![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
টুইস্ট
প্রতি আষাঢ়-শ্রাবণেই ওদের ঘরদোর ছেড়ে ভেসে যাওয়ার রোমান্স। ভাসতে ভাসতে বেশ অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ভাবলে এটাও একটা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা জীবন-যন্ত্রণার থেকে মাসদুয়েকের রিলিফ। এতবড় মুক্তির খুশিতে ওরা বোধহয় কোরাস গায়, ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে’… অকুল দরিয়ায় ভাসতে মনে মনে সবাই চায়। কেউ কেউ আবার কষ্ট চেপে বলে, সুফিগান এসব হেঁয়ালিপানা কথা কয়।
ড্যাম থেকে ছেড়ে দেওয়া জল, নদী-উপছানো জল, নাছোড় বৃষ্টির জল আর তার সাথে ড্রেনের জল মিলে মিশে আড়ে-বহরে জলের গতরখানা খাসা হয়ে উঠলেই ঢেউ তুলে তারা গ্রামের ভেতর ট্রেসপাস করে সবাইকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে ভাসিয়ে দেয় সাতঘাটের নোংরা জলে। অস্তিবাদী মানুষেরা কেউ কেউ এই সাতঘাটের জলের মধ্যে গঙ্গাজলেরও আভাস পায়। কেউ বাঁচে, কেউ মরে। যে শিশুগুলো আনন্দে বাড়ির উঠোনের বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকো ভাসাচ্ছিল, তাদের সুদ্ধু ভাসিয়ে ডুবিয়ে দিতে একটুও মায়া করে না।
কেউ কেউ আবার ভেসে যাওয়া খড়ের চালা
আঁকড়ে প্রাণপণে বাঁচতে চায়, পরের বর্ষায় ভাসতে হবে জেনেও। এমনিতে তো প্রতিদিনই ভাসছে
বাজারদরের সাথে। আষাঢ়-শ্রাবণে স্পেশ্যাল ভাসা।
তো সেদিন বৈশাখের নির্মেঘ আকাশে মহুলকে নিয়ে ভাসতে চেয়েছিল আসরাফ। মহুয়া বলেছিল আর দুদিন অপেক্ষা করো! ঘাটাল তো আষাঢ়-শ্রাবণে ভাসেই! সেই সাথেই ভেসে যাব আমরা দুজন! কেউ আমাদের সন্দেহ করতে পারবে না। কিন্তু তারপর?
-তারপর হারিয়ে যাব আমরা! লোকে ভাববে
ডুবে মরেছি! বডি কোথায় হারিয়ে গেছে, কার বয়ে গেছে ফালতু খোঁজ করতে!
-কিন্তু যাবো কোথায় আমরা! কোন দেশে!
-সে এক অচিনপূরে! ঘর বাঁধবো আমরা
দুজন!
-কোন অচিনপূর? সেটা কোথায়?
-আরে ধ্যাত্! অচিনপুর কি জানা
থাকে মানুষের? অচেনা কোনও শহরে! শহর শুনে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে মহুয়া। বলে সেখানে প্যাচপ্যাচে
বিষ্টি নেই তো আসরাফ? জন্মে ইস্তক তো ভেসেই আছি। হয় জলে নয় পচা পাঁকে, তাই বলছি!
মুখ মুচকে হেঁসে আসরাফ বলে, কাদা
আর পাঁক কোথায় নেই বলো!
সেই বৈশাখ থেকেই ওরা ভেসে-যাওয়ার
মাসের জন্য বসেছিল!
সেবার আষাঢ়ে তেমন বৃষ্টিই নেই।
মহুয়া বলে, শ্রাবণ আসুক! আমাদের গ্রাম না ভেসে যাবে কোথায়! তখন আমরাও…
সেবার ভাসানেবালা বর্ষা এলো না, তার আগেই এলো নতুন নতুন অনেক যন্ত্রপাতি যা ওরা জন্মেও কোনদিও দেখেনি। সাক্সান পাম্প দিয়ে জল টেনে নিচ্ছে কেউ। বোলডার আসছে, গিট্টি আসছে। পঞ্চায়েতের কাজ চলছে পুরোদমে, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে স্টাইলে। সামনেই ভোট।
বিরক্ত হয়ে উঠে আশরাফ ফোনে মহুলকে
ডেকে পাঠায় আমবাগানের সেই জোড়া আমগাছ তলায়। বিষাদমাখা মুখে বলে, আর থাকবো না রে এই
গ্রামে আমরা। খবর পেয়েছি গ্রামের বুড়োপার্টি সুযোগ পেলেই আমার গলা কেটে রেখে তোকে তুলে
নিয়ে গিয়ে…
না আর দেরি করা যাচ্ছে না রে মহুয়া!
চল আমরা শুখা শুখাতেই পালাই। মহুয়া অবাক হয়ে বলে, দেরি করা যাচ্ছে না মানে?
-মানে যেভাবে চোখ রাখছে গ্রামের
ওরা আমাদের ওপর, দেখ, কোনদিন হয় আমার গলা কেটে জঙ্গলে ফেলে দেবে, নয়তো তোকে তুলে নিয়ে
গিয়ে…
আসরাফের মুখে হাতচাপা দেয় মহুল।
আসরাফের আরও কাছে ঘনিয়ে এসে বলে, চলো তবে। সেই অচিনপুরেই যাবে তো?
-চলো আমরা একেবারে বোম্বাই চলে
যাই।
-সে তো অনেক দূর গো!
-দূর বলেই তো বলছি। কেউ আমাদের
আর খুঁজে পাবে না।
-চলো তবে! ভয়ে বুক কাঁপছে মহুলের।
একে শহর, তারপরে এতখানি দূর। সেখানে গিয়ে তারপর? বাড়িতে কি কোনদিন আসতে পারবে!
-আরে চিন্তা করো কেন? সেখানে দেদার
কাজ। একটা কাজ ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে। তোমার জন্য আমি সব কাজ করতে পারি মহুল! তুমি আমার
মহুয়ার নেশা যে! তোমাকে ছাড়তে পারবো না। সেজন্যই তো এতদূর যাওয়া! শুনে খুশিতে ঝকঝকে
মহুলের মুখ। মহুল ভরাসা দেয়, আমিও তো পঞ্চায়েতের গ্রামোদ্যোগ দিদিমণিদের কাছে সেলাই,
ছাঁটকাট শিখেছি গো! সেখানে গিয়ে আমিও না হয় অন্য মেয়েদের সেসব শিখিয়ে রোজগার করব। দুজনের
আয়ে ঠিক চলে যাবে আমাদের বলো?
দুজনের রোজগারে আগামী সুখের সংসার গূছাতে গুছাতে শুকনো আকাশকেই সাক্ষী রেখে ওরা বোম্বের ট্রেনে বসলো। প্রথম ট্রেনে ওঠার খুশিতে মশগুল মহুল। ট্রেনের সাথে ওদের গুছানো সংসারও চলতে থাকে। ট্রেনের দুলুনিতে দুলতে দুলতে কখন যেন কথার বাঁক বদলে যায়!
আসরাফ আবার বলে ওখানে থাকলে আমাদের
বাঁচতে দিতো না রে। আমাকে কাটতো আর তোকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী বুড়োগুলো লোফালুফি করতো
ঠিক। আসরাফহীন মহুয়া নিজেকে কল্পনা করে শিউরে ওঠে! আসরাফের হাত চেপে ধরে বলে, ভাগ্যিস
আমরা তার আগেই চলে এসেছি। শহরে এসব নে ই, বলো! শ্বাসছেড়ে আসরাফ নিশ্চিন্ত হয়। বলে,
ওখানে সবাই নিজের নিজের মতো থাকে। কেউ কারো কাজে নাক গলায় না। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার বাঁক
বদলিয়ে ওদের সংলাপে এবার প্রেমের কথাকলি ফোটে।
বকম বকম করতে করতে কখন যে মহুল ঘুমিয়ে পড়েছে!
ওঠো ওঠো মহুল, নামতে হবে যে! এসে
গেছি আমরা! ঘুমভাঙা ঘোরে মহুল বুঝতে পারে না কোথায় আছে। ঘোরের মধ্যে ব্যাগ তুলে নিয়ে
ভিড়ের ঠেলায় দমবন্ধের জোগাড়! আসরাফ চট করে নেমে পড়ে হাত বাড়ায়, মহুল ভিড়ের অনেক পেছনে।
লোকজন নেমে পড়তেই ট্রেন চলতে শুরু করে দেয়। মহুয়া ট্রেনেই থেকে যায়। চলন্ত ট্রেন থেকে
কিছুতেই নামতে পারে না। ট্রেনের ভোঁ মহুলের কান্না খেয়ে ফেলে। ট্রেন নিজের মনে স্পিড
তোলে।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে আসরাফ ব্যাগের থেকে দুজনের ফোন বার করে। ঘুমন্ত মহুলের হাত থেকে নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই ওর ফোনটা নিজের ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। মহুলের ফোন পকেটে চালান করে নিজের ফোনে বলে, হ্যালো ম্যাডাম, রেডি আছেন তো? মেয়ের নাম মহুয়া। এই ট্রেনেই আছে কোচ নম্বর বলছি লিখে নিন…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন