শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

রম্যাণি হাজরা

 

একফালি মাটির প্রত্যাশী




ফার্পো'স-এর ক্যাবারে ফ্লোরের ঠিক মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে আছে আরতি। আলোতে বারবার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। এত আলো আগে দেখেছে কখনও? এরম জামা কাপড়ও কি দেখেছে আগে? কত লোকজন, ব্যস্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছে একটা টেবিল থেকে আরেকটায়। হাতের ট্রেতে রঙিন তরলের বোতল, কাঁচের গ্লাস। কাঁচে কাঁচে ঠোকাঠুকি লেগে টুং টাং শব্দ হচ্ছে বারবার। এসব বোতলেরও আলাদা আলাদা নাম আছে। বিলিতি নাম।

টেবিলে টেবিলে সাদা চাদর পাতা, তার উপর সেরামিকের ফুলকাটা কাপ প্লেট বাটিতে সুন্দর করে সাজানো খাবার! কতরকম খাবার! বাড়িতে কোনোদিনও একসাথে এত খাবার আরতি দেখেনি। মা এত রাঁধতেই পারে না! একবেলা রান্না হলে, পরের বেলার জন্য মায়ের হেঁশেলে আর চাল থাকে না।

কি মায়াবী, স্বপ্নের মত। যেন ঘোর লেগে যায়। ঘরের ভিতরটা কি ঠান্ডা!

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ড্রামারের কিউতে ফের মুহূর্তে স্নায়ু চনমনে হয়ে ওঠে। শরীরের সমস্ত পেশী টানটান করে। খানিকটা নিঃশ্বাস নেয় আরতি। প্রতিটা ইন্দ্রিয়ের নির্যাস নিংড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে প্রাণপণে।

মিউজিকের টেম্পো বাড়ছে।

আস্তে আস্তে পায়ের পাতায় রিদমটা ধরতে আরম্ভ করে সে। পায়ের পাতা দিয়ে যেন মিউজিকের প্রতিটা বিট তরঙ্গের মত উঠে আসছে ওর শরীর বেয়ে। অচেনা বিদেশি সুরে শরীরের শেষ পেশিটাও নিজেকে ভেঙেচুড়ে নির্ভুল নিখুঁত ছন্দে সাড়া দিচ্ছে ঠিক। নাচ শেখেনি তো কোনোদিন! কেই বা শেখাবে? তবু আরতি জানে, ওকে ঠিক কী কী করতে হবে, কোন বিটে কত স্টেপ, কোথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে উস্কে দিতে হবে দর্শকদের। এর কোনো ব্যাকরণ নেই। শরীরী জ্যামিতির কোনো পাঠ্যবই হয় না। খিদে মিটিয়ে নেওয়ার, বেঁচে যাওয়ার, টিকে থাকার সমস্ত কৌশলই মানুষের শরীর গোপনে আয়ত্ত করে রেখেছে সেই গুহাজীবনের দিন থেকেই।

নাচতে নাচতেই এগারো বছরের আরতির মনে পড়ে গতকাল ওকে যখন আজকের নাচের কস্টিউমটা দেওয়া হয়, কস্টিউম দেখে কেঁদে ফেলেছিল ও। বুঝেছিল, এখান থেকে আর কোনোদিনও বাড়ি ফেরা হবে না। কালকের পর থেকে ওর আর কোনো বাড়ি থাকবে না। বা মা, আত্মীয়, কেউ থাকবে না। আস্ত একটা মধ্যমেধার মধ্যমানের ভদ্রসমাজ ওকে আর কোনোভাবেই জায়গা ছেড়ে দেবে না এক চুলও। দিনের বেলার পৃথিবীটা ওর নাগালের বাইরে চলে গেছে চিরকালের মত।

না। বাড়ি ওদের এমনিতেও ছিল না। বাবার মুখে শুনেছিল, এককালে ওদের দেশ ছিল, দেশে ঘর ছিল, গ্রাম ছিল, দু বেলা ভাত ছিল!...তারপর কোথায় কারা যেন স্বাধীন হল, নরম ঘাস জমির উপর মাইলের পর মাইল কাঁটাতার বসল, আরতিদের গ্রাম, ঘর, সব গেল। বাবার সাথে পায়ে পায়ে এসে জুটল 'এপারে'। 'রিফিউজি'।

সবাই মরছিলই। সবাই ভেবেছিল আরতিও মরবে। কিন্তু আরতির জেদ ছিল, ও কিছুতেই মরবে না। পারলে মরণের এঁটো মুখ থেকে জান কেড়ে নিয়ে বাঁচবে।

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নিজের জন্য বড্ড গর্ব হল মেয়েটার। এইত্ত! এইত্ত ও পেরেছে! অভাব, আকাল, খিদে, কাঁটাতার, কেউ মারতে পারেনি ওকে। রাতের পৃথিবীর সমস্ত আলো আর অন্ধকার ওকে দুহাত দিয়ে আগলে নিয়েছে। নিজের দমে, নিজের চেষ্টায়, ও বেঁচেছে!

পোশাকটার দিকে আরও একবার তাকায়। না, আর কান্না পাচ্ছে না ওর। আর কোনোদিন কান্না পাবে না।

ওরা দেখতে এসেছে? দেখুক!

দেশ, গ্রাম, ঘর, সবেতেই এখন ওদের দখল। কিন্তু স্টেজ? স্টেজের দখল থাকবে শুধু ওর হাতে। এই সামান্য বৃত্তটুকু অন্তত ও নিয়ন্ত্রণ করবে একা। বাকিরা দূর থেকে, অনেক দূর থেকে ঘোর লাগা চোখে দেখবে ওকে। দেখে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, মাথা ঘুরে যাবে, মায়াবী মরীচিকার মত বারবার ছুটে এসে ছুঁতে চাইবে মাত্র একবার, তবু পারবে না, ছিটকে সরে যেতে হবে অনেক দূরে, পড়ে যেতে হবে আরতির স্টেজের চেয়ে অনেক নীচে।

এসপ্লানেড মেট্রো স্টেশনে নেমে হাত ধরে হাঁটতে শুরু করি, রাস্তার বাঁ পাশের ফুটপাথ ঘেঁষে; খুব ভিড় তো...! ফুটপাথের গা দিয়ে সারি সারি দোকান; রুমাল, চুড়ি, বাদাম ভাজা, সুতির জামা, জুতো, চটি, সস্তার সানগ্লাস...।

লম্বা টান সাদা দেওয়ালটার দিকে চোখ যেতেই হঠাৎকরে পড়ে এই সেই ওবেরয় গ্র্যান্ড! কেরিয়ারের একেবারে শীর্ষে ফার্পো'স এর আরতিকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে নিয়ে গেছিল গ্র্যান্ড, তাঁর দৌলতেই ধীরে ধীরে অবস্থা ফেরে গ্র্যান্ডের। ওহ না! তখন তো আর সে রিফিউজি পাড়ার আরতি দাস নয়, ততদিনে সে নিজের দমে অর্জন করে নিয়েছে ‘মিস শেফালী’ নাম খানা। গোপন ইশারায় ইয়ার দোস্তদের আড্ডায় ভদ্রসমাজ তাকে 'রাতের রানী' বলে সমীহ করে। বলতে বলতে চাপা উত্তেজনায় চোখ চিকচিক করে ওঠে বাঙালি বাবুদের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার সৈনিকদের আস্তানা হয়ে ওঠে গ্র্যান্ড। তারা সাথে করে প্রথম ভারতে নিয়ে এলো Jazz এবং কোকাকোলা।। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ক্যাবারের পুনরুত্থান গ্র্যান্ডের ফ্লোরে। ধীরে ধীরে আরতির মত গ্রাম ঘরের মেয়েরা যুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ পেরিয়ে যখন আপাত খিদের তাগিদেই ক্যাবারের ফ্লোর দখল করতে আরম্ভ করলো, তখন Anglo শিল্পীদের কড়া প্রশিক্ষণের পাহারা এড়িয়ে Charleston, Cha Cha Cha, Can Can, Rumba,Hawaiian এর ফাঁকফোকর গলে ঢুকে পড়তে লাগলো ভারতের আদিম পাড়া গেঁয়ে লোকনৃত্যের ভাব, মুদ্রা, তাল, গতি...।

যুদ্ধ, আকাল, চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই রাতের শহরের বুকে দু এক টুকরো মরীচিকার মতো বেঁচে রইলো ফার্পো'স, ওবেরয় গ্র্যান্ডদের ক্যাবারে ফ্লোর, সেই অনিশ্চয়তার সূচক হয়েই।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় ক্লাসে দেখা ফার্পো'স রেস্তোরাঁর ছবি। ভিতরে সুখাদ্য, পানীয়, শৌখিন নাচ গান আমোদের আয়োজন। বাইরে, রাস্তার উপর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কালো কালো কঙ্কালসার শরীর, কোনোটার নিঃশ্বাস পড়ছে, কোনোটার বা পড়ছে না। বহুদিনের অনাহারে মৃত্যু, 'prolonged starvation owing to famine'। সেই সময়কার এক মার্কিন পর্যটকের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "তখন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শুধুই মৃত্যুর দুর্গন্ধ, মনে হত শহরটা একটু একটু করে পচে যাচ্ছে"।

ছবিটার কথা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে রুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশ সেনার প্রয়োজন প্রচুর অর্থ এবং খাবার। উপনিবেশের অর্থনীতির বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তখন স্বয়ং জন মেইনার্ড কেইন্স। ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনা করেছে 'গরীবদের' ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস করে, খাদ্য ও অন্যান্য উৎপাদন তাদের হাতের নাগালের বাইরে সরিয়ে ফেলার। সেই খাদ্য এবং উৎপাদনেই ব্রিটিশ সেনার যুদ্ধের খরচ অনেকটা জোগানো যাবে। নিঃশব্দে সম্মতি জানান কেইন্স। সেই মত কাজ হল। এক পয়সাও মজুরি না বাড়তে দিয়ে জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হল প্রায় ছ’গুন। স্রেফ না খেতে পেয়ে মরেছিল তৎকালীন বেঙ্গল প্রভিন্সের প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন 'কালা আদমি', ব্রিটিশ সরকারের কুখ্যাত 'six-fold inflationary policy' বা 'consumption diversion policy'কে সফল হল।

যুদ্ধ করতে কবে শিখল মানুষ? দখলদারির নেশা তার ঠিক কতটা পুরনো? পৃথিবীতে মালিকানার ইতিহাস কত বছরের? শ্রেণীর উৎস কোথায়?

বাসে উঠে জানালার ধারের সিটটারও এক কোণে সরে গিয়ে বসেছিl বাইরে সন্ধ্যা নামছে। জানালা দিয়ে দেখতে পাই, রাস্তায় আলোর স্রোত।

পুরনো চিন্তাটার জাল কেটে গিয়েছিল, একটু ধাতস্থ হতেই আবার প্রশ্নটা মাথার মধ্যে এসে ধাক্কা দিল। যুদ্ধ। যুদ্ধের শুরু কোথায়? কীভাবে? By a divine accident?

না। না না। মনে আছে, পেরি সাহেবের সেই লেখাটা ওর মনে আছে। কবে যেন পড়েছিলাম?

সারাদিন বড্ড গরম ছিল। এখন অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। চোখে ঠান্ডা হাওয়া লাগলে খুব আরাম হয়। চোখ বুজে আসে। চোখ বন্ধ করতেই ধীরে ধীরে দেখতে পেলাম, একটা নদী। তার জল রূপকথার মত পান্না সবুজ। নদীর দু’পাশ দিয়ে উর্বর জমি, তাতে প্রথম শস্যের বীজ ছড়িয়েছে মানুষ। ঠিক সময়ে নদীর জলে আপনা থেকেই জমির সেচ হয়।

তবে বছরে একবার, মাত্র একবার, নদীটা দু’পাড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় বন্যায়। জলের তলায় তলিয়ে যায়  হলুদ চাষজমি। দিনটা আসে হঠাৎ, অতর্কিতে। আগে থেকে তৈরি হওয়ার সুযোগ হয় না। জমি, বাড়ি, গ্রাম কিছুই রক্ষা পায় না। বড় বিপদ। জলের দেবী, মাটির দেবী, গ্রামের প্রধান রক্ষিকা দেবী, আদিম মাতৃদেবীকে নানান উপাচারে তুষ্ট করার চেষ্টা করে বুড়োচাষি। মূর্খ!

তারপর একদিন হঠাৎ কেউ একজন, গ্রামেরই কেউ একজন চাঁদ আর তারাদের গতি অনুসরণ করে মারাত্মক একখানা হিসেব কষে ফেলল। নাইল নদীর দুটো বন্যার মধ্যেকার ব্যবধান মেপে ফেলল। চাঁদের হিসেবে। তিনখানা ফিজিক্যাল ডাইমেনশনের পাশাপাশি নতুন এক বোধের জন্ম হল - 'সময়'। সম্ভবত মানুষের মনোজগতে প্রথম mathematical convention।  সময়ের হিসেব রাখতে শিখে গেল নখ দাঁতহীন আপাত দুর্বল এই পশুশ্রেণী।

নাইল নদীর জলে সামান্য চাষাবাদ করা মূর্খচাষি আবিষ্কার করে ফেলেছে পৃথিবীর প্রথম lunar calendar! হতচ্ছাড়ি নদী আর তাদের জব্দ করতে পারবে না, চাঁদের হিসেব মিলিয়ে মিলিয়ে তারা ঠিক আগে থেকে জেনে যাবে বন্যার দিনটা, ঘর বাঁধবে, চাষ সেরে ফেলবে, সেচ করবে সেই মত।

কিন্তু এত বড় আবিষ্কারখানা করল যে, সে তো সাধারণ মানুষ নয়, সে ক্ষণজন্মা, আদিমাতা স্বয়ং তাঁকে রক্ষা করছেন। আদিমাতার সমস্ত প্রাণদায়ী বৈশিষ্ট্য তারও আছে। খবর ছড়িয়ে পড়তে তখনও সময় লাগত কমই। অল্প দিনের মধ্যেই চাঁদের হিসেব মিলিয়ে দিনক্ষণ বলে দিতে পারা পরিবারগুলো গোষ্ঠীর মধ্যে হয়ে উঠলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাশালী। একদল মানুষের দর বেড়ে গেল বাকি সকলের চেয়ে। শ্রেণীর প্রথম বীজ পোঁতা হয়ে গেল নাইলের উপকূলের উর্বর মাটিতেই। যারা দিনের হিসেব, বছরের গণনা করতে শিখল, মানুষের ইতিহাসে নাকি তারাই প্রথম 'উচ্চশ্রেণী'। যদিও শাসকের বা রাজার সমস্ত রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হতে সময় লেগেছিল আরও বেশ কিছু বছর।

রাজার স্বার্থ তখনও ছাপিয়ে যেতে পারেনি গোষ্ঠীর স্বার্থকে। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল বয়স হলে রাজার প্রাণদায়ী শক্তি ক্ষয়ে আসে, তখন আর তার জীবন যৌবনের ধারক হওয়ার ক্ষমতা থাকে না। যৌবন-ক্ষয় অতি অলক্ষণে। তাই নিয়ম ছিল বুড়ো হলেই রাজাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া হবে, গোষ্ঠীর মঙ্গল কামনায়।

একেবারে গোড়ার দিকে নৃতাত্ত্বিক W.J. Perry সাহেব যেসব হদিস পেয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল প্রাচীন সুমেরের (বর্তমানে ইরাক) এরিডু শহরের রাজা এন্কি। খোঁজ মিলেছে Tammuz এরও। Tammuz নাকি আদিমাতার সন্তান, তাকে বয়সকালে তার প্রজারা জবাই করতে গেলে, আদিমাতা নাকি তাকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এমন গল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে।

রাজার প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইজিপ্টের রাজা হোরাসের বর্ণনায়। গোষ্ঠী স্বার্থরক্ষা, এবং লুনার ক্যালেন্ডারের সাথে রাজা এবং রাজনীতির অস্তিত্ব তখনও শক্ত করে বাঁধা। হোরাসের পিতা ওসিরিস,  মৃতদের দেবতা তিনি। মৃত্যুলোকের রক্ষক। ওসিরিসকে খাবার, কড়ি, শামুক ইত্যাদি দিয়ে তুষ্ট রাখেন রাজা হোরাস, বাঁচিয়ে রাখেন পিতৃপুরুষের কাল্ট। ইতিমধ্যে আদিমাতা প্রধানা দেবীর আসন থেকে সরতে শুরু করেছেন একটু একটু করে। গোষ্ঠীর জীবন্ত রাজনীতিতে আদিমাতার প্রেমিক ও পুত্রগণ ক্রমে হয়ে উঠলেন রাজা, প্রধান পিতৃদেবতা, মধ্যমণি। বিষাক্ত সাপ, সিংহী ইত্যাদি টুকটাক পার্শ্বচরিত্রে গোষ্ঠীর প্রধান পুরুষদের রক্ষক হয়ে রইলেন প্রস্তরযুগের সর্বময়ী কর্ত্রী আদিমাতা।

হোরাসের বয়স হলে, মুখের চামড়া ঝুলে পড়লে, নতুন হোরাস সিংহাসনে বসেন, বৃদ্ধরাজা যাত্রা করেন ওসিরিসের দেশে। ওসিরিসের পরলোকবাসের হাত ধরেই প্রথম মমির যাত্রা শুরু। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় তখনও 'স্বর্গের' ধারণা তৈরি হয়নি।

ভারতের আদিবাসী দ্রাবিড় গোষ্ঠী ওঁরাওদের মধ্যেও আকাশের মাঝে অপার সুখ-স্বর্গের ধারণার প্রচলন নেই। বরং ওসিরিসের দেশের মতোই তাদের লোকগল্পেও মৃত্যুলোকের উল্লেখ পাওয়া যায়, নাম 'মারি মোপড়া'। পশুপাখি, পাহাড়, গাছপালা, চাষের লাঙ্গল, কুঠার, কাস্তে সবেতেই মৃত পিতৃপুরুষের আত্মার স্পষ্ট অস্তিত্ব। বিয়ে, বা নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশের আগে মুরগি বলি দিয়ে পিতৃপুরুষকে তুষ্ট করার নিয়ম  রয়েছে। তাঁদের কবরে ময়লা করলে বা কোনোরকম অসম্মানমূলক বেয়াদবি করলে রাতে এসে 'ভুলা' ভূত ধরে নিয়ে যায়, রাস্তায় রাস্তায় ছুটিয়ে পাগল করে দেয়।

কিন্তু মুশকিল হল, চাঁদের হিসেব দিয়ে হোরাসের রাজপুরোহিতেরা বেশিদিন সুবিধে করতে পারলেন না। প্রায়ই হিসেবে গোলমাল হয়, বন্যার সঠিক দিন বলতে পারা যায় না। ইতিমধ্যে হেলিওপলিসের পন্ডিতেরা সূর্যের হিসেবে দিনক্ষণ মাপা আরম্ভ করেছেন। প্রথম Solar calender তৈরি করে ফেলেছেন, তাদের হিসেব নির্ভুল। ক্রমে সোলার ক্যালেন্ডারের গুনেই মিশরের রাজনীতিতে জায়গা দখল করতে আরম্ভ করে হেলিওপলিস।

উর্বরতা বা শস্য উৎপাদন নয়, বরং নিখুঁত সোলার ক্যালেন্ডারের সাফল্যই মিশরের বিশ্বাস প্রণালীতে জায়গা করে দেয় হেলিওপলিসের সূর্য দেবতার জন্য।

দু এক টুকরো missing linkএর মত এখনও ওঁরাও এবং মালপাহাড়িয়াদের বিশ্বাসে খুঁটি বা চড়ক ঠাকুরের দিব্যি রমরমা। চড়ক সময় বা periodicityর প্রতীক। সময়ের গতি নিয়ন্ত্রণ করেন বলেই সূর্য ঠাকুর 'বেরু নাডু' বা বেরু গোঁসাইয়ের সাথে তাঁর ওতপ্রোত সম্পর্ক। সবসময় একসাথে পুজো পান দুজনে। আদিম সোলার ক্যালেন্ডারের নিয়ন্ত্রক, শাসক, ঈশ্বর সূর্যদেবতা ইজিপ্টের গন্ডি পেরিয়ে এককালে হয়ত থাবা বসিয়েছিলেন পৃথিবীর কোণায় কোণায়।

হেলিওপলিসের শাসক Re। নাইলের বন্যার দিনে তাঁর জন্ম। মা স্বয়ং আদিমাতা Nut। Khunm নামের এক ডিমের থেকে Re র জন্ম। Nut গাভীরূপে Reকে পিঠে করে নিয়ে চলেন আকাশপথে। সেখানে প্রতিদিন আকাশের মাঝে Nutএর শরীর থেকে জন্ম হয় Reর। সূর্যের analogy স্পষ্ট হয়। Re হোরাসের মত নিয়তির কাছে হার মানতে নারাজ। কেন তাকে মরতে হবে? সে তো রাজা! তিনি মাতৃশক্তি Hathor এর শরণাপন্ন হলেন। বৃদ্ধ Re আদেশ দিলেন যারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তাঁকে মেরে ফেলার ছক কষছে তাদের সমূলে বিনাশ প্রয়োজন।

Hathor সিংহী রূপে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন রাজ্যময়। অবিরাম হত্যালীলা। শেষে মাদকের নেশায় তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে কোনোমতে পৃথিবী রক্ষা পেল। এই গল্পখানা হেলিওপলিসের পুরোহিতেরা প্রচার করলেন সারা মিশর জুড়ে। রাজা বৃদ্ধ হলেও তাঁকে মারার প্রয়োজন নেই। তাঁর উদ্দেশ্যে যে কোনো একজন কাউকে বলি দিলে সেই রক্তেই রাজার যথেষ্ট যৌবন রক্ষা হবে। গোষ্ঠীর মঙ্গল সাধন হবে।

পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে সেই দিনই বোধহয় সবচেয়ে অন্ধকারময় সময়ের সূচনা। গণৎকার  রাজারা এতদিন ছিলেন উচ্চশ্রেণী, এবার হয়ে বসলেন প্রজার শারীরিক অস্তিত্ত্বের সর্বময় মালিক। প্রজা তাঁর অধীন। রাজার প্রয়োজনে তাদের বলি দেওয়া চলে। দিকে দিকে অন্যান্য গোষ্ঠীর উপর দখলদারি কায়েম করতে রাজারা হাতিয়ার বাগিয়ে ছুটে যেতে লাগলেন। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে মুখোমুখি দ্বন্দ্ব। যুদ্ধ। যুদ্ধে যারা হারবে, তারা বিজয়ী রাজার 'দাস'। গোষ্ঠীর এবং রাজার স্বার্থ রক্ষার্থে তাদেরই বলি দেওয়া হবে।

এতদিন গোষ্ঠীর স্বার্থই ছিল শেষকথা। তার সামনে রাজাও ছিল নস্যি। এবার গোষ্ঠীর উপর গায়ের জোরে রাজা তাঁর ব্যক্তি স্বার্থ কায়েম করা আরম্ভ করলেন। ব্যক্তিস্বার্থ এবং গোষ্ঠী স্বার্থের মধ্যেকার ফাটল সেই থেকে চওড়া হতে শুরু করল একটু একটু করে। রাজা এবং প্রজার মধ্যে, উচ্চ এবং নিম্নশ্রেণীর মধ্যে পরস্পর বিরোধী স্বার্থের সমীকরণের সেই শুরু, শুরু বঞ্চনার অনন্ত ইতিহাসের। শুরু মালিকানার। শুরু দাসত্বের। এবং যুদ্ধের।

ইজিপ্টের কোন রাজা কবে কোথায় কীভাবে চাঁদ তারা গুনে ক্ষমতা দখল করে, প্রথম যুদ্ধের বীজ পুঁতেছিল, সেসব আরতি জানে না। তবু রাজা রে'র গল্প যে বঞ্চনার বীজ পুঁতে গিয়েছিল, হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পেরিয়েও তারই বিষ বৃক্ষের শিকড় যেন হাত বাড়িয়ে মুঠোর মধ্যে ধরতে চায় আরতিদের।

আরতি একগুঁয়ে। কারোর কথা শোনে না। জ্বলন্ত চোখে লাইসেন্স না দিতে চাওয়া পুলিশকে প্রশ্ন করে, "তুমি তো আমায় খাওয়াবে না, তাহলে আমার কাজের ভালো মন্দ বাতলে দেওয়ার তুমি কে?"

মধ্যমেধার মধ্যমানের ভদ্রসমাজের কাছে জানতে চায়, "তোমরা যারা 'নাচ' এর 'ন' ও জানো না, তারা কেন আমার শিল্প, আমার পেশাকে অপসংস্কৃতি বলে দাগিয়ে দেবে?"

জানতে চায়, তার সস্তার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সত্যজিৎ আর উত্তমের সাথে ছবি দেখিয়ে কেন তারা বারবার ব্যঙ্গ করে বলবে, "তুমি নয় বলো সত্যজিতের সাথে কাজ করেছ, তাই বলে কি সত্যজিৎ কোনোদিন ফলাও বলেছেন তিনি মিস শেফালী'র 'সাথে কাজ করেছেন'?"

বাস থেকে নেমে পড়ে অন্ধকার ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। মাথা ঝিমঝিম করছে। গুমোট! ভালো লাগছে না একটুও। রাস্তার উপর একটা গ্রাফিতি, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগান সমেত।

মনে আছে কোন একটা ক্লাসে স্যার পড়িয়েছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে আশ্বস্ত করে বলছেন, শত্রুকে দূর থেকে মেরো, এত দূর থেকে যাতে তাদের মুখও তোমার চোখে না পড়ে। বলেছিলেন, আকাশের অনেক ওপর থেকে আস্ত একটা শহরের উপর যখন কেউ বোমা নিক্ষেপ করে, শহরের একটা বাড়ি, একটা ছাদ, একটা মুখও তার চোখে পড়ে না, মানুষ খুন করার গ্লানি থেকে এতে বোধহয় খানিক মুক্তি পাওয়া যায়! যাদের মুখই দেখতে পায়নি, তাদের হত্যা করার গ্লানি হবে কেমন করে? রাফার উদ্বাস্তু  শিবিরে যারা বোমা ফেলেছে, অসউইজের গ্যাস চেম্বার থেকে প্রতিদিন শ'য়ে শ'য়ে মৃতদেহ বের করে এনে তাদের হাড় গুঁড়ো করে যারা জমির সার তৈরি করেছে, বা '৪৩তে যুদ্ধের খরচ জোগাতে একটা আস্ত কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে ফেলেছে, তাঁরা বোধহয় হত্যার গ্লানি থেকে এভাবেই বাঁচার চেষ্টা করেছেন। মানুষগুলোকে, মুখগুলোকে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে অস্বীকার করেই।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হয় সমস্ত মুখ বুঝি একরকম। হাজার হাজার, নাম পরিচয়হীন dehumanized entity। হাজার হাজার নাম পরিচয়হীনের ভিড়ে প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকেন হোরাস।

রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে দিন গোনেন। শেষ দিনের আর কত দেরি? মাটির তলা থেকে ভ্যাপসা নিঃশ্বাস উঠে আসে। তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আকাশের ফলে ফুলে টইটুম্বুর স্বর্গ নয়। তিনি পিতৃপুরুষের অন্ধকার মৃত্যুলোকেই ফিরতে চান ।

হাজার হাজার নাম পরিচয়হীনের পায়ের তলায়, যুদ্ধহীন ভ্যাপসা অন্ধকারেই, একফালি মাটির প্রত্যাশী।


1 টি মন্তব্য: