কবিতার কালিমাটি ১৪৮ |
মৃত্যুশয্যায় সূর্যের মাথা ঝুলে আছে
আমার অস্থিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবি — এসব কি আমার পেশি-মজ্জা-স্নায়ুর সংসর্গী ছিল এবং এগুলো কি নিরুদ্দেশ ধুলোর সাথে আমাকে মেশাতে চেয়েছিল? ভস্মের ভেতর অর্ধজাগ্রত বিস্মৃত স্বরের প্রতিধ্বনি। অস্থির সমস্ত খণ্ডাংশকে তাদের স্মৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। অননুবাদ্য নিরবতায় কেঁপে ওঠে তাদের উত্তর।
চূর্ণ হয়েছে সময়ের আয়না। আমি যখন দেউতির পথে হেঁটে চলি, ধুলোর ছায়ায় অদৃশ্য হতে থাকি। আমি চিৎকার করে আমার অস্তিত্বকে ধ্বনিময় করে তুলি, কিন্তু আমার ধ্বনি ধোঁয়াময় প্রশ্নচিহ্নের সাথে উড়ে যায়।
একসময় নদীগুলোর শরীরে জেগে থাকতো নক্ষত্রের গান। বালু আর পাথরে সঙ্গীত মিনার নির্মিত হলেও আকাশ কখনও ঢালেনি শোকজল। মানচিত্রের পরিবর্তন লক্ষ করতে গিয়ে বিক্ষত আঙুলের রক্তে মানচিত্রকে দুর্ভেদ্য করে তুলি; আমার গন্তব্য অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আলোর শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে। মৃত্যুশয্যায় শায়িত সূর্যের মাথা ঝুলে আছে দিগন্তে। তার দৃষ্টি থেকে ঝরে কিছু স্ফুলিঙ্গ যা কেবল ক্ষত সৃষ্টি করে। আর্ত মহাকর্ষের টানে আমি সম্মুখে পা বাড়াই।
আমি একটি প্রান্তরে এসে পৌঁছাই — কাঠের দরজা পেরিয়ে দেখি এক পদ্মরমণী মৃণালের ছায়া দিয়ে দড়ি পাকাচ্ছে; বন্ধনত্রাসে কাঁপছে আকাশ।
রাতে শব্দময় নক্ষত্রের ক্ষত উন্মোচিত হয়। অন্ধকারের ঊর্ণাজালে ঝরে পড়ে নক্ষত্রের অজস্র বাক্য। আমি একটির পর একটি বাক্য পাঠ করি আর ক্রমান্বয়ে আমার পার্শ্বদৃষ্টি সংকুচিত হতে থাকে।
হাতের মুঠোয় ধুলো নিয়ে বসে থাকি। ধুলোর গন্ধের ভেতর একটি মাঠ জেগে ওঠে; বাতাসের লিমিনায় যে বর্ণগুলো সাকার হয়ে উঠতে থাকে সেগুলো অর্থবোধক বাক্য নির্মাণ করে না বলে আমি কালের সংগ্রাম আখ্যান উপেক্ষা করে শ্রীঘরে প্রবেশ করি।
আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি। সমস্ত অস্থির শুভ্রাংশ থেকে একটি হাত বেরিয়ে আসে; শালপাতার গেলাসে তুলে ধরে অ্যান্টার্কটিকা-অধঃস্থ জল। জলে প্রতিফলিত তুষারাচ্ছন্ন আকাশ। পান করার সাথে সাথে আমার সমস্ত শরীরে কম্পন জাগে, তীব্রতর হয় শ্বাসকষ্ট এবং আমি ক্রমে নিস্পন্দ হয়ে পড়ি।
কচ্ছপের কাছে গ্রহের সৃষ্টি রহস্য শুনতে শুনতে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে। ঋতুচক্র থেমে যায়, উড়ে আসে কুঞ্চিত ডুমুরপাতা অথচ কোথাও ডুমুর বৃক্ষের অস্তিত্ব নেই। অ্যানেমনি বীজের সাথে ভেসে আসে বন্য শূকরের ডাক। পৃথিবীর নিদ্রা ভাঙে না।
রাতে রোদার ক্রন্দন ভেসে আসে। সে জেনেছে পৃথিবীর সঙ্গে তার দূরত্ব অসহ। পৃথিবীর ছবি আঁকতে আঁকতে নিজেই জীবন প্রবাহের বাইরে দাঁড়িয়ে সে ক্রন্দন করে— "Oh, save me, from being blown for every outside the loop of time!"
আমার শরীর ভস্মে আচ্ছাদিত। ত্বক ও ভস্মের ভেতর কোনো ব্যবধান নেই। ভস্মে বহ্ন্যুৎসবের যে আখ্যান প্রচ্ছন্ন তা আপাতত পরিমার্জনের প্রয়োজন নেই।
দিগন্ত ও আকাশের বিচ্ছিন্ন বিন্দুতে আমি শুয়ে পড়ি। সূর্যের মৃত্যুশয্যার পাশে প্রজ্বলিত অস্থিপঞ্জরের গন্ধে কেঁপে ওঠে স্বপ্নবীজ — উদ্ভাসনে আমার বিশ্বাস রয়েছে।
কিটসের হৃৎপ্রবাহ ও দক্ষিণের আকাশ
বিকেলের সূর্যালোক হ্যাম্পস্টেডে জাফরান-দুধের সুলভ্তা নিশ্চিত করলে কিটস মিল্টনের সুবর্ণ দ্যুতি নিয়ে ভাবেন এবং প্লাম গাছের নিচে বসে প্যারাডাইস লস্টের পাতা ওলটাতে থাকেন। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন কিটসের দৃষ্টিকে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। সিথিউরিজমের ভেতরেও তিনি প্রকৃতির স্বাধীন ইচ্ছা প্রত্যক্ষ করেন।
কিটসের মন্দির থেকে সাইকি বেরিয়ে এসে মিল্টনের পঙ্ক্তিগুলো পাঠ করতে থাকেন। ইডেন থেকে নির্বাসিত অ্যাডাম ও ইভের বিষাদ কিটসকে স্পর্শ করেছিল। সাইকি স্যাটানের উক্তি পড়ে শোনান, “The mind is its own place, and in itself / Can make a Heav'n of Hell, a Hell of Heav'n.” মনের শক্তির বিপুলতার সন্ধান পেয়ে কিটস সাইকির কোমল আনন্দের দিকে তাকান।
বাতাসের কাঁধে চেপে শহরে সন্ধ্যা বিলি করতে থাকে নিস্তব্ধতার চিঠি। বিচ-ক্যানপির অদৃশ্য কাষ্ঠরেখা থেকে ভেসে আসে নাইটিঙ্গেলের গান। সঙ্গীত ও সৌন্দর্যের অবিনশ্বরতা নিয়ে কিটস অসন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন।
লাইলাক ও বুনো গোলাপের হার্প-সুরের ভেতর দিয়ে কিটস সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে হ্যামলেটের পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে দেন ক্যান্ডেলের আলো। নৈঃশব্দ্য ভেঙে রাজকুমার মন্দ্রিত স্বরে উচ্চারণ করেন, "To be, or not to be, that is the question..."। দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের জন্য হ্যামলেট কি আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন? কিটসের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মাঝে কেঁপে ওঠে একটি রেশমি পর্দা। তাঁর স্নায়ুর ভেতর শেকসপিয়ারের শব্দবৃক্ষ ছড়িয়ে দেয় অগণিত পত্রাঙ্কুর।
শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতির বিপ্রতীপ কোণে কিটস জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। অরণ্যের সাম্পানে ভেসে আসছে চাঁদ। সাইকির কেইসমেন্টে ঝরে পড়ছে অদৃশ্য টর্চের আলো।
অন্তর্গত বেদনায় কিটস অস্থির হয়ে ওঠেন। দেয়াল-প্রান্তের অ্যাপার্টমেন্টে নিঃসঙ্গ প্রেয়সীর চিন্তায় তাঁর হৃদয়ে ক্ষরণজ্বালা।
কিটসের চেতনার সমগ্র ভূগোলে জেগে থাকে ফ্যানি কমলিনী। যে গার্নেট অঙ্গুরি প্রতিদিন জননীর মুখচ্ছবি উন্মোচন করে তা তিনি ফ্যানির অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছেন; অলংকৃত আঙুলের দিকে তাকিয়ে প্রেয়সী নির্জন অ্যাপার্টমেন্টে ছড়িয়ে দেন গোপনতম নিশ্বাস।
কিটস তার প্রিয়তমাকে এক অবিনাশী পত্রে জানিয়ে দেন, তিনি তাঁর জীবনের অনুজ্জ্বল প্রভাত সম্পর্কে তাকে সাবধান করতে অনাগ্রহী। তাকে ছাড়া তাঁর অস্তিত্ব অকল্পনীয়। ফ্যানির সঙ্গই তাঁর একমাত্র কাম্য। ধর্মের জন্য মানুষ শহীদ হতে পারে ভেবে তিনি এক সময় বিস্মিত, শিহরিত হতেন। এখন থেমে গেছে তাঁর শিহরণ। তিনি ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত — প্রেমই তাঁর একমাত্র ধর্ম। কিটস প্রেয়সীর জন্য মৃত্যুর শীতলতায় ডুবতে পারেন। তাঁর 'I cannot breathe without you' বাক্যে কোনো মিথ্যাচার নেই।
শীতের এক রাতে জ্বরে আক্রান্ত কিটস শহর থেকে ফিরে আসেন। তাঁর কম্পমান শরীরে নিশ্চয়ই মদের প্রভাব নেই। তাঁর কাশির সঙ্গে বিছানার চাদরে ঝরে পড়ে একফোঁটা রক্ত। বন্ধু ব্রাউনকে জানান, এ আর্টেরিয়াল রক্তে লেখা হলো তাঁর ডেথ-ওয়ারেন্ট। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষরণে শ্বাসরোধের উপক্রম হলে তাঁর চোখের গভীরে স্পষ্ট হয় ফ্যানির মুখচ্ছটা।
রোমে বসে কিটস ফ্যানিকে চিঠি লেখার শক্তি সঞ্চয় করতে পারেননি। ব্রাউনকে লিখেছেন, অন্তিম অন্ধকারে তিনি নিমজ্জিত হতে পারেন কিন্তু বিচ্ছেদযন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি তাঁর নেই। পৃথিবীতে কোথায় তিনি পাবেন সামান্য সান্ত্বনা? হ্যাম্পস্টেডের বিচ কিংবা মালবেরির দৃঢ়তা নিয়ে তিনি হৃৎপ্রবাহকে সঞ্চরমাণ রাখতে চেয়েছেন।
কিটস শুয়ে আছেন, তাঁর শ্রান্ত চক্ষুপল্লবের নিচে ক্রমাগত জেগে ওঠে দৃশ্যাবলি — হ্যাম্পস্টেডের পন্ড স্ট্রিট ডেপোতে দাঁড়িয়ে আছেন ভারাক্রান্ত ফ্যানি, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী কবির জন্য অপেক্ষমাণ; কিটস বিশুষ্ক তৃণদল বেষ্টিত হ্রদের পাশে ঘুরছেন, প্রত্যাবর্তনের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না; কোথাও নেই পাখির কলরব।
দক্ষিণের আকাশ কিটসকে সোনালি উষ্ণতায় আবৃত রেখেছিল কিন্তু তাঁর ফুসফুসে জমে থাকা তুষারের আস্তরণ গলাতে পারেনি। তাঁর নিথর বুকে বেঁধে দেয়া হয়েছে ফ্যানি ব্রনের একগুচ্ছ চির-অপঠিত চিঠি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন