শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(১৫) 

   

পলাশীর প্রান্তর

 

বিশাল তিনমহলা একশ বছর পুরনো বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকেই বাড়িটি। লাগোয়া পরিত্যক্ত জমি কাঠা তিনেক আগাছা আর কচুবন, মহীরূহ এবং সাপ আর বাদুড়ের রিসর্ট।

প্রধান ফটকের সামনে ভিড়। একটি মেয়ে পেঁয়াজ রঙের বেনারসী পরে দাঁড়িয়ে। দুধ ফুটছে মাটির মালসায়, আলতা দুধ তাতে পা ডুবিয়ে ঢুকতে হবে। মেয়েটির চোখে ক্লান্তি, ভয়, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর, অজানা জগতটি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আগুনে তার চিরকাল খুব ভয়। কালীপুজোর ঘরে লুকিয়ে থাকে, সামনে দুধ উথলোবে, একপাল পাড়া ভাঙা দর্শক সাসপেন্সে। লক্ষ্মী নাকি অলক্ষ্মী! বাড়ির গিন্নি ছোটোখাটো চেহারা। রূপসী। আস্তে আস্তে বললেন, এতো মানার দরকার কী, বেচারার মুখ শুকিয়ে গেছে, ঘরে তোলো। উলু শঙ্খধ্বনি সহযোগে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার উঠোনে এসে শিলপাতা লাল মেঘের অঙ্গন।  সেখানে দাঁড়াতে হলো মেয়েটিকে জবরজং সাজে, হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো জ্যান্ত ল্যাটামাছ। মেয়েটি আতঙ্কিত। মা-বাপের বাড়িতে জলটুকু সে গড়িয়ে খায়নি। রান্নাঘরে ঢোকেনি। বই_পড়া বোকা মেয়েটির এই রাগিং দৃশ্য দেখতে বাড়ি ভেঙে পড়েছে লোকে। এলো ধান দুর্বো। মা বাবা ছাড়া কখনও থাকেনি সে। আর কখনও ফিরবে না সেখানে সে। আনুষঙ্গিক কাজ শেষে বিদায় নিলেন সবাই। তখন তাকিয়ে দেখা গেল তিন মহলা বাড়িটি, মাঝে চক, কুয়োতলা, চিলেকোঠার, ছাদ সর্বত্র অযত্নের ছাপ।

যেন এক ভৌতিক মহল। আত্মীয়রা বিদায় নিলেও রয়ে গেলেন কয়েকজন। তার মধ্যে একজন বড় মামা শ্বশুর। অকৃতদার। আজীবন বামপন্থী করা মানুষটি বাংলার মাস্টারমশাই। সমস্ত অবিবাহিত পুরুষের মতোই ভয়ঙ্কর খামখেয়ালি মানুষটিকে মেয়েটি ভালোবেসে ফেলল প্রথমেই। সেই বৃদ্ধ মানুষটির স্নেহ অকৃপণ ছিল শেষ দিন অবধি, হাজার ঘাত প্রতিঘাতে যা ছিন্ন হয়নি। বিরাট হলঘরের মতো একেকটা ঘর, প্রাচীন পালঙ্ক, দেওয়ালে দেওয়ালে ফাট ধরে আর বর্ষার জল বসে অপূর্ব মানচিত্র সৃষ্টি হয়েছে। এঁরা স্বামী স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র মেয়েটির আজীবনের ভার নিয়েছেন।

নতুন বিয়ের পর সবই ভালো। কালো কিছুই টের পাওয়া যায় না। তার কারণ নর-নারীর প্রথম সঙ্গম। চোখ কান মস্তিষ্ক কিছুই কাজ করে না। প্রথম দফা সেই অবস্থা কাটতে ক্রমশ তাদের আর্থিক ও মানসিক দারিদ্র্য চোখে পড়ল। আমাদের বাড়িতে তেতো এবং শাক থেকে শুরু করে পাঁচ রকম রান্নার আয়োজন ছিল। মহার্ঘ্য নয় কিন্তু মা রান্না করতে যত্ন করতে ভালোবাসতেন। এ বাড়িতে একদিন মাছ বাকিদিন নিরামিষ। আমি, মেয়েটি একসময় লোকের সামনে কাঁদতে পারতাম না। তাই মায়ের ঘর ছেড়ে আসার সময় যে হৃদয় বিদারক ক্রন্দন দৃশ্য দেখতে দর্শক অপেক্ষমান ছিল তারা সেদিন হতাশ হয়েছিল। তারপর গোপনে কেঁদেছি। চিলেকোঠার ঘরে শোবার ঘরে লোহার গ্রাম আঁকড়ে ধরে, বৃদ্ধ নিমগাছটি সাক্ষী থেকেছে, চানঘরে জলের ধারায় মিশে গেছে কান্নার জল। প্রতিদিন এবং চিরকালীন।

শ্বশুমশাই জীবন নিবেদন করেছেন বামপন্থায়। ঘরে রাশিয়ার পত্রিকা, গণতন্ত্র, পোস্টার বিড়ি, মিটিং পার্টি অফিস থেকে শোবার ঘর সর্বত্র তাঁর। তারমধ্যে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা সন্তান সম্পর্কে চিন্তার অবকাশ তাঁর ছিলো না। যে লোকটি বিবাহের আগে শক্তি সুনীল বিষ্ণু দে আওড়াতো মন পেতে, বিবাহের পর সেসব উধাও হলো। রইল শুধু জৈব তাড়না। কাগজপত্র মাফিক চাটার্ড একান্টেন্ট প্রতিদিন কেন সকাল থেকে সাঁঝ ঘরেই শুয়ে বসে ঘুমিয়ে থাকে, কলেজের গেটে, পথে বৌকে নজরদারি করার এত সময় জোটে ডিজিটাল হীন ভারতের পাড়ায় ঘরে সেই রহস্য ঘনীভূত হতে থাকল মনে। বন্ধ হলো কবিতা। গদ্য আর গান। ব্যক্তিত্বহীন শাশুড়িমাতা রেওয়াজ এবং লেখায় নিরন্তর উৎসাহ দেন গোপনে। অপূর্ব তাঁর আবৃত্তি শোনা হয় আড়ালে। পৃথিবীতে প্রতারণা শব্দটির সঙ্গে নতুন পরিচয়। বয়স কুড়ি। জীবন সংগ্রাম শুরু। নতুন বিয়ের পর এক সকালে অদ্ভুত আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তর পশ্চিম কোণার ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি

বড়মামা গানের রেওয়াজ করছেন। হারমোনিয়াম সহযোগে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতচর্চা। গান যে কত ভয়ানক আকার ধারন করতে পারে তা না শুনলে অজানা থাকত সেদিন। কলকাতার সেই বাড়িতে কয়েকজন মামশ্বশুর বাস করতেন। প্রত্যেকেই বিচিত্র। একবার পথে যেতে যেতে আমার অবসম্ভাবী স্বামী বলেছিলেন, “আমি তো মামার বাড়িতেই থাকি।” কথাটার অর্থ সেদিন বুঝিনি। বিবাহের পর বুঝেছিলাম। এক মামা ছিলেন ভক্ত। এত বড় বাড়ির কোথাও নির্দিষ্ট ছিলো না তাঁর ধ্যান করার জায়গা। কখনও রাতে খাবার বেড়ে শাশুড়ি ডেকে আনতে বলতেন সবাইকে। সারা বাড়ি খোঁজাখুঁজি পড়ে যেত, শেষে ছাদের ঘরের এক কোণে কিম্বা দোতলার বারান্দার শেষে সিঁড়ির নীচে কোথাও একটা পাওয়া যেত। জয় মা তারা শব্দে হঠাৎই বাজখাঁই চিৎকার করে উঠতেন। ছোটো মামাশ্বশুর ছিলেন আমার স্বামীর প্রায় সমবয়সী। তার সঙ্গে প্রথম থেকেই খুব ভাব হয়ে গেল। তিনি আরো অদ্ভুত খামখেয়ালি ধরনের ছিলেন। এসব নিয়ে আমার ও বাবা অর্থাৎ শ্বশুরের সঙ্গে খুব হাসাহাসি হতো, শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকাকালীন। শ্বশুর মানুষটিকে আমার ভালো লাগত যদিও সেটা  আদর্বাদী কম্যুনিস্ট ছিলেন বলে হয়ত। প্রায় অধিকাংশ বাঙালি কম্যুনিস্টদের মতো তাঁর আচরণে দেখেছি কথা ও যাপনের ফারাক।

তিনি ছিলেন তিন বড়ো বোনের শেষে একমাত্র পুত্র। মেজ ও সেজ দুই পিসি শাশুড়ির আগমন এই বাড়িতে লেগে থাকত। তাঁরা এলে শাশুড়ি তটস্থ হয়ে থাকতেন। তাঁদের মুখ নিভৃত বাণী তুর্কি বাহিনীর খোলা তলোয়ারের মতো শান দেওয়া। শুধু বাক্যবাণে একটি লোককে হত্যা করার ক্ষমতা রাখতেন। নতুন বিয়ের কনে তখনও কুড়ি পেরোয়নি। তাকে তাঁদের মুখেই শুনতে হয় তার স্বামী বংশের কত বড় কুলাঙ্গার। সমস্ত বিষয়ে অন্ধকারে থাকা মেয়েটির সদ্য পাওয়া টাটকা নতুন ঝকঝকে স্বামী নিন্দা কানে বিষ বর্ষণ করেছিল বলা বাহুল্য। পরবর্তীকালে উপলব্ধি করেছি সে সব কথাই বড়ো সত্য ছিল আর এও উপলব্ধি করেছি সমস্ত সত্য কথাই যে সব সময় নগ্ন প্রদর্শন জরুরি তা নয়। সত্য ও মিথ্যার মাঝে বাস করে সময়োচিত গোপনতা যা মানবিকতার প্রয়োজনে, কুৎসিত বর্ণমালা এড়িয়ে যাবার প্রয়োজনে দরকার। সব মিলিয়ে বহু বছর পরে মেয়েটি নিজে মধ্য বয়সে উপনীত হয়ে অল্প বয়সের অসহিষ্ণুতার জন্য লজ্জিত হয়, মনে হয় স্বামীরত্নটি ছাড়া শ্বশুরবাড়িটি তেমন খারাপ ছিলো না। সেই লাল মেঝের দরদালান। ঘুলঘুলির পায়রাবাসা থেকে ঝরে ঝরে পড়া পালক, চিলেকোঠার ঘরটি আর বড় প্রিয় সে নিমগাছটি, মনে হয় হৃদয়ের একটি অংশ সেখানে পড়ে আছে ধুলো মেখে।

দিদি শাশুড়ির কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল, যেমন আমাদের মাতামহী গল্প লিখতেন, পত্রিকা করতেন। তাঁর খাতাটি শাশুড়ি একসময় আমার হাতে সঁপে দিলেন। সবই আধ্যাত্মিক কবিতা, অনেকটা কুসুমকুমারী দেবীর স্টাইলে লেখা। আমার দিদিশাশুড়িকে আমি দেখিনি কিন্তু তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি মৃত্যুর বহু পরেও এলাকায় আলোচিত হতেন। শোনা যায় বাইরের লাল রকটিতে তিনি বসে থাকতেন সাদা থানার গায়ে পৃথুলা শরীরে। ভেতরের ঘরে বাঁধা হতো বোমা পোস্টার লাল আন্দোলনের সশস্ত্র কাজকর্ম। কিসের জন্য সে আয়োজন তা আজ অপ্রাসঙ্গিক শুধু এটাই যে তিনি নিজে ঢাল হয়ে বসে পাহাড়া দিতেন বানানটি এবং রাজনৈতিক কাজকর্ম, তাঁকে দেখে পিছিয়ে যেত শোনা যায় অনেক শত্রু। তিনি যখন ইহলোকগতা হলেন তখন আমার স্বামীর বয়স দশ। তিনি আর দশটি বছর বাঁচলে বোধহয় বর্ণমালার সাতকাহন অন্য ইতিহাস লিখত। কলেজে পড়াকালীন টিউশন ও তারপর কয়েকটি ছোটো ছোটো চাকরি করতে হয় পড়াশোনা ও সংসার চালিয়ে যেতে এবং সেই সঙ্গে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো মনের ঝুলিতে। প্রথম টিউশন দুটি শিশুর সব পড়া পড়ানো। তখন ফার্স্ট ইয়ার কলেজে। একটি টালির ঘর। একটিই। একটিতে বারান্দার একপাশে রান্না। বাবার স্ট্রোক হয়ে কাজ চলে গেছে। তারপর আরও একটি। ক্ষীণভাবে চলছে হৃদয়। দুটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে। এই প্রথম এবং শেষ বাড়ি, যেখানে বুঝি একটি স্টিলের কাঁসিতে ভাত অল্প তরকারি খেতে দিলেন। দিতেন প্রায়। এবং তারপর একটি সাজা পান। এই দারিদ্র্যপিড়িত পরিবারের মাটির এই আপ্যায়নে খুবই অবাক ও মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের পরিচিত সমাজে কেউ গেলে ভাত কেউ দিতো না মাস্টারকে। ছাপিয়ে বউটির পাশের ঘরে তার একশ পৌঁছনো কুঁজো হয়ে যাওয়া শ্বশুর ও শাশুড়ি। দুটি সরীসৃপের মতো ঘরের মধ্যে... বাচ্চাদের বাবা বিছানায় থেকে থেকে পৃথুল। বসে বসে হাঁপান। গলির সামনে কর্পোরেশনের কল। অবিরাম জল পড়ে। নর্দমা। বাচ্চাগুলি পড়ে।

(ক্রমশ)

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন