![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
সোনালি গন্ডারের পীতাম্বরী
গল্প
আমাদের বিড়ি সহ এগিয়ে দেওয়া হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পীতাম্বর দা বললেন-
- নো বিড়ি। আমি ঠিক করেছি ধুমপান
বিরোধী পখবাড়া পালন করবো।
- পখবাড়া? সেটা আবার কী?
- পাতি বাংলা ছাড়া তো আর কিছু
শিখলি না! পখবাড়া মানে পক্ষকাল মানে পনেরো দিন।
- বলো কী? পনেরো দিন বিড়ি খাবে
না। তাহলে খাবে কী?
- কেন খৈনি। খৈনির নেশাতে ধূমপান
নেই।
- সে তো নস্যিতেও নেই।
- কিন্তু নস্যি বড়ো তাচ্ছিল্যের
নেশা। কথায় বলে না, এতো আমার কাছে নস্যি! শুনিসনি?
মাথা নেড়ে জানাতেই হলো শুনেছি।
তারপর আমাদের মুখের অবস্থা জরিপ করে পীতাম্বরদা বললেন-
- ওকি! তোরা কেন মুখ ব্যাজার করে
আছিস? আমি খাবো না। তোদের খেতে তো বারণ করছি না! এটা আমার ব্যক্তিগত ব্রত।
- কিন্তু ধোঁয়া ভেতরে না গেলে
ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হবে কী করে?
- মতলব?
বেয়াক্কেলেকে সমবেত দাবড়ানি দিয়ে
থামিয়ে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিলাম।
- আমরা সবাই যে আপনার কাছ থেকে
সত্য কাহিনী শুনতে চাই। সেটা কী করে হবে?
- হবে। হবে। ধূমপান ছাড়াই স্টোরি
হবে। তবে এড্যাল্ট স্টোরি নয়। চিলড্রেনস এডভেঞ্চার স্টোরি। কাজিরাঙ্গার গভীরে গোল্ডেন
গন্ডার। তারই স্টোরি। কাজিরাঙ্গাটা কোথায় জানিস তো?
- হ্যাঁ, আসামে।
- হ্যাঁ, আসামে। একসময় সেখানে
গিজগিজ করতো গন্ডার। এখন কমে গেছে। শিং শিকারিদের অত্যাচারে প্রায় নির্মুল হতে বসেছে।
তবে হ্যাঁ...
আমরা গভীর উৎসুকতা নিয়ে কান পেতে
রইলাম। পীতাম্বরদা নিরাশ করলেন না।
- শিং শিকারিদের ওপর বর্তমানে কঠোর
ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। জানিস তো গন্ডারের শিং অতিমূল্যবান পাচারযোগ্য বস্তু। যদিও
গন্ডারের শিং আসলে শিং নয়। একগোছা জটপাকানো চুল। তারই নাকি আছে রহস্যময় ঔষধি গুণ।
বলতে পারিস কী বিড়ম্বনা! একমুঠো চুলের জন্য বিশাল বপুর গন্ডার পরের পর শিকার হয়ে
যায়। সেই গন্ডার, যার গোটা গায়ে পুরু চামড়ার দুর্ভেদ্য বর্ম। তা ভেদ করে তার শরীরের
মধ্যে গুলি সেঁধানো চাড্ডিখানি কথা নয়। তাসত্ত্বেও প্রচুর গন্ডার শিকার হতো। এখনো
হয়। শুধু মাত্র শিংটুকু কেটে গন্ডারের ফুলবডি জঙ্গলের মধ্যে ফেলে বেআইনি শিকারিরা
পালাতো। অবশ্যই এসব করতে পারতো বনকর্মীদের সাথে মিলিভগতে।
- এই মিলি আর ভগত এরা কারা?
- আ মোলো যা! মিলি আর ভগত হবে কেন?
মিলিভগত মানে একসাথে। মানে বাংলায় যোগসাজশে।
- ওওওও!
- আমি একবার গেছিলাম কাজিরাঙ্গায়।
ঐ মিলিভগতের তদন্ত করতে।
নিজের অজান্তেই পীতাম্বরদার ডান
হাতটা আঙ্গুল ফাঁক করে এগিয়ে আসছিল। আমরা গল্পের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
- দেবো বিড়ি?
- ওহ্ নো। ইটস আ মিস্টেক। হ্যান্ড
এন্ড মাইন্ড কোঅর্ডিনেশন এখনো পুরোপুরি সিন্কোন্রাইজড হয়নি। হ্যান্ড জানে না মাইন্ড
এক সপ্তাহের জন্য ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে।
- কিন্তু, একটু আগে আপনি তো বললেন
পখবাড়া!
- চোপ্ বেয়াদব।
আমরাই পুনরায় পরিস্থিতি সামাল
দিলাম।
- পীতাম্বরদা, পোলাপানের আর ধূমপানের
বিষয় ছেড়ে আপনি গন্ডারে ফিরুন।
- হুঁ। তাই ফিরি। "মারি তো
গন্ডার লুটি তো ভান্ডার" এই প্রবাদটাও শুনেছিস নিশ্চয়। এ প্রবাদ মিথ্যে নয়।
গন্ডার মেরে সত্যি সত্যিই ভান্ডার পাওয়া যেতো।
এখনো যায়। তাই মিলিভগতের গ্যাং বিরাট। এবং তেমনি তাদের দাপট। কিন্তু সরকারের নির্দেশে
আমাকে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সারতে হবে একা একা এবং গোপনে। খবর পেলাম একটা শিং কাটা
গন্ডারের বডি পাওয়া গেছে জঙ্গলের গভীরতম অঞ্চলে। এলাকাটা প্রায় হিমালয় পর্বতের গোড়া
ঘেঁষে। গেলাম ছুটতে ছুটতে। বিশাল বডিটা পড়ে আছে। বড়ই বিভৎস ও করুণ সে দৃশ্য। হিংস্র
লোভী মানুষের শিকার হয়েছে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। সত্যিই গন্ডারের মতো আর কোনো
জন্তু নেই।
পীতাম্বরদা গন্ডারের বৈশিষ্ট মাহাত্ম্য
ভেবে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর আবার বলা শুরু করলে-
- সেখানকা ঘন জঙ্গল ভেদ করে আলো
আসে না। তাই সদা অন্ধকার এলাকা সেটা। আমার সাথে শক্তিশালী টর্চ ছিল। সেটা জ্বালিয়ে
আমি বডির কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখতে হবে শয়তানরা গন্ডারের চামড়া ফুটো করলো কীভাবে?
কোন্ বুলেট ব্যবহার করে? সেটা কি বিদেশি বুলেট? যদি সেটা প্রমাণ হয় তবে এটাও প্রমাণ হবে এটা একটা আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্র।
এছাড়া এটাও জানতে হবে ওরা শিংটাকে দেহ থেকে কেটে আলাদা করলো কীভাবে? সেটাও তো কঠিন
ব্যাপার। সে জন্যেও তো ভীষণ ধারালো ছুরি লাগবে। তাও সেটাকে হতে হবে বিশেষ ধাতুর। শক্ত
অথচ নমনীয়। আমার টর্চের আলোতে হঠাৎ দেখলাম একটা ঝোপের নিচে কিছু একটা চকচক করছে। হাত
বাড়িয়ে দেখলাম সেটা একটা ধারালো ছুরি। তাও আবার করাতের মতো খাঁজকাটা। তার মানে পাওয়া
গেল সেই আশ্চর্য ছুরি। হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম সত্যিই অসাধারণ এক অস্ত্র। আমি সেটা
নিয়ে আমার নিজের কাজে লেগে গেলাম। গন্ডারের চামড়া কাটা। চামড়া কেটে বুলেটের সন্ধান
করা। সেই কাজই করছি মন দিয়ে, হঠাৎ একটা মৃদু গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেটা আসছে
আর একটা ঝোপের ভেতর থেকে। বারবার টর্চ জ্বালালে টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে। তখন
এই গভীর অরণ্যে বিপদ আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই হাতড়ে হাতড়ে শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম।
শব্দটা বলছিল দুটো কথা। গোল্ড আর রিভার। সোনা
আর নদী। হঠাৎ সড়াৎ করে কিছু একটা আমার পাশ দিয়ে ছুটে গেল। এবার প্রাণের দায়েই টর্চ
জ্বালালাম। দেখলাম একটা হিমালয়ান তুষার চিতা। একটা লোককে কামড়ে ধরে তরতর করে পাহাড়ে
উঠে গেল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একটা থাকলে আরো কয়েকটা থাকতে পারে। গন্ডারের মোটা চামড়ায়
দাঁত বসানো তুষার চিতার কম্মো নয়। কিন্তু আমার তো আর গন্ডারের চামড়া নয়। সুতরাং
আমি তো তাদের কাছে সফ্ট টার্গেট। বলতে বলতে সাদা বিদ্যুৎ ঝলক। আমি শুধু সেই আশ্চর্য
ছূরিটা বাগিয়ে ধরলাম। অল্প একটু গাঁক আওয়াজ তুলে তুষার চিতার ধড় আর মুন্ডু অলগ অলগ
হয়ে দুপাশে ছিটকে পড়লো।
বুঝলাম অলগ অলগও হিন্দি কথা।
- তার মানে তখন তোমার সামনে পড়ে
আছে দুটো বডি। দ্বিখণ্ডিত চিতার এবং গোটা গন্ডারের।
- নট অর্ডিনারি গন্ডার। বাট গোল্ডেন
গন্ডার।
পীতাম্বরদা ভুল সংশোধন করে দিলেন-
- ততক্ষণে আমার মগজ ঝটপট বিশ্লেষণ
করে দারুন এক সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। এ গন্ডারের গায়ে ধুলো নয় সোনার গুঁড়ো মাখানো।
এলো কোত্থেকে? কাছে পিঠে কি সোনার ভান্ডার আছে? সে ভান্ডারের সোনা কোনো নদীর জলের সাথে
বয়ে চলেছে? আর সেই জলে নামার ফলে সোনা জড়িয়ে গেছে গন্ডারের শরীরে? এ তো আরো বিশাল
আবিষ্কার! আর মনে হয় ঐ চোরাচালানিদের একজন সেটা টের পেয়ে গেছিল। কিন্তু তাতে ফল হয়েছে
উল্টো। দল তাকে আহত করে ফেলে পালিয়েছে। শিংএর লোভের থেকে সোনার লোভ প্রবলতর।
- এ তো দারুন আবিষ্কার পীতাম্বরদা।
খবরে বলছে ওড়িশার কোথাও নাকি মাটির তলায় সোনার ভান্ডার পাওয়া গেছে। এ তো তার চেয়েও
বড়ো ব্যাপার। সোনার পাহাড়ের সন্ধান। দারুন দারুন। তারপর।
- তারপর ভুমিকম্প।
- এ্যাঁ?
- হ্যাঁ। হঠাৎ চরাচরের নৈঃশব্দ্যকে
তছনছ করে দিয়ে গুমগুম করে ভীষণ আওয়াজ উঠলো। কেঁপে উঠলো মাটি, গাছপালা, এবং পাহাড়টাও। ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।
ওখানে ভুমিকম্প হতেই থাকলো। এখানে কিন্তু সব চুপচাপ। পীতাম্বরদার মুখে শব্দ নেই। তাই আমাদেরই মুখ খুলতে হলো-
- তার মানে সব স্বর্ণ ভান্ডার ধামাচাপা।
- সেটা হলে তো ভালোই হতো রে। কিন্তু
ভয় হচ্ছে খুব ভয় হচ্ছে। বিষয়টা ধামাচাপা পড়েনি। এটা পড়ে দেখ।
পীতাম্বরদা একটা ভাঁজ করা খবরেরে
কাগজ এগিয়ে দিলেন। দুদিন আগের কাগজ। সাদামাটা গতানুগতিক খবর সব।
- কোনটা পড়বো?
- বিচারপতির অবজারভেশনটা।
- এই যে বলেছেন আসাম সরকার কেন
গোটা একটা জেলাই তুলে দিচ্ছে সিমেন্ট কোম্পানিকে। এটা?
- হ্যাঁ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওটা
সিমেন্ট নয়। সিমেন্ট কারখানার জন্য অতো অতো জমি লাগে না। কিন্তু সোনার খবর ধামাচাপা
দিতে লাগে। গোটা এলাকা ঘিরে ঢাকা চাপা দিতে হয়।
এবার আর বাধা এলো না। পীতাম্বরদা
হাত বাড়িয়ে বিড়ি নিলেন। আমরা সেটা ধরিয়েও দিলাম।
পরিস্থিতির পরিবর্তনে ব্যক্তিগত
ব্রতেরও পরিবর্তন ঘটে গেল। তা যা গেছে তা যাক্। কিন্তু গল্পগুলো থাক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন