শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

অলোকপর্ণা

 

সমকালীন ছোটগল্প


উইপিং ওম্যান

কী লেখা উচিত আর কী লিখবো না, সে বলে দেয় আমায়।

“এ ব্যথাগুলি নরম, বাসি, এদের নিয়ে গল্প লেখ”, আলমারি থেকে পুরনো জামা কাপড় খালাস করার মত সে আমায় তার আধো গোপন ক্ষতগুলি দেখায়, পাশাপাশি রাখে, তুল্যমূল্য করে। আমি সেগুলি হাতিয়ে নিই অর্ধেক দামে, কখনো বা মাগনায়। সে কথা রোপন করতে এসেছে পৃথিবীতে, ব্যথা বিতরণেও তার জুড়ি মেলে না।

আমি শব্দ খেয়ে বেড়ে উঠি ডগমগিয়ে। নেশায় টলি। ডেঁয়ো পিঁপড়ের একাগ্রতা নিয়ে তার জিভের আড়ষ্টতায় বসবাস করি নিঃশুল্কে। সে হ বললে আমি হট্টবিলাসিনী বুঝি। সে ঊঃ বলে উঠলে আমি ঊর্ধে তাকাই, দেখি সেইখানে পাক খায় কালপুরুষ, সারমেয় সহিত, সদা- সর্বদা উদ্যত, শিকারের লালসায়।

“একবর্ণ লিখবি না! খুব খারাপ হয়ে যাবে এসব যদি লিখে ফেলিস! দিজ আর নট ফর সেল!”, বলে সে গোপনগুলি আমার নজর বাঁচিয়ে রাখে, যদি-বা প্রকাশ্যে আসে,- সে ফের ছিনিয়ে নিজের ডানার আড়ালে টেনে নেয় তাদের, যেন কষ্টেরা তার ছা আর সে আমার শ্যেনদৃষ্টি যুঝে উঠতে না পারা অসহায় পাখিমা।

শব্দের পিম্প আমি, কবেই বা কার বাধ্য ছিলাম। মাটিতে পানের পিক ফেলে, তার ঠোঁট থেকে, কানের লতি থেকে, চুলের ভাঁজ থেকে ছোঁ মেরে রাশি রাশি কয়েন বের করে আনার মতো সারাদিন শব্দ শিকার করি। আর মাঝরাতে তাদের পাচার করে দিই, জলের দরে বেচে দিই বাজারে। কেউ নিতে না চাইলে জোর করে বিনে পয়সায় গছিয়েও দিই অনেক সময়। দান খয়রাত করি। আমার গল্পের উইপিং ওম্যান উমা তখন ঘুমের গোপনে কাঁদে। আমি দূর থেকে তাকে দেখি আর চুষে চুষে ললিপপ খাই। আপেলের, কমলার, আমের নকল স্বাদে স্বাদালো ললিপপ।

তার সঙ্গে আমার এমনই বনিবনা।

আমাদের পিতা

ভাগ্যের ফেরে উমাকে আমি পুকুরপাড়ে বসে থাকতে দেখে ফেলেছিলাম। এলোচুলে। যেসব দুপুরে প্রত্যেকে একা, সেইসব গ্রীষ্মকালীন দুপুরে, লেবুর গন্ধ মাখা বাতাসে সে বসেছিল জলে পায়ের পাতা ডুবিয়ে আর তার পায়ের আঙুল ঠুকরে দিচ্ছিল কুচোমাছ, হয়তো উহাদের আদর এমনই। বুঝি তার বুকে অভিমান ছিল, একরত্তি সদ্যজাত। অনেক হাঁকডাক করার পরেও বিয়েবাড়িতে আগত নতুন পুরুষটি তাকে সেদিন চোখ তুলে দেখেনি। বিয়েবাড়ির মেয়েরা যত্ন করেনি তার তেমন, খাওয়ার সময় দেয়নি আরেক হাতা পায়েস, করেনি পাখার বাতাস, সাধেনি আরেক খিলি পান। তাই উমা হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে আজ পুকুরপাড়ে, দুহাত থেকে গোছা গোছা অভিমান খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে জলের মধ্যে। তার অভিমানেরা জ্যান্ত মাছ হয়ে গেছে শীতল পানির ছোঁয়ায়। মাছেরা খায় মাছেদের, আর নির্লিপ্তভাবে ঘুরে বেরায় এঁদো জলে, কারো কোনো বক্তব্য নেই। যেন কেউ কোনোদিন দেশের-দশের চিন্তা নিয়ে মাথাব্যথা করেনি, মাছেরা এমন। অভিমানও তাই।

- বোবা।

ফিশ একটি মাছ। ফিশ একাধিক মাছও। কিছুতেই বহু হয়ে উঠতে পারে না সে নিজেদের মধ্যে। পুকুরের জল ফিসফিস করে ওঠে দুক্কুরবেলা। আর আমি উমার পাশে গিয়ে বসি।

“যতদিন যাচ্ছে, আমি বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি”, যেন সে চেনে আমায়, জানে আমাকে, এমনভাবে বলে।

আমি কিছুক্ষণ তার মুখ দেখি। যেন তাকে চিনি, যেন সে জ্ঞাত, আমি বলি, “আমাকে তোমার বাবার কথা বলো।”

উমা-শ্যামার বাবাকে রিক্সাওলা ছেঁড়ানোট গছিয়ে দেন। উমা-শ্যামার বাবা বেশি দাম দিয়ে বাজার থেকে আধমড়া পটল, মৃতপ্রায় ধনেপাতা কিনে আনেন। ট্রেনে, বাসে উমা-শ্যামার বাবাকে কেউ বসার জায়গা করে দেয় না। উমা-শ্যামার বাবাও কখনো কারো থেকে অর্থ, অধিকার এমনকি শব্দও, ছিনিয়ে আনতে পারেননি। উমা-শ্যামার বাবার চোখের সামনে দিয়ে অন্যলোকে অটো ধরে চলে যায়, ভালো মাছটা ব্যাগে ভরে ফেলে, টাকা তোলার লাইনে বেদখল জায়গা করে নেয়, উমা-শ্যামার বাবা কাউকে কিছু বলে উঠতে পারেন না। ভরা সমাগমে লোকে তামাশা করে উমা-শ্যামার বাবার মুদ্রাদোষ নিয়ে আর সমাগম জমে ওঠে। উমা-শ্যামার বাবা গুটিয়ে যান। মটরশুঁটি হয়ে থালার একপাশে গড়াগড়ি খান, আর কাগজ পেলেই তাকে এরোপ্লেন করে দেন, ভরে যায় উমা-শ্যামাদের বসতবাড়ি। বাড়িটি কাগুজে বিমানবন্দর হয়ে ওঠে। উমা-শ্যামার বাবা গ্রীষ্মকালের ছুটিরদুপুরে পুকুরপাড়ে এসে বসে থাকেন। আমি উমা-শ্যামার বাবার পাশে এসে বসি।

“যতদিন যাচ্ছে, আমি বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি”, যেন তিনি চেনেন আমায়, জানেন আমাকে, এমনভাবে বলেন।

আমি কিছুক্ষণ তাঁর মুখ দেখি। যেন তাঁকে চিনি, যেন তিনি জ্ঞাত, আমি বলি, “আমাকে আপনার বাবার কথা বলুন।”

জীবন বড়ই সুন্দর

উমার দিদি শ্যামার গায়ে উমার জামাইবাবু প্রথম যেদিন হাত তুলল, উমার মা সেদিন মেয়ে জামাইয়ের জন্য পাকা কাঁঠাল পাঠিয়েছিলেন। মার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর শ্যামা ও তার বর একত্রে খাবার টেবিলে গাছপাকা কাঁঠাল নিয়ে বসেছিল। কাঁঠাল এমন উগ্র ফল যে, তার কোয়ার গন্ধ চেয়ারে বসে থাকা শ্যামার গায়ের জ্বালা যন্ত্রণা অবধি গ্রাস করছিল। শ্যামার বর চোখ বুজে কাঁঠাল খাচ্ছিল আর শ্যামার চক্ষু থেকে জল বেরিয়ে তার কাঁঠালখাওয়া গাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল।

মুখ ভর্তি কাঁঠাল নিয়ে শ্যামার বর এই সময় বলে ওঠে, “জীবনটা সুন্দর কেন জানো? কাঁঠালের কোয়ার জন্য! আহা!”

এসব কথা উমাকে যখন জানানো হয়, উমা উদাস হয়ে প্রাক বিকেলর রক্তশূণ্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কিছু বলে না। হাতের কাছে যে কোনো কাগজ এমনকি সিগারেটের প্যাকেটের রাংতা পেলেও সে এরোপ্লেন বানিয়ে দেয়। এইভাবে উমার গা হাত পা কাগজের ছোট বড় প্লেনে ভরে ওঠে। তার কপালে, কাঁধে, নাভিতে, ঊরু ও পায়ের পাতায় ছোট ছোট সোনালি কাগজের এরোপ্লেন বিশ্রাম নেয়, অবতরণ করে, আর তার দেহ একটি সফল হাওয়াই-আড্ডা। উমা একথা বলে না, তবে সে মনে করে, শ্যামা যেন একটি ফল, হয়তো বা কাঁঠালই, আর তাকে গাছ থেকে পেড়ে এনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে টিফিনবক্সে ভরে তার শ্বশুর বাড়িতে। টেবিলে বসে এখন উগ্রগন্ধি শ্যামাকে চোখ বুজে অল্প অল্প করে খাচ্ছে শ্যামার বর। আর বলে উঠছে, “জীবন বড়ই সুন্দর!”

বিপজ্জনক বাড়ি

গভীর নেশার পর কলকাতার পথে হাত ধরে চলতে চলতে উমা এটুকু বলে থেমে যায়। আমরা তার ছোটবেলার পাড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি তখন। আকাশে একটা রাত দশটার চাঁদ। রাস্তায় একটা পাঁচ মাসের বেড়াল। আমরা রাস্তার বেড়াল ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমরা বাসার বেড়াল ঘাঁটাঘাঁটি করি।

হলুদ ট্যাক্সির ভিতর আমি উমার দিকে চেয়ে থাকি। তার কানের দুল থেকে ঝুলে থাকা শব্দদের দেখি। তার হাতের দিকে হাত বাড়াই। দেখি তার ঘন চুলের ফাঁক থেকে উঁকি মারছে কটা পঙক্তি,

 

“পা টিপে টিপে জেব্রাদাগ বেয়ে

টলোমলো এসে দাঁড়াই কার দোরে,

হে নির্ঘুম,

হাত ধরে চেনাচ্ছো ব্রেইল কলকাতা।”

আমি ছোঁ মারি। উমা আমার কাঁধে তার মাথাটা রাখে। আমি উমার চুলের গন্ধ পাই। আমি উমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখি।উমার ধকধকে আত্মাকে আমি নিজের হাতে ছুঁয়ে ছেনে দেখি, উমা টের পায়না। টের পেলে সে আমায় নির্ঘাত “অসভ্য! ইতর!” বলে দূর করে দিত। এখন আমি যে কাউকে একমুহূর্তে উমার আত্মা স্পর্শ করিয়ে দিতে পারি। এসব নিয়ে শুরুতে যে আমার অপরাধবোধ হত না তা নয়, এমনকি কাঁচা বয়সে আমি ডায়েরিতে লিখেওছিলাম,

"মনে মনে আমি ঘুমন্ত তোমার ঠোঁটে

শেষ না হওয়া কথার মত লেগে থাকা তিল দেখি,

দেখি অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা এলোচুল আর চোখ তার একটু দূরে পড়ে আছে।

ক্লান্ত, নিঃশেষ।

আমার আঙুল অসাড় হয়, নরম নখর,

গোপনে তোমায় দেখে ফেলায়,

মনে মনে।"

উমার চোখ দুটো এসেছে বর্ধমান থেকে ক্যুরিয়ারে। উমার নাক শ্রীরামপুরী। উমার ঠোঁট প্রাচীন উজ্জ্বয়িনী হতে ভূখনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। উমার বুক হুগলী নদী থেকে ভরা বর্ষার ইলিশের সঙ্গে উঠে এসেছে জেলে নৌকোর জালে। উমার তলপেট মেঘনার চোরাস্রোতে ভেসে ভেসে বয়ে গেছে বহুদূর। উমার সুবৃহৎ ঊরু জেগে উঠেছে হাওড়া ব্রিজ ঘেঁষে দিগন্ত আড়াল করে। উমার দেহাংশগুলো কোনোটা কোনোটার জায়গায় নেই। উমার হাতগুলো পিঠে ডানার মতো লাগানো। উমার পা বেরিয়ে এসেছে তার পেট থেকে। উমার গ্রীবা তার পশ্চাতে স্থাপিত। উমার স্তন তার ঊরু থেকে দোদুল্যমান। উমার যোনি ললাটে ত্রিনয়ন। উমা আমার গল্পের উইপিং ওম্যান। সে আমার নয়, উমারা কখনো কারোর না, এমনকি তারা নিজেদেরও না। তবু উমার জঙ্ঘায় মাথা রেখে শুয়ে আমি গভীর রাতে গেয়েছি গান, “হজারো খ্বাহিশে এয়সি কে হর খ্বাহিশপে দম নিকলে…”

সেই প্রথম ঈশ্বর আমার চোখে জল দেখেছেন। সেই একটিবার লিখে উঠে আমি আমার কলমের নিব ভেঙে দিয়েছি। আমি চেয়েছি উমা আমার মাথায় হাত রাখুক। কিন্তু সে হাত সরিয়ে নিয়েছে অচিরে।

ঘনিষ্ঠ হলে আমি টের পাই উমা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নাম লিখতে পারছে না বইতে, সই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সব এলোমেলো। আমি চেয়েছি উমা আমার মাথায় হাত রাখুক। কিন্তু সে হাত সরিয়ে নিয়েছে অচিরে। আমি পিছিয়ে এসেছি।

ঘনিষ্ঠ হলে আমি টের পাই উমা আমার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। আমি চাই উমা আমার মাথায় হাত রাখুক। কিন্তু সে হাত সরিয়ে নেয় অচিরে। আর আমি পিছিয়ে আসি।

উমা নিকটে এলে আমার চোখ বুজে যায়। উমা নিকটে এলে আমার চোখ চকচক করে। পোয়াতি মেঘের মতো উমার গায়ে আমার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে ইচ্ছে হয়। আমি পিছিয়ে আসি। কারণ আমি চাই উমা আমার মাথায় হাত রাখুক। আর সে প্রতিবার হাত রেখেও, সরিয়ে নেয়, অচিরে।

তবু বিপজ্জনক বাড়ি সেজে আমরা একে অপরের নাগালে দাঁড়িয়ে থাকি। ঘাড়ে নি:শ্বাস ফেলি।

আর জীবন, সুতীব্র, সুন্দর জীবন বয়ে যায় আমাদের মাঝখান দিয়ে।

উমাদের গল্পরা

পতঙ্গরা যেভাবে আগুনে ঝাঁপ দেয়, উমা আর আমি তেমন দলবেঁধে আত্মহননের কথা ভাবি। উমা আর আমি স্থির করি একসঙ্গে শান্তিনিকেতন যাবো। উমা আর আমি কলকাতার কোন ক্যাফেতে, কোন রেস্তোরাঁয় অভিনব কোন খাবারের স্বাদগ্রহণ করা যায়, তা ঠিক করি। উমা আর আমি হাঁটতে বেরোই শহরে ছুটির দিনে। উমা আর আমি বৃষ্টির দিনে একে অপরকে মনে করি। উমা আর আমি নিজেদের শহরের উত্তরা ও দক্ষিণী চাঁদের ছবি পাঠাই।- বাসি পূর্ণিমার চাঁদ। উমা আর আমি নেশা করে হাতে হাত রাখি, অন্ধকার রাস্তায় ঠোঁটে ঠোঁট। উমা আর আমি রাত শেষ হয়ে এলে যে যার ডেরায় ফিরে আসি। উমা আর আমি রাত শেষ হলে দুজনে একা হয়ে যাই। উমা আর আমি একত্রে নিঃসঙ্গ।

শ্যামা ফিরে এসেছে মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি। শ্যামার মেয়েকে দেখে আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণার বিউগল বাজে। সাধারণ জ্যোৎস্নার রাতে ছাদে বসে আমরা শ্যামার নজরুলগীতি শুনি। নজরুলগীতি টানেনা তেমন কোনোদিনই, শ্যামার কন্ঠে তা আরোই মলিন শোনায়। ছাদে একফোঁটা হাওয়া নেই। উমা ওর মাথাটা খুলে আমার ঘাড়ে বসিয়ে দেয়। আমি উমার পিঠে মাসাজ করে দিই আস্তে আস্তে। আমি উমার চুল নিয়ে খেলি।

আমার লেখা গল্পগুলো উমাকে উত্যক্ত করে মারে। উমা আতসকাঁচ নিয়ে বসে আমার গল্প পড়ার সময় আর নিজেকে খুঁজে মরে। দূর থেকে ললিপপ খেতে খেতে আমি উমাকে দেখি, আমাদের পিতারা উমাকে দেখে, তাদের পিতারা, তাদের- তাদের পিতারা…

“আমার নিজেকে উদোম লাগে তোর সামনে”

গল্প প্রকাশ পেলে উমা বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে কোনো কথা বলে না। আমি অপেক্ষা করি উমার ফিরে আসার। উমা ফিরে আসে, দেখি তার তলপেট তার মাথার উপর বসানো, হাঁটু তার কান হতে উৎপন্ন হয়েছে। বুঝি উমা নিজের ভোল পাল্টেছে। আমি আবার নতুন গল্প পেয়ে যাই উমার মধ্যে। আমি ফের আমার একটা হাত উমার গলার ভিতরে প্রবেশ করাই আর তার পেট থেকে একপ্যাকেট নতুন গল্প বের করে আনি।

“আমাকে নিয়ে লিখবি না তুই আর!”

একদিন একথা বলায় আমি উমার দিকে চমকে তাকাই। আমার দাঁত নখ খসে পড়ে। অস্ত্রহীন আমার দম বন্ধ লাগে। আমার মৃত্যু হয়। অচিরে।

চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়

লেখা থেমে গেছে ছ মাস হল। আমি উমার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করছি না আর। সে আমার বিষ মেরে দিয়েছে এটুকু বুঝি। উমার বাড়ি গিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা কাগজের এরোপ্লেনগুলোর দিকে বিবর্ণ চোখে তাকাই। প্লেনগুলো কখনো দূরপাল্লায় উড়বে না- একথা জানি।

বন্ধুদের কাছে উমার গল্প বলে বেরাই। তারা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না আমার উইপিং ওম্যান। একবর্ণ লিখতে না পেরে আমি শুধু উমার কথা খই করে ছড়িয়ে দিই কলকাতার পথে ঘাটে।

অবস্থা দেখে শ্যামা একদিন আমায় কফি খেতে ডাকল। আমি আর শ্যামা কফিশপে মিলিত হলাম।

“তুমি কি শব্দের জন্য যা খুশি তাই করতে রাজি আছো?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি।

“অথচ যে শব্দের উপর ভিত্তি করে করে উমা,- তুমি কি জানো যে তারা সর্বৈব মিথ্যে?”

আমি চমকে শ্যামার দিকে তাকাই।

“উমার ঘরের কাঠের দেরাজটা খুলে দেখেছ কোনোদিন?”

মাথা নেড়ে না বলি।

“খুলে দেখো এরপর,”

এরপর থেকেই আমি ওঁত পেতে থাকি। উমাদের বাড়ি গেলে সুযোগ খুঁজি উমার ঘরের কাঠের দেরাজ খুলে দেখার। সুযোগ পাই না। উমা নানা কথা বলে। উমা একেকদিন একেক রঙ। কোলের উপর হাত গুঁটিয়ে বসি।

উমার কাছে ক্ষমা চাইবো কিনা ভাবি। ভাবি তাকে মিছিমিছি বলবো, “উমা, ভালোবাসি”, ভাবি বলবো, “উমা,- তুমি অভূতপূর্ব”, ভাবি বলবো, "জীবন আসলেই সুন্দর", তবে যদি উমা খুশি হয় আর গল্প লেখার অনুমতি ফেরত পাই!

আমার হাত নিশপিশ করে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।

উমার কাছে জল চাই। সে জল আনতে যায়।

ঘরে এখন আমি আর উমার কাঠের দেরাজ।

মাথার ভিতর দপ করে “নরওয়েজিয়ান উড” বেজে ওঠে।

ধীরে ধীরে উমার কাঠের দেরাজ খুলে ফেলি আর দেখি তার মধ্যে থরে থরে আমার, আমার পিতার, তস্য পিতার, তস্য তস্য পিতার, আমাদের সকলের মাথা (যেভাবে কুমারটুলিতে দেব দেবী অসুরের মস্তক শুকোতে দেওয়া হয় সেভাবে) উলটে উলটে সাজিয়ে রাখা আছে। আমি ছিটকে সরে আসি।

জলের গ্লাস নিয়ে উমা ঘরে ঢোকে। অন্য আলোয় তাকে দেখি।

এতদিনে বুঝতে পারি - আমরা চিরকাল একে অপরকে ভক্ষণ করছিলাম। উমা স্বেচ্ছায় তাকে আত্মসাৎ করতে দিয়েছিল, আর আমি অজান্তে উমার খাদ্য হয়ে উঠেছি।

গল্পের হায়না

উমা ঘুণাক্ষরে টের পায়, আমি সব জেনে ফেলেছি।

আমি জানি উমাকে কোণঠাসা করে দিলে সে ছোবল মারবে, নির্মম হয়ে উঠবে আরও। মায়া লাগে আমার। আমি উমাকে রেহাই দিই।

উমা আমায় তার কবিতা পড়ে শোনায়। আতসকাঁচ নিয়ে আমি উমার কবিতা পড়তে বসি। আমি দেখতে পাই কবিতায় সে আমার শিরোচ্ছেদ ঘটিয়েছে। আমি বা আমার মতো অসংখ্য শব্দের পিম্প লক্ষ কোটি বছর ধরে জবাই হয়েছে তার কবিতায়। আমার অস্বস্তি হয়। উমার কবিতার সামনে আমি নগ্ন বোধ করি। শ্যামার কথা মনে পড়ে আমার। নিমেষে উমার শব্দদের অবিশ্বাস করি। উমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই।

বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি আর উমা একে অপরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলি। এ কেমন অদ্ভুত খেলা চলেছে সেই কবে থেকে আমরা কেউ জানিনা। আমাদের দেখে বাকিরা হাসে। আমাদের শুঁকে ছেড়ে দেয় কলেজস্ট্রিটের গল্পের হায়নারা। উমা আর আমি একে অপরের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকি। আমরা পূজাবার্ষিকীর জন্য গল্প ও কবিতা লিখে চলি।

এতদিনে আমাদের যা অনিষ্ট হওয়ার তা হয়েই গেছে।

যতদিন যাচ্ছে, আমরা আমাদের ঔরসে বেড়ে উঠছি। আমরা আমাদের পিতা হয়ে উঠছি, আমাদের পিতা তাদের পিতা, তাদের পিতা তাদের-তাদের পিতা হয়ে উঠছেন। একটি পিতা সমগ্রে পৃথিবী ভরে উঠছে।

আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের আর কোনো নিস্তার নেই।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন