সমকালীন ছোটগল্প |
রফা
আজ বেশ কয়েকদিন ধরেই একই বিষয় নিয়ে তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে এলাকার কাউন্সিলর তপন দেবনাথ। কিন্তু সুকুমার দাস বোঝা তো দূরের কথা, তপন দেবনাথের কথায় কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না । তার বাড়ির বারান্দায় ছোট্ট ঘুপচি চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে বসতে বসতে তপন বলল,
-- সুকুমার, দুটো আচ্ছা করে দুধ
চা বানা তো।
-- কেন? তুমি তো একা, দুটো কেন?
তাহলে বলো বড়ো করে বানিয়ে কাঁচের গেলাসে দিচ্ছি।
-- আরে ধুর। আমার একটা আর তোর একটা।
-- আমার?
-- হ্যাঁ, রোজই তো আমাদের চা খাইয়ে
গেলি। আজ না হয় আমিই তোকে একটা চা খাওয়ালাম। এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি তো এটুকু
করতেই পারি। নে, নে, নে-- আচ্ছা করে দুটো বানা তো।
সুকুমার বোঝে সেই একই ধান্দায়
শালা এখন তেল মারছে। কিন্তু সুকুমার তাতে ভোলার পাত্র নয়। ঝটপট করে সে উত্তর দিল,
-- আমি এখন চা খাবো না, দুধ চা
খাই না। খুব গ্যাস হয়ে যায়। আর তাছাড়া বিনা কারণে তোমার পয়সায় আমি চা খাবো কেন
বলতে পারো?
বলেই সে তার দুই চোখ কুঁচকে তপনের
দিকে তাকায়।
-- আরে বাবা মাত্র তো এককাপ চা।
তাতে তোমার পয়সা, আমার পয়সার কী আছে ? আমরা তো সামাজিক মানুষ নাকি?
-- অ তাই নাকি? তবে সমাজের ক্ষতির
চিন্তা তুমি করো না তাই তো?
-- হ্যাঁ। এটাই তো একজন জনপ্রতিনিধির
দায়িত্ব।
-- তা দায়িত্ব তো তোমার এলাকার
সব মানুষের জন্যই তো নাকি?
-- এতে কোনো সন্দেহ আছে নাকি আবার?
-- আছেই তো।
-- কী রকম?
-- দেখ তপন দেবনাথ, আমি তোমার মতো
রাজনীতি বুঝি না কিন্তু ওলট-পালট বুঝি।
সুকুমারের কথায় কেমন যেন ঘাবড়াতে
শুরু করে কোনোমতে মাধ্যমিক পাশ তপন দেবনাথ। সে আমতা আমতা করে বলে,
-- তুই, কী বলতে চাইছিস বলতো?
-- তুমি কি তা বুঝবে?
-- বুঝব না কেন? তুই বল।
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সুকুমার
বলে,
-- দ্যাখো তপন, তুমি কিন্তু আমার
থেকে বয়সে কম করে হলেও বছর চারেকের ছোটো। কাউন্সিলর হওয়ার আগে আমাকে 'তুমি' করে বলতে।
আর এখন জনপ্রতিনিধি হওয়ার মাস ছয়েক পর থেকেই আমাকে 'তুই- তুকারি' করছ। প্রথম প্রথম
একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম কিন্তু ধীরে ধীরে সইয়ে নিয়েছি। জনপ্রতিনিধি হলেই বোধহয় এই
অধিকারটা এমনি চলে আসে বলো? আর আমরা সাধারণ গরীব মানুষরা এটাকেই ঠিক বলে মেনে নিতে
বাধ্য হই। তাই তো তপন দেবনাথ?
-- না, মানে ইয়ে...
-- থাক, থাক আর তোতলাতে হবে না।
একটু বোসো ভালো করে চা বানিয়ে দিচ্ছি।
আপন মনে চা করতে করতে সুকুমার বলে,
-- তপন,
-- হ্যাঁ বলো।
-- আমি চা করছি, এই চা করা থেকে
শুরু করে তোমার চা খাওয়ার শেষ পর্যন্ত তুমি ভেবে তোমার নামের বানানটাকে একটু ওলট পালট
করে একটা আতঙ্কের শব্দ তৈরি করে ফেল।
-- ধুর, তুই চা কর তো । ওসব আলতু
ফালতু ব্যাপার বাদ দে।
তপনের কথা শুনে সুকুমার চায়ের
গেলাসে চামচ দিয়ে চিনি মেশাচ্ছে টকাটক্, টকাটক্ শব্দের তরঙ্গ তুলে ইথারে ভাসিয়ে দিচ্ছে
তার সাথে সঙ্গত করছে খ্যা, খ্যা করা তার হাসি।
চা হয়ে যাওয়ার পর ভীষণ যত্ন করে
তপনের হাতে চা তুলে দিতে দিতে সে বলল,
-- বলো, কিসের জন্য আজকে এই স্পেশাল
চা খাওয়ানোর ইচ্ছে জাগল তোমার মনে?
-- না, এমনি।
-- উহুঁ, মোটেই না। ঠিক করে বলো
তো মামু।
চায়ের গেলাসে এক গভীর চুমুক দিয়ে
তপন বলল,
-- আসলে কি জানিস...
-- জানি।
-- কী জানিস?
-- যে ধান্দাবাজিতে এসেছ, তা হবে
না।
-- মানে?
-- মানে আবার কী? তুমি ঐ তোলাবাজ,
গুন্ডা প্রোমোটার ন্যাপলার জন্য আমাকে পটাতে এসেছ।
সুকুমারের কথায় কিছুক্ষণ থ মেরে
থাকে তপন। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বলে,
--- না, তুই ভেবে দ্যাখ, একটা ফ্ল্যাট
তো পাবিই তার সাথে এই গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা দোকানও পাবি। সাথে কিছু টাকা। ব্যাপারটা
একবারও ভেবে দেখেছিস?
-- দেখেছি। একবার কেন একশোবার ভাবার
পর ভাগফল শূন্যই এসেছে।
সুকুমারের কথায় তপনের মাথায় আগুন
লেগে যায়। সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। তার কাউন্সিলরের সত্তার সাথে কন্ঠস্বরেরও
পরিবর্তন ঘটে যায়। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-- কাজটা তুই কিন্তু ভালো করেছিস
না!
তপনের কথায় সুকুমার ফিক করে হেসে
বলে,
-- বলছিলাম না তোমার নামের অক্ষরগুলো
একটু ওলট পালট করে দ্যাখো একটা নতুন শব্দ পাবে যার অর্থ তোমার কাছেই হবে আতঙ্কের। কিন্তু
তা তো আর বলতে পারলে না। আমিই বলে দিচ্ছি, তোমার নামের সামনের অক্ষর মাঝে চালান করে
মাঝের অক্ষরটি প্রথমে বসালেই দেখো তো কী দাঁড়ায়!
সুকুমারের এই কথায় বেশ কিছুক্ষণ
চুপ করে থাকে। অর্থাৎ সে মনে মনে সুকুমারের দেওয়া থিওরি অনুযায়ী নিজের নামের দুটো
অক্ষর এদিক ওদিক করে যা বুঝল তাতে তার চোখে মুখে ঘাম ছুটতে শুরু করল।
তার অবস্থা দেখে সুকুমার মনে মনে
হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সুকুমারই খুব সহজভাবে বলে,
-- ওসব বাদ দাও। আরেক কাপ চা খাও।
এটা আমি খাওয়াচ্ছি তোমাকে।
তপন চুপ করেই থাকে। তার এই অবস্থা
দেখে সুকুমার বলে,
-- আরে ঘাবড়াচ্ছ কেন? জনগণ চাইলে
আবার ক্ষমতায় আসবে। আবার কাউন্সিলর হবে, দুটো বাড়ি হয়েছে তখন না হয় আরো দু চারটে
ঠিক হয়ে যাবে। নাও চা খাও তো।
একথা বলে সুকুমার আরো একটি চায়ের
গেলাস সাথে একটা লেড়ে বিস্কুট তপনের হাতে ধরিয়ে দিল। এক ঘোরের মধ্যে থাকা তপন চা
বিস্কুট দুটোই হাতে নিল। সে তখনও আত্মমগ্ন। কিছুক্ষণ পর যেন ঘুম থেকে সবেমাত্র জেগে
উঠল এমন স্বরে সে বলল,
-- হ্যাঁ রে সুকুমার একটা কথা বলবি?
-- কী?
-- এবারের ভোটে কি সত্যিই আমি হেরে
যাবো! লোকজন কিছু বলছে? তোর কাছে কোনো খবর আছে?
সুকুমার বুঝতে পারে এতক্ষণে একটু
মচকাতে শুরু করেছে। এইবার ব্যাটাকে একটু কড়কে দিতেই হবে। তাহলেই জব্দ হবে। মাথামোটাকে পথে আনার এই সুযোগ।
এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। সে একটু আমতা আমতা করে বলল,
-- হ্যাঁ, সেরকমই তো একটা কথা লোকে
বলাবলি করছে। কিন্তু...
-- কিন্তু কী? বল্, বল্।
সুকুমার বোঝে এবার ভাঙতে শুরু করেছে।
তাই সে একটু চালাকি করে বলে,
-- না, থাক। ওসব কথা শুনলে তোমার
মন খারাপ হয়ে যাবে। তুমি চা টা খাও তো! ওসব কথায় কান দিও না। যা হবার ভোটের সময়
হবে।
এক অসহায় প্রাণীর মতো তপন কঁকিয়ে
উঠল। তার কন্ঠস্বর খাদে নেমে গেছে একেবারে। সে বলল,
-- সুকুমার তোর কোনো ক্ষতি হোক
আমি চাই না। তুই বল লোকজন কী বলাবলি করছে?
আরো একটু খেলাবার জন্য সুকুমার
বলল,
-- থাক না ওসব খারাপ কথা।
-- খারাপ কথা!
-- তাছাড়া আর কী বলি বলো। লোকজন
বলে তুমি নাকি এলাকার প্রমোটারদের হয়ে ওদের কাছ থেকে মোটা টাকা খেয়ে এলাকার মানুষকে ভয় দেখিয়ে জমি
প্রমোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছ অথচ এলাকার কোনো উন্নয়নমূলক কাজই করছ না, কেউ কোনো সার্টিফিকেট
চাইতে গেলে তাকে শুধুই ঘোরাও এবং শেষে সার্টিফিকেট দিলেও 'উপরের নির্দেশ' আছে বলে সার্টিফিকেট
পিছু গুরত্ব বুঝে একশো থেকে পাঁচশো টাকা পর্যন্ত নিচ্ছ - আরো কতসব আজেবাজে কথা যে বলে
তা শুনলেও গা ঘিনঘিন করে।
-- এইসব বলছে?
-- বলছে তো! এ তো আর আমার নিজের
কথা না। আমি বাপু ওসব কথা শুধু শুনে যাই। কী দরকার আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ
নেবার। এই চায়ের দোকানে হাজার রকমের মানুষ আসে তারা আলোচনা করে। আমি শুধু শুনেই যাই।
নিজের দোকান আর সংসার নিয়েই আমার দিন চলে যায়। কে কার টাকা মারল, কার জায়গা কে প্রমোটারকে
দিল, ঐসব খবর দিয়ে আমার কী লাভ? আরে বাপু, আমি বুঝি না প্রোমটাররা কি জোর করে তোমার
জায়গা নিচ্ছে নাকি? তোমার যদি ইচ্ছে না থাকে তবে কি জোর করে নিতে পারে? দেশে আইন কানুন
বলে তো কিছু আছে নাকি? কৈ আমার জমি তো নিতে পারেনি! কারণ কি জানো?
-- কী?
-- আমার ইচ্ছে নেই তাই। বাপের দিয়ে
যাওয়া ভিটেকে আমি সামান্য একটা পায়রার খোপের জন্য, যাকে তোমরা বলো ফ্ল্যাট, সেই ভিটেকে
চোদ্দোজনের হাতে ছেড়ে দেব? তুমি কী বলো তপন?
সুকুমারের প্রশ্নে তপন একটু ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়ে গিয়ে বলে,
-- নিশ্চয়ই।
-- তবে? তুমিই বলো 'বাড়ি' শব্দটার
গন্ধই আলাদা। সেই জন্মের পর থেকে এর সঙ্গে যোগ তা কি কখনো ঐ পায়রার খুপরি বানানোর
জন্য তুলে দেওয়া যায়? নাকি উচিত? তোমার যতগুলোই ফ্ল্যাট থাকুক না কেন তুমি তো এখনও
তোমার পৈতৃক বাড়িতেই বসবাস করছ! তাই না?
সুকুমারের যুক্তি ও কথায় তপন দিশেহারা
হয়ে গিয়ে বলে,
-- হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস।
-- আরে তুমিই ভেবে দ্যাখো, আমার
তিন তিনটে ছাদ দেওয়া পাকাঘর, রান্নাঘর, ঠাকুরঘর, পায়খানা, বাথরুম করেও ঐ চারকাঠা
জমিতে অনেকটাই ফাঁকা উঠোন, বেশ কয়েকটা গাছও আছে। পশ্চিমদিকে প্রাচীরের গায়ে বড়ো
একটা নিমগাছ। একটা ছোট বাগানের মতো। যখন খালি পায়ে উঠোনের মাটি আর ঘাসে পা ডুবিয়ে
হাঁটি তখন যে কী তৃপ্তি হয় তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তুমিও তোমাদের উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে দেখো, খুব তৃপ্তি পাবে।
-- কিন্তু সুকুমার…
-- কী?
-- তাহলে এবারের ভোটে....
তপনের কথা শেষ হবার আগেই সুকুমার
বলে,
-- ও তুমি ভেবো না। একটু ভালো কাজ
করো, দেখবে সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। আরে দু'সপ্তাহ আগের রবিবার হাইস্কুলে পরিবেশ দিবসে তোমাদের দল যে গাছের
চারা বিতরণ করল, তুমি তো মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গেই মঞ্চে ছিলে, চেয়ারম্যান
তাঁর বক্তৃতায় বললেন যে, গাছ না লাগালে পরিবেশের ক্ষতি হয়ে যাবে, আমাদের ক্ষতি হয়ে
যাবে। তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করলেন সবাই যেন তাদের বাড়িতে গাছ লাগায়। তিনি আরো বললেন,
নিমগাছ নাকি অন্য গাছের থেকে বেশি অক্সিজেন দেয়। আমার বাড়িতে নিমগাছ থাকা সত্ত্বেও
আমি আরেকটা নিমগাছের চারাই সেদিন নিয়েছিলাম।
-- হ্যাঁ, আমি দেখেছি।
-- আচ্ছা তুমিই বলো, বাড়িতে মাটি
না থাকলে লোকে গাছ লাগাবে কোথায়? আর সবই যদি প্রমোটারদের হাতে তুলে দাও তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ।। কী বলো তপন?
এক তীব্র খোঁচা খেয়ে তপন বলল,
-- সব ঠিক আছে কিন্তু এবারের ভোটে...
-- শোনো, একটা যুক্তি শোনো।
-- কী?
-- আমার চায়ের দোকানে হাজার কিসিমের
লোক আসে, আলোচনা করে। আমি তো সবই শুনি...
তপন একেবারে লাফ দিয়ে ওঠে।
-- ওরা আমার ভুল ত্রুটি যে গুলো
আলোচনা করে আমাকে জানাবি সুকুমার? আমি তাহলে সেগুলো শুধরে নেব। না হলে যে…
-- না হলে কী?
-- ভোটে হেরে গেলে যে মান সম্মান
একেবারে শেষ। তুই একটু দ্যাখ প্লিজ!
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সুকুমার।
তারপর বলে,
-- ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়!
-- না, দেখি না, তোকে দেখতেই হবে।
আমি কথা দিচ্ছি তোর জমির দিকে কোনো প্রমোটারই আর হাত বাড়াতে পারবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন