কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৯ |
মহালয়া
যা ভয় করেছিল, তাই হল। আঙুল ফসকে মার্বেলের মেঝের উপর দিব্যি পড়ল কাপটা। যেন পড়বে বলে ঝুঁকেই ছিল। কী চমৎকার শব্দ! অসীম ভয়ে ভয়ে তাকালো পিছনে। নির্বিকার চোখে ঝুমুর দেখছিল। কিন্তু অসীমের ভেতরটা কী যে এক আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল! এইই হয়। মাল্টিটাস্কিং কোনদিন তার দ্বারা হয় না। চাকরিতে থাকাকালীন এ সব করতে গিয়ে কতোবার যে নাকাল হতে হয়েছে! কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর ব্যাপারটা সামান্য বদলেছে। অভ্যাস কতো কিছু পাল্টে দেয়! এখন ভোরে ওঠে। গাছে জল দেয়। ফুল তোলে। ক্লাশ ইলেভনের মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। নিয়ম করে বাজার। ঝুমুরের দেওয়া টাকার পাই টু পাই হিসেব বুঝিয়ে দেয়। মেয়ে নীপা বলে, বাবা, তুমি পারোও বটে। অসীম চোখ বন্ধ করে চা খায়। ঝুমুর তো সামনেই বসে।
অসীম আরো কিছু করে। বিছানা পাতে। তোলে। আকাশ বুঝে জানলার স্লাইড টানে, খোলে। মেয়ের বই গুছিয়ে রাখে। পাউচ থেকে কন্টেনারে তেল ঢেলে দেয়। চালের বস্তা থেকে চাল টিনে ঢোকায়। সবজি ধুয়ে দেয়। নিয়ম করে ঝুমুরের চওড়া ফোন চার্জে বসায়। তবু এখন ঝুমুর ফুট কাটলো, যা পারো না, করতে যাও কেন! যত্তসব অকম্মার ঢেকি! এখন এই কাঁচ পরিস্কার কে করবে শুনি! অসীম সাবধানে ঝুমুরের সামনে চায়ের কাপটা রাখে। মেয়েকেও দেয়। ও প্রাণপণ ভুলে যেতে থাকে, কিছু বছর আগেও ও একটা আই টি ফার্মের চিফ ম্যানেজার ছিল। এখন গাড়ির চাবিটা, আই টি রিটার্নের ফাইলটাও ঝুমুরের হেফাজতে।
এসবের মানে কিন্তু অসীম একেবারে গৃহপোষ্য নয়। সন্ধ্যাবেলা ও বেড়োবেই। লোডশেডিং, বৃষ্টি, ঝুমুরের বারণ কোনকিছুই তখন ওর কানে ঢোকে না। দুপুরে ইচ্ছেমতো বই পড়বেই। রাত্তিরে দু পেগ নেবেই। মোবাইলে ঠিক সময় করে সিনেমা দেখবেই। কারো ক্ষমতা নেই ওকে আটকাবে। মাঝেমধ্যেই দু একদিনের জন্য বেড়িয়ে পরে। এ নিয়ে কত অশান্তি। অসীম যে কে সেই।
পুজো এসে গেল। দু বছর করোনার ভয়ে ঝিমিয়ে থাকার পরে এবার যেন মানুষ একটু বেশি সাহসী। পাড়ায় পাড়ায় সেজে উঠছে থিমের কাঠামো। একদিন পর মহালয়া। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে অসীমের। শীত শীত ভোর, রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর বন্ধুদের সঙ্গে ছুট ছুট, শিউলি কুড়িয়ে এনে মায়ের হাতে দেওয়া। এখনো কি সেই হলুদ বোঁটার আশ্চর্য্য শিউলি ফোটে!
পাড়ায় একটা পুজো হয়। তার তোড়জোড় চূড়ান্ত পর্যায়ে। এবার পছন্দের কাউন্সিলার। জোশ্টা তাই কিছু অতিরিক্ত। মহালয়া হবে ভোরে। এখন রাত্রে মাংসের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। ক্লাবের ছেলেদের উল্লাস ফেটে পড়ছে আনন্দে। টের পাওয়া যাচ্ছে শব্দবাজিতে। ডিজে-তে। অসীম জানে, পাশের বাড়িতে অসুস্থ একজন মহিলা আছেন। আর তার এক স্বামীপরিত্যক্তা মেয়ে। রাত্রি একটা নাগাদ ও আর সহ্য করতে পারলো না। গেট খুলে সোজা ক্লাবের ছেলেদের হুল্লোড়ের মধ্যে।
-ভাই, ডিজে-টা একটু বন্ধ করবে?
আর তোমাদের ঐ ক্র্যাকারের শব্দ? তোমরা বোধহয় জানো, ঐ বাড়িতে হার্টের একজন পেশেন্ট আছেন।
-তো? আমরা কি করতে পারি! নার্সিং
হোমে নিয়ে যান। নিদেন পক্ষে হাসপাতালে।
জড়ানো গলায় এমন উত্তর শুনে অসীম
আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলো না।
-তোমরা এত ইডিয়ট কেন! মানুষের সুবিধে
অসুবিধে একটু বুঝবে না! বন্ধ করো এ সব এক্ষূনি। না হলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব আমি।
-ওরে! এ কে রে! মাঝরাত্রে পুলিশ
দেখাচ্ছে! ধর্তো শ্লা ওর মুখটা। খানিক বিদেশী ঢেলে দিই।
যে ক’টা জানলা খুলেছিলো, চটপট বন্ধ
হয়ে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টলমলে কিশোরটিকে
লক্ষ্য করে অসীম একটা চড় ছুঁড়ে দিলো।
পিছনে শুনতে পেলো, ঝুমুর আর নীপা
আপ্রাণ চিৎকার করছে।
এত সবের মধ্যে অসীম খেয়ালই করেনি, মদ্যপ একটা রড তার মাথা লক্ষ্য করে নেমে আসছে।
চমকে দেবার মতো বিভৎস বাস্তবতা, যা অমানবিকতার চিত্রায়িত সন্ত্রাস। বিপন্ন করে বোধ কিন্ত বিদ্রোহী করে না। ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুন