বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

অদিতি ফাল্গুনী

 

সমকালীন ছোটগল্প


ক্রুদ্ধ পরীর গল্প

In the glen where shadows dance,\

Fairies weave their mystic chance,

Softly whispering to the trees,

Entwined in the evening breeze.

গুলশানের অফিস থেকে ধানমন্ডি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা প্রায়ই পার হয়ে যায় ডরোথীর। আজ কলিং বেল টিপতেই যে দরজা খুলে দিল সে ডরোথীর বড় দিদি নয়- বড় দিদির বরও নন- এক বছর চোদ্দর দীর্ঘকায় কিশোর, শ্যামলা মুখে কাটা কাটা নাক-চোখ- দরজা খুলে দিয়ে ডরোথীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, কেমন আছো তুমি?

ডরোথী অবাক হতে গিয়েই দ্যাখে কিশোরের পেছন পেছন... ওহ্ নীপাবৌদি... হায় হায় - ওনার ছেলেরা এত বড় হয়ে গেলো কখন? বড়দিদি ক্রিস্টিনা - ক্রিস্টিনা অধিকারীর দেবরের ছেলে - দেবর কয়েক বছর আগে অকালে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। নীপাবৌদি কিশোরগঞ্জে তাঁর বাবার বাড়ির ওখানেই স্কুল পরিদর্শকের চাকরি করেন। মাঝে মাঝেই কখনো বদলী করে যেন দূরে কোথাও পোস্টিং না দেয় বা তাঁর বড় ছেলের অসুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখাতে আসেন- না, শুধু বড়ছেলে না- ছোট ছেলেরও অসুস্থতা ছিল- তখন ডরোথীর উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা বড় বোনের কাছে তদ্বির করাতে আসেন। বেচারী বিধবা মহিলা! ডরোথীর একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। গত তিন/চার বছর ওরা আসেনি- এর ভেতরেই বাচ্চা দু’টো এত  বড় হয়ে গেলো? এ মনে হয় বড় ছেলেটি।

’নীপাবৌদি - কেমন আছেন? এই বুঝি বড় ছেলেটা, আপনার এত বড় হয়ে গেলো?’

’না- এ ত’ ছোটটা। বড়টাই ত’ ছোটটার মত মাথায় লম্বা হলো না। ওর যে জন্ম থেকে কিডনীর সমস্যা-   পায়েও সমস্যা।’

নীপাবৌদির চোখে অল্প-স্বল্প অশ্রুবিন্দু টলমল করে। ভদ্রমহিলার চোখে সার্বক্ষণিক অশ্রু।

’ওহ্- ও ছোট? ওর নাম যেন ছিল?’

’ডাকনাম ত’ বুলু আর বড়টার ডাকনাম মিলু।’

’হ্যাঁ-বুলু বাবা- কেমন আছ?’

’ভাল আছি, ডরোথীমাসী। তুমি কেমন আছ?’

’এই ত’ বাবা!’

দিদির শ্বশুরবাড়ির সবার ভেতর এই নীপাবৌদি নামে ভদ্রমহিলার জন্য সবচেয়ে বেশি সমব্যথা বোধ করে  শায়লা। এত অল্প বয়সে বিধবা হয়ে কী যে এক পরিস্থিতি! তাতে বাচ্চা দু’টো বেশ অসুস্থ ছিল ছোটবেলা থেকেই। কেন অসুস্থ সেই কারণও একবার নীপাবৌদিই বলেছিলেন, ’আমার বড় ছেলেটার জন্ম থেকে  হাঁটায় সমস্যা। চোখ একটা ট্যারা- কান একটা নাই। তাতে কিডনীর সমস্যা। ওর বাবা আমাকে জোর  করতো- বাচ্চা হবার আগের মাসেও যদি জোর করে?

’থাক- থাক- বৌদি! মোটামুটি চির অবিবাহিতের জীবন পার করতে চলা ডরোথী থামিয়ে দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা কেঁদেছিলেন। বড় দিদির নিজেরই বিয়ে ভাল হয়নি। তার শ্বশুরবাড়ি নিজেদের অনেক কিছু গোপন করায় ডরোথীরা সরল মনে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে দেবার পরই কেবল তারা জানতে পারে যে বড় দিদির শ্বশুরের দুই বিয়ে ছিল। নীপা বৌদি বড় দিদির আপন শাশুড়ির ঘরের দেবর নন। নীপবৌদি কিন্তু কিশোরগঞ্জের বেশ ভাল ঘরের মেয়ে। তবে আজকাল কিনা মেয়েদের পড়া-শোনা শেষ করে, চাকরিতে ঢুকতে ঢুকতে কিছুটা বয়স হয়ে যায়। তখন খুব ভাল বিয়ে অনেক সময় হয়ও না। নয়তো নীপাবৌদির মত মেয়ের বড়দির দেবর কিশোর দা’র ভাইয়ের মত কারো সাথে বিয়ে হবার কথা না।

ডরোথীদের এ বাসায় বাবা-মা বেঁচে থাকার সময় ছিলেন। তাঁরা চলে গেলেন আর চার আপন ভাইই থাকে দূর পশ্চিমে। এক ভাই থাকে ঢাকাতেই- আধা মাইল দূরত্বে; তার নিজের পরিবার নিয়ে। ডরোথীর ইমিডিয়েট বড় মার্গারেট উত্তরায় তার প্রাইভেট ভার্সিটির ক্যাম্পাস কোয়ার্টারে থাকে। মার্গারেট বিয়ে না করায় ডরোথীও বোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখন মোটামুটি চির একাকীত্বের পথে। তবে এ নিয়ে মন খারাপ হবার চেয়ে তার নির্ভার বোধই বেশি। অফিসের সময় বাদ দিয়ে ছবি আঁকা (কয়েকটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তার), ভায়োলিন বাজানো বা স্প্যানীশ ভাষা কোর্স নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই তার ভাল লাগে। ঘরে মানুষ বলতে এখন ডরোথী, বড়দিদি এবং তার বর। বড় দিদির দুই ছেলেও এখন বিদেশে পড়া-শোনা করছে।

‘নীপাবৌদি- এ তাহলে আপনার ছোটছেলে বুলু? এত বড় হয়ে গেল কখন?

’বড় হইতে কি আর সময় লাগে? নীপাবৌদি হাসেন। মাথায় তত লম্বা নন। একটু মুটিয়েও গেছেন। তবু সবসময়ই ভারি স্নিগ্ধ একটি চেহারা যেন।

’আর বড়ছেলে কই?

’এই যে খালা আমি! বড় ছেলেটি আসে। দেখে মায়া হয়। এই ছেলেটিও বড় হয়েছে। তবে ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেঁটে। হাঁটেও একটু টেনে টেনে।

’ওর কি হয়েছে?’

’কি আর হইব? ওর কিডনীতে একটা অপারেশন করতে হবে। চলেন- আপনার ঘরে গিয়া বসি। নাকি এখন রেস্ট নেবেন? ফ্রেশ হবেন?’

’আরে- না- আসেন। কত দিন পর আসলেন!’

(২)

আমার কপালটা বুঝলেন এত খারাপ হবে কেউ ভাবে নাই। দুই ভাই, এক বোন- সবার বড় আদরের ছিলাম। বিয়া না করলেই বরং ভাল থাকতাম। কিন্তÍ ঐ যে সমাজে একটা বয়সের পর বিয়া না করলে বা বিয়া না হইলে এত বাজে কথা হয়- গায়ে একটা মশা উইড়া আইসা বসলেও মেয়ের চরিত্র খারাপ- আর বিয়ার পর থেকেই শুরু হইলো আমার দূর্দিন। আপনাদের কিশোরদা ত’ মইরা বাঁচছে, আমার কপালে-  ছোট ছেলেটার ছোটবেলায় পেট খারাপ বা জ্বর-জারি লাইগা থাকতো তয় এখন ভাল হইয়া গেছে। কিন্তু  বড় ছেলেটা- ওর প্রস্রাবের সমস্যা। মাসে দশহাজার টাকার ডায়াপারই কিনতে হয়। স্কুল ইন্সপেক্টরের  চাকরিতে কত টাকাই বা বেতন? মা-বাবা মরছে। দুই ভাই আমারে ভালবাসলেও ভাই বউরা... এখন ময়মনসিংহ শহরে বাসা ভাড়া নিয়া আছি। আমার ডিউটি আবার নরসিংদিতে। রোজ ট্রেনে যাওয়া-আসা করি। কখনো কখনো দু/তিন দিন নরসিংদিতেই থাকি। ওরা দুই ভাইই নিজেরা নিজেরা থাকে। ওরা এখন পাউরুটি-ডিম, ম্যাগী নুডলস, খিচুড়ি, ডাল-ভাত-মাছ ভাজা... সব নিজেরাই করতে পারে। বিশেষ কইরা বড়টা।’

’তাই?

’হ্যাঁ- বড়টা পড়াতেও ভাল।’

’নীপা- ডরোথী - তোমরা খেতে আসো!’ বড়দিদি দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।

(৩)

আজ শুক্রবার নীপাবৌদি তার বড়ছেলে আর ভাসুর বা ডরোথীর বড় বোনের বরের সাথে সকালেই চলে গেছেন এক প্রাইভেট হাসপাতালে। সারাদিন চলবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সব ভাল থাকলে কালই ছেলেটির একটি ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি হতে পারে। ডরোথীর বড় দিদির আজ অফিস নাই। যথারীতি রান্নাঘরে। ডরোথী ভাবছিল মাত্রই তার ভায়োলিন নিয়ে বসবে। এরই ভেতর নীপাবৌদির ছোটছেলে বিলু ডরোথীর রুমের সামনে উঁকি দেয়।

’আসব?’

’আরে- হ্যাঁ- এসো। বসো। কোন্ ক্লাসে যেন পড়ো তুমি?’

’আমি এইটে আর বড়দাদা টেনে।’

’হুম। তুমি ত’ এই বয়সেই অনেক লম্বা হয়ে গেছো।’

’আমি কি ছোট নাকি? আর তুমিও ত’ খুব সুন্দর!’

’আরে- দূর- আমি তোমার মাসী হই জানো ত’?’

’হ্যাঁ- কিন্তু তুমি অনেক সুন্দরী ডরোথীমাসী!’

’দূর পাগল ছেলে!’

’তুমি দেখবে মাসীমণি যে আমি তোমার চেয়ে কতটা লম্বা?’

’তা’ ত’ হতেই পারো। ছেলে-মেয়েরা এ বয়সেই যা লম্বা হবার হয়।”

’মাসীমণি- তুমি কি চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরো?

’ওমা- তুমি কন্ট্যাক্ট লেন্সের কথা কি করে জানো- এইটুকু ছেলে? না- আমি পরি না। কিন্ত তোমার এমন কেন মনে হলো?’

’আমি মোটেও এইটুকু ছেলে না। আমার বয়স চোদ্দ।’

’চোদ্দ? ওরে বাবা- তাহলে ত’ তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো!’ বলেই হাসিতে ফেটে পড়ে ডরোথী।

’এভাবে হাসছো কেন মাসী? তবে হাসলে তোমাকে আরো সুন্দর লাগে।’

এবার ডরোথী একটু বিব্রত হয়। ছেলে লম্বায় পাঁচ আট ছাড়িয়ে গেছে। গালে হাল্কা দাড়ির আভাস।

’আচ্ছা- তুমি আর কিছু বলবে? আমি এখন একটু ভায়োলিন বাজাব।’

বুলু সে কথার উত্তর না করে ডরোথীর ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।

’তোমার আঙুলগুলো খুব সুন্দর, খালামণি! কোন্ রঙের নেইলপলিশ তোমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে?’

’বুলু- এবার তুমি আসো, বাবা। আমি বলছি না একটু ভায়োলিন প্র্যাক্টিস করব এখন?’

বুলু এবার ডরোথী বেডরুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। হায় যিশু- ওখানে যে রোদে তার ব্রা শুকাতে দেওয়া হয়েছে।

’বুলু!’

ডরোথী প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে সাথে সাথে ব্যালকনিতে গিয়ে কোনমতে পাশের একটি বড় তোয়ালেতে ব্রা ঢেকে দ্যায়। তার এই ব্যালকনিতে বাড়ির ছুটা বুয়া ছাড়া কেউ আসে না।

’এখানে কি করছো তুমি? যাও- টিভি রুমে গিয়ে টিভি দ্যাখো।’

’এমন করছো কেন? এখানে কত সুন্দর বাতাস।’

’না- তুমি এক্ষণি এখান থেকে যাবে।’ ডরোথী আরো রেগে যায়।

’তুমি এত- এত রাগছো কেন মাসী? তোমাকে এই শাদা জামাটায় একদম পরীর মত লাগছে। তুমি এত রাগছো কেন? আমাদের না কেউ ভালবাসে না- আমাদের বাবা নেই ত’!

ডরোথী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে কি কিছু ভুল বুঝেছে? ছোট দুটো বাচ্চা- আর সেসময় দমকা হাওয়া এসে ডরোথীর বুকের ওড়না উড়িয়ে নিলে সে স্পষ্টত: দেখতে পায় যে বুলু তার বুকের দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে। বাচ্চা না ছাই-

’এই- তুমি এখন যাও ত’ একটু- বলছি টিভি রুমে যাও!’

’আচ্ছা- ঠিক আছে, যাচ্ছি!’

বড়দিদি বোধ হয় ডরোথীর জোর গলা শুনেই ঘরে ঢোকেন, এ্যই তোর কি হয়েছে? এত জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন?’

’বিকজ হি সাডেনলি হ্যাজ এন্টারড ইনটু মাই ব্যালকনি এ্যান্ড মাই আন্ডারগার্মেণ্টস ওয়্যার গেটিং ড্রায়েড ইন দ্য সান।”

’ওহ- বুলু- চলো বাবা- টিভি রুমে যাই আমরা!’

’তুমি এত কড়া কেন মাসী? সবসময় এত রাগ কেন তোমার? গজগজ করে বুলু। বড়দিদিও সাথে তাল ঠুকে ঠুকে পা বাড়িয়ে, ড্রয়িংরুমে চলে যায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন