ধারাবাহিক উপন্যাস
দ্য ক্লাউড
(ষষ্ঠ পর্ব)
হাসি ও হাসিনা - এই দুটিই আমি। হ্যাঁ ও না-এর দ্যোতনাময় জৈবিক আলোড়ন। আমি তো সেই ব্যাক্তি, যে গত কয়েকদিন ধরে ব্যবসা হারানো জাতকের গল্পের বাংলার সেরিবান ছিলাম। ঘুরছি আর ঘুরছি। ভাবছি, এই যে মাথায় হিমালয়ের মতো চিন্তার বোঝা, এ বোঝা কোন শহরে নামাবো! কোন খদ্দেরকে বলবো, আমার কাছে এক ঝুরি না-হাসি আছে। আপনারা কেউ নেবেন গো! ভাবছি আরও কতো কিছুই। এই যেমন মুখের যত হাসির ঢেউ গঙ্গা পদ্মার ওপরে এতো দিন ধরে নাচতো, হঠাৎই কোন বাঁধের বাঁধন আমার শরীরের চরকে কষে বেঁধে দিলো!
এক অদ্ভুত অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
আর সেই মুহূর্তে আমি হাসি থেকে হাসিনা-তে চলে গেলাম। আমি কি পালাবো? কিন্তু আমি যে
ঘোরতর সংসারী মানুষ! তবে কি রাষ্ট্রের কাছে নতজানু হয়ে বলবো,
‘হে রাষ্ট্র, তুমি আমাকে এই মুহূর্ত
থেকে স্বয়ম্ভু করে দাও। যাতে আমি যা চাই, তাই হয়!'
বরাবরই ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে আমার।
আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রমী মানুষের সাথে তিনি থাকেন। তবে সে মানুষকে বুদ্ধিমান হওয়ার
দায় তার-ই।
ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপন কোম্পানির লোকজনের ইশারা মতো আমার প্রাণখোলা হাসির টেক ক্যামেরা বন্দি হয়ে গিয়েছে। বাৎসরিক দশলাখ। আর হাসিখুশি বৃদ্ধাবাসে আমার স্থায়ী একটি চাকরি। এটুকু কায়দা করে আদায় করে নিয়ে তবেই আমি ওই কোম্পানির ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন এসব নিয়ে আমি বেশ আছি। ওই প্রান্তিক অঞ্চলে বৃদ্ধাবাসকে কেন্দ্র করে কিছু প্রয়োজনীয় দোকানপাট, ডাক্তারখানা, ওষুধের দোকান ইত্যাদি হতে শুরু করেছে। জনবসতির প্রবল চাপ বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে সরকার একটি কো-এড কলেজ তৈরির জন্য জমি সার্ভে করবে।
ইতিমধ্যেই আমাদের হাসিখুশি বৃদ্ধাবাসে
দু'একজন আসতে শুরু করেছেন। তাদেরকে পুনর্বাসন নামক চমৎকার একটি হাসির বিনিময়ে অর্জিত
টাকা ও চাকরির দৌলতে আমি যথেষ্ট সময় দিই। তবুও দিনের অধিকাংশ সময়-ই আমার কায়িক শ্রমহীন
অবস্থায় থাকে।
বৃদ্ধাবাসে যারা সাপ্লায়ার, তাদের
সাথে যোগাযোগ রাখি। কেননা আমি আমার জীবনের যৌবনের শুরু থেকেই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের
অভ্যাস টাকার গন্ধ নাকে টানা। তো, মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প বেড়িয়ে পড়ি। এ অঞ্চলে চারিদিকে
জলা-জংলা জমি। সে-সব সস্তা জমি আমি অল্প টাকা দিয়ে বুক করি। আর, সময়মতো সেগুলো শহুরে
খদ্দের ধরে বিক্রি করি জুতসই দামে।
গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার জন্য
ধীরে ধীরে কতোগুলো উড়ালপথ হয়ে গেলো। সে সব পথের সুবাদে আমাদের হাসিখুশি বৃদ্ধাবাসের
অঞ্চল এখন আর গ্রাম নয়। আমি থামতে শিখিনি কোনো দিনই। এ-রই মধ্যে জমিজায়গার কারবারের
পাশাপাশি আমার ইমারতি কারবারও হয়েছে। এ অঞ্চলে জলাজমি বুঁজিয়ে দিয়ে প্রোমটরি শুরু হয়েছে।
সে-সবের অনেকাংশেই আমি নেপথ্যচারী। আমার চার্টার এ্যাকাউনটেন্ট জানেন, হিসেব বহির্ভূত
সম্পদকে কিভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়।
এই অবসরে বলি, এতোদিনে আমার কিছু
শত্রুপক্ষও তৈরি হয়েছে। তারা আমার সোনার নেকলেস
পড়া স্বর্ণময় ভাগ্যকে ঈর্ষা করে। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে গোলযোগ হয়। সব সমস্যা সমাধানের
জন্য আমার মাসল ম্যান বাহিনীই যথেষ্ট। ওদেরকে ক্ষমতাধর করেছি আমিই।মাঝেমধ্যেই মন্ত্রী
সান্ত্রির আগমন। আর সে উপলক্ষে পঞ্চম 'ম'এর আয়োজন আমাকে রাখতে হয়। কর্তাভজা পদ্ধতিতে
আমার বাহিনী চলে। এরপর আমি চলি। আমার পরে আরও আরও অনেকেই...
তবে, একটি কথা বলে নিতে চাই। আমি
কিন্তু আমার মাদার বিজনেসকে ভুলিনি। অর্থাৎ হাসির বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করাকে।
সেদিন কি হলো, আমাদের হাসিখুশি বৃদ্ধাবাসে আমার হাসির রিনিউয়াল উপলক্ষে ফাইনাল টেকের আগে আমি বহুদিন আগে ফেলে আসা আমাদের পৈতৃক বাড়ির গোয়ালের দুষ্ট প্রকৃতির, কপালে রাজ তিলক নিয়ে জন্ম নেওয়া ও আমার ভাগে পড়া বলদের কথা চিন্তা করছিলাম আর ভাবছিলাম,রাজতিলক নিয়ে জন্মানো বলদ ভাগ্য কতোটা সুপ্রসন্ন হলে একজন সর্বস্ব হারানো ব্যাবসায়ী আবারও ফুলে কেবল নয়, ফেঁপেও ওঠে!
ঠিক এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরে আমি
মনে মনে একটু হাসলাম। না। হাসিটা তেমন জমলো বলে মনে হলো না। আয়নার সামনে গিয়ে নিজের
চেহারা দেখে অবাকই হলাম। গলায় কয়েক ভড়ি মোটা সোনার চেন। হাতের আঙুলে জ্যোতিষীর দেওয়া
বেশ কয়েকটি রত্ন সজ্জিত আংটি। চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচরাতে গিয়ে দেখলাম, কুকুরের বকলেসের
মতো আমার কব্জি থেকে ঝুলন্ত সোনার চেনটি বেশ টাইট হয়ে গেছে। ওটাকে আর-ও ইজি ও আরও ঝুলন্ত
করতে হলে স্যাঁকরার কাছে পাঠাতে হবে। কেননা সেই আমি আর নেই। এখনকার আমি'র বাৎসরিক দশলাখ
একটি ফুঁৎকার মাত্র।
বিজ্ঞাপন কোম্পানির আবিস্কৃত সেই
আনন্দ পুরনো শরীরকে পরিত্যাগ করে নতুন এক আনন্দজি হয়ে গিয়েছে। তখনকার নামও ছিলো আনন্দ।
আর এখনকার নামও আনন্দ। তবে তফাৎ একটাই। নাম আনন্দজি হলে-ও, এই আনন্দকে দুর্মূল্যের
বাজারে অনেক টাকা দিয়ে কিনতে হয়!
অতএব দশ হয়ে গেলো বিশ লাখ! প্রথমে
থ্রেট। আর তারপরেই শুরু হোলো তুমুল বচসা। আমি কোম্পানিকে বললাম , দেখি, আমি ছাড়া কোন
শালা আপনাদের সাইনবোর্ডে হাসির পোজ দিতে আসে!
এক সন্ধ্যায় আমার স্কোরপিও গাড়িটা
অ্যাক্সিডেন্ট করলো। খবরে প্রকাশ হোলো, আনন্দ রিয়েল এস্টেটের মিস্টার আনন্দজি এক মর্মান্তিক
পথ দূর্ঘটনায় মারা গেছেন।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন