শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


মথ

অপঘাতে মিত্তু হলে সে ভুত হবেই। মুক্তি নেই। এই বলে পিসি চলে গেল দালান পেরিয়ে রান্নাঘরে। আমি বসে রইলুম পশ্চিম কোণার শোবার ঘরে। এমন বর্ষার সন্ধ্যায় হঠাৎ কারেন্ট অফ হয়ে গেলে একখানি টিমটিমে ল্যাম্পের আলো কতখানি মস্তিষ্কের যুক্তি বুদ্ধি আর কতটা সচল রাখতে পারে, তা অনুমানযোগ্য। বাইরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। একটানা ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ আর দূরে ট্রেন যাবার হুইশিল বিনা আর কিছু নেই। বাইরের খণ্ড খণ্ড অন্ধকার ঘরের এখানে সেখানে জটলা করে আছে। এপাশ ওপাশ ভয়ে ভয়ে তাকাই। দু চারটে মশা সুরধ্বনি করে ঘিরে ঘিরে নাচছে। ঘরের ভেতর খুট করে শব্দ হয়। খাটের নিচে কখনও আলমারির পাশের অন্ধকার প্রদেশে। যত রাত বাড়ে এই সব মহা জাগতিক আওয়াজে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীর। যেন পিঠে হিম হাত রাখবে কেউ। কোত্থাও কিছু নেই দুম করে মনে পড়ে গেল সিস্টার হেলেনা মণ্ডল গত সোমবারে মরে গেছে। মা বলতেন মরে গেছে বলতে নেই, বলো মারা গেছেন। স্কুল পেরিয়ে পিচরাস্তা। তারপর নদী। আর নদীর পাড়ে মাঠ, মাঠের শেষে কবরখানা। বন্ধ ঘরের ভেতর উড়ছে মথ। একটুখানি মথের বিরাট ছায়া আছড়ে পড়ছে এপার থেকে ওপার। মথটার নাম কি হেলেনা মণ্ডল? কারা যেন গলা টিপে খুন করে ফেলে গেছিল নদীর ধারে। গ্যাং রেপ। দেওয়ালে বিরাট টিকটিকি। বেরোবার পথ নেই।

মুক্তি নেই দেহের খাঁচা থেকে আত্মার। কী থেকে কী! তবু অন্ধকার চিরন্তন। ভয় চিরন্তন। এইসব ওড়াউড়ি মনের বন্ধ ঘরে। চলছে চলবে।

ভেতরে পা দিতেই খারাপ খবর। কেউ টালিগঞ্জ, কেউ সরোবর, কেউ নজরুল নামবে। অথচ উঠেছে কোন দশকে কে জানে! একটা বিশালাকায় এনাকোণ্ডার মত এগিয়ে যাচ্ছে সুরঙ্গ দিয়ে ট্রেন। ডিপ ফ্রিজে একরাশ জীবন্ত লাশ। মোবাইল আলো।

এদিকের সারিতে ঘুমে ঢুলে পড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, এখন নয় পরে কোনো এক দূরবর্তী স্টেশনযাত্রী। মেজাজ চিত্তির। শোভাবাজার থেকে উঠে গীতাঞ্জলি। লম্বা পথ। অর্ধশতকের পদাতিক অবসন্ন।

নামগুলো সুরঙ্গপথে অমর। অন্তত বাচ্চারা জিজ্ঞেস করবে কে উত্তমকুমার তারপর সূর্য সেন তারপর হঠাত গীতাঞ্জলির পর শহীদ ক্ষুদিরাম আর তারপরেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই নেমসেক চলাচল মনের গতির মত বিক্ষিপ্ত। তাৎপর্যহীন সূত্রছেঁড়া ঘুড়ি। হঠাৎ একটি ফাটা জিন্স কালো টপে চোখাচোখি হতে ইসারা করল। সামনে আসতেই ফুরুৎ করে ভিড় গলে নেমে গেল। বসা হলো। একটা কাঁটা টক করে খোঁচা দিল। এত লোক থাকতে হঠাত করে বিশেষ একজনকে? আমাকেই কেন? তবে কি দেখতে আজকাল বুড়ি লাগছে? ক্লান্ত? অথবা চেনা কেউ অচেনা ভিড়ে?

ওয়াটস্যাপে তেমন কোনও ব্যাকুলতার মেসেজ নেই। থাকত। কয়েকটি লাইক কমেন্ট ছুঁয়ে মুখ তুলতেই ঝাপসাকাঁচ। ওপারে কালচে গাছের সারি মেঘলা বিকেল। সমিত আজকাল সরে যাচ্ছে যেন। নির্বিকার। এভয়েড করছে বেশ বোঝা যায়। ব্যস্ত সব সময়। সব সময় ব্যস্ত! পরের বরের থেকে বেশি আর কী আশা করা যায়। পটি পটি পাচ্ছে, সেই ভোর থেকে বিকেল, কোভিডের পর সময় পরিবর্তন হয়েছে ইস্কুলটায়, ফোন বাজছে ছেলে বলছে কিছু, অন্ধকার হয়ে আসছে দিন। পরবর্তী স্টেশন নেতাজি। উসখুশ শরীর। কতদিন উপোস। তারপর নামা। চলমান বিশ্বের পতন।

ভীষণ বাজ আর বৃষ্টির মধ্যে প্লাস্টিকের ঘেরাটোপে অটোর ভেতর অন্ধকার। ফেরার পথ দুর্যোগপূর্ণ। পিসী কত বছর আগে চলে গেছে মরে হেজে। রাতগুলো একই আছে। মন বাড়ে না। পাশে খসখস কেউ বসেছে। আবছা অন্ধকারে অস্পষ্ট অবয়ব। সিস্টার হেলেনা। হাসছে। মুখের ভেতর অন্ধকার। একটা মথ উড়ছে। খুব জোরে একটা বাজ পড়ল।









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন