শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

রাশিদা সুলতানা

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্বপ্নমঙ্গল

এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইন পার হয়ে এসে স্যুটকেসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছি। একের পর এক লোকজন তাদের স্যুটকেস নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার স্যামসাং স্যুটকেসের মতো কয়েকটা স্যুটকেস এলো। হাতলে ছোট লাল ফিতা বাঁধা আমার স্যুটকেসের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। স্যুটকেসটিকে দৃষ্টিসীমানার মাঝে পেয়ে গুপ্তধন পাওয়ার আনন্দে ট্রলি ঠেলে বের হই। ট্যাক্সি নিয়ে বুকিং দেওয়া হোটেলের সামনে নামতেই হোটেলের ম্যানেজার মোহাম্মদ তার সহজাত উজ্জ্বল হাসিতে অভ্যর্থনা জানায়। রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখে রুমের চাবি নিয়ে ফিরতেই দেখি, হোটেলের লবিতে বসে আছো তুমি। সামনে হুইস্কির গ্লাস। অনুমান করেছিলাম তোমার সাথে দেখা হবে আবার। মাত্র দু’দিন আগে স্বপ্নে দেখেছি মৃতদের রাজ্যপাট ঘুরে দেখাচ্ছ আমাকে। বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছিল তোমাকে তখন।

এত দ্রুত দেখা হবে ভাবি নাই। সাত-আট দিন আগে লন্ডনে চ্যানেল আই সংবাদে দেখেছি তুমি মারা গেছ। সংবাদে বলছিল সত্তর বছর বয়সে। কিন্তু ইনসেটে পঞ্চাশের বেশি মনে হয় নাই, এখন মনে হচ্ছে পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ।

আমি বলি, “পত্রিকায়, টিভিতে দেখলাম তোমাকে খানিক বৃদ্ধ দেখাচ্ছে, চামড়া কুঁচকে গেছে, এখন এত ইয়াং লাগতেছে কেমন করে?”

হোটেলের লবিতে লোকজন দেখছে আমি উত্তেজিতভাবে কথা বলছি, আমার দু’চোখে বিস্ময়। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করলে, কাছে এসে বললে, “আস্তে কথা বলো, প্লিজ! চারপাশের সব মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।”

জিন্স আর কালো-লাল টিশার্ট পরা, যার বুকের উপর লেখা “হাকুনা মাতাতা”, আকর্ষণীয় দীর্ঘদেহী তরুণ হেঁটে আসছে পঞ্চাশ-ছুঁইছুঁই পৃথুলা আমার পিছে পিছে।

রুমে ঢুকে সব লাইট জ্বেলে দেই।

প্লিজ, লাইট কমাও, টিভি অন করে দিতেছি, ভল্যুম বাড়ায়া দিতেছি, হোটেলের লোকজন সন্দেহ করবে।”

হাস্যকর! অন্যদের নিয়া তোমার দুশ্চিন্তা আর গেল না। লাভ কি লাইট কমায়া? তুমি হয়তো এখুনি উধাও হয়ে যাবা। আমি জানি এটাও স্বপ্ন, স্বপ্ন ভাঙলে শুধু দীর্ঘশ্বাস।”

এই স্বপ্ন তুমি আমৃত্যু দেখবা, তোমার যন্ত্রণা কোনোদিন কমবে না। প্লিজ, লাইট বন্ধ করো। টিভি অন করে ভল্যুম বাড়াও। এত জোরে কথা বলতেছ পুরা হোটেলের লোকজন টের পাবে রুমের ভেতর কী হচ্ছে।” তুমি নিজেই বাথরুমের শাওয়ার ছেড়ে দাও, রুমের লাইট বন্ধ করে টেলিভিশন চালু করো উচ্চ শব্দে।

কে কী শুনল তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। তোমার মতো রাজনীতি করার বা মন্ত্রী হওয়ার প্ল্যান আমার কখনোই ছিল না।”

টিশার্ট খুলে ফেললে তুমি, টেলিভিশনের হালকা আলোয় তোমাকে গ্রীক ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছে; খাঁজকাটা বুক, নিখুঁত বাহু, গ্রীবা আর পেশী।

চব্বিশ বছর আগে প্রথম যেদিন দেখছিলাম তোমাকে, ঠিক তেমন সুন্দর লাগতেছে। টিভিতে দেখলাম তোমার ছবি, মারা গেছো, অনেক ভক্ত, রাজনৈতিক নেতা, প্রচুর ভিড়, ছবিতে তোমাকে বৃদ্ধ লাগতেছিল।”

না, মারা যাই নাই তো। তাইলে ওটাও স্বপ্নে দেখছো। আমি যেমন ঠিক তেমনই দেখতেছ এখন। এখন বকবকানি থামাও, প্লিজ, অনেক পাগলামি হইছে।” বলে আমার ঘাড়ে, মাথায়, কপালে আলতো চুমু খেতে খেতে আমার জীবনের সব যন্ত্রণা চুমুকে শুষে তুমি নাও।

চব্বিশ বছরের এই স্বপ্নপ্রয়াণ। দিনটা কোনোভাবে পার করি; স্বামী, সন্তান, চাকরি, সমাজ- আর অপেক্ষায় রাত্রির, ঘুমের...

তুমি একবার বলো, “কিছুদিন আগে... আমার নানির বাড়ি গেছি তোমাকে নিয়ে। সারাটা উঠান ফেটে চৌচির, এখানে ওখানে অযত্নে বেড়ে ওঠা লেবুগাছ, ঘাস, আগাছা। বাড়িময় মাকড়শার জাল আর ঝুল। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, সবই জীর্ণ-মলিন। আমার চার খালার সবাইকে অপুষ্ট দেখাছে। সবারই মাথা মোড়ানো। তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার প্রেমিকা বলে। খালারা সবাই থুথু দিচ্ছে আমাদের আর পাশে আমার মা, পুরোপুরি নগ্ন। তুমি দেখে ফেলবে ভেবে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম। উঠানের পাশে কাঁঠাল বাগানের নীচে চেয়ারে বসে বেশ ক’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমাদের দিকে চোখ রাখছিল আর ফিসফিস করছিল নিজেদের মধ্যে। তোমার মনে পড়ে?”

না, পড়ে না। আমার একটা অভিজ্ঞতা তোমাকে বলি : একটা মাঠে তোমার কোমর জড়ায়ে হাঁটতেছি। মাঝেমাঝেই লম্বা ঘাসে আমার পা জড়িয়ে যাচ্ছে। দূরে একটা সামার হাউসের মতো বাড়ি, সামনে ধবধবে সাদা চেরি ফুলে পুরো বাড়ি আলোকিত। মাঠের পরেই জংলামতো বড়-বড় ঘাস, গাছ, আর তার পরেই বড় একটা লেক, লেকের অপর প্রান্তে পাইন বন। হাঁটতে হাঁটতে লেকের কাছে পৌঁছাই। সবুজ মাথাওয়ালা তিনটা হাঁস পানিতে খেলছে। বিকালের হাল্কা হাওয়ায় ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে নিরন্তর। হঠাৎ পিছনের পাইন বন থেকে সশব্দে কোনো প্রাণী ছুটে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখি একটা এল্ক্, সেও ভয়ার্ত চোখে আমাদের দেখছে।

হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে তোমার গায়ে হেলান দিয়ে মাঠে বসে পড়ি। তোমার কোলে শুয়ে আকাশে তুষারসাদা মেঘের গায়ে শেষ বিকালের সূর্যচ্ছটা প্রতিফলিত হতে দেখি। তুমি বলছিলা, আমার চোখের তারায় আকাশের সাদা মেঘের ছায়া দেখা যায়। তুমি গল্প করছিলা পাইন গাছের দীর্ঘ জীবনের রহস্য; কেমন করে পুরো শীতকাল বরফঢাকা থেকেও এর পাতা সবুজ থাকে; আর মাঠে উড়ন্ত প্রজাপতির ডানার ঝিলমিল দেখে আমার উচ্ছ্বাসে তুমি হাসতেছিলা। তোমার কোলে শুয়ে দেখি উষ্ণ বাতাসের মৃদু ঝাপটায় তোমার চুল উড়ছে, তুমি গল্প করছ গাছভর্তি থোকা থোকা সফেদ নক্ষেত্রের মতো চেরি ফুলের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী, তুমি গল্প করছ আর আমি তখন ভাবছি আমার পাশে যতক্ষণ থাকো ততক্ষণই ভালবাসবে আমাকে, তারপর আর বাসবে না।”

আমি বলি, ‘ তুমি আসলে আমাকে আর ভালবাসো না।’

তুমি বলো, ‘ অপ্রেমটা খুব তড়িঘড়িই অনুমান করে ফ্যালো। অপ্রেমই তুমি চাও?’

- আমি তো মরে যাব, জান।

- বাট ইউ আর অলওয়েজ টু ইগার টু ইনফার ইট। তোমার মুখে যেন লাইগাই থাকে এই বাণী।

- আসলে ইনসিকিওরড ফিল করি।

- তোমার সুখের মেয়াদ সবসময় এত কম।

- তুমি তো কিপটার মতো আদর করো।

- তোমার যন্ত্রণা দেখে কষ্ট পাই। যতটুকু তোমারে চিনি আমি বুঝি আমৃত্যু কষ্ট পাবা তুমি। আমার লোড

হয়ে যায় কখনও কখনও। আমাদের সম্পর্কটা হতে হবে সহজ স্বাভাবিক এবং সত্য, কিন্তু তুমি এত টেনশন করো যে আমার ভয় লাগে। কোনটা চাও তুমি? স্থায়িত্ব না তীব্রতা?

- স্থায়িত্ব, পৃথিবীর কোনোকিছুর বিনিময়েই হারাতে চাই না তোমাকে।

- তোমার পাগলামিতে আমার টেনশন লাগে গো, এতে তীব্রতা আসে কিন্তু স্থায়িত্ব কমে।

- কী করব বলো? চব্বিশ বছর তোমাকে চেরিশ করেছি। চব্বিশ বছর আই হ্যাভ বিন লিভিং আ ডাবল-লাইফ।

- এটা তো ঠিক না, বেবি। সারাদিন আমার যা ব্যস্ততা তাতে স্বপ্নবিলাসের সময় কই আমার। প্রতিদিন হাজার মানুষের হাজার সমস্যার সমাধান দিতে হয়।

- শোনো, তোমার সাথে আমার পার্থক্য হইতেছে, আমার সাথে কাটানো এ-সময়গুলো তোমার জন্য বিলাসিতা, অ্যান্ড দ্যাটস মাই লাইফ। এমন তীব্র উন্মাতাল সুখের এবং যন্ত্রণার জীবন বোধ হয় আর কারো নাই। এতগুলা বছর...

কিন্তু আমি চাই না এ অস্বাভাবিক জীবন তুমি যাপন করো।’ তারপর আমার কপালে চুমু খেয়ে চলে যেতে চাইলে তোমাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরি। আমার হাত ছাড়িয়ে চলে গেলে তুমি। পাইন বনের পাশে খোলা প্রান্তরে চিৎকার করে কাঁদি। আমার বিছানায় তীব্র হৃৎস্পন্দন নিয়ে জেগে উঠি। বাকি রাতটা বারান্দায় বসে কাটে।”

তোমার বুকের খাঁজে আঙুল দিয়ে নকশা আঁকতে আঁকতে বলি, “তোমার কী মনে আছে এই কথা?”

হ্যাঁ, মনে আছে। আমি আসলে অনেস্টলি চাইছি তুমি এ থেকে মুক্তি পাও।”

আমি বলি, “শোনো, তারপর অনেকদিন তোমারে দেখি নাই, বা হয়তো টানা তোমাকে ফোন করে যাইতেছি, ফোন তুমি রিসিভ করো না, বা মোবাইল বন্ধ করে রাখো। হায় কী ভীষণ! সারাক্ষণ হইটম্যান জপি প্রায় তসবি গোনার মতো। শব্দগুলি, বাক্যগুলি একসময় আমার হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আমার ধমনীতে, শরীরের প্রত্যেক কোষে-কোষে:


Blow! Blow!Blow!

Blow up sea-winds, along Paumanok’s shore!

I wait and I wait , till you blow my mate to me.


Soothe! Soothe! Soothe!

Close on its waves soothes the wave behind,

Again another behind, embracing and lapping,

Everyone close,

But my love soothes not me, not me.


Loud! Loud!Loud!

Loud I call to you, my love!

High and clear I shoot my voice over the waves,

Surely you must know who is here, is here,

You must know who I am, my love.


Land! Land! O Land!

Whichever way I turn

O I think you could give me

My mate back again.


তুমি বলো, “তোমার কি মনে পড়ে ঝড়ের দিনে তুমি আমার বাড়ি এসে হাজির? জরুরি কাজে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি বড় বড় সব গাছ মুখ থুবড়ে, শাখাপ্রশাখা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে রাস্তার উপর। পৃথিবী নিকষ অন্ধকার। এমন দুর্যোগে বাড়ি ফিরে দেখি আমার বেডরুমে বসে আছো। সারা শরীর ভেজা। কাঁপছ কবুতরের মতো। আমি জড়িয়ে ধরতে, বললে, পুরো বাস-এ এই দীর্ঘ পথে তুমিই ছিলা একমাত্র, শঙ্কিত, যাত্রী।”

আমি বলি, “হ্যাঁ, সেদিন খুব ভয় পাইছিলাম বাস-এ। আর ড্রাইভারটার লাল দুই চোখ, যেন বাস-এর ভিতরে দুই হেডলাইট।

আরেকদিন তোমার সাথে খুব ঝগড়া হবার পর অন্ধকারে রিকশায় বসে কাঁদছি। রিকশাওয়ালাকে বলছি শহরে তার ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে, টাকা যা লাগে দিব। আমি তোমাকে বলেছিলাম, ‘ছোটলোক, বদমাইশ, লাফাঙ্গা, প্রায় তোমার সমান লম্বা ঐ স্নিগ্ধার সাথে তোমার সম্পর্কের কথা সবাই বলতেছিল। ঐ হারামজাদি আমার কয়েকজন বান্ধবীরে বলছে নিয়মিত তোমার বাসায় গিয়া তোমারে পানিশমেন্ট দিয়া আসে। পুরো শহরে বিদ্যুৎ ছিলো না। অন্ধকারে রিকশাায় কেঁদেছি আর গালি দিয়েছি।

তুমিও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলে, ‘তোমার এত বড় সাহস, আমাকে গালি দিচ্ছ? লোকের কথা ঠিকমতো যাচাই না-করেই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছ?’

আমি বলেছি, ‘তুমি জানো না তোমারে কতখানি আমি ভালবাসি? তোমারে নিয়া কিছু শুনলে আমার দুনিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, বোঝো না? আজ সারারাত আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব বা নদী পার হয়ে পদ্মার চরে গিয়ে ঘুমাব, বাসায় আমি ফিরব না, শান্তিতে থাকো তুমি।’ বলে ফোন কেটে দিয়েছিলাম।

টি গ্রেইন বাঁধের পাশে নেমে রিকশাওয়ালাকে টাকা দিয়ে দেই। বিদ্যুৎহীন শহরে সুনসান রাতে বাঁধের উপরে হাঁটি। জেগে থাকা বৃক্ষ, পদ্মার সরু-সরু জলস্রোত আর সমুদ্রের মতো বিস্তৃত চর জোৎস্নায় পরিপ্লাবিত। দূরে বাঁধের উপর জেগে থাকা কিছু মানুষের হল্লা শোনা যাচ্ছিল। বাঁধ থেকে নদীর কিনারে নেমে আসি। পা জড়িয়ে যাচ্ছিল চোরকাঁটায়। ডেবে যাচ্ছিল কাঁদায়। সামনে নলখাগড়ার বন। কিছু দূরে একটা নৌকা। বাতাসে জলীয় গন্ধ। তিড়বিড় পানির স্রোত সাপের মতো ছুটে পালাচ্ছে। আকাশের মেঘ আর চাঁদটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। তখন তুমি ফোন করে বললে, ‘কানতেছ এখনও?’

- না।

- কোথায় তুমি?

- পদ্মার পাড়ে।

- চলে আসো আমার কাছে, ঢাকায়। সোজা আমার বেডরুমে।

- এত কষ্ট কেন দাও আমারে?

আমি ফুঁপিয়ে উঠি। বাঁধের উপর ফিরে রিকশায় উঠে তোমার এসএমএস পাই, ‘ইউ অর সাচ আ সানসাইন, লাইফ অ্যান্ড লাভ ইজ স্মাইল অব ইয়োর আইজ। স্টে হোয়াট ইউ আর।’

পরদিন সারাদিনই ঘোরে কাটে। সন্ধ্যায় সিনডারেলার ছাদে ইচক দুয়েন্দেকে বলি আমার স্বপ্নলোকের বৃত্তান্ত। তাঁকে বলি, ‘জানেন, বাসার সবাই ভাবে আমি এমন ঘুমপাগল কেন। কাজ থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়েই সোজা বিছানায়। টিভি দেখি না, কারো সাথে আড্ডা না, কোনো বই, ম্যাগাজিন কোনো কিছু না... সমান্তরাল দুটো জীবন।’

ছাদে জোৎস্নাপ্লাবিত ইচক দুয়েন্দে ড্রাই বানাতে বানাতে বলে, ‘আপনি দারুণ একটা মেয়ে।’

রুমে এয়ারকন্ডিশনের ঠাণ্ডায় লেপটা শরীরে টেনে নিয়ে তোমার হাতের উপর থেকে মাথাটা সরিয়ে মাথার নীচে বালিশ দিতে দিতে বলি, “এখনও পদ্মাপাড়ের কথাটা মনে হলে কী যে লজ্জা লাগে। কত যে বাজে কথা তোমারে বলছি।”

তুমি জবাব দাও, “কই, এমনকিছু মনে পড়ে না তো আমার?”

আমি বলি, “শাওয়ারটা বন্ধ করি? পানির অপচয় মানতে কষ্ট হচ্ছে। টিভি-র ভল্যুমটাও কমিয়ে দেই, কী বলো। লোকজন হয়তো ঘুমাতে চলে গেছে।”

না না, এখনও না। তোমার কথা সবাই শুনে ফেলবে।”

তোমার অনর্থক অতিসতর্কতা থেকে খোদা আমারে বাঁচান,” আমি বলি, “টিভিতে যখন তোমার মৃত্যু সংবাদ দেখছি, দেখছি তোমার ভক্তকুল কাঁদছে তোমার মৃতদেহ ঘিরে, আমি কিন্তু জানি তোমাকে আমি হারাই নি, বরং আরও বেশি করে হয়তো পাব এখন।

তোমার পাশে হাঁটছি, বুনো ঝোপঝাড়, পাথুরে ন্যাড়া পাহাড়, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে কিছু বাও বাও গাছ। নিথর হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কবুতর, চিল। খরতাপে সব দৃশ্য কাঁপছিল চুলার উপরের বাষ্পের মতো। নিস্তব্ধ এই পাথুরে এলাকা পার হয়ে গেলে সামনে একটা নারীর কালো নগ্ন মূর্তি, এক বিশাল সামুদ্রিক মাছের পিঠে বসা। তার সামনেই একটা হ্রদ। সেখানে ছড়িয়ে আছে কয়েকটা দ্বীপ। নানাবয়সী লোকজন দ্বীপগুলায়। তুমিসহ দ্বীপের সব মানুষই সাদা কাফনের কাপড় পুরাকালের রোমান নরনারীদের মতো গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। মাথার উপর গাছে বাদুড়, চিল আর শকুন। পানির উপর ভেসে থাকা গাছে কানি বক এবং সারস, আর ছিল মস্ত মস্ত একেকটা ফার্ন, প্রায় নারকেল গাছের সমান। বাতাসের ঝাপ্টায় ঝাপ্টায় ধুধু শোনা যায় কত অশরীরী প্রেমালাপ, কত হাহাকার, কত গুমরানো কান্না আর দীর্ঘশ্বাস। একটা মরা গাছের গুঁড়িতে বসে আঙুর খাচ্ছিল একটা লোক, তুমি ফিসফিস বললে, “এই লোকটা খুব নামজাদা মন্ত্রী ছিল। তার আগে ছিল সরকারি আমলা। সুশাসক বলে পরিচিত ছিল সে, ছিল ‘রিজনেবলি অনেস্ট’-ও। বহু মানুষের উপকার করেছে চাকরি-জীবনে। বিপন্ন কাউকে ফেরাতেন না। মিডিয়ার কল্যাণে, মন্ত্রিত্ব থেকে রিটায়ার করার পর তিনি হয়ে উঠেন দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের একজন। দেশের আপদে বিপদে বিবৃতি দিতেন। সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন তিনি চোরছ্যাঁচর, বেশ্যা, দালাল, ছিনতাইকারী, গাঁজামদখোর, খুনি-ডাকাত, ইভটিজার, পরকীয়া প্রেমিকদের ধরে ধরে ক্রসফায়ারে মারেন। মন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন আগে হজ্ব করতে গেলে দু’চারজন ঈর্ষান্বিত সহকর্মী বলত ‘ তামাম চুহা খা-কর বিল্লি চলে হজ্ব-কে’। এমন কিছু পরশ্রীকাতর লোক ছাড়া, মিডিয়া-সহ অন্যেরা তাঁকে খুবই পছন্দ করত।”

লোকটার কাছেই, পাখির বিষ্ঠায় আকীর্ণ একটা পাথুরে বেঞ্চিতে ঘুমন্ত এক মেচেতাভরা নারীমুখ। কণ্ঠার হাড় বেরুনো। ঘুমের মাঝেও তাকে ভারি কাহিল দেখাচ্ছে। তুমি বললে, ‘মেয়েটার নাম পারুল, বেশ্যা ছিল গুলশান এলাকায়, বড়লোকদের ড্রাইভার, দারোয়ান, কেয়ারটেকাররাই হত তার শয্যাসঙ্গী। গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাত, গ্রামে পাড়াপড়শি-আত্মীয়স্বজন জানত, ঢাকায় চাকরি করে সে। বাড়িতে বাবা গুরুতর অসুস্থ শুনে তার চার মাস বয়সী সন্তানকে তার বৃদ্ধা পড়শি মাজেদার কাছে রেখে সে খদ্দেরের খোঁজে বের হয়। সে-রাতে গুলশান থানার পুলিশ সমাজের নৈতিকতা রক্ষায় এলাকা থেকে পারুল-সহ বেশ কয়েকজন ভ্রাম্যমান পতিতাকে থানায় নিয়ে যায়। সারারাত থানায় ডিউটি অফিসারের সামনে বসে কেঁদেছে সে, “আমার দুধের বাচ্চা রাইখা আইছি ল্যাংড়া এক বুড়ির কাছে, না খাইয়া বাচ্চাডা মইরা যাইব।”

নষ্ট মেয়েমানুষের মুখে সংসার-সন্তানের জন্য নাকিকান্নায় পুলিশের মন গলে নাই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। পাঁচ দিন পর তার কাছে সংবাদ পৌঁছায় যে দুধের অভাবে এবং ডায়রিয়ায় মারা গেছে তার বাচ্চাটা। সন্তান হারানোর বেদনায় কিংবা অসুস্থতায়, সেও সপ্তাহ-খানেকের মাথায় মারা যায়।’

পারুলকে দেখিয়ে তুমি বলছিলে, ‘এখন ঘুমিয়ে আছে বলে বুঝছ না। জেগে থাকলে রাতদিন সে বিলাপ করে হারানো বাচ্চাটার জন্য।’

তারপর তুমি দেখালে পাহাড়ের পাথরের উপর মাঝারি উচ্চতার শ্যামলামতো এক লোক গান গাইছে, ‘একবার দেখেছিনু আপনা ভুলিয়া’। লোকটার পাশে বয়ে যাওয়া ঝর্নাটা দেখিয়ে বললে এটা একটা উষ্ণ প্রস্রবণ। লোকটার দিকে আঙুল তুলে বললে, “এর নাম বাবুল। পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিল, ক্রসফায়ারে মারা যায়। এইখানে এই মানুষটাই সবচেয়ে হাসিখুশি থাকে। মারা যাওয়ার পর জীবিত সব আপনজনের স্মতিতে ধুলা পড়লেও, তার বারো বছরের মেয়েটা সারাদিনই কথা বলে তার সাথে। মেয়েটা খুলনা করোনেশন গভর্মেন্ট স্কুলে পড়ে। বাড়িতে দিনরাত টেবিলে মুখ ডুবিয়ে থাকে। সবাই জানে সে খুব পড়–য়া, কিন্তু আসলে সারাদিনই গল্প করে বাবার সাথে। সারাদিন বন্ধুদের সাথে কী-কী করল, শিক্ষক বা বন্ধুরা কী-কী বলল, বাসার সবাই কে কী করল, প্রতিদিনের জমে-ওঠা সব গল্প বাবাকে বলে তবে সে ঘুমায়।

কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, মেয়েটা বাবুলের ঔরসজাত নয়। ওর বাবা-মা দু’জনকেই বরং বাবুল খুন করেছিল। ওর বাবা ছিল ইউপি চেয়ারম্যান। বাবুল তার পার্টির আরো কিছু লোকজন নিয়ে রাতের বেলা তার ঘরে ঢুকে ওর বাবাকে যখন গুলি করে, মেয়েটা বাবার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। মেয়েটার মা পাশের ঘর থেকে ঢুকে স্বামীকে গুলিবিদ্ধ দেখে চিৎকার দিলে তারা তাকেও গুলি করে। বাবার গায়ের রক্তে পাঁচ মাসের ঘুমন্ত শিশুটা জেগে উঠলে বাবুল বিহ্বল হয়ে পড়ে। মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে আসে। পথে কোনো এক জলাশয় থেকে তার গায়ের রক্ত ধুয়ে তাকে তার বউয়ের হাতে দেয়। বাবুল বেশিরভাগ সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকত। যখনই বাড়ি ফিরত, মেয়েটাকে নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়াত, গোসল করাত, এমনকি মেয়ের কাপড়চোপড়ও নিজ হাতে ধুয়ে দিত। মেয়েও ছিল বাবা, মানে বাবুল, বলতে অজ্ঞান। এই মেয়েটাই মৃত্যুর পরও তাকে এত সুখী রেখেছে।”

আমি বলি, “ওর পর-দিন সারাদিনই পারুল আর বাবুলের মেয়ের কথায় আছন্ন হয়ে ছিলাম।” তুমি বললে, “বাবুলকে এত সুখী দেখে আমারও বিস্ময় লাগত।”

টিভির শব্দে আমার ভারি অস্বস্তি হচ্ছে। তোমার চোখ-দু’টি ঘোলাটে, যেন অন্য আরেক পৃথিবীকে তুমি দেখছ। আমি বলি, “প্লিজ, শাওয়ারটা বন্ধ করি। টিভিও।”

ঠিক আছে, ফিসফিসিয়ে কথা বলো।” তুমি বললে। টিভি বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার বন্ধ করতেই দরজায় অনেক মানুষের শব্দ শুনতে পাই। ভিউ হোলে চোখ রাখি, দরজায় প্রায় এক মিছিল। প্রাক্তন মন্ত্রী, পত্রিকা সম্পাদক, ফটোগ্রাফার, প্যাপারাৎসি, আরব, আফ্রিকান, পোপ, রাজনীতিক, সরকারি আমলা, পুলিশ, কত যে! তার মাঝে একজোড়া বড়-বড় চোখ, অনেকেই হয়তো ঈশ্বরের নির্ভরতা পায় এই দু’চোখে, কিন্তু আমি সারাজীবন যত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, তার প্রত্যেকটিতে এই বড় চোখের লোকটা ছুির হাতে তাড়া করেছে আমাকে, আমি পালিয়েছি বনেজঙ্গলে, -ঘর থেকে ও-ঘরে। আতঙ্কিত ফিরে আসি আমি, আমার প্রেমিকের কাছে। বলি, “শুনতে পাচ্ছ, তুমি শুনতেছ? এখানে একটা বড়-বড় চোখের মানুষ আছে, তার হাতে ছুরি। আমাদের খুন করবে ওরা।”

তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো: “ভয় পেয়ো না, কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। কেউ নাই ওখানে।”

ততক্ষণে শত মানুষের চিৎকার, দরজায় ধাক্কা আমার স্নায়ুতে, শিরাতে বইতে থাকে। তোমাকে গায়ের জোরে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখি। খানিক পর সব শান্ত হয়ে আসে। আস্তে আস্তে নীরব হয়ে যায় পুরো পৃথিবী। তোমার শরীরটা ঠাণ্ডা পাথরের মতো লাগে। চোখ মেলে দেখি ধবধবে সাদা মার্বলের একটা গ্রীক ভাস্কর্যকে জড়িয়ে ধরে আছি। কী অনুপম সুন্দর তার শরীর, কাটা-কাটা চোখ-নাক-ঠোঁট, বুকের খাঁজ। আর তার পরই, কোথায় কী, শুয়ে আছি সিডনির এক ব্যাকপ্যাকার্স হোটেলে। উঁচু সিলিংয়ে একটা ফ্যান ঘুরছে ঘটাং ঘটাং, একমাত্র জানালাটি দিয়ে ভোরের সূর্য ঢুকছে ঘরে। প্রচুর ধুলা জানালায়।







1 টি মন্তব্য: