৌকিক শক্তি ভর করেছে তমালের ওপর। মেয়েটা আবার চলে আসছে নজরে। অনুসরণের আঠায় বিদ্যুৎ গতিতে ধেয়ে যাচ্ছে তমাল। আশেপাশের দোকানপাট, বাড়ি, ক্ষয়াটে গাছ, লাইটপোস্ট, লোকজন, সাইকেল রিক্সা, রাস্তার কুকুর, পাগল, ফেরিওয়ালাদের পার হতে হতে নাগরিক ছাপ যে কখন মুছে এসেছে, সন্ধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে চরাচরে, তমাল খেয়ালই করেনি। মাঝেমাঝে এভাবে গোত্তা খেয়ে ছুটে চলাই নিয়তি হয়ে ওঠে, কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কারণও কি থাকে?

তমাল এখন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে জায়গাটা সুনসান। অন্ধকারের ভাগই বেশী। অদূরে একটা মাংসের দোকান। সেখানকার বাল্বটার হলুদ আভায় মনে হচ্ছে একটা আলোর চৌখোপ থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আলোর সূঁচোলো শলাকারা। বিঁধে যাচ্ছে অন্ধকারের শরীরে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অন্ধকার। ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে।

এই অদ্ভুত জায়গাটা তমাল চিনতে পারল না। ওর মনে হচ্ছিল – “কোথায় এলাম?” তখনই ওর মনে পড়ে গেল পাঁচটার সময় ডঃ শর্মার চেম্বারে ভিজিট করার কথা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকিয়ে ও অবাক হয়ে গেল। সাড়ে সাতটা! মানে সেই চারটে পনেরো থেকে ও তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট এগিয়ে চলে এসেছে! কিন্তু কেন! কীভাবে চলে এল এতটা পথ! তমালের মনে পড়ল না। জামাটা ভিজে গেছে দেখে বুঝতে পারল, ও দৌঁড়নোর মত হেঁটেছে।

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে গিয়ে দেখল ম্যাচবক্সে একটাই কাঠি। তমালের মনে হল কাঠিটা মিস করে ফেলবে। তবুও চেষ্টা করল এবং সত্যিসত্যি কাঠিটা জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সিগারেটটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেল সেই মেয়েটা একেবারে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে, মুখে রহস্যময় হাসি। তমাল ভীষণ অবাক হয়ে গেল।

“আমাকে ফলো করছেন কেন?” মেয়েটার সরাসরি জিজ্ঞাসায় তমাল চট করে কিছু বলে উঠতে পারল না। দেখতে পেল মাংসের দোকানের লোকটা চপারটা ধার দিচ্ছে। আরেকটা লোহার পাতের ওপর একবার ঘষে তুলে নিচ্ছে, আবার ঘষতে শুরু করছে। এভাবে বারবার করেই চলেছে। ঝুলন্ত মুন্ডহীন পশুদেহে এসে বসছে মাছিরা। লোকটার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই ধার দেওয়ার আওয়াজে অনেকটা ভেতর পর্যন্ত শিনশিন করে ওঠে। তমালের কেন যেন মনে হল, এখানে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। ও বলল, “সেদিন আপনাকে দেখেছিলাম…”

“কোন দিন? কোথায়? কী দেখেছিলেন?”

এভাবে মুহুর্মুহু প্রশ্নের চোটে তমালের সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল মাথার ভেতর। ও জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই জায়গাটা কোথায়?”

“যা জিজ্ঞেস করলাম, তার উত্তর দিন।” জিজ্ঞাসায় কমনীয়তা নেই। থাকলে কী হত তমালের জানা নেই, কিন্তু এই ঝাঁঝালো প্রশ্নে ও সম্বিত ফিরে পেল। বিড়বিড় করে বলল, “সিগারেটটা ধরাতে পারলে ভালো হত।” মেয়েটা জিনসের পকেট থেকে লাইটারটা বের করে দিল। তমাল সিগারেটটা ধরানোর আগে সৌজন্য করে বলল, “আপনি কি নেবেন একটা?”

“দিন।”

দুজনের সিগারেটের ধোঁয়ায় জায়গাটা ভরে উঠল। মেয়েটা বলল, “আপনি কোথায় থাকেন?”

“কেন বলুন তো?” তমাল পাল্টা জিজ্ঞেস করল।

“আপনি এখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন তপসিয়ার নয়া বস্তি এলাকার বিলু খানসামা লেন-এ।”

“ও। চলে যেতে পারব।” তমাল নির্ভাবনায় বলল।

“সে তো পরের কথা। আপনি আমাকে ধাওয়া করে এখানে চলে এলেন কেন? পুলিশের খোচর নাকি? সত্যি কথা বলুন।”

“সেদিন কারমাইকেল মেসের সামনে দুপুরবেলায় ওই ভদ্রলোকের পকেট মেরে যে টাকাটা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে আপনার কতটা উপকার হয়েছিল, জানি না। কিন্তু ভদ্রলোকের যে কত বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল, তা  বোধহয় আপনার জানা নেই! থাকার কথাও না।”

মেয়েটার ঠোঁটে সিগারেটটা জ্বলে উঠেই স্তিমিত হয়ে এল। নাক দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী বের করতে করতে ও বলল, “এই কথাটা বলতে এতদূর চলে এসেছেন?”

“না। এসব কিছুই বলতে আসিনি। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তাই… আসলে আপনাকে দেখে মোটেই পকেটমার মনে হয় না, অথচ এ কাজটা কেন যে করে চলেছেন…”

“আপনার ওপর এখন কতজন লোক নজর রাখছে, আইডিয়া আছে?”

“আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি! শুধু বুঝতে চেয়েছি আপনি এত সন্তর্পণে কাজটা করছেন কীভাবে? আর কেনই বা করছেন?”

“এজন্যই তো আমার আজ বিকেলের ধান্ধা চৌপাট হয়ে গেল। এসব জেনে আপনার কী লাভ?”

“ভয় পেয়ে গেছিলেন না?”

“সালাম ওয়ালেকুম, আপা।” একজন বিশ্ব চোয়াড়েমার্কা লোক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে হেসে চলে গেল।

মেয়েটাও আলগা হাসল, কিছু বলল না।

“এরকম ভুল আর করবেন না কিন্তু! এরপর আমি আর আপনার দায়িত্ত্ব নিতে পারব না।” এই কথা শুনে  তমালের জানতে ইচ্ছে করছিল, ও ঠিক কী ধরনের দায়িত্ত্ব নিয়েছে!

“এখন চলে যান। সোজা গিয়ে বাঁদিকে যাবেন। কিছুদূর গেলে পার্ক স্ট্রীট। ওখান থেকে কিছু একটা পেয়ে যাবেন।”

“বলছিলাম…” তমাল কথাটা শেষ করতে পারল না।

মেয়েটা সোজা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কিন্তু জিজ্ঞেস করল না, “কি বলতে চাইছেন?”

মেয়েটাকে তমালের যা বলতে ইচ্ছে করেছিল, তা আসলে বলা হয়ে ওঠে না। বলতে পারলে অনেককিছুই অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। খবরের কাগজগুলোর উস্কানি আলুনি হয়ে পড়ে। সমাজের তৈরী করে রাখা বেড়াগুলোর অস্তিত্ব থাকে না। রাজনীতির খোরাকও গায়েব হয়ে যায়। বলতে পারলে অনেক সহজ হয়ে যায় পেরোনোর সাঁকোগুলো। নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া রোগা নদী ভরে আসে কুলকুল স্রোতে। এই না-বলায় নেমে আসে হিমযুগ। স্তুপাকৃত বরফের গুঁড়োয় আলো হারিয়ে যায়। শীত করতে থাকে। কেঁপে ওঠে ভেতরদালান।

সোজা গিয়ে বাঁদিকে ঘোরার আগে তমাল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওকে তাকাতেই হল। দেখতে পেল ওরা এতক্ষণ একটা লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়েছিল, যে আলোটা এখন জ্বলে উঠেছে। আর তার ঠিক নীচে এদিকে তাকিয়েই তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা। যেন ও নিশ্চিত জানত, তমাল ঘুরে তাকাবেই। দূরে চলে এসে তমালের মনে হল, “ওকে বেশ দেখতে তো!” এভাবে দুজনেই কিছুক্ষণ স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটা সোজা দৃষ্টিরেখা বরাবর। তারপর মেয়েটা হঠাতই পেছন ফিরে চলে যেতে শুরু করল। তমাল তখনো দাঁড়িয়েই রইল। উল্টোদিকের গলিটার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে মেয়েটা আরেকবার পেছনে তাকালো। তমালকে দেখতে পেয়েই দ্রুত হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘিঞ্জি ভেতরদিকটায়। তমাল বুঝতে পারল না, ওর মুখে এক চিলতে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠেই মিলিয়ে গেল কিনা!

এই একটুকরো অব্যক্তের কাছে বাধিত হয়ে রইল এ মুহূর্তটুকু, যার কোন উদ্দেশ্য নেই, বিধেয়ও নেই। যার গহীন আবর্তে সময়ের বৈষয়িক মাপে ভুল হয়ে যায়, বিরক্তি গলে জল হয়ে যায়, ঘনিয়ে উঠতে চেয়েও আদপে ঘনিয়ে উঠল না যে নিবিড় মৌতাত, তার রেণুগুলো একত্রিত করতে পারলে কি তৈরী হতে পারত নয়নাভিরাম এক প্রতিমার মুখ? কোন অর্থ ছাড়াই অনর্থের ব্যঞ্জনা যে কী ভীষণ তুলকালামের ইঙ্গিত রেখে গেল! অথচ শেষপর্যন্ত অতিক্রম করতে পারা গেল না এক অনতিক্রম্যকে।

তমালের মনে হল ওর নামটা জানা হল না তো! ফোন নম্বরও নেওয়া হল না। আবার কোন একদিন কি এভাবেই আচমকা দেখা হয়ে যেতে পারে? আবার যদি দেখা হয়ে যায়…

মোবাইলটা বেজে উঠল। একঝটকায় তমাল ফিরে এল আবার আগের মাত্রায়। “আজ এলে না তো?” ডঃ শর্মার জিজ্ঞাসার উত্তরে তমাল বলে দিল, “স্যরি, স্যার। আজ একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আগামীকাল আসি?”

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন