বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

বাসব দাশগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


অন্ধকার ও মেঘের সংলাপ

যা ভয় ছিল, ঠিক তাই ঘটলো। দুপুরের শেষাংশে হালকা মেঘ ক্রমে ঘন, পরে মেঘের বর্ণ ধূসর থেকে কালো,  ক্রমে গাঢ়‌ কালো হয়ে অস্পষ্ট ছায়ায় ঢেকে দিল দৃশ্যমান চরাচর, চন্দ্রপুলি গ্রাম। নামে‌র সঙ্গে গ্রাম শব্দটির  সংযোগের এখন আর কোন কারণ নেই। বলা চলে‌ শহরতলী, এই জনপদে বর্তমানে শহরের মিশেল যতটা‌ আছে তার কিয়দংশও গ্রামের ছোঁয়া নেই। শুধু চন্দ্রপুলিতে এরকমটা তা নয়, পশ্চিম বাংলার যে জনপদগুলোকে গ্রাম বলে চিহ্নিত করা হয় তাদের অধিকাংশই এমনই। কেবল নামের সঙ্গে জুড়ে আছে একটা স্মৃতি। কবে এখানে গ্রামের সুবাস বইতো‌, খুঁজে ‌পাওয়া যেতো তারাশঙ্কর কিংবা বিভূতিভূষণের গ্রামকে,  খড়ের চালের ঘর, বলদে  লাঙল টানা, সেসব স্বাভাবিক ভাবেই বিস্মরণের অতল গভীরে হারিয়ে গেছে। সেসব যারা দেখেছেন‌, যতই মানুষের আয়ু ‌বাড়ুক, তাঁরা প্রায় কেউই আর এ‌ পৃথিবীতে নেই। হয়  কোনো কোনো বাড়ির দেয়ালে সাদাকালো ফোটোগ্রাফ‌ হয়ে ঝুলছেন অথবা সামান্য কয়েকজনের মনে অতীতের অনেক কথার মতো মানুষগুলোর স্মৃতি  থিতিয়ে পড়েছে। অবরেসবরে কোন উপলক্ষকে নিয়ে‌ যখন তুলনামূলক আলোচনা হয়, তখন আবছায়া হয়ে যাওয়া স্মৃতিতে‌ টান লেগে প্রসঙ্গক্রমে সেসব কথা উঠে‌ আসে। নচেৎ কেইবা মনে‌ রেখেছে এই অঞ্চলের মেয়েবউরা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অসাধারণ পিঠে তৈরি করতে পারতেন। তাদের দক্ষতা এমন  শীর্ষে পৌঁছেছিল যে লোকমুখে ‌এই অঞ্চলের আদি নাম বদলে চন্দ্রপুলি হয়ে গেছিল। শীতের দুপুরে ঘরে ঘরের মেয়েবউরা কুরানো নারকেল, চালের গুঁড়ো, দুধটুধ নিয়ে ‌বসে যেতেন। নারককেল‌ কোরাকে ভালো করে শিল-নোড়াতে বেটে নিয়ে গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে কাঠের উনুনে জ্বাল‌ দিয়ে হালুয়ার মতো পুর বানিয়ে সামান্য ময়দা-নারকেল কোরা-গুড় দিয়ে গুটি তৈরি করে লুচির  মতো বেলে তার মধ্যে পুর  ঢুকিয়ে বাঁশের ধারালো চটা দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে‌ তেলে ভেজে রসে ফেলে নিপুণ দক্ষতায় পিঠে বানাতেন। কী স্বাদ ছিল তার! একবার মুখে ফেললে সে স্বাদ জন্ম জন্মান্তরেও ভোলা যেত না। চন্দ্রপুলি পিঠে। আপাতত সেসব কথা থাক, বর্তমানে আমরা ফিরে আসি শাহাদাত শেখ বা‌ খোকার কথায়। বাংলাদেশের মতো ‌এখানে মূল নামের পিছনে ডাকনাম জুড়ে দেবার প্রথা চালু হয়নি। পাড়ার লোকেরা যাকে খোকা বলে চেনে ইস্কুলের সহপাঠীরা তাকেই শাহাদাত বা শাহাদাত শেখ নামে ডাকতো। আপাতত  সে সুঠাম যুবক, ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ, রোগা গড়ন। চোখ দুটি উজ্জ্বল, কথা বলা, একমাথা ঝাঁকড়া চুলে মুখটা দেখলে মায়া লাগে। আজ আকাশে ঘনায়মান  মেঘের উপস্থিতি সত্ত্বেও সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত সে।

এমনিতে খোকা পাড়ায় তার সমবয়সীদের সঙ্গে এখন খুব একটা সময় কাটায় না।‌ নিজের মতো থাকে। শৈশবে ভালো ফুটবল খেলতো।‌ সেন্টার ফরোয়ার্ড।‌ অনেক গোল করেছে পাশের গ্রামের সঙ্গে ম্যাচে। এই অঞ্চলে সেরা খেলোয়াড় ছিলেন ছোটন মল্লিক, কলকাতায় বেশ কয়েক বছর খেলেছেন। প্রথমে ওয়াড়ি, পরে জর্জ টেলিগ্রাফ এবং এক বছরের  জন্য মোহনবাগান। যদিও  বড় টিমের হয়ে  লিগে একটিমাত্র ম্যাচে চান্স পেয়েছিল। তেমনি কিছু করতে পারেননি। কিন্তু ব্যাঙ্কে গ্রুপ ডি-র চাকরি তাঁর  চূড়ান্ত সাফল্য। তবু তিনি চন্দ্রপুলি পিঠের মতই এই গ্রামের  গর্ব, এখনও লোকে তাঁর নাম মনে রেখেছে। মৃতুর পর ছোটন মল্লিক চ্যালেঞ্জ কাপের সূচনা। চন্দ্রপুলি ক্লাবের হয়ে ঐ প্রতিযোগিতায় একটি খেলায় শাহাদাত শেখ  বেস্ট প্লেয়ারের পুরস্কার পেয়েছিল। শিয়ালদা স্টেশন  থেকে বেরিয়ে  মহাত্মা গান্ধী রোডের  ফুটপাতের পাশের সার দেয়া খেলাধুলার সরঞ্জাম বিক্রির দোকান থেকে কেনা কাপটা এখনও তার বাড়ির দেয়ালের কুলুঙ্গিতে সাজানো আছে।

সময় যায়, পরিস্থিতি বদলায়, মানুষ আর আগের মতো থাকে না। নদী খাদের গভীরতা কমে, বন কেটে বসত তৈরি হয়, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একজন খেলোয়াড়ের মন খেলা‌ থেকে সরে যায়‌ অন্য দিকে। খোকা যখন খেলা থেকে অন্য দিকে বেশি উৎসাহ পেতে থাকে তখন ক্রমেই মাঠে যাওয়া আর ভালো লাগে না তার। সেসব অবশ্য বেশকিছুদিন আগের কথা। আজ আকাশের দিকে মুখ তুলে সে ভাবতে চেষ্টা করছিল এই মেঘে বৃষ্টি কি নামবে? ক্রমে বোঝা যাচ্ছে মেঘ আরও জমাট বাঁধছে, চন্দ্রপুলি গ্রামের চন্ডীমন্ডপের টিনের ছাদের উপর বৃষ্টির টুপটাপ হালকা‌ শব্দ শুরু হলো। খোকার মুখে আরও কালো অন্ধকার মেঘের ছায়া, বিষণ্ণতা। এতো পরিশ্রম সব পানিতে ভেসে যাবে?

একবার টিনের ছাদের অংশ থেকে পাকা ছাদের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো সে। এখানে এই পাকা ছাদের নিচে  তথাকথিত গ্রামের বারোয়ারি পুজোআর্চা হয়। দুর্গা, কালি,  ধর্মঠাকুর  আর বছরে দুবার তিনদিনের কীর্ত্তনের আসর বসে। এখানেই তখন দুবেলা নিরামিষ খাওয়াদাওয়া গোটা গ্রাম এমনকী পাশের গ্রামের অনেকেই এখানে পাত পাড়ে। যদিও তাদের কেউ বারণ করেনি তবু খোকাদের আব্বা, চাচারা কেউ ওখানে খেতে যেতেন না। খোকার ভাই ওদের সমবয়সীদের সঙ্গে ওখানে খেতেটেতে যায়।  প্রায় হাজার দেড় হাজার লোকের পাত পড়ে দুবেলা। গ্রামের ছেলেরা খাবার পরিবেশন করে, যদিও পরিবেশনকারীদের  মধ্যে কোনো মুসলমান ছেলেরা থাকে না। এ যেন অলিখিত নিয়ম, দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

এমনি সময় এখানে ছেলেপেলেরা সকাল বিকেলে আড্ডাটাড্ডা মারে। বিড়ি সিগারেট টানে। অতি মনোযোগে মোবাইল দেখে। আপাতত সেসব কথা থাক, আমরা ফিরে আসি খোকা শেখের কথায়। সে এখন অস্থির, ভিতর বাইরে করছে। যেখানে পুজোর প্রতিমা বসে সেখানে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে সাদাচাদর ঢেকে তার উপর একটা ফোটোগ্রাফ, একটা মালা, রজনীগন্ধার। সামনে একগোছা ধূপ জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়ার গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ মিলেমিশে একাকার। দূর থেকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে গ্রাম মন্ডপে আরও কয়েকজন অপেক্ষা করছে। সতরঞ্চির উপর বসে। নির্বাক অপেক্ষা করছে।‌

এই মুহূর্তে খোকা ভাবছিল, এতো কাঠখড় পুড়িয়ে শোক সভাটা এখানে করে তার উদ্দেশ্য কি সফল হবে? কম বাধার সামনে তো তাকে পড়তে হয়নি। বোঝা যাচ্ছিল এখনকার সময়ে লোকের মুখের কথা আর কাজের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এমনিতে সে বা অন্য কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা দুর্গা মন্ডপের ভিতরে আড্ডা দেয় না। সামনে টিনের ছাদ ঢাকা অংশ পর্যন্ত ওদের যাতায়াত। কিন্তু মজাটা হচ্ছে, আদতে এটা মন্ডপ কাম ক্লাবঘর। এমন কী পুজোর সময়ে যেখানে প্রতিমা বসে তার পাশেই এখন রঙিন একটা টিভি সেট। তবে কী খোকারা একেবারেই কোনদিন ভিতরে পা রাখেনি, ব্যাপারটা‌ তেমনও নয়। ক্যারাম বোর্ডটাকে‌ বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচাতে ভিতরেই রাখা। সকলেই স্ট্রাইকার চালায় ওখানে দাঁড়িয়ে। কোন আপত্তি কেউ করেনি। এখন আর সময় পায় না খোকা। বছরখানেক আগেও সে এখানে দাঁড়িয়ে ক্যারাম খেলেছে। তবে নৈমিত্তিক নিয়মে একটা রঙিন ‌টিভি চলতেই থাকে। সিরিয়াল, খেলা ইত্যাদি টিভিতে চললে সকলে মোবাইল দেখতে দেখতে একঝলক টিভি-র দিকে তাকায়। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হরনাথ চক্রবর্তী, সেক্রেটারি ধনঞ্জয় মন্ডল এদিকে প্রয়োজন ছাড়া আসে না, ছোটরা বিড়ি সিগারেট টানে। দরকারে ওনারা কাউকে ডেকে পাঠান বুড়ো বটতলায়, ওখানে বয়ষ্ক লোকদের প্রতি বিকেলে জমায়েত। মন্ডপটার দখল নিয়েছে ছেলে ছোকরারা,  ক্লাব তৈরি করেছে। গ্রামে ফুটবল খেলাটেলা উঠে গেছে। তাতে অবশ্য খোকার কিছু যায় আসে না। বেশ কিছুদিন হল খেলাধুলায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে খোকা, এখন এসব আর ভালো লাগে না তার। অন্যদিকে তার মন।

উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে সহজলোভ্য বাংলা অনার্স নিয়ে পড়তে গিয়েই‌ চরম ফেঁসে গেল। সেখান থেকে নিজে লেখার চেষ্টা, কয়েকটা পত্রিকায় লেখা ছাপা এবং কয়েকজনে মিলে একটা পত্রিকা প্রকাশ। বাংলা  এবং বাংলা সাহিত্যের হালকা থেকে তীব্র সংক্রমণ। টিউশনির টাকা, চেয়েচিন্তে আনা অর্থে প্রকাশিত কাগজটা হাতে নিয়ে খেলায় গোল করার থেকেও অনেক বেশি আনন্দে সে যে ভেসেছিল তার থেকে এখনও সে মুক্তি পায়নি। এখনও ভাসছে। ওই পত্রিকার প্রথমসংখ্যা হাতে দিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যার জন্যে লেখা চাইতে গিয়ে প্রথম দেখা সাহিত্যিক শহীদুল আলমের সঙ্গে । সাহিত্য জগতে তাঁর নাম পরিচিত। প্রায় পঞ্চাশ বছর লেখালিখি করছেন। নিজের চিন্তায় স্পষ্ট। সোজাকথা‌ দুমদারাক্কা বলে দেন। এরজন্য তিনি অনেকের অপছন্দের। খোকা এর আগেই শহীদুল আলমের লেখা পড়েছে। বুঝেছে অন্য ধরনের লেখক। লেখার একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। সব সময়ে বৃহত্তর একটা ভাবনা কাজ করছে ওনার সৃষ্টির মধ্যে। বোঝা যায় যারা বেশি সংখ্যক পাঠকের তুষ্টির জন্যে লেখেন, ইনি সেই দলের নন।

খোকা কেন শহীদুল আলমের এতো কাছে, এতো দ্রুত চলে এলো? সে কী শুধুই বয়সে অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও চিন্তার মিল, সে কী কেবলই একজন সিনিয়র লেখকের তীব্র আকর্ষণের ক্ষমতার জন্য, অপরকে প্লাবিত করে দেয়ার মতো পার্সোনালিটি থাকার জন্য? ঠিক‌ বুঝতে পারে না সে। এটুকু সে বোঝে নিজে এবং শহীদুলদা পরস্পরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে এক অসমবয়সী বন্ধুতা। এটাকে কী বন্ধুতা বলে? নাকি ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা বেয়ে গুরু শিষ্যর সম্পর্ক। বাউল ফকিরদের ভিতরে যে পরম্পরা বহমান! কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো এমন ছিল না, যে একজন ঊর্দ্ধতলে অন্যরা তুলনায় নিম্নে অবস্থিত। কোনদিন শহীদুলদা, কোনো কম বয়সীদের সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা করেননি। লেখা পড়ে জুনিয়রদের ‌মতামত চেয়েছেন, শুনেছেন গুরুত্ব দিয়ে। কম বয়সীদের লেখা সব সময়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ে আলোচনা করেছেন। তবু একটা ভাবনা এই  হালকা বৃষ্টির শব্দময় বিকেলে খোকার মনে‌ আসছে, তাদের এতো তাড়াতাড়ি নৈকট্যের কারণ কী সংখ্যালঘু হিসেবে দুজনের কোথায় একটা‌ নিরাপত্তার অভাব, একটা গোপন কিন্তু নিশ্চিত অনিশ্চয়তা? কেউ না বুঝলেও যেটা সংবেদনশীল সংখ্যালঘুরা ঠিকই বুঝতে পারে।

বেশ মনে আছে আজ থেকে বছরখানেক ‌আগে এমনি এক বিকেলে, শহীদুল আলমের বাড়িতে, সেদিন মারাত্মক কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিল, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। ওরা দুজন বসার ঘরে লেখার টেবিলের এ পাশ ও পাশে বসে। কথা হচ্ছিল বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। শহীদুলদা বলেছিলেন, কী অমূল্য ঐতিহ্য আমাদের ধ্রুপদী ‌সাহিত্যে, সেসব‌ কথা। কথা বলতে বলতে হঠাৎই ‌অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া ওর স্বভাব। কী যেন চিন্তা ‌করতে‌ থাকেন গভীরভাবে। অথচ‌ কোনো ভড়ং নেই। কয়েক বছর লেখালিখিতে থাকার জন্য খোকা কম লেখক কবিকে কাছ থেকে দেখেনি! তরুণ লেখককে সামনে‌ পেলে তারা এমন ভাব করেন যেন, যেন কোন মহামানব। পৃথিবীতে বসবাস করা এক ফরিস্তা। সে রকম কোনো ব্যাপারস্যাপার শহীদুল আলমের নেই।

সেদিন সেই ঝড় বাদলের সন্ধেবেলা ইলেক্ট্রিক কারেন্ট দপ্ করে চলে যাওয়ার পর ভাবি চা মুড়ি দিয়ে গেল, টেবিলের  থেকে একটা বই টেনে তার উপর। টেবিলের উপরে এতো  বই যে এ ছাড়া‌ উপায়ও নেই। খোকা জানে এর প্রায় প্রতিটি‌ বই শহীদুলদা পড়েন, চাইলে মতামত দেন। প্রতিদিন, যদি কোনো কাজে না বেরিয়ে যান শহীদুল আলম, তরুণ লেখকরা আসে। আজ এই ঝড়বৃষ্টির পরিস্থিতিতে আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই বলে না, দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি, এমন অবস্থা। করবো করবো করে সেদিন প্রশ্নটা করেই ফেলল  সে, এটা নিয়ে ‌অনেক ভেবেছে সে, উত্তর পায়নি।

‘আপনি তো গোড়া থেকেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তবু দলে যতটা গুরুত্ব আপনার পাওয়া উচিত তা পেলেন না কেন? বিভিন্ন সময়ে লেখক কবি হিসেবে যাদের নাম প্রথম সারিতে বলা হয়‌ তাদের মধ্যে আপনার নাম থাকে না কেন? ‘শহীদুল কী যেন একটা কথা ভাবছিলেন। প্রশ্নটা শুনে সশব্দে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর একটুক্ষণ চুপ। ধীরে বললেন, আমি ঠিক এ প্রশ্নের ‌উত্তরটা জানি না। তবে একটা‌ জিনিস অনুমান করতে পারি, কিন্তু সেটা যেহেতু নিশ্চিত নয় তাই বলা ঠিক হবে না।

সেদিন তরুণ লেখক শাহাদাত শেখ নাছোড়। সে এই প্রশ্নের উত্তরটা না নিয়ে ছাড়বেই না। বলল, ‘বলুন না, এখানে তো আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই। আপনি তো আমাকে জানেন, আমি এসব কথা কখনোই কাউকে বলবো না।’ আরও কিছুক্ষণ চুপ শহীদুল আলম। দুজনের একটা সংকটময় সাধারণ যোগসূত্র যেন পরস্পরকে ক্রমেই আরও নিকটবর্তী করে তুলছে। কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠতে একবার তিনি বলেছিলেন,  কোনো দেশে ধর্ম কিংবা বর্ণ ব্যবস্থার সংখ্যালঘুদের মানসিক অবস্থা যে কী ধরনের দুঃখজনক হতে পারে তাই একমাত্র সংখ্যালঘুরাই বুঝতে পারে। অতি সংবেদনশীল মানুষরা অনেকটা আন্দাজ করতে পারে কিন্তু পুরোটা বুঝতে পারে না। একটা আপাত ধূসর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিতরে কতটা জটিলতা কাটাকুটি থাকতে পারে‌ তা সত্যিই উপরিতলের স্থিতাবস্থা দেখে বোঝা যায় না।

‘আমার ঘরটা দিকে তাকিয়ে দেখ। বাপঠার্কুদার আমলের পুরনো বাড়ি। দেখছো তো দেয়ালে ড্যাম্প ধরে গেছে। এখন গ্রীষ্মের সময়, তাই ঠিক বুঝতে পারবে না। বর্ষাকাল হলে‌ দেখতে, ঘরের মধ্যে পানি চুইয়ে আসার বিচিত্র সব দাগ। কোনটা ভারতবর্ষের ম্যাপের মতো, কোনটা বা বাংলাদেশের। ‘শব্দ করে হাসছিলেন তিনি। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, আমার লেখাপড়ার দৌড় জানো? টেনেটুনে বি এ। তাও  কোন এলিট কলেজ থেকে নয়, বনবিহারী স্মৃতি মহাবিদ্যালয়। আবারও হা হা করে হাসি। আমাদের পরিবারের অনেকেই জায়গাজমি বিক্রি করে ওপারে চলে গেছে। আমার আব্বা যাননি। ধীরে ধীরে তখন ‌পরিবারে স্কুল কলেজের শিক্ষার প্রচলন হচ্ছে। আমিও পরিবারের মধ্যে প্রথম বি এ পাশ। বুঝতেই পারছো, কোন এলিট পরিবার, কোন এলিট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ আমার গায়ে নেই। তুমি জানো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরের‌ দিকে অর্থ কষ্টে‌ ছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তিনি কিন্তু ‌প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন।  এটাই‌ কি চট করে দৃষ্টিতে‌ পরার একটা কারণ, এলিট কলেজের ছাত্র তাই।

তাতে কী হল? প্রশ্ন করলো তরুণ সাহিত্যকর্মী।

তাতেই হল। বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন প্রবীন সাহিত্যিক। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হলো না খোকার। সে অবাকই হল। আপাতত সে চুপ করে তাকিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের দিকে। দুজনের মুখেই তখন বাদল মেঘের ছায়ার দাপট।‌

তোমার ভাবিকে বলো না দু কাপ চা দিতে। খোকা জানে প্রবীন লোকটিকে ডাক্তার বারেবারে চা, সিগারেটে নিষেধ করেছেন। হার্টের রোগ ধরেছে। শহীদুলদা বললে ভাবি‌ কিছুতেই এখন চা বানাবে না। চা মানে তারপরেই সিগারেট। কিন্তু সে বললে, ভাবি না করতে পারবে না। গলা তুলে সে বললো, ভাবি একটু‌ বিরক্ত করবো, দু কাপ‌ চা হবে?

বাইরের থেকে ঝড়ের আওয়াজ। বন্ধ জানলায় ধাক্কা‌ দিচ্ছে জোরালো বাতাস। ঝমঝম শব্দ উঠছে। গৃহপরিবেশ এবং বাইরে একটা তুমুল তোলপাড় চলছে। ঘরের ভিতরে বসে থাকা দুটো মানুষের বহিরাঙ্গ দেখে এদের অন্তরের আলোড়ন বোঝার উপায় নেই, ঠিক যেন প্রচন্ড ঝড়ের সময় দরজা জানলা টাইট করে বন্ধ করা‌ একটা ঘরের অন্দরমহল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কথাকার শহীদুল আলমের দিকে তাকিয়ে তরুণ শাহাদাত শেখ।

‘দুজনেই এক সময়ে সক্রিয় পার্টি কর্মী ছিলেন। পরে দুজনের মনেই সন্দেহ, প্রশ্ন জাগে, সাহিত্যিক হিসেবে নিজেদের কথা শিল্পসম্ভবরূপে তুলে ধরার জন্য দল তাদের ব্যবহার করেছে। সময়ের ফারাক সত্ত্বেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সমরেশ বসুর কথা ভাবতে বলছি। প্রথম‌ প্রথম দুজনকেই পার্টি‌ গুরুত্ব দিলেও পার্টির এলিট নেতৃবৃন্দ কী সমান চোখে দেখেছেন তাঁদের? ৪৬ ধর্মতলার পরিচালকরা‌, হীরণ সান্যাল, স্বর্ণকমলবাবু, ননী ভৌমিকরা? ‘প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন শহীদুল আলম। অথচ ভেবে দেখ, সমরেশের পরিচয়ে প্রকাশিত প্রথম গল্প আদাব-এর পর উনি দ্বিতীয় যে গল্পটা জমা দিয়েছিলেন, সেটা ছাপার আগে‌ পড়ে মানিক ওনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এই গল্পটি যেন না ছাপেন, তালে লেখক হিসেবে তাঁর মূল্যায়নে ক্ষতি হবে। সমরেশ বসুও সিনিয়র লেখকের কথা মেনে নিয়ে লেখাটি ফেরৎ নিয়ে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই দুজনের মধ্যে সেই সুসম্পর্ক ছিল। তবু আমার ধারণা,  সেভাবে নামী স্কুলকলেজে না পড়া, শ্রমিক সমরেশ এদের তুলনায় তারাশঙ্করের নিকটবর্তী হয়েছিলেন স্বভাবগত মিলের জন্য, গোপন উদাসীন মন আর বাউল ফকির সন্ন্যাসী সুফিদের প্রতি আকর্ষণের জন্য।‌ সাধারণ জনতার মন বুঝতে চাইতেন দুজনেই। রহস্য আকর্ষণ করতো। মনে রেখ ভাই, এলিটরা কিন্তু এলিটদেরই প্রাধান্য দেয়। একটা শ্রেণিগত ব্যাপার আর কি!

হঠাৎই সম্বিত ফিরলো খোকার। মন্ডপের সামনে টিনের ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল সে। বৃষ্টির বেগ প্রবল না হলেও বাইরে বেরোতে গেলে ছাতা লাগবে। টিনের উপর বৃষ্টির শব্দ, সর্বদাই মনে হয় প্রবল জোরে বৃষ্টি পড়ছে। একটা ভুল ধারণা তৈরি করে। জীবনে যে কত ভুল ধারণা মানুষ বহন করে  তার ঠিক ঠিকানা নেই। এই তো‌ বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শহীদুল আলমের স্মৃতি সভা যে প্রায় একক উদ্যোগে খোকাকেই করতে হবে, সে কী ভাবতে পেরেছিল? ভাবতে পেরেছিল এক সময়ে বহু আলোচিত উপন্যাস – ‘এগিয়ে চলার মরশুম’ আর ‘শেষ পর্যন্ত’-র লেখক এবং অজস্র গুরুত্বপূর্ণ ছোটগল্পের রচয়িতা একজন  লেখককে নিয়ে ছোটখাটো দুপাঁচটি মামুলি স্মৃতি সভা ছাড়া বড় করে কোনো কাজই হলো না। কেউ তার সৃষ্টির মূল্যায়ন করলো না। তার‌ দলের স্মরণসভাও যেন কর্তব্য পালনের জন্য। তেমনি লোকজনও ছিল না। বাড়ি ফিরে খোকার এতই গাঢ় বিষণ্ণতা পেয়ে বসেছিল যে, সে রাতে তার ঘুম আসেনি তার। মাঝরাতে উঠে শহীদুল আলমের শ্রেষ্ঠ গল্প বইটা খুলে ওর প্রিয় গল্প ‘এখন যেমন আছি’ পড়তে পড়তে কিছুটা যেন শান্তি  পেলো সে।

সে ভেবেছিল, শহীদুলদা যদি এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের একজন ‌হতেন অথবা‌ পরিকল্পিতভাবে তৈরি বাজারের বড় কাগজের লেখক‌ হতেন তবে কী তাঁর এ অবস্থা হতো? অথচ সে জানে ঐ কাগজের প্রতিষ্ঠিত একজন মুসলিম লেখকের মৃত্যুর পর, ওরা শহীদুলদাকে উপন্যাস লেখার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছিল, সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে ঐ বাড়ির একজন ‌সিনিয়ার লেখক বলেছিলেন। সে প্রসঙ্গে শহীদুল আলম সাহাদাতকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ওদের আমাকে নয়, একজন সংখ্যালঘু লেখক প্রয়োজন ছিল। নিজে উজিয়ে তিনি সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। ইতিমধ্যে ওরাও অন্য একজন সংখ্যালঘু লেখক জোগাড় করে ফেলেছিল। ওদের প্রয়োজন মিটে গেছিল।

কিছুদিন সব দেখেশুনে খোকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কিছু  না‌ পারুক, নিজের উদ্যোগে একটা স্মরণসভার আয়োজন সে প্রতি বছর করতেই পারে। আজ তিরিশে শ্রাবণ, কথাসাহিত্যিক শহীদুল আলমের জন্মদিন। আজকেই তার স্মরণ সভা বা শোকসভা হবে। চন্দ্রপুলি গ্রামের ইস্কুল কলেজে পড়া সমস্ত ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আজকের সভায় উপস্থিত থাকতে বলেছে সে। খুব বেশি উপস্থিতি আশাও করেনি সে, কথা বলে বুঝতে পেরেছে ওদের এলাকার পড়ুয়ারা বেশিরভাগ সাহিত্য পড়েই না, যারা একটু আধটু পড়ে তাদের অনেকেই শহীদুল আলমের নামই শোনেনি। তবু‌ যারা নিশ্চিত আসবে বলেছিল, যারা এই দুর্গামন্ডপ স্মৃতি সভার জন্য ব্যবহার করতে সাহায্য করেছিল তারাও বোধহয় বৃষ্টির জন্য আটকে গেছে।

এই দুর্গামন্ডপ কাম ক্লাবঘরটার ব্যবহারের জন্য পেতে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রেসিডেন্ট হরনাথ চক্রবর্তী গোঁড়া ধরনের লোক, সব শুনে আমতা আমতা করে না করে দিয়েছিলেন। কারণ, পুজোআর্চার জায়গায় শোকসভা করা যাবে না। খোকা বুঝতে পারছিল, এসব শুধু বাহানা। ধর্মীয় কারণে কোনো মুসলমান লেখকের স্মৃতিসভা এখানে করতে‌ দেবে না বুড়ো। চন্দ্রপুলি গ্রামে, মাথায় ছাউনী দেয়া  অনুষ্ঠান করার মতো একটু বড়ো কোন জায়গা নেই। এখানেই গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু হরনাথ  বিশেষ কারণে রাজি নয়। কিন্তু কারণটা‌ তিনি বলছে না, নানা‌ অজুহাত খাঁড়া করছে  লোকটা। সেদিন  সঙ্গে ছিল ওর বাল্যবন্ধু বাপী আর পলাশ। ওরা গলার স্বর নামিয়ে বলল, বুঝতে পারছিস, বুড়ো এইখানে কোন  মুসলিম লেখকের শোকসভা করতে দেবে না। ওরাও নাছোড়। খোকার ধারণা শহীদুল আলমের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাকারের স্মৃতিসভায় অনেক মানুষের জমায়েত হবে। কাজেই একটা বড়ো জায়গা লাগবে। ওরা পরপর উদাহরণ দিল, গ্রামের কোন কোন মৃতদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে এই মন্ডপ ব্যবহার করা হয়েছিল।   কিছুতেই রাজি নয় হরনাথ। শেষপর্যন্ত ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলো বাপী পাল। বলল, জেঠু এখানে কিন্তু আপনার দাদার শ্রাদ্ধ‌ অনুষ্ঠান রীতিমতো ঘটা করে করেছিলেন। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাধ্য হয়ে পাঁচশো টাকায় ভাড়ায় আজকের অনুষ্ঠানে রাজি হয়ে চিঠিতে ‘অনুমোদন করা হল’ কথাটার নিচে স্বাক্ষর করে দিলেন। অনুমোদনের কথাটা খোকাই লিখে এনেছিল। হরনাথ চক্রবর্তী শুধু সইটাই করতে পারেন। লেখালিখিতে স্বছন্দ নন। এখানে শহীদুল আলমের মালা পরিহিত ছবির পাশে বসে আছে জোনা পাঁচেক মানুষ। তারমধ্যে বাপী পাল, পলাশ দাসসহ আরও তিন চারজন।

আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখা যাচ্ছে ধূসর কালোমেঘ। হালকা বাতাস বইছে। দূরের কাঁঠাল গাছটার পাতা নড়ছে, টুপটাপ জল পড়ছে ভিজে মাটিতে । সোঁদা মাটির গন্ধ। আবহাওয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হচ্ছে। অনেকটা দূরে কোথাও একটা বাজ পড়লো। আলোর একটা ঝলক চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই মিলিয়ে গেল। বৃষ্টির বেগ বাড়লো। তরুণ সাহিত্যকর্মী সাহাদাত শেখ ভাবছিল, এই‌ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যারা আসবে না তাদের পক্ষে ‌অজুহাতের সুযোগ করে দিল। অথচ কোন‌ সভায় উপস্থিত থাকার কথা থাকলে, যে কোন পরিস্থিতিতে সেখানে হাজির হতেন প্রবীন সাহিত্যিক শহীদুল আলম। তাঁর একটা মূল্যবোধ ছিল‌। জীবনাচরণের সুস্পষ্ট সত্যের উপস্থিতি তার কথাবার্তা,  প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করত। কোথাও যাওয়ার কথা দিলে ঝড় বৃষ্টি শরীর খারাপ কোনো কিছুই তাঁকে আটকে রাখতে পারতো না। মৃত্যুর সামান্য ‌কিছুদিন পরে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এ কী অবস্থা! মাত্র সাত-আটমাস আগেও মানুষটি ছিলেন, বিপুলভাবেই ছিলেন, সংখ্যালঘুদের সাহিত্যক্ষেত্রে অন্যতম গৌরব হিসেবে। খোকা শেখের ফিলজাফার এবং গাইড।‌ অবশ্যই সিনিয়ার বন্ধুও। অনেকেই তো আসতেন শহীদুল আলমের কাছে, লেখা পড়ে সে বিষয়ে নানা উপদেশ নিতে, কখনও সাক্ষাৎকার।

বৃষ্টির বেগ বাড়লো। এবার বেশ বড়সড় ফোঁটায়। টিনের ছাদের অতি প্রবলভাবে শব্দের নৃত্য শুরু হলো। ভিতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, কী রে অনুষ্ঠান ক্যানসেল করে‌ দিবি নাকি? মনে তো হচ্ছে, আর কেউ‌ আসতে পারবে না। কী করবি রে?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না খোকা। বস্তুতপক্ষে উত্তর তার জানা নেই।‌ এমনিতেই বক্তা, প্রধান অতিথি, সভাপতি জোগাড় করতে ওর‌ কালঘাম বেরিয়েছে। শহর থেকে কেউই ট্রেনে করে এদিকে আসতে‌ চায় না। বন্ধু লেখকের জন্য এতটা‌ পরিশ্রম করতে রাজি নয়। অনেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টাকা চাইছিল, মুখে বলছে গাড়িভাড়া। কত কষ্টে সে সমস্ত ব্যবস্থা করতে পেরেছে। প্রচুর সময়‌ গেছে, কিছু টাকা এদিক‌ ওদিক ধার হয়ে গেছে।‌ সে ভাবছিল, একে তো স়ংখ্যালঘু লেখক, স্বীকৃতি দিতে প্রচন্ড কষ্ট, আগেকার দিনের কয়েকজন লেখককের বাইরে নতুন কোনো স়ংখ্যালঘু লেখককে তেমনভাবে আর সামনে আসতে দিতে‌ চায় না একদল।‌ তারপর দেশের অবস্থা ক্রমেই  হিন্দু কট্টরপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে। একদল নিজেদের সেক্যুলার প্রমাণ করতে অযোগ্য স়ংখ্যালঘু লেখকদের নিয়ে হৈ চৈ করে‌ আরও সর্বনাশ করছে।

এতো‌ হাওয়া দিচ্ছে যে বৃষ্টির ‌ছাট গায়ে লাগছে। খোকা সরে‌ গিয়ে ভিতর দিকে একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।‌ এদিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। হঠাৎই যেন মনে হল, চোখের সামনে সে‌ দেখতে পাচ্ছে একটা শোকসভা। 

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, ৭ ডিসেম্বর ১৯৫৬, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ‌পর‌ সমবেত হয়েছেন অনেকে  তাঁর স্মৃতি আলোচনায়। উপস্থিত সভাপতি উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।‌ একে‌ একে‌ বলছেন প্রেমেন্দ্র‌ মিত্র, সজনীকান্ত দাস, গোপাল হালদার, আবদুল ওদুদ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। অধিকাংশ যা বলছেন‌, তা কী‌ তাদের মনের কথা? তরুণ লেখক সমরেশ বসু‌ এইসব আবেগময়ী কন্ঠ কৃত্রিম ‌বক্তব্যের বিরুদ্ধে ‌ক্ষোভে‌ ফেটে‌ পড়লেন। আর সহ্য হচ্ছিল না‌ তার। সভা ঘরের প্রান্তে মানিকের পরিবারের সাহায্যের জন্য সাদা একটা  ‌চাদর ধরা‌ হয়েছে। উপস্থিত অনেকেই সেখানে টাকা ফেললেন। আর পড়লো একটা সোনার চুড়ি। সেটা‌ যে‌ কোন মহিলা দিলেন তা  বুঝতে‌ পারলেন না সমরেশ। মুখের কথা আর কাজকে কিছুতেই মেলাতে‌ পারছিলেন না তিনি। ছয়ফুট লম্বা মানুষটি‌ চলে গেলেন কারও কথা না শুনে, কাউকে কেয়ার না করে। খোকা ভাবলো, সমরেশ বসুও তাই‌, নিজের‌ মতো করে বেঁচে, চলে গেলেন কিন্তু যা লিখতে চেয়েছেন তা পুরোপুরি ‌লিখে উঠতে পারলেন কি? শহীদুল আলমও খোকার কাছে‌ বলেছিলেন, ‘যা লিখতে চাই নানা কারণে সেসব লেখা‌ হয়ে উঠলো না। বুঝলে একজন লেখকের কাছে নানা ধরণের দৃশ্য অদৃশ্য বাধা থাকে, সেসব লেখকই জানেন’। খোকা ভাবছিল, আজ যাঁদের আসার কথা ছিল তাঁরা অনেকেই শহীদুলদা সম্পর্কে বানিয়ে ‌কথা বলতেন। তার ওসব শুনতে ভালো লাগতো না। একদমই না।

সন্ধের ঘোর নেমেছে। মুষল ধারায় বারিপাত। সঙ্গে ঝোড়ো‌ হাওয়া, বলা‌ চলে মারাত্মক ‌দুর্যোগ। জলকণা উড়ছে।‌ প্রজাপতির মত। গুনগুন ‌করে কানের‌ কাছে, চোখের সামনে ভাসছে অতি সূক্ষ্মকণা।  যা প্রতিমুহূর্তে সিক্ত করে দিচ্ছে মন। ভিতরে বসা কয়েকজন ডাকছে সাহাদাত শেখ ওরফে খোকাকে। ওদের স্বর ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে চলমান মেঘের মতো। মনে হচ্ছে গোটা চন্দ্রপুলি গ্রামটাকে প্রদক্ষিণ করছে। মেঘ, অন্ধকারের কথোপকথন চলছে। এমন অস্ফুট কথা যা কোনদিন বলা হয়নি। তরুণ লেখক সাহাদাত দেখছে পানির আঙুল ক্রমেই ছুঁয়ে দিচ্ছে ‌তার প্রিয় লেখক শহীদুল আলমকে। কেমন যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছেন কলমে কথা বলা মানুষটা। জীবনের ‌শোক‌, দুঃখ‌, অপ্রাপ্তি,‌ জয়‌পরাজয় সব মুছিয়ে‌ দিচ্ছে প্রকৃতির নির্ভেজাল শুশ্রূষা।

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন