বড় পর্দায় ইংরজী ছবি
(সপ্তম পর্ব)
কলকাতায় কনিষ্ঠতম ৭০ মিমি প্রেক্ষাগৃহ
কলকাতায় দু’টি সিনেমা হলে – একটি বোধহয় এখনও আছে, আর একটি অধুনালুপ্ত – তাদের সারিয়ে নবরূপদানের আগে এবং পরে গেছিঃ হুমায়ুন প্লেসে নিউ এম্পায়ার আর চৌরঙ্গীর ওপর টাইগার। এর মধ্যে নিউ এম্পায়ার নিয়েই প্রথমে কথা হবে, কারণ এটি ১৯৭০ সালে ‘Home of Warner Bros. 7 Arts’ পরিচয় নিয়ে, গ্লোবের মতো প্লাস্টিক পেন্ট করা ৭০ মিমি প্রোজেকশানের উপযুক্ত wall নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
দ্বিতীয়
পর্বেই বলেছি যে, এর আগে, নিউ এম্পায়ারে সাদা পর্দার পেছনে ছিল মঞ্চ, যেখানে অনেক সময়
নাটক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান হতো। এখানে দেখা কিছু ইংরাজী ছবির নামও ঐ পর্বে উল্লেখ করেছি।
নবরূপদানের আগে এখানে অনেক ছবিই দেখেছি। সবচেয়ে বেশী মনে আছে আমার দেখা প্রথম The
Three Stooges-এর ছবি The Outlaws Is Coming, আর ডাইনোসরদের নিয়ে দুটি ছবি । প্রাগৈতিহাসিক
যুগের প্রেক্ষাপটে One Million Years B. C., দেখেছিলাম ১৯৬৮ সালে, ও ১৯৭০ সালে দেখা,
আধুনিক সময়ের পটভূমিতে The Valley of Gwangi।
১৯৭০-এর
দ্বিতীয়ার্ধে নিউ এম্পায়ার মঞ্চ তুলে দিয়ে পুরোপুরি সিনেমা হল হয়ে গিয়ে সর্বপ্রথম নিয়ে
এল হলিউডে আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা জন ওয়েন অভিনীত Chisum, যে ছবি ঠিক ঐ বছরেই বিদেশে
মুক্তি পেয়েছিল। অর্থাৎ, আগের মতো অন্তত এক বছরের – কখনও চার-পাঁচ বছরের – অপেক্ষার
দিন শেষ হয়েছিল, অন্তত কিছু ছবির ক্ষেত্রে। ১৮৭৮ সালে ঘটে যাওয়া Lincoln County
War ছবির বিষয়বস্তু। ওয়েন অভিনীত ইতিহাসে নাম-থাকা চরিত্রের – John Chisum - পাশাপাশি
একাধিক এমন কিছু কুশীলবদের আমরা দেখতে পাই যাদের নামও ইতিহাসে পাওয়া যাবে – যেমন
Billy the Kid এবং বাস্তবে যার হাতে বিলির মৃত্যু ঘটেছিল (এই ছবিতে নয়), সেই Pat
Garrett, ইত্যাদি। একটি অসাধারণ Western, মুগ্ধ
হয়ে দেখেছিলাম। দেখতে ঢুকে দেখি দেওয়ালে ছবিটি নির্বাক অবস্থায় চালিয়ে দেখে নেওয়া হচ্ছে
– বোধহয় নবরূপলাভের পর উদ্বোধনের দিনেই দাদার সঙ্গে গিয়েছিলাম। তবে, যতদূর মনে পড়ছে,
ছবির প্রোজেকশান পুরো ৭০ মিমির বড় দেওয়াল জুড়ে ছিল না – সিনেমাস্কোপেই দেখানো হয়েছিল।
দেওয়াল
জুড়ে প্রোজেকশান দেখেছি নিউ এম্পায়ারে দেখা জন ওয়েন-অভিনীত এর পরের একাধিক ছবিতে। তার
মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ১৯৭২ সালে আমার বৌদির সঙ্গে দেখা The Cowboys। এটিও ঐ একই বছরে
বিদেশে মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম ডেল জেনিংস রচিত উপন্যাসের ওপর
আধারিত এই ব্যতিক্রমী Western-এ হলিউডের অন্যতম ‘স্টার’
ওয়েন অনেকটাই কাহিনির পশ্চাদভূমিতে, পুরোভাগে একদল বালক-কিশোর। সাময়িক
gold rush-এর জন্য নিজের গবাদি পশুদের ৪০০ মাইল তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে লোকের অভাবে
উইল অ্যানডারসেন (ওয়েন) বাধ্য হন স্থানীয় ইস্কুল থেকে দশজন, এবং বাইরে থেকে এই ছেলেদের
চেয়ে কিছু বড় আরেকজন, শিশু-কিশোরদের নিযুক্ত করতে। পথে ছেলেদের সঙ্গে উইলের সম্পর্কের
বিবর্তন, ছবির বিয়োগান্ত সমাপ্তির আগে তাদের চোখে উইলের কঠোর কিন্তু স্নেহময় পিতায়
বিবর্তিত হওয়া ছবির বিষয়। আমার মতো ওয়েন-ভক্তদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল খলচরিত্রের
গুলিতে উইলের মারাত্মকভাবে আহত হওয়া এবং অবশেষে তাঁর মৃত্যু!
এছাড়া
ওয়েনের ছবি নিউ এম্পায়ারে দেখেছি আরেক Western-কমেডি The Train Robbers, যার কাহিনির
শেষে খুব উপভোগ্য চমক ছিল, আর Western ছবি ধীরে-ধীরে অচল হয়ে যাবার কারণে Clint
Eastwood-এর হ্যারি ক্যালাহান-নামক পুলিশ-গোয়েন্দার আদলে সৃষ্ট McQ চরিত্র-কে নিয়ে
রহস্য ছবি।
ইস্টউড
খ্যাতিলাভ করেছিলেন Western ছবি করে – তাঁকে অনেকে ঐ জঁরের ছবিতে জন ওয়েনের উত্তরসূরি
(তবে ওয়েনের ‘কাউবয়’ চরিত্রের একেবারে বিপরীতধর্মী
উত্তরসুরি) বলে থাকেন। ইস্টউডের আমার দেখা প্রথম দেখা Western ঐ নিউ এম্পায়ারেইঃ এম
এর ক্লাস কেটে (সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের পড়ানো একেবারেই ভালো লাগত না!) The Outlaw
Josey Wales। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পাশবিকতায় স্ত্রী-সন্তান হারানো জোসি ওয়েলসের
Outlaw-এর জীবন যাপন।
১৯৭৩
সালে ইস্কুলের প্রান্তিক পরীক্ষা – আই এস সি, তখনও বলা হতো ‘সিনিয়র কেম্ব্রিজ’ – শেষ হবার পর তিন সহপাঠী মিলে – উদ্যোগ ছিল সেই রাহুলের – দেখলাম
রাশিয়ার তৈরি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-সংক্রান্ত ছবি Battle for Berlin, যা Liberation-নামের
সিরিজের চতুর্থ ছবি। চমকপ্রদ ছিল উক্ত সময়ের রাষ্ট্রনেতাদের চরিত্রে আবির্ভূত অভিনেতাদের
বাস্তব চরিত্রগুলির সঙ্গে অদ্ভুত চেহারাগত সাদৃশ্য, বিশেষ করে যে অভিনেতা স্ট্যালিন
হয়েছিলেন, তাঁর ক্ষেত্রে।
১৯৭৮
সালের পর মাকে সঙ্গে নিয়ে নিউ এম্পায়ারের বড় দেওয়াল জুড়ে পরপর দেখেছি ক্রিস্টোফার রীভ-রূপায়িত
Superman-কে নিয়ে তিনটি ছবি, যার মধ্যে দ্বিতীয়টিই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছিল। সাময়িক
ভাবে প্রেমিকা লোইস লেনের সঙ্গে ঘর-বাঁধার স্বপ্নে ক্যাল-এল (ভিনগ্রহী সুপারম্যানের
পিতৃদত্ত নাম) যাবতীয় পরাশক্তি বিসর্জন দিয়ে তারপর বিপাকে পড়ছে।
ঠিক
এইভাবেই, আশির আর নব্বইয়ের দশকে যিনি প্রথমে ছিলেন আমার হবু-স্ত্রী এবং পরে গৃহিণী,
এবং তারপর তাঁকে আর শ্যালিকা-শ্যালককে নিয়ে এই প্রেক্ষাগৃহে পরপর দেখেছি Batman,
Batman Returns, আর Batman Forever।
আগে,
মার সঙ্গে এখানে দেখেছি এককালে জেমস বন্ড-করে খ্যাত শন কনারি অভিনীত কল্পবিজ্ঞান আখ্যান
Outland, যার ঘটনাক্ষেত্র বৃহস্পতি গ্রহের অন্যতম উপগ্রহ আয়ো, যেখানে পাকাপাকিভাবে
মনুষ্যবসতি শুরু হয়ে গেছে, এবং যেখানে মানুষ নিজের অপরাধ-প্রবণতা পূর্ণমাত্রায় বজায়
রেখেছে!
এছাড়া
মার খুব ভাল লেগেছিল Dark Shadows সিরিজের দ্বিতীয় ছবি Night of Dark Shadows, যাতে
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডাইনি হওয়ার – এবং নিজের দেবর বা ভাসুর Charles-এর সঙ্গে পরকীয়া করার
– অপরাধে ফাঁসিতে চড়া Angelique-এর প্রেতাত্মা ফিরে আসে Quentin Collins-রূপে পুনর্জন্ম-প্রাপ্ত
নিজের প্রেমিকের ওপর দাবী নিয়ে, যার ফলে Quentin-এর স্ত্রী Tracy-র জীবন হয়ে ওঠে বিপন্ন!
সম্ভবত
নিউ এম্পায়ারে দেখা আমার শেষ ছবি হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম কিস্তিঃ Harry Potter
and the Philosopher’s Stone।
নতুন
বিদেশী ছবি ছাড়াও পুনর্মুক্তি-প্রাপ্ত কিছু ক্ল্যাসিক ছবিও দেখেছি নবরূপী নিউ এম্পায়ারেঃ
১৯৫২
সালের কমেডি-Western Son of Paleface, অভিনয়ে বিখ্যাত কৌতুক-শিল্পী বব হোপ, আর ছোটবেলায়
যাঁকে নিয়ে একাধিক গল্পের বই আর কমিকস দেখেছি, সেই Roy Rogers ও তাঁর অসাধারণ ঘোড়া
Trigger। ডাকাতরাণী নায়িকার ভূমিকায় জেন রাসেল (যাঁকে ব্যক্তিগত-ভাবে আমার ম্যারিলিন
মনরোর চেয়ে অনেক বেশী আকর্ষণীয় লাগে)।
১৯৩৯
সালের যুগান্তকারী ছবি Gone with the Wind, যা প্রথম দেখেছিলাম এলিট সিনেমার ৭০ মিমি
পর্দায় ১৯৬৮ সালে বাবা-মা-দাদার সঙ্গে। নিউ এম্পায়ারে দেখলাম শ্বশুরবাড়ীর সকলকে নিয়ে,
তবে এবার ৩৫ মিমি প্রোজেকশানে।
নিউ
এম্পায়ারে বিদেশী ছবি ছাড়াও একবার ফিল্মোৎসবের সময়ে দেখেছি একাধিক পুরনো দিনের বাংলা
ও হিন্দী ছবি, বেশীর ভাগ তিরিশ অথবা চল্লিশের দশকে তৈরি, যেমন নিউ থিয়েটার্সের অধিকার
(প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ও অভিনীত, সঙ্গে যমুনা দেবী, মেনকা দেবী, পাহাড়ী সান্যাল,
পঙ্কজ মল্লিক), বিদ্যাপতি (নাম-ভূমিকায় পাহাড়ী সান্যাল, রাজার ভূমিকায় দুর্গাদাস, রাণী
ছায়া দেবী, বিদূষক অমর মল্লিক, এবং, সবাইকে ম্লান করে দিয়ে অনুরাধা-রূপে কানন দেবী),
বম্বে টকীজের অছূত কন্যা (নাম ভূমিকায় দেবিকা রাণী, আর বিপরীতে অশোককুমার), সোহরাব
মোদি পরিচালিত এবং অভিনীত পুকার।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন