ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি
… শ্রী শ্রী বিনোদিনী দাসী সহায় … থিয়েটার
প্রতি,
থিয়েটারের
মেয়ে? নাকি মেয়েদের থিয়েটার? থিয়েটারের মেয়ে হতেই পারে, এখানে মেয়েদের থিয়েটার হবে
কেন? থিয়েটারকে ছোট পরিসরে নিয়ে আসার আদৌও কোনও দরকার রয়েছে? থিয়েটার যেখানে বৃহত্তর
পরিবার, থিয়েটার মানে যৌথ শিল্পকলা ও মাধ্যম, সেখানে মেয়েদের থিয়েটার, না, না না, থিয়েটারে
মেয়েদের কথা বরং আলোচনা করা যেতেই পারে।
হ্যাঁ,
এই তো সেদিনের কথা বাংলা থিয়েটারের হাল হকিকত নিয়ে গরমা-গরম বিষয়চূর্ণ, হরির চা-সহযোগে
আলোচনা হচ্ছিল। তখনই পাশ দিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে চলে গেলেন গন্ধমাখা এক অভিনেত্রী। থিয়েটার
থেকে ক্যামেরায় গিয়ে কাজ করছেন, এবং সফল তিনি। একটু যেন ভ্রূ-কুঁচকে গেল। থিয়েটার?
ছেড়ে সিনেমায়? আরে দূর, থিয়েটারে ও সিনেমায়
তিনি। এমন সাফল্যের উদারকথা আমাদের আলোচনার। এবং এই সাফল্য একদিনে আসেনি, আমাদের এক রাউন্ড চায়েও আসেনি। তবে,
পর্দার-অভিনয়ে, ক্যামেরার অভিনয়ের সাফল্যের মূল মন্ত্র বা শ্রম, বা আগের অধ্যায় বা
প্রথম অধ্যায় হল -- মঞ্চ, মঞ্চে অভিনয় করা। মঞ্চ, লাইভ অ্যাক্টিং। আর সেটাই তো অভিনয়ের
পালস, নার্ভ তৈরি করে।
এই
ধাপ পেরতে এক শিল্পী বা অভিনেতা-অভিনেত্রীর কত যে সময়, কত যে সাধনা লেগে যায়, তার ইয়ত্তা
নেই। দু-ভাঁড়ের চায়েও এই আলোচনা খেই পায় না। আমরা, পায়ে পায়ে একটা শো দেখতে ঢুকে পড়ি।
সেই শোয়ের মূল উদ্যোক্তার কথা মেয়েদের থিয়েটারের সঙ্গে মিলে যায় না। বরং, থিয়েটারের
মেয়েরা... হ্যাঁ, মিলছে। মনে হল, একটা জীবন ঢেলে দিয়েছেন অভিনয় করতে করতে। ঠিক কিনা?
জানি ঠিক কিনা, বুঝতে গেলে, বা পাঠকের কাছে নিয়ে আসতে গেলে আরও কয়েক ধাপের আলোচনা, লেখালিখি, বক্তৃতা ঘাঁটাঘাঁটি,
এবং আগে-পরের সময়ে হাঁটি হাঁটি করে দেখা যায়। দেখা মানে, এই বক্তব্যের যথার্থতার সন্ধান।
ততক্ষণে...
ততক্ষণে
ফিরে গেছি অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর সন্ধানে। আচ্ছা, একাডেমীতে আজ যদি ঘোষণা হত...
আসছেন আসছেন আসছেন স্বনামধন্যা অভিনেত্রী শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী... আজ অভিনয় করবেন
'শ্রীচৈতন্যলীলা' নাটকে।
সময়ের
ফেরে ফিরে তাকাতে হবে। ফ্ল্যাশব্যাকে আমাদের বিনোদিনীর অভিনয় দেখতে পারি না হয়তো...
কিন্তু বিনোদিনীকে স্মরণ করাতে পারি তো।
না,
গুগুলে জনপ্রিয়তার তুঙ্গ-লম্ফের অভিপ্রায় নেই। নেই সেই মঞ্চের দুটো চারটে হাততালি দেওয়া
অদৃশ্য দৃশ্যমানতা, ভাবুক দর্শক, মদ্যপের এনকোর এনকোর...। রয়েছে ইতিহাসের সিঁড়ি ধরে
নেমে আসা এক আলো।
সেন্টার
স্টেজ-এ আবছা আলো। তেরচা বসা এক মহিলা। আলুথালু বেশবাস। খোলা চুলে পিছলে যাচ্ছে না
হলদে আলো। অপ্রতিভ সব আলো অপেক্ষা করছে... কখন তিনি জাগবেন... জাগাবেন। মনে হচ্ছে তিনি
শোকসাজে রয়েছেন। কিন্তু ভাব ফুটে উঠতে যে মঞ্চ-আলোর সাহায্য নেবেন, তা করছেন না। এমন
করে বসে, যেন সব আলো, শব্দ উপেক্ষা করেছেন। এই ভাবখানা নিয়েই পর্দা উঠেছে। আবহে এসরাজ
বাজছে। কি হয় কি হয় ভাব...। এরইমধ্যে মনে হল প্রথমেই...
এই
চরিত্রের নাম বিনোদিনী হলে? আমাদের উৎকর্ণ দর্শক অপেক্ষা করছেন। আজ বিনোদিনী এসেছেন 'আমার কথা' বলতে। কিন্তু বাইরে তো 'চৈতন্যলীলা'
নাটকের পোস্টার দেখেছিলাম যদ্দুর মনে পড়ছে। এই চৈতন্যের লীলা-র মানে কী তবে?
দু-মিনিট
তো অনেক সময়। কেন এই সময় দেবে এই জেড-যুগের দর্শক? আর কেনইবা সময় নেবেন পরিচালক ও অভিনেতা
বা অভিনেত্রী বা শিল্পী।
এইখানে
তিনটে বেল পড়ল।
প্রথম
বেল। মনে পড়ল...
বিনোদিনী
‘স্টার থিয়েটার’এ যখন ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে চৈতন্যের ভূমিকায়। তখন তিনি কুড়ি কি একুশ
বছরের যুবতী। তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। সেই সময়ে বিনোদিনী বাংলার নাটক জগতে প্রায় দশ
বছর অতিবাহিত করে ফেলেছেন। তাঁকে ডাকা হয় ‘মঞ্চসম্রাজ্ঞী’। সেই সময়ে নামল এই ‘চৈতন্যলীলা’
নাটক।
এই
নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ২ আগস্ট ১৮৮৪ সালে। মাত্র ১৪১ বছর আগে। নাটকে চৈতন্যের ভূমিকায়
অভিনয় নিয়ে প্রথমদিকে বিনোদিনী খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। প্রথম অভিনয়ের আগের রাত্রে
সারারাত তিনি ঘুমোতে পারেননি। এর কারণ? কারণ অনেকগুলো। এক, তিনি সিরিয়াস অভিনেত্রী।
দুই, তিনি এক বিশেষ মনোকষ্টে ছিলেন। যেখানে তিনি পতিতপাবনের কৃপা চেয়েছিলেন। এবং তাঁর
একমাত্র সাধনার ধন... 'অভিনয়'টুকু যেন দর্শকের কাছে তুলে ধরার মতো হয়... এই প্রার্থনা
তিনি করেছিলেন।
একজন
শিল্পী বনাম এক সমাজের মানুষ, তাঁকে একঘরে এক বিশেষ সমাজের অংশ বলে ধরা হচ্ছে... এই
দুই সত্তার দ্বন্দ্বে জর্জরিত... একজন অভিনেত্রী। সেই অভিনেত্রী বিশ বছরের তরুণী থিয়েটারের
মেয়ে। যিনি মেয়েদের থিয়েটারের এক বৃক্ষ। সেই গাছের ডালে ডালে এখন অনেক নাম।
তাহলে,
মেয়েদের থিয়েটার থেকে থিয়েটারের মেয়ে বলা যায় কি অভিনেত্রী নটী বিনোদিনীকে? হ্যাঁ,
ওই যেখানে আমরা আলোচনা করছিলাম...থিয়েটারের মেয়ে হতেই পারে, এখান মেয়েদের থিয়েটার হবে
কেন? থিয়েটারকে ছোট পরিসরে নিয়ে আসার আদৌও আর কোনও দরকার রয়েছে?
থিয়েটার
এক বৃহত্তর পরিবার-সংগঠন, থিয়েটার মানে যৌথ শিল্পকলা মাধ্যম। সেখানে মেয়েদের থিয়েটারের প্রতিনিধি বিনোদিনী? নাকি
আরও যথাযথ হবে একুশ শতকের এই ফিরে দেখা-র পর্বে থিয়েটারের মেয়েদের প্রতিনিধি বিনোদিনী?
এই তো দুটো শব্দের হেরফের... কিন্তু কত পালটে যাচ্ছে কথা।
আমরা
এগোচ্ছি, তাই বিনোদিনী দাসী-র কথা... ১০৮ বার লিখুক, না, ১০৮ কোটিবার লিখবে আগামী পৃথিবী...
সেকথা বরং আলোচনা করা যেতেই পারে। শেষে তাই, শ্রী শ্রী বিনোদিনী দাসী সহায় … থিয়েটার
লেখাই যায়। কারণ, তাঁর নামে নাটক নামালে এখনও বিক্কিরি … হাউজফুল!
তাতে,
কোনওজন আশীর্বাদ করে লিখবেন, হে জাতি চৈতন্য হোক… এই তো সংস্কৃতির লীলা। বা জাতির চৈতন্যলীলার নাটকের অন্তহীন চলা।
_
ইতি
একুশ
শতকের ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্বাধিকারী…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন