বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

অম্লান বোস

 

সমকালীন ছোটগল্প


পঙ্কিতা

ঘুম ঘুম আমেজের হাল্কা আঁচটা হঠাৎই নিভে গেল। কানের ওপর একটা শীতল ধাতুর স্পর্শ। চমকেই উঠলাম - পাশের মেয়েটির কানের বড় মাপের গোল দুলটা প্রায় গ্রাস করে ফেলছে আমার কানের পাতা, ঘুমের ঢুলুনিতে মাথায় তার অনিয়ন্ত্রত দোলুনী। জামশেদপুর থেকে কলকাতা, দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী আমরা সবাই। এই প্রথম একা ট্রেনে যাচ্ছে মেয়েটি। তার বড়ভাই ট্রেনে তুলতে এসে আমার দুহাত ধরে মিনতি করে গেছেন, বোনকে যেন আমি একটু সঙ্গ দিয়ে দেখাশোনা করি।

সাবধানে দুহাতে মেয়েটির সাজিয়ে তোলা কেশবিন্যাস বাঁচিয়ে মাথাটা সরাবার চেষ্টা করতেই ট্রেনের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে মেয়েটি জেগেই উঠল - সলজ্জ অপ্রতিভ হাসি আর ঘুমে ভেজা চোখে অবর্ণনীয় আকর্ষণ। বলতেই  হলো, “না না, ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও । আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।” মুহূর্তে মাথাটা কাত হলো আমার কাঁধে। ওপরের ঘড়ঘড়ে ছোট্ট পাখার ছোঁয়া-না-ছোঁয়া হাওয়ায় গা শিউরানো রোমান্টিক এক ফরাসী সুগন্ধ  ঝাপ্টা দিয়েই মিলিয়ে গেল। হতচকিত আমি, তবে বিহ্বলতার আয়ু ট্রেনের অবিরাম ঝাঁকুনির দৌলতে মাত্র পনেরো মিনিট। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে হাতের আড়ালে একটা ছোট্ট হাই তুলে মেয়েটি জানলার বাইরে অন্ধকারে দৃষ্টি চালিয়ে দিল। তারপর ছোট সুদৃশ্য ব্যাগ তুলে নিয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এলো সে।

শুরু হলো আমাদের ভাঙ্গা ছেঁড়া কথামালা। আরম্ভটা অবশ্যই জামশেদপুর ভিত্তিক। আগের কোন পরিচয় নেই, অথচ আমাদের শহরের ইতিকথার সূতোয় বোনা সেই মিলনী, রবীন্দ্রভবন, স্কুলে পড়াশোনা, পাড়ার ক্লাবে নাচগান, ডিমনা দোমোহানীর ভাললাগা মাধুর্য, নির্দিষ্ট সময়ে লোহা কারখানার সাইরেন, ঝকঝকে সন্ধ্যার পূব আকাশে ব্লাস্ট ফার্ণেসের গোলাপী রং, সাঁতার কাটার চেষ্টায় নাকানি চোবানি, গানের স্কুলের হেনস্থা - কী যে ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে গেল মনের ভেতরে! সেই সুরে সেই তালে নেচে উঠল আমাদের মন প্রাণ কোন এক নিবিড় ছন্দবন্ধনে!

মেয়েটি নিজের নাম জানালো পঙ্কিতা। জীবনে কখনও এর আগে এমন নাম শুনিনি। আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তাই বলেই দিল পঙ্কিতা নামের মানে - ফুলের পাঁপড়ির মত কোমল। সবাই বোধহয় নামের মানেটা জানতেই চায়। চোখে তার উড়ন্ত পরী এয়ার হস্টেস হবার স্বপ্ন। এবং তার ইন্টারভিউ দিতেই তার কলকাতা যাত্রা। এর মধ‍্যেই আমার সম্বন্ধেও অনেক জমে থাকা তথ‍্য জোগাড় করে ফেলেছে নিপুণ কৌশলে।  কথাবার্তায় জড়তা নেই, নেই কোন অপ্রাসঙ্গিকতা। হাবভাবে, আচার আচরণে আকর্ষণীয়া। বিমান সেবিকার নিটোল প্রতিমূর্তি বলেই মনে হলো আমার।

রাতের অন্ধকার চিরে দুর্ধর্ষ গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের অজান্তেই নিছক পরিচিতির বেড়াজাল ভেঙে আমাদের মানসিক রসায়নও মিশ্রণের পথে। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে ছাড়িয়ে  গেছে।

কথার মাঝে হঠাৎই আমার আঙ্গুলগুলি নির্দ্বিধায় নিজের চাঁপাকলি আঙ্গুলে জড়িয়ে নিল - স্বাভাবিক, অনায়াস ভঙ্গীতে। বাঁহাতের আঙ্গুলগুলো তখন খেলা করছে আমার রিস্ট্ওয়াচের ওপর। কলকাতার কোন ক‍্যাফেতে কবে দেখা হবে, ‘অরণ‍্যের দিনরাত্রি’ ছায়াছবিটা কোন সিনেমাহলে ক’টার শো’য়ে যাব, বিরতির সময় পপ্ কর্ণ না ফিশরোল, ভারত অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট যুদ্ধ, প‍্যারিস না সুইটজারল‍্যান্ড, ফ্লাইটে মোটামুটি কোন পংক্তির ধারের দুটো সীট চেষ্টা করা উচিত, প্রায় সব পরিকল্পনাই পাকা হয়ে গেল।

কানফাটা ভেঁপু বাজিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রৌরকেল্লা এক্সপ্রেস্, আলো ফুটি ফুটি ভোরে। কলস্রোতে নামছে জনসমুদ্রের অধৈর্য বন‍্যা হাওড়া স্টেশনের দশ নম্বর প্ল‍্যাটফর্মে। আমার কোলের ওপর ভর দিয়ে জানলায় ঝুঁকে পড়ে পঙ্কিতা তার বাবাকে খুঁজছে। দেখতে পেয়ে পাগলের মতই হাত নাড়ল সারা শরীরে ঢেউ তুলে। ব‍্যস্ত হাতে ছোট স‍্যুটকেশটা তুলে নিয়ে বহির্গামী যাত্রীদের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ঠাসা দরজার দিকে এগোতে লাগলো সে আমার প্রত‍্যাশী দৃষ্টি উপেক্ষা করেই।

ছোট্ট লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমেই দৌড়ে গিয়ে পায়ের আঙ্গুলের ওপর দাঁড়িয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা স‍্যুটকেশটা হাতে নিয়ে নিলেন। ফুটন্ত শারীরিক ভাষায় উচ্ছল পঙ্কিতা পায়ে পায়ে নিষ্ক্রমণের পথে এগিয়ে গেল।

পঙ্কিতার দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাওয়া পায়ের নিষ্ঠুর গতি তখনই মনে ঝাপটা দিয়ে উঠল – তাই তো, নিজেদের কন্ট‍্যাক্ট নাম্বারটাই দেওয়া নেওয়া হয়ে ওঠেনি যে!

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন