সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

অচিন্ত্য দাস

 

সমকালীন ছোটগল্প




এক গৃহহীনের গল্প

আমেরিকা দেশটা বড়লোকদের দেশ তো বটেই আর এদের কয়েকটা শহর আছে যেখানে পয়সাওয়ালা লোকের সংখ্যা বেশি। যেমন পশ্চিম উপকূলের শহর লস এঞ্জেলস। আকছার দেখা যায় বিরাট রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি থেকে অনেক দামের লম্বালম্বা গাড়ি নিয়ে হুসহুস করে চলে যায় তারা। কিন্তু বাংলাতে একটা কথা আছে “প্রদীপের নিচে অন্ধকার” – এই এতদূরের আমেরিকা দেশেও দেখলাম বাঙালির বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।

এখানের ইউনিভারসিটি খুব বড় এবং অনেক বিষয় নিয়ে পড়ার বা গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। এর চত্বর বলে তেমন কোনো ঘেরা জায়গা নেই, বিভিন্ন বিভাগের বাড়ি, পড়ুয়াদের আবাসন, আতিথিদের জন্য হোটেল – সব এক অঞ্চলে হলেও চারিদিকে পাঁচিল নেই। শহরের কিছু বড় বা ছোট রাস্তা এর মধ্যে দিয়ে চলে গেছে।

সন্ধেবেলা এখানে ঘুরতে ঘুরতে লোকটাকে দেখলাম। ফুটপাথের রেলিংএ হেলান দিয়ে বসে আছে। কৃষ্ণাঙ্গ। তার সামনে একটা স্টীলের চাকাওয়ালা ট্রলি। কোনো শপিং মল থেকে নিয়ে আসা। তাতেই ধরে গেছে তার সংসার। কম্বল, জামা-কাপড়, দু-একটা পিচবোর্ডের বাক্স। এক জোড়া জুতোও দেখলাম। তবে লোকটা একা নয়।

পাশেই বসে আছে একটি কুকুর। তার আসল মালিক বোধ হয় তাকে অনেক দিন ত্যাগ করেছে, মানে সেও গৃহহীন।

আগ্রহ হলেও এভাবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, তাই একটু দূর থেকে ঘুরে এলাম। এবার দেখি লোকটা একটা বাক্স থেকে খাবার বার করে খাচ্ছে। না ভুল বললাম। খাচ্ছে দুজনে। তার বন্ধুটি পাশে বসে ভাগ পাচ্ছে। বড় বড় অট্টালিকা চারিদিকে, দেয়ালে আর রাস্তার মোড়ে চমকে দেওয়া সব জ্বলজ্বলে বিজ্ঞাপন। পথ চলতে থাকা কিছু লোকজনকে দেখে বোঝা যায় তারা মেধাবী, কিছু ভাবতে ভাবতে চলেছে – গবেষণা কিংবা আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতির কথা। দু-একটা কপোত-কপোতী বেঞ্চিতে বসে নিবিড় আলাপে ডুবে আছে। এদের সকলেরই লক্ষ্য আছে, স্বপ্ন আছে। এ শহরের বাতাসে ডলার ওড়ে, যাদের দেখা যাচ্ছ তারা লক্ষ্যের দিকে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলেছে। সন্ধ্যার আলোতে নগরীর মেজাজ উদ্ধত আর অহঙ্কারী – ‘আমার সব আছে’ গোছের।

এরই মধ্যে ফুটপাথের এই দুটি প্রাণীকে একেবারেই আলাদা লাগছিল। দুজনে রাত্তিরের খাওয়া সারছে। ধনরত্ন, উচ্চাশা কিছুই নেই। কী মধুর সখ্য, কী নিশ্ছিদ্র পরিতৃপ্তি!!

ঘরে ফেরা সময় হলো, আর একবার এদের দেখে নিয়ে হাঁটা লাগালাম। চোখ মনের ভেতর এদের ছবি রয়ে গেল।

**

আমেরিকা দেশে খবরের কাগজের ভারি খারাপ অবস্থা। কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। মোটামোটা পঞ্চাশ-ষাট পাতার কাগজ বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। সে কাগজ রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে সারাদিন কষ্ট পেয়ে শেষে জঞ্জালের বাক্সে জমা পড়ে।

সকালে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট না হলেও আমার চলে কিন্তু খবরের কাগজ না থাকলে বড় খালি খালি লাগে। তাই সেদিন একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম। লস এঞ্জেলস টাইমস। গোটা কাগজ বিজ্ঞাপনে ভর্তি, একটা লোকও যদি বিজ্ঞাপন দেখে কিছু কেনে তাহলেই কাগজ ছাপা সার্থক – এই বোধ হয় মনে করে কাগজ-ছাপানেওয়ালারা। বিজাতীয় সব খবর, আগ্রহ জাগে না। খেলার পাতাগুলোতে বাস্কেট আর বেস বল। না ফুটবল, না ক্রিকেট।

একটা খবরে কিন্তু চোখ আটকে গেল। এই শহরে এক নতুন মেয়র এসেছেন। এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আগে যে শহরে ছিলেন সেখানে এঁনার সুনাম ছিল। ইনি লস এঞ্জেলস শহরের গৃহহীনদের জন্য একটা আবাসন তৈরি করবেন বলে অর্থ সংগ্রহ করছেন। আবাসন কী রকম হবে তার বিবরণও দেওয়া হয়েছে। লিখেছে – আবাসনে প্রায় দুশো ঘর থাকবে। প্রতি চারটে ঘরপিছু একটা বাথরুম। গোটা পাঁচেক ডাইনিং কাম বসার হলঘর। একটা ঘরে একজন করে থাকবে, পরিবার বা পোষ্য নিয়ে থাকা যাবে না।

এই অবধি পড়ে থেমে গেলাম। কাল সন্ধেবেলার দৃশ্যটি চোখে ভাসতে লাগল। পাকাবাড়ির অনেক সুবিধের মোহে সেই লোকটি কি তার পোষ্যটিকে ছেড়ে চলে আসতে পারবে?

মেয়র মহোদয়া যতই চেষ্টা করুন না কেন আর সে আবাসনে যত ঘরই থাকুক, আমার স্থির বিশ্বাস লস এঞ্জেলস শহরে একজন গৃহহীন থেকেই যাবে।


 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন