সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৯




সীমান্তে

শ্রীনগর। ভূস্বর্গ। অক্টোবরের রাতে বেশ ভালোই ঠান্ডা। গ্লাভসের মধ্যেও হাত একেবারে জমে যাচ্ছে। উত্তরপাড়ার ছেলের মনে কেমন করে যে এই সময় পুজোর ঢাকের বাজনা বাজে তা তার সঙ্গীরা বোঝে না। হাসাহাসি করে। উত্তরাখণ্ডের সানি বলে, ‘আরে ইয়ার, তুম সোলজার হো ইয়া ক্লার্ক হো? ইতনা রোতে হো কিউ? দুগ্গাপূজা মে কেয়া খাস হ্যায়? সুহাস মনে মনে গালি দেয়, সানিকে না নিজেকে, তা বুঝতে পারে না। বাবা বলেছিল, ‘নিজেদের ব্যবসা, খেয়ে পরে চলে যাবে। কী দরকার এসব কষ্টকর কাজ করার? সুখে থাকতে ভূতে কিলাল?’ মা তো হাউমাউ করে কান্না। সমানে বলে যাচ্ছিল ‘ওরে বাবু, তোর পায়ে পড়ি, আমার দিব্যি, যাসনা রে, ওরে তোর কিছু হলে আমি বাঁচব কী করে?’ শুধু চিন্ময়ী বলেছিল, ‘তুমি যাও সুহাস, তোমার স্বপ্ন আমি জানি। আমাদের জন্য সে স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ো না’। হ্যাঁ, সুহাসের একটা অদ্ভুত স্বপ্ন জ্ঞান হওয়া থেকেই, সে সীমান্ত পাহারা দেবে। বাইরের কেউ তার দেশে ঢুকতে গেলে আগে তাকে মারতে হবে। সাধারণ ভীতু পরিবারের ছেলের যে কেন  এরকম একটা আশ্চর্য স্বপ্ন বুকের মধ্যে পোষা ছিল তা সুহাস নিজেও জানে না। চিন্ময়ীকে এক দুর্বল মুহূর্তে বুকের মধ্যে নিয়ে বলেছিল এ কথা। চিন্ময়ী তার সুঠাম মেদহীন শরীরে ঘন হয়ে বলেছিল, ‘আমার তোমার জন্য গর্ব হচ্ছে। তোমার এই স্বপ্ন পূরণের জন্য যা করার করো।’

সুহাস তখন ভেবেছিল, এ মেয়ে তো একেবারই অন্য রকম!

সুহাস যখন সীমান্তে এলো মায়ের কান্না উপেক্ষা করে তখন চিন্ময়ীর শরীরে মা হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট।

সুহাসের হাতটা পেটের ওপর রেখে বলেছিল চিন্ময়ী, 'তুমি থাকলে আমার সঙ্গে'।

‘আরে কী ভাবছিস রে সুহাস? শিগগির চ। কমান্ডো হরিপ্রসাদ মিটিং ডেকেছেন।’

‘এতো রাতে!'

’’আমাদের আবার দিন আর রাত?

রাত দুটোর সময় মিটিং রুমে কমান্ডো জানান একটা নয়, দুটো নয়, অন্তত সাতটা সোলজার ভর্তি ট্যাঙ্কর বর্ডারের দিকে এগিয়ে আসতে দ্যাখ গেছে। পাকিস্তান থেকেই আসছে, অনুমানে এখনও পর্যন্ত তাই মনে হচ্ছে। এখনই তাদের সকলকে তৈরী থাকতে হবে।

সীমান্ত বরাবর রকেট লঞ্চার বসানো। তার একটার পিছনে শুয়ে পড়ে সুহাস। তার পুজোয় বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি চাওয়ার চিঠিটা পকেট থেকে বের করে দুমড়ে ফেলে দেয় পাশে। আজ তার ছেলের তিনবছর পূর্ণ হলো। এখনও সে ছেলেকে স্পর্শ করেনি।

সীমন্তে সেই প্রথমদিন থেকে অপলক তাকিয়ে থাকে সুহাস। দূরে। কখনও ওপারে, কেউ ঢুকছে কী না দেখতে। কখনও এপারে ফোনের ছবির দিকে। স্বপ্নের মধ্যে সে এখন তার ঘর দ্যাখে। বাবা, মা, চিন্ময়ী আর তার কখনও কোলের মধ্যে জড়িয়ে না ধরতে পারা ছেলেকে। যে ছেলে তার ছবির দিকে দেখিয়ে বলে, ‘আমার বাবা সোলজার’।

ট্যাঙ্করগুলোকে এগিয়ে আসতে দ্যাখে সুহাস। লঞ্চারের ট্রিগারে আঙুল ঠেকায়।

কানে ভেসে আসে, ’ফায়ার’! 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন